আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু। আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে খাদ্য ও শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে ঝালকাঠি জেলার সব ধরনের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য, কমিটি গঠন, নির্বাচনে মনোনয়ন সবই ছিল তার নিয়ন্ত্রণে। টিআর-কাবিখার বরাদ্দ থেকে কমিশন গ্রহণসহ টাকা নিয়ে নৈশ প্রহরী নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, আমির হোসেন আমুর কাছে নতুন টাকার বান্ডিল আর স্বর্ণের নৌকা ছিল খুব প্রিয়। যেকোনো অনুষ্ঠানে গেলে তাকে স্বর্ণের তৈরি নৌকা, কোটপিন দিতে হতো। আবার তদবিরের জন্য দিতে হতো নতুন টাকার বান্ডিল। ব্যাংক-ব্যবস্থার ওপর ভরসা না থাকায় বস্তা ভরে টাকা রাখতেন বাড়িতে। যার প্রমাণ মেলে গত ৫ আগস্ট। ওই দিন তার ঝালকাঠি ও বরিশালের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় বান্ডিল বান্ডিল নতুন টাকা লুট করেছে বহু মানুষ। ওই রাতে ঝালকাঠির বাসা থেকে ডলার, ইউরোসহ প্রায় ৫ কোটি টাকা উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশ।
বরিশাল বিএম কলেজের সাবেক ভিপি আমির হোসেন আমু ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ-৭ আসন থেকে প্রথম সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। ২০০০ সালের উপনির্বাচনে ঝালকাঠি-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ ও ২০২৪ সালে একই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী এবং ২০১৪ সালে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন আমির হোসেন আমু।
নতুন টাকার বান্ডিল আর স্বর্ণের নৌকা ছিল প্রিয়
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, নতুন টাকার বান্ডিল আর স্বর্ণের নৌকা প্রিয় ছিল আমুর। ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে স্বর্ণের নৌকা উপহার নেওয়ার পর গণমাধ্যমে এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বর্ণের নৌকা উপহার নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। তখন থেকে আমু স্বর্ণের নৌকা নেওয়া বন্ধ করেন।
কিন্তু তার নতুন টাকার বান্ডিল নেওয়া বন্ধ হয়নি। ব্যাংক-ব্যবস্থায় আস্থা না থাকায় আমির হোসেন আমু তদবির আর কমিশনের টাকা বস্তাবন্দি করে রাখতেন। তার টাকার লেনদেনের হিসাব রাখতেন ভায়রা কিরণ। আমির হোসেন আমুর সবচেয়ে বিশ্বস্ত ছিলেন সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) ফখরুল মজিদ কিরণ। কিরণ আমির হোসেন আমুর পার্সেন্টেজ আদায়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ধনসম্পদের ভান্ডার দেখাশোনা করতেন। ব্যক্তিজীবনে নিঃসন্তান আমু শ্যালিকা মেরী আক্তার ও কিরণ দম্পতির কন্যা সুমাইয়াকে পালক হিসেবে নিয়েছিলেন।
পরিচয় না প্রকাশের শর্তে জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, এমন কোনো সেক্টর নেই যেখান থেকে টাকা পেতেন না আমু। টাকার লেনদেনের হিসাবে কাজ করতেন ভায়রা ফখরুল মজিদ কিরণ। শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে আমুর এপিএস ছিলেন তিনি। নরসিংদী জেলার বাসিন্দা হলেও তিনি পড়ে থাকতেন ঝালকাঠিতে। আমুর সঙ্গে দেখা করতে হলে কিরণের অনুমতি নিতে হতো। তার কথার বাইরে এক পা-ও ফেলতেন না আমু। উন্নয়নমূলক সব কাজের ভাগ-বাঁটোয়ারা করতেন। এই কিরণের মাধ্যমেই নির্বাচনি এলাকা থেকে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন আমু। আমুর অবৈধ পন্থায় আয় করা টাকা হুন্ডিসহ নানা উপায়ে দুবাইয়ে পালক মেয়ে সুমাইয়ার কাছে পাঠানো হয়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
চার খলিফার নেতৃত্বে ভাগাভাগি উন্নয়ন প্রকল্প
জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন খান সুরুজ, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজ আল মাহমুদ, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক রেজাউল করিম জাকির ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক কামাল শরীফকে নিয়ে একটি বাহিনী তৈরি করেছিলেন আমির হোসেন। ঝালকাঠিতে এই বাহিনী ‘চার খলিফা’ নামে পরিচিত। এই চার খলিফার মাধ্যমে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন গ্রহণ এবং ঠিকাদার নির্বাচন করতেন আমু। চার খলিফার আশীর্বাদ ছাড়া কোনো ঠিকাদার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করতে পারতেন না। প্রতিটি ঠিকাদারি কাজ শুরু করার আগেই আমুর কমিশনের ভাগ হিসাব করে ঢাকায় পাঠিয়ে দিতেন তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ঠিকাদার নির্বাচনে আমুর সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত।
ই-টেন্ডার চালু হওয়ার পর দরপত্রের সব কাগজ তুলে দিতে হতো ‘চার খলিফা’র হাতে। কথা না শুনলে সরকারি কর্মকর্তাদের কেবল বদলি নয়, হেনস্তা করা হতো। তিনি বলেন, চার খলিফার নেতৃত্বে ঢাকার এলজিইডি, সওজ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে অপ্রয়োজনীয় কালভার্ট ও সেতু প্রকল্প তৈরি করে নিয়ে আসা হতো। অনেক সময় ভালো সেতু ভেঙেও নতুন সেতু নির্মাণের কার্যাদেশ আনা হতো। এসব কাজে অতিরিক্ত বরাদ্দ ধরা থাকত। ফলে ৪০ শতাংশ কমিশন দিয়ে কাজ নিলেও ঠিকাদারের লাভ থাকত। সওজ এলজিইডির মতোই শিক্ষা প্রকৌশল দপ্তর, গণপূর্তসহ জেলা পরিষদ, দুটি পৌরসভা, উপজেলার প্রকৌশলী বিভাগ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনের প্রকল্পসহ সব ক্ষেত্রেই ছিল একই নিয়ম।
ঝালকাঠির প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার শফিকুল ইসলাম বলেন, লটারির মাধ্যমে কাজ পেয়েও আমুকে ৫ পার্সেন্ট হারে কমিশন দিতে হয়েছে। টাকা না দিলে কাজ করা সম্ভব হতো না। ৬৮ লাখ ও ৩৩ লাখ টাকার দুটি কাজের বিপরীতে আমুকে ৪ লাখ টাকা কমিশন দেওয়া হয়েছে। নৈশ প্রহরী থেকে শুরু করে সব চাকরিতে আমুকে টাকা দিতে হতো। টাকা নিতেন টিআর-কাবিখা থেকেও।
নৌকার মাঝি নির্ধারণ করতেন আমু
বরিশাল বিভাগের অন্যতম বাণিজ্যিক জেলা ঝালকাঠি। জেলার চারটি উপজেলা, দুটি পৌরসভা ও ৩২টি ইউনিয়ন রয়েছে। আর সংসদীয় আসনের সংখ্যা দুটি। আমির হোসেন আমু ঝালকাঠি সদর ও নলছিটি উপজেলা নিয়ে গঠিত ঝালকাঠি-২ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু বাকি দুই উপজেলা কাঁঠালিয়া ও রাজাপুরের রাজনীতি ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। প্রতিটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আগে এলাকায় অবস্থান করে প্রভাব বিস্তার করতেন। টাকা দিয়ে আমুর আশীর্বাদ নিতে পারলেই তার জয় ছিল সুনিশ্চিত।
আওয়ামী লীগ নেতারা দাবি করেছেন, নতুন টাকার বান্ডিল আমুর কাছে না পৌঁছানো পর্যন্ত মনোনয়ন জুটত না প্রত্যাশীদের কপালে। নির্বাচন মৌসুমে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে শতকোটি টাকা আয় করতেন আমু। জেলা পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা এবং ইউনিয়নের গুরুত্ব অনুসারে ৫০ লাখ থেকে কোটি টাকা নিতেন আমির হোসেন আমু।
দখল করা জমিতে স্ত্রী ও মা-বাবার নামে প্রতিষ্ঠান
২০১৫ সালে ক্যাডার বাহিনী দিয়ে কালেক্টরেট স্কুল ভবনের দুটি কক্ষ ও সীমানাপ্রাচীর গুঁড়িয়ে দিয়ে সরকারি জমি দখল করেন আমু। তার স্ত্রী বেগম ফিরোজা আমু টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের ভবন নির্মাণের নামে ওই জমি দখল করা হয়। পরবর্তী সময়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান দুটির নামে দখল করা জমি বন্দোবস্ত করিয়ে আনেন। সেখানে প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা না হলেও তিনি তা দখলে রাখেন। ২০২৩ সালে বেগম ফিরোজা আমু হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নামে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়।
বেগম ফিরোজা আমু ঝালকাঠি টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও সাবেক পৌর মেয়র লিয়াকত আলী তালুকদার বলেন, ‘কলেজের ভবন নির্মাণের জন্য যে জমির প্রয়োজন, সমঝোতার মাধ্যমে তা নেওয়া হয়েছে। পরে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়।’
কালেক্টরেট স্কুলের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. আশরাফুর রহমান বলেন, ‘আমি এ জেলায় নতুন যোগ দিয়েছি। বিদ্যালয়ের জমি অবৈধভাবে ব্যবহার করলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শুধু সরকারি জমি নয়, ২০১১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছ থেকে প্রায় ছয় একর জমি জোর করে নামমাত্র মূল্যে লিখে নেন আমির হোসেন আমু। ওই জমিতে তার মা-বাবার নামে আকলিমা মোয়াজ্জেম হোসেন ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। জমির দখল নিতে আমু নিজে ও পুলিশ দিয়ে ভয় দেখাতেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন।
ভুক্তভোগী ফজলুল হক হাওলাদার বলেন, ‘কলেজের পাশে তার নিজের ৩৬ শতক এবং প্রবাসী জামাতার ৭৫ শতাংশ জমি ছিল। ওই জমিতে একটি পেট্রল পাম্প নির্মাণ শুরু করেছিলাম। এ জন্য ৩৬ লাখ টাকা ব্যয় করে বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়। ২০১১ সালে আমির হোসেন আমু চাপ সৃষ্টি করেন কলেজের জন্য সেই জমি লিখে দেওয়ার জন্য। এতে অস্বীকৃতি জানালে আমুর চার খলিফার একজন জি এস জাকিরের নেতৃত্বে নেতা-কর্মীরা জমি লিখে দিতে হুমকি দেন। তারা একদিন আমাকে ও আতিকুর রহমানকে আমুর বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডের বাসায় নিয়ে যান। সেখানে বসে আমু বলেন, আমার নামে জমি লিখে না দিলে তোমাদের পরিণাম হবে ভয়াবহ। পরে ভয়ে আমি ও আমার জামাতা তার বাসায় বসে জমি লিখে দিই।’
খলিলুর রহমান নামে আরেক জমির মালিক বলেন, ‘কলেজের পাশে ছয় শতক জমির ওপর একটি পাকা টিনশেড ঘর তৈরি করেছিলাম। সেই জমি লিখে দিতে জি এস জাকির চাপ সৃষ্টি করেন। জমি লিখে না দেওয়ায় বাড়ির প্রবেশপথ কলেজের সীমানাপ্রাচীর দিয়ে আটকে দেন আমুর লোকজন। কিছুদিন মই দিয়ে প্রাচীর টপকে বাড়িতে প্রবেশ করতাম। জমিটি যাতে লিখে দিতে না হয় সে জন্য আমুর ঢাকার বাসায় স্ত্রী দিয়ে গৃহকর্মীর কাজও করিয়েছি। কিন্তু আমুর মন গলেনি। একপর্যায়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকার জমি মাত্র ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে লিখে দিতে বাধ্য হয়েছি।’ একইভাবে আমু তার বাবা-মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজের জন্য আবদুর রাজ্জাক, পরিমল চন্দ্র দে, মো. সামসুল হক মনু ও তার ভাইবোনসহ কয়েকজনের জমি দখল করে নেন।