ঢাকা ২৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, রোববার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪

পদ-পদবি বিক্রি করেই টাকার কুমির আবদুর রহমান

প্রকাশ: ১১ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩০ এএম
আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৬ পিএম
পদ-পদবি বিক্রি করেই টাকার কুমির আবদুর রহমান
ফরিদপুর-১ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আবদুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

কথিত রয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন। আর এই পছন্দকে কাজে লাগিয়ে তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন জেলা কমিটি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পদ-পদবি পাইয়ে দিয়ে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ছিল। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন তিনিসহ কয়েকজন। এদের দ্বারাই পছন্দমতো পদ-পদবি বিক্রি হতো। বিভিন্ন অভিনয়, নাটক সাজিয়ে তারা সৃষ্টি করতেন গল্পের নায়ককে। আর নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে কথা বলে সেই নায়ককে পাইয়ে দিতেন বড় পদ। এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হতো ত্যাগী নেতা-কর্মীদের।

এর মধ্যে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ নিয়ে ব্যাপক কানাঘুষা রয়েছে। প্রবাসী শামীম হককে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ পাইয়ে দিতে তিনিসহ তার সিন্ডিকেট নেন কয়েক কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়েন ত্যাগ-তিতিক্ষায় থাকা নেতা-কর্মীরা।

বলছি ফরিদপুর-১ আসনে (মধুখালী-বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা) আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আবদুর রহমানের কথা। মঞ্চ কাঁপানো বক্তব্য দিয়ে পছন্দের তালিকায় চলে যান আওয়ামী লীগ সভাপতির। আর এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি ব্যাপক চাঁদাবাজিসহ অপকর্ম করে গেছেন অবলীলায়। নিজস্ব কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও শত শত কোটি টাকার মালিকবনে যান দল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। বোয়ালমারী উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রামে কৃষক পরিবারে তার জন্ম। ফরিদপুরের সরকারি ইয়াসিন কলেজে পড়াশোনার সময় জেলা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ঢোকেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বাগিয়ে নেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

গত নির্বাচনের সময় তার দেওয়া হিসাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে তার বার্ষিক আয় ২৮ লাখ ১১ হাজার ৬২৪ টাকা। তার নিজের নামে নেই কোনো ফ্ল্যাট। নিজগ্রাম কামালদিয়ায় রয়েছে একটি বাড়ি। তবে তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট। এসব কথা বলা হলেও তার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর নামে রয়েছে ব্যাপক সম্পদ। নিজ আসন বোয়ালমারী মধুখালীতে রয়েছে অনেক জমিজমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এরই মাঝে এসব সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুদুক।

গত নির্বাচনে হলফনামায় আবদুর রহমান আয়ের উৎস জানিয়েছেন, কৃষি খাত থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা, ব্যবসা থেকে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৪০০ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭২ টাকা, চাকরি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পারিতোষিক প্রাপ্তি) ৪ লাখ টাকা, জমি বিক্রয় থেকে মূলধনি লাভ ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৬০২ টাকা এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও পারিতোষিক হিসেবে ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা বার্ষিক আয় করেন তিনি।

হলফনামা অনুযায়ী অস্থাবর সম্পদের মধ্যে বর্তমানে আবদুর রহমানের নিজ নামে নগদ ২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৯২ টাকা, স্ত্রীর নামে ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮১০ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজ নামে জমা ৫ লাখ ৮ হাজার ৮৬২ টাকা, স্ত্রীর নামে ৭৮ লাখ ২৭ হাজার ৮৮৩ টাকা। বন্ড, ঋণপত্র ও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে রয়েছে এ আর সি সিকিউরিটিজের ৭১ লাখ ৪৩ হাজার ৭ টাকা, সিডিবিএলের ৬২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮২ টাকা, আইসিবির ১০ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে সিডিবিএল ৮ কোটি ৭ হাজার ৯৯৫ টাকা। পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ নিজ নামে ৩৯ লাখ ৮১ হাজার ৭০৯ টাকা, স্ত্রীর নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র ২৫ লাখ টাকা।

এ ছাড়া ৭০ লাখ ২৫ হাজার ৪০৫ টাকার জিপগাড়ি, স্ত্রীর নামে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার প্রাইভেট কার। নিজ নামে ৩০ তোলা স্বর্ণ, ৬৪ হাজার ৩৫০ টাকা রয়েছে।

হলফনামা অনুযায়ী স্থাবর সম্পদ হিসেবে রয়েছে ২৪ লাখ ১১ হাজার ৪২২ টাকা মূল্যের কৃষি জমি, স্ত্রীর নামে ২ কোটি ২২ লাখ ৪১ হাজার ৫৩ টাকা মূল্যের কৃষি জমি। এ ছাড়া ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ১২ টাকা মূল্যের অকৃষি জমি এবং স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার ৮৪২ টাকার অকৃষি জমি। নিজগ্রাম কামালদিয়ায় ৫০ লাখ ৮০ হাজার ৬২৫ টাকার একটি দালান রয়েছে। নিজের নামে অ্যাপার্টমেন্ট না থাকলেও স্ত্রীর নামে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার ৮০৯ টাকার ৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে।

আবদুর রহমান ফরিদপুর-১ আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথমবার এমপি হওয়ার পর থেকেই তার সম্পদ বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। তবে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ থাকায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। আর গত নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী হন। আবদুর রহমানের সঙ্গে স্ত্রী ও মেয়ের জামাইরাও শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এর আগে ২০০২ সালে এক লাফে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। আর বর্তমানে তিনি দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।

মধুখালী উপজেলার কামালদিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া আবদুর রহমান পৈতৃক সূত্রে ভিটেবাড়িসহ কয়েক বিঘা জমির মালিক হলেও এমপি হওয়ার পর পরই বাড়তে থাকে তার সম্পদ। তার সঙ্গে স্ত্রী রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. মির্জা নাহিদা হোসেন বন্যারও সম্পদের পরিমাণ কম নয়। তার নামে-বেনামে ঢাকার পূর্বাচলে জমি এবং ধানমন্ডি, উত্তরা ও পরীবাগে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। রয়েছে কয়েকটি ভিআইপি গাড়ি। নিজ ইউনিয়ন কামালদিয়ার টাকদিয়া মাঠ, কামালদিয়া মাঠ, বোয়ালমারী উপজেলার কাদিরদী পোস্ট অফিসের পাশে, কাদিরদী কলেজের সামনে, মুজুরদিয়া ঘাটসংলগ্ন জমি এবং কানখরদী ও বেড়াদীর বিলে আছে কয়েক শ বিঘা জমি। এ ছাড়া কানখরদীর জমিতে ‘রাজ অটো ব্রিকস’ দেখিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে কয়েক শ কোটি টাকা লোন নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

নির্বাচনি এলাকায় নিজের বলয় তৈরি করতে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন তিনি। তবে ক্ষমতাধর এই নেতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করতে পারেননি কেউ। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগে সভাপতি পদে নিজের পছন্দমতো নেতা বসিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। নিজের তৈরি করা কমিটিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বড় একটি অংশ তার কথায় চলত।

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, আবদুর রহমানকে টাকা দিয়ে সহজেই যেকোনো পদ নেওয়া যেত। অর্থলোভী এই নেতাকে টাকা দিয়ে যেকোনো কাজ করানো যেত বলে তিনি জানান। ঘুষ হিসেবে যেকোনো অঙ্কের টাকা তিনি অবলীলায় নিয়ে নিতেন। টাকা দেখলে তার মাথা নষ্ট হয়ে যেত বলেও তিনি জানান।

ফরিদপুর-১ আসনের তিনটি উপজেলায় একচ্ছত্র ‘রাজত্ব’ ছিল আবদুর রহমানের। তার বিরুদ্ধে রয়েছে দখলদারির অভিযোগ। নিজ নামে এবং ছেলেমেয়ের নামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ব্রাহ্মণকান্দায় ‘আবদুর রহমান টেকনিক্যাল কলেজ’ ও ‘আয়েশা-সামি’ জেনারেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারি জায়গায় প্রভাব খাটিয়ে কলেজের নাম দেন। কাদিরদী এলাকায় সরকারি অর্থায়নে গড়ে তোলা একটি কারিগরি কলেজের নাম তার মা ও বাবার নামে করার চেষ্টা চালান। মধুখালী নরকোনা কলাগাছিতে রয়েছে আবদুর রহমান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

আবদুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা হওয়া নিয়ে রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। তিনি কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা হলেন, সেটি নিয়ে খোদ মুক্তিযোদ্ধারাও হাসাহাসি করেন।

ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহসভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম বলেন, আবদুর রহমানের ছত্রচ্ছায়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তিন উপজেলায় মাদক দিয়ে সয়লাব করে দিয়েছিলেন। তিনি সরকারি জায়গা দখল করে তার বাবা, ছেলে ও মার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন।

এদিকে আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুদক।

গত ৫ আগস্টের পর থেকেই আবদুর রহমান আত্মগোপনে। সরকার তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিলেও শোনা যায়, দেশ ছেড়ে পাশের দেশ বা অন্য কোনো রাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

টাকার বিনিময়ে বানাতেন স্কুল-কলেজের সভাপতি

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৫ এএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৯ পিএম
টাকার বিনিময়ে বানাতেন স্কুল-কলেজের সভাপতি
নড়াইল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বি এম কবিরুল হক মুক্তি। ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী হোক কিংবা বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মী হোক, কারও বিরোধিতাই পছন্দ করতেন না। যারাই তার মতের বিরোধিতা করেছেন, তাদের কঠোরভাবে দমন করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে নড়াইল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বি এম কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে।

বিএনপি নেতা-কর্মীরা জানিয়েছেন, কবিরুল হক মুক্তি ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের দলীয় কার্যক্রমে বাধা দিয়েছেন বহুবার। কেউ তার বিরুদ্ধে গেলে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। এমনকি বাদ যায়নি আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও। মতের বিরোধিতা করায় তাদের ওপরও চড়াও হয়েছেন মুক্তির লোকজন। 

স্থানীয় সূত্র জানায়, নড়াইল-১ আসন সদর উপজেলার ৫টি ইউনিয়ন, কালিয়া পৌরসভা ও কালিয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত। বি এম কবিরুল হক মুক্তি ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কালিয়া পৌরসভার মেয়র থাকা অবস্থায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী সময় টানা দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে কোন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি কে হবেন, তাও নির্ধারণ করতেন মুক্তি। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সভাপতি বানাতেন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সূত্র জানায়, স্কুল-কলেজের সভাপতি হওয়ার জন্য কবিরুল হক মুক্তিকে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দিতে হতো। আবার সেসব স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার সময় আবার নতুন করে টাকা দিতে হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ৮ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হতো এমপিকে। টাকা না দিলে নিয়োগ স্থগিত করে রাখা হতো।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনি এলাকায় গ্রুপিং সৃষ্টির কারণে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সাবেক এমপি মুক্তির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া যায়, তার মধ্যে অন্যতম হলো, নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত রাখতে তার নির্বাচনি এলাকার সব ইউনিয়ন থেকে গ্রাম পর্যায়ে গ্রুপিং সৃষ্টি করা। মুক্তির আমলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই জনপদে বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর। 

স্থানীয়রা জানান, তার এলাকায় উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোতে পছন্দের প্রার্থীকে জেতাতে স্থানীয় প্রশাসনকে চাপ দিতেন মুক্তি। সংসদ সদস্য হয়েও নিয়ম ভেঙে এলাকায় ভোটে প্রভাব বিস্তার করতেন। সবশেষ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সকল প্রার্থী আওয়ামী লীগের হলেও নিজ পছন্দের প্রার্থী শামীম রহমানকে বিজয়ী করতে মাঠে নামেন এবং বিজয়ী করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

এ ছাড়া এমপির পরিবারের বিরুদ্ধে রয়েছে নিয়মিত চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ। কালিয়া সাবরেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক ও কালিয়া দলিল লেখক বহুমুখী সমবায় সমিতির সদস্যসচিব উৎপল সিকদার জানান, সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ঘুষ-বাণিজ্যের টাকা নিতেন মুক্তি ও তার স্ত্রী চন্দনা হক এবং চাচাতো ভাই জামাল বিশ্বাস। অফিসের নৈশপ্রহরী সৈয়দ নাজমুল হুদার মাধ্যমে এই টাকা নিতেন তারা। প্রতি মাসে মুক্তি ও তার স্ত্রী ১ লাখ টাকা করে চাঁদা নিতেন। মুক্তির ভাই জামাল বিশ্বাস নিতেন ৫০ হাজার করে। আওয়ামী লীগের আরও অনেকেই টাকা নিতেন। জমির ক্রেতা-বিক্রেতাকে বিভিন্নভাবে জিম্মি করে জামাল বিশ্বাস টাকা নিতেন বলেও অভিযোগ আছে। এ ছাড়া দলিললেখক সমিতিতে থাকা লেখকদের টাকাতেও মুক্তির পরিবার ভাগ বসাতেন। 

সাবেক এমপি বি এম কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে জেলায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। তবে দলের দুর্দিনে নেতারা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাননি। 

কালিয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক স ম রাকিবুজ্জামান পাপ্পু বলেন, “ভোট ডাকাতির মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মুক্তি তার নিজস্ব বাহিনী দিয়ে কালিয়ায় সন্ত্রাসের অভয়ারণ্য গড়ে তুলেছেন। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিএনপির শতশত নেতা-কর্মীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। বিএনপি নেতা-কর্মীর কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঢাল করে কাল্পনিক ঘটনা ঘটিয়ে ‘নাশকতা’ মামলা দিয়েছেন।” মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে মুক্তি ও তার লোকজন অনেকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

কালিয়া উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক কামাল সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার নামে ৮টি নাশকতার মামলা হয়েছে। বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সর্বশেষ গত ছয় মাস আগে নাশকতা মামলায় জেল খেটে বের হয়েছি। আমাদের প্রত্যেকটা নেতা-কর্মীর নামে মামলা হয়েছে।’ সব মামলা সাবেক এমপি মুক্তির ইন্ধনে হয়েছে বলে দাবি তার।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর নড়াইল-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বি এম কবিরুল হক মুক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হয়। এরপর থেকে আত্মগোপনে চলে যান চারবারের সাবেক এই সংসদ সদস্য। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে কবিরুল হক মুক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

ঢালাও মামলা, আসামিদের চেনেন না বাদীরা!

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:৩০ পিএম
ঢালাও মামলা, আসামিদের চেনেন না বাদীরা!
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

‘আমিও কইতে পারি না, এই আসামি কারা?’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক এক হত্যা মামলার আসামিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে খবরের কাগজকে কথাগুলো বলেন মামলার বাদী মো. রফিকুল ইসলাম। তার ভাই মো. সুজনকে হত্যার অভিযোগে ৭৯ জনের নাম উল্লেখ করে এই মামলা করেন তিনি। 

শুধু তিনি নন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক বিভিন্ন মামলার আসামিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মামলার আসামিদের চেনেন না। আবার অনেক আসামি জানিয়েছেন যে, মামলাসংশ্লিষ্ট ঘটনার সঙ্গে তাদের ন্যূনতম সম্পর্ক নেই, এমনকি আন্দোলনের সময় বা এর অনেক আগে থেকে বিদেশে অবস্থান করা ব্যক্তিদেরও এসব হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, এভাবে ঢালাও মামলা করার মাধ্যমে ঘটনাগুলোকে হালকা করে দেওয়া হচ্ছে, ফলে আন্দোলনে আত্মদানকারীদের অবদানকেই খাটো করা হচ্ছে। আবার সাধারণ মানুষও হেনস্তার শিকার হচ্ছে। সর্বোপরি দেশে-বিদেশে সবখানে দেশের দুর্নাম হচ্ছে।

মামলার বাদী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, মো. সুজন ছিল আমার আপন ছোট ভাই। সে ট্রাকের হেলপার ছিল। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সে মারা গেছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় করা এই মামলার ১৩ নম্বর আসামি ‘যুবলীগ নেতা মিলন চৈতা’, ৩২ নম্বর আসামি ‘আওয়ামী লীগ নেতা পীযুষ বাবু’ ও ৭০ নম্বর আসামি জহির উদ্দিন জালাল ওরফে বিচ্ছু জালাল (মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন)।

এ আসামিদের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনারা কারা আমিও কইতে পারি না। আমি যে সময় মামলাটা করেছিলাম তখন আমার সঙ্গে জামায়াত ছিল, মোহাম্মদপুর থানার তখনকার ওসি ছিলেন। আমি তো আর এতটা শিক্ষিত না। নিজের নামটাও ঠিকমতো লিখতে পারি না। নাম-ঠিকানা কোনটা কীভাবে দিয়েছে, তা তো আর আমি জানি না। আমাকে চারদিন ঘুরিয়ে বলেছে, আপনার মামলা (প্রস্তুত) হয়ে গেছে। আপনি একটা সাইন দেন। পরে টেবিলে কাগজটা আনছে। তখন আমি কোনো রকমে সাইন করি।’

নিহতের পরিবার হিসেবে এরই মধ্যে তারা জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে ২ লাখ টাকা এবং আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ১ লাখ টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন বলেও জানান তিনি। এ ছাড়া সরকারি সহযোগিতার জন্য কাগজপত্র জমা দিয়েছেন বলেও জানান রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার এই মামলার বাদী।

শুধু শহুরে বাদী নন, গ্রামে বসবাস করা এক বাদী রুজিনা আক্তারের সঙ্গে কথা বলেও এমন চিত্র উঠে এসেছে। রুজিনার সঙ্গে দৈনিক খবরের কাগজের কথোপকথন ছিল এমন: 

 ‘মেয়র তাপস’ কে?
‘জানি না’
‘আপনার মামলার ৪ নম্বর আসামি। আরও প্রায় দেড় ডজন আসামির পরিচয়ে উনার সংশ্লিষ্টতা দেখানো হয়েছে।’
‘বোধ হয় বোরহান উদ্দিনের (ভোলা জেলার উপজেলা)’।

এই মামলায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র ও সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে আসামিদের সংশ্লিষ্টতা বর্ণনা করা হয়েছে বিভিন্ন ভাবে। এর মধ্যে রয়েছে, ‘মেয়র তাপসের সহযোগী ও অর্থদাতা’, ‘তাপসের সহযোগী’ ও ‘ভোট চোর মেয়র তাপসের সহযোগী’ ইত্যাদি।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীতে তার স্বামী মো. মনিরকে হত্যার অভিযোগে যাত্রাবাড়ী থানায় এই মামলা করেন বাদী রুজিনা আক্তার। এই মামলায় মোট ২২৪ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ১৭ জন আসামির পরিচয় দেওয়া হয়েছে সাবেক মেয়র তাপসের সঙ্গে জড়িয়ে। অথচ এই আসামিকেই তিনি চেনেন না! রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল পরিচিত সাবেক মেয়র তাপসকে যেমন মামলার বাদী চিনতে পারেননি, আবার আসামির তালিকায় ১৫০ নম্বরে থাকা অখ্যাত ব্যক্তি বেনজির আহমেদকেও চেনেন না বলে জানান ভোলার এই গৃহিণী।

তিনি বলেন, শুধু তার উপজেলা তজুমদ্দিনের আসামিদের তিনি চেনেন। অন্যদের নাম গুছিয়ে দিয়েছেন আইনজীবী।

এ বিষয়ে তার আইনজীবী ফারহানা আখতার (লুবনা) বলেন, একজন ম্যাজিস্ট্রেট যখন মামলা আমলে নেন, তখন তা বুঝেশুনেই নেন। মামলাটি আমলে নিয়েছেন আদালত। সুতরাং আইনত এটি ঠিকই আছে। মামলার বাদী আসামিদের চেনেন।

মামলায় নিহতের পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলার আলতাফ আলী দফাদার বাড়ির জয়নাল আবেদীনের ছেলে। জানা গেছে, নিহতের বাবার নাম মূলত আবদুল মান্নান। এই বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শুভ দেবনাথ দৈনিক খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পেরেছি নিহতের জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) বাবার নাম জয়নাল আবেদীন লেখা থাকলেও আসলে তার বাবার নাম আবদুল মান্নান। জয়নাল আবেদীন নিহতের দাদার নাম। এখান থেকে আমরা কাগজপত্রে তার বাবার নাম উল্লেখ করেছি জয়নাল আবেদীন ওরফে আবদুল মান্নান।

এই মামলার আসামিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীও আছেন। তারা বলছেন, মামলার বাদীকে না জানিয়ে এসব নাম লেখার কারণেই এমনটা হয়েছে। কারণ নিহতের বাবা এই মামলার বাদীর শ্বশুর। কোনোভাবেই তিনি শ্বশুরের নাম ভুল বলতেন না।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক আরেক ঘটনায় একটি হত্যা মামলা করেন রফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। রাজধানীর আদাবর থানায় করা এই মামলায় আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৫৬ ব্যক্তি ও সংগঠনকে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০-৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে এই মামলায়। মামলায় নাম উল্লেখ করা আসামিদের মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক, বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার এবং সাবেক এমপি সাকিব আল হাসানসহ বেশ কয়েকজন আসামি ঘটনার সময় বা তারও আগে থেকে বিদেশে অবস্থান করছিলেন।

এই বিষয়ে কথা বলতে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা বাদীর ফোন নম্বরে ফোন করলে অন্য একজন কল রিসিভ করেন। তিনি জানান, তার নাম মো. শিবলী আহমেদ। মামলার বাদী রফিকুল ইসলাম তার চাচা হন। রফিকুল ইসলাম শিক্ষিত নন, কথা গুছিয়ে বলতে পারেন না। মামলায় উল্লেখ করা ফোন নম্বরটি তারই (শিবলী)।

প্রমিত উচ্চারণে কথা বলা শিবলী জানান, মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, তা তিনিসহ কয়েকজন মিলে লিখে দিয়েছেন। কারও প্ররোচনা ছাড়াই এই নামগুলো দিয়েছেন তারা। মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের জন্য আবেদন করা হবে বলেও জানান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক আরেক হত্যা মামলার বাদী কোহিনূর আক্তার। তার ছেলে ইমরান হাসানকে হত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য, তার মন্ত্রিসভার সদস্য এবং বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকসহ ২৯৭ জনের নাম উল্লেখ করে এই মামলা করেন। এ ছাড়া আরও ২৫০-৩০০ জন অজ্ঞাতনামাকে আসামি করা হয় মামলায়।

মামলায় ১১৯ নম্বর আসামি জাহাঙ্গীরের পরিচয় উল্লেখ করা আছে ‘তোফায়েল আহমেদের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে।’ ১৭৬ নম্বর আসামি মাহিনের পরিচয় লেখা আছে ‘ছাত্রলীগ নেতা’ এবং ১৭৭ নম্বর আসামি জুয়েলের পরিচয় উল্লেখ করা আছে ‘যুবলীগ নেতা’। এই দুজনের ফোন নম্বরও এজাহারে উল্লেখ করেছেন বাদী।

তবে যাত্রাবাড়ী থানার এই মামলার এসব আসামির পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি একজন গৃহিণী। যাত্রাবাড়ীতে থাকি না। আমি থাকি সোনারগাঁওয়ে। যাত্রাবাড়ীর আসামিদের নাম দিয়েছেন আমাদের সংগঠন থেকে।’

‘আপনাদের কোন পার্টি?’ –প্রশ্নের জবাবে কোহিনূর আক্তার বলেন, বিএনপি- জামায়াতের লোকজন নামগুলো দিয়েছেন।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকেন্দ্রিক এক হত্যা মামলার ‘ঢালাও আসামি’ হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় (বেরোবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহামুদুল হক। তিনি জানান, মামলার বাদীর সম্মতি ছাড়াই তাকে এই মামলার আসামি করা হয়েছে।

গত ১৮ জুলাই রংপুরে মডার্ন মোড়ে অটোচালক মানিক মিয়া হত্যা মামলায় আসামি করা হয় সাংবাদিকতার এই শিক্ষককে। মামলার বাদী নিহত মানিক মিয়ার মা নুরজাহান বেগম।

মাহামুদুল হক জানান, কোটা আন্দোলনের সময় থেকেই তার অবস্থান ছিল কোটার বিরুদ্ধে। সেই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া তার পোস্টগুলো তার প্রমাণ। তিনি বলেন, যারা নিরপরাধ ব্যক্তিদের মামলায় আসামি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে সরকারের উচিত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।

এই শিক্ষক বলেন, মামলার বাদী এফিডেভিট করে আমিসহ ৭-৮ জন নিরপরাধ আসামিকে লিখিত দিয়েছেন যে, নামগুলো তিনি দেননি। এসব আদালতে জানানো হবে বা আইওকে দেওয়া হবে।

জানা গেছে, এই মামলায় নিহতের আপন মামা অর্থাৎ বাদীর আপন ভাইকেও আসামি করা হয়েছে।

শুধু রংপুরের এই শিক্ষক নন। খোদ রাজধানীতেও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা ব্যক্তিদের আসামি করার উদাহরণ আছে। তাদের একজন শামীমা সুলতানা। 

মামলার বাদী এই নারী আসামিকে চেনেন না। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর সূত্রাপুর থানার সোহরাওয়ার্দী কলেজের সামনে পাকা রাস্তার ওপর (লক্ষ্মীবাজারের অংশ) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা গুলি চালালে মিছিলে থাকা সাগর মিয়ার পায়ে গুলি লাগে। এর ২ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান সাগর, এই অভিযোগে একটি হত্যা মামলা করা হয়। গত ১৯ অক্টোবর দৈনিক খবরের কাগজে ‘মিছিলকারীরাও আসামি’ শিরোনামে দৈনিক খবরের কাগজে এই নিয়ে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই মামলার বাদী বাছিরুল ইসলাম খান। দৈনিক খবরের কাগজকে তিনি বলেছেন, তিনি কারও বিরুদ্ধে মামলা করেননি। তিনি তাদের চেনেন না। এ ছাড়া মামলায় এসব আসামির নাম তিনি দেননি। দিয়েছেন অন্য কেউ।

খবরের কাগজকে ওই বক্তব্য দেওয়ায় দেড় মাস পর গত বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) দৈনিক খবরের কাগজকে আবারও তিনি বলেন, ‘মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানি না ভাই।’

গৃহিণী শামীমা খবরের কাগজকে বলেছেন, মামলার ঘটনাস্থল সূত্রাপুরে তিনি জীবনেও যাননি। তাছাড়া তিনি ধানমন্ডি মোহাম্মদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অভিভাবক হিসেবে মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন। তার পরও কেন তাকে হত্যা মামলার আসামি করা হলো, তা তিনি বুঝতে পারছেন না।
একইভাবে নাটোরের সিংড়া থানার আজিজ, মুন্সীগঞ্জের সাঈদ শেখ, গাজীপুরের মোজ্জামেল হক কাকন এবং কেরানীগঞ্জের সরোওয়ার্দী শেখকেও এই মামলায় ঢালাও আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তারা।

সাকিব আল হাসানের মতো চেনাজানা মানুষ বিদেশে থেকেও যেমন আসামি, আবার অখ্যাত সাধারণ মানুষও আসামি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিত জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী নূর খান