অন্তত ৩০ বছর ধরে সব সরকারের আমলে ঘুষ-বাণিজ্য করেই ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য গড়েছেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রুগ্ণ কোম্পানি কোহিনুর কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডকে কৌশলে লিজ নিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটানো শুরু করেন।
জানা গেছে, তিনি ওই সময়ে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাবিত করে দরপত্র ও প্রতিযোগিতা ছাড়াই কোম্পানিটি হাতিয়ে নেন। এরপর প্রতিটি সরকারের আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রীদের গোপনে ও প্রকাশ্যে ঘুষ দিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী আমলাদের নানা রকম আর্থিক সুবিধা দিয়ে ব্যবসার প্রসার ঘটান। এরপর আর থামেনি ঘুষ-বাণিজ্য।
২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকারের একাধিক মন্ত্রী-এমপিকে ঘুষ হিসেবে নগদ টাকা ছাড়াও দিয়েছেন বিএমডব্লিউর মতো বিলাসবহুল গাড়ি। ২০০৭ ও ২০০৮ সালে সেনা-সমর্থিত ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের নানাভাবে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ তার বিরুদ্ধে ১৪টিরও বেশি মামলা হয়। এর মধ্যে ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় । তবে ২০০৯ থেকে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপিকে নামমাত্র শেয়ারে ব্যবসায়ী পার্টনার বানিয়েছেন। তাদের বদৌলতে বিভিন্ন পাওয়ার প্ল্যান্টসহ ঠিকাদারি কাজে নানা রকম দুর্নীতি-অনিয়ম করেও টিকে ছিলেন ১৫ বছর। ওয়ান-ইলেভেনের সময় ওবায়দুল করিমের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা ১৪টি মামলার মধ্যে কয়েকটি মামলার রায়ে ঘুষ-বাণিজ্যের এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা চলাকালে রাজধানীর ধানমন্ডির রাস্তায় প্রায় এক দিন পড়ে থাকে একটি বিলাসবহুল গাড়ি বিএমডব্লিউ। তৎকালীন দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্স গাড়িটি উদ্ধার করে মালিককে খুঁজতে থাকে। পরে জানা যায় গাড়িটির মালিক বিএনপির সাবেক হুইপ আশরাফ হোসেন। পরে ওই গাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীকে দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে গাড়িটি ঘুষ হিসেবে দিয়েছিলেন ওরিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ওবায়দুল করিম। এ নিয়ে ওই সময়ে আশরাফ হোসেন, ওবায়দুল করিম, হারিছ চৌধুরীসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দাখিল করা হয়। বিচারিক আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। ২০১২ সালে যখন চার্জ গঠন হয় ততক্ষণে ওবায়দুল করিম কৌশলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের কয়েকজন প্রভাবশালী মন্ত্রী ও এমপিকে নামমাত্র শেয়ারে ব্যবসায়িক অংশীদার বানিয়ে ফেলেন। ফলে ওই সরকারের প্রভাবশালী মহলের পরামর্শে চার্জ গঠনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ওবায়দুল করিম। একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর তাকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন হাইকোর্ট। তবে অপর চার আসামির বিরুদ্ধে মামলা চলবে বলে আদেশ দেওয়া হয়েছিল। হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিলও করে দুদক। আপিল চলাকালে ২০০০ সালের জুলাই আশরাফ হোসেন এবং ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হারিছ চৌধুরী মারা যান।
দুদক সূত্র জানায়, নানা কারণে দুদকের আপিলটি এখন নিষ্ক্রিয় রয়েছে।
এদিকে গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চের দেওয়া রায়ে ওবায়দুল করিম ২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে উল্লেখ করা হয়েছিল। ২৭৩ পৃষ্ঠার ওই রায়ে উল্লেখ করা হয়, ওরিয়নের ডিজিটাল পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড অনৈতিকভাবে কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ২০০৫ ও ২০০৬ সালের বিভিন্ন সময়ে তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। এর মধ্যে ওবায়দুল করিম তার সাউথইস্ট ব্যাংকের ১১১০০০১২৮১৪ অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে ৮১৯১৩৫৪ নম্বর চেকের মাধ্যমে