ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে এখনো শৃঙ্খলা ফেরেনি। সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় একটি অংশ ছাত্ররাজনীতি বা লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছে। তবে এই দাবি বাস্তবায়নে এখনো কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। ফলে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি, সাধারণ শিক্ষার্থী, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্রসংগঠনগুলোর নানা ইস্যুতে বিরোধ তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হল প্রশাসন, কার্যকর ছাত্রসংসদ এবং সব শিক্ষার্থীর জন্য আবাসিক সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতির ধারা বন্ধ হবে। একই সঙ্গে ক্যাম্পাসে দীর্ঘমেয়াদে শৃঙ্খলা ফিরবে। তবে ছাত্ররাজনীতি একেবারে বন্ধের পক্ষের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়।
ছাত্ররাজনীতির কাঠামো বা রূপরেখা তৈরির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় গত মাসে একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে আমরা এক দফা বসেছি। শিগগিরই আবার বসব। আমরা ধাপে ধাপে অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ করব। একটি কমিটি গঠনের বিষয়েও অগ্রগতি হয়েছে। সেই কমিটি পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমাদের পরামর্শ দেবে। আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটি করার জন্য।’
অপরদিকে ছাত্ররাজনীতি ইস্যুতে বিশৃঙ্খলার সমাধান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের একজন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক খবরের কাগজকে বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি থাকবে। তবে এটাকে একটা কাঠামোর মধ্যে আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে হল প্রশাসনকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকায় থাকতে হবে। কার্যকর ছাত্রসংসদ থাকতে হবে। ফলে দুই পক্ষই একটা মনিটরিংয়ের মধ্যে থাকবে। অনিয়মের সুযোগ কম থাকবে। আবাসিক সিট নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার্থীদের দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে রাজনীতি করানো যাবে না। এ অবস্থায় ক্যাম্পাসে ছাত্ররা বুঝে-শুনে রাজনীতি করবে। ছাত্ররাজনীতি থাকলেও প্রতিপত্তিমূলক প্রভাব কমে আসবে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশ ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় থাকবে।’
জুলাইয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশের একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা করে ছাত্রলীগ। একপর্যায়ে ১৬ জুলাই মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিরোধের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়ে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা। একই অবস্থা হয় রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৭ জুলাই ভোরে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ৫ হল, পরে ছাত্রদের হলগুলোতেও দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে নোটিশ দেওয়া হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে এসব নোটিশে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন তৎকালীন হল প্রাধ্যক্ষরা। একই সঙ্গে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সিট বরাদ্দ এবং গণরুম (এক কক্ষে একাধিক শিক্ষার্থীর থাকার ব্যবস্থা), গেস্টরুম (ছাত্র নেতাদের কাছে জবাবদিহি) সংস্কৃতি বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে নোটিশ দেওয়ার দিনই সিন্ডিকেট আবাসিক হল বন্ধ ঘোষণা করে। সরকারও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনির্দিষ্টকালের ছুটি ঘোষণা করে। দেশব্যাপী আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শিক্ষাঙ্গনে ভিন্ন পরিস্থিতি দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনের পক্ষে-বিপক্ষে থাকা নিয়ে পদত্যাগ, বহিষ্কার ও হেনস্তার ঘটনা ঘটে। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেতৃত্বেও পরিবর্তন আসে।
আওয়ামী সরকারের পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা গা-ঢাকা দেন। এ সময় দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা সংগঠনগুলো সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। দেশের একাধিক উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রশিবির।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই আবাসিক হলগুলোকে রাজনীতিমুক্ত রাখার পক্ষে। ফলে ছাত্রলীগ-পরবর্তী ক্যাম্পাসে অন্য সংগঠনগুলোও শিক্ষার্থীদের মেজাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সতর্কভাবে কর্মসূচি পালন করছে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ছাত্রদল হল প্রাধ্যক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে। মধুর ক্যান্টিন-কেন্দ্রিক দলীয় ফরমও বিতরণ করেছে। তবে ৭ নভেম্বর উপলক্ষে ছাত্রদল ক্যাম্পাসজুড়ে পোস্টারিং করে। এরপরই সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। মধ্যরাতে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। ৫টি আবাসিক হলে পোস্টারিং নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ। ছাত্রদলের পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া আসে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিবির আর ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়। আবার ছাত্রশিবিরও বিভিন্ন ইস্যুতে উপাচার্যকে স্মারকলিপি দেয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা হলে অবস্থান তৈরির চেষ্টা করেন। এরই মধ্যে ছাত্রশিবিরও তাদের কমিটি প্রকাশ করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা লিফলেট বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও একই অবস্থা।
পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাসগুলোতে শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে চায় ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। বিভিন্ন বাম ছাত্রসংগঠনও ক্যাম্পাসে সক্রিয় রয়েছে। তবে সংগঠনগুলো কৌশলী ভূমিকা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারার ছাত্ররাজনীতির সংস্কার দরকার। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর তিন মাস পার হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির কোনো রূপরেখা তৈরি হয়নি। ফলে শিক্ষার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে মুখোমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে কর্মসূচি পালনের পাশাপাশি ভার্চু্য়ালি পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে নানা বিষয় সামনে আসছে।
সিটের বিনিময়ে বাধ্যতামূলক রাজনীতি থেকে মুক্তি চান শিক্ষার্থীরা
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবাসনসংকট এখনো চরম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থীর আবাসন সুবিধা নেই। প্রতিটা হলে আসনসংকট থাকায় ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনগুলো হলের কক্ষের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শিক্ষার্থীদের উঠিয়ে থাকে। ফলে রাজনৈতিক আশ্রয়ে হলে থাকায় তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। না গেলে নেমে আসে নির্যাতন। ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এই সংস্কৃতি থেকে মুক্তিলাভ করেন শিক্ষার্থীরা। ছাত্রত্ব শেষ হওয়া শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ছেড়েছেন। একাধিক হলে মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করেছেন হল প্রাধ্যক্ষরা। বৈধভাবে সিট পাওয়ায় তারা সন্তুষ্ট। এই ধারায় আর ছেদ ঘটুক, চাচ্ছেন না তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা যখন প্রথম বর্ষে আসি, তখন আমাদের পুরো বছর বাধ্যতামূলকভাবে প্রোগ্রামে অংশ নিতে হয়েছে, যা আমাদের ফলাফলে প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু এবার সবাই বৈধভাবে সিট পেয়েছেন। সবাই নিজেকে স্বাধীন ভাবছেন। হলে রাজনীতির মাধ্যমে আবার সেটি ফিরে আসুক আমরা তা চাই না।’
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির খবরের কাগজকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসবিরোধী আইনে নিষিদ্ধ হয়েছে। এটা গণআকাঙ্ক্ষার ফল। এখন একুশ শতক উপযোগী মেধাভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বিনির্মাণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ চলমান। আমরা হাজারের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়েছি। সেখানে শিক্ষার্থীরা যে আউটলাইন দিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা মনে করছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আমাদের রাজনৈতিক অংশীদার হবেন। ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীরাও আমাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অংশীদার হবেন। পরাজিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ও গোপন রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্তরা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে চান। তাদের এক ধরনের মনোবাসনা রয়েছে। আমরা মনে করছি, শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক সচেতনতা দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আমরা কয়েকদিনের মধ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আমাদের রাজনৈতিক রূপরেখা উপস্থাপন করব।’