ইকবাল মাহমুদ টুকুকে ৫০ লাখ টাকা দেন। এ ছাড়া ২০০৬ সালের ৬ জুন ওবায়দুল করিমের ঘুষ বিতরণের প্রতিষ্ঠান ওয়ান এন্টারটেইনমেন্টের মাধ্যমে ভারতে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া, বাংলাদেশের আইএফআইসি ব্যাংকের ০২৩৩০২২৬১৩ ও ০৫১৩০৯৫৯২০০১ নম্বর অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ১ কোটি ২৪ লাখ ২৩ হাজার ৭৮৯ টাকা দেওয়া হয়েছে। এসব টাকার ৪৭ লাখ ৭৬ হাজার ৯০৬ টাকায় একটি বিএমডব্লিউ গাড়ি কিনে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে দেওয়া হয়েছে, ৭৪ লাখ ৮ হাজার ৩০০ টাকায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩ কাঠার একটি প্লট কিনে দেওয়া হয়। বাকি ২ লাখ ৩৮ হাজার ৫৮৩ টাকা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদকে দেওয়া হয়েছে। তবে ওবায়দুল করিম দাবি করেছেন, সেই টাকা ওই সময়ে ভারতে অবস্থানরত তার ভাইকে বাড়ি ভাড়া বাবদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ২০০৫ সালের ৬ ডিসেম্বর ওয়ান এন্টারটেইনমেন্ট থেকে ওরিয়েন্টাল ব্যাংক কারওয়ান বাজার শাখার পে-অর্ডার নম্বর ০৩৯২৯৫৯ মাধ্যমে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর স্ত্রী রুমানা মাহমুদকে ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এই পে-অর্ডারে রিসিভার হিসেবে ওবায়দুল করিমের জামাতা মেহেদী হাসানের নাম থাকলেও পরে তার নাম কেটে দিয়ে সেখানে রুমানা মাহমুদ লেখা হয় এবং পার্টিকুলার রিসিভার হিসেবে রুমানা মাহমুদ ওই টাকা উঠিয়ে নেন। এর আগে একই বছরের ২৮ মার্চ রুমানা মাহমুদকে পে-অর্ডারের মাধ্যমে আরও ১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এভাবে বিভিন্ন সময়ে ওবায়দুল করিম অন্তত ২৫ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে রায়ের বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে। বিচারের সময় সাউথইস্ট ব্যাংকের প্রধান শাখার ব্যবস্থাপক এ এফ এম শরিফুল ইসলাম, আইএফআইসি ব্যাংকের গুলশান শাখার ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট সাক্ষীরা অভিযোগের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। ফলে অভিযোগটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়।
পুরো রায়টি লেখেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার। রায়ে সমর্থন জানান বিচারপতি খিজির হায়াত।
অর্থ আত্মসাৎ, অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন, প্রতারণা ও জালিয়াতিসহ ১৪টিরও বেশি মামলা এবং এর মধ্যে ৩ মামলায় ৪৮ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে ওবায়দুল করিম ২০০৯ সালে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠন করলে সব অপকর্মের দায় থেকে বাঁচতে ওবং ওই সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপিসহ ক্ষমতাধর নেতাদের বাগে আনতে তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করে নেন। এর মধ্যে ওরিয়নের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেন সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজমকে। ডাচ্-বাংলা পাওয়ার অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের পরিচালকের পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক এমপি আলাউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী নাসিমকে। ওরিয়ন পাওয়ার সোনারগাঁও লিমিটেডের পরিচালক পদ দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমানকে। এমন অনেক মন্ত্রী-এমপিকে তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার বানিয়ে গত ১৬ বছরে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ওবায়দুল করিম, তার পরিবারের সদস্যদের এবং ওরিয়ন গ্রুপের কর্ণধারদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতোমধ্যে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরসহ বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অনুসন্ধান ও তদন্ত চালাচ্ছে। তবে বসে নেই ওবায়দুল করিম ও ওরিয়নের কর্ণধাররা। তারা বর্তমান সরকারের উপদেষ্টাদেরও আশীর্বাদ পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তবে তাদের সেই প্রচেষ্টা সফল হওয়ার এখনো কোনো সম্ভাবনা তৈরি হয়নি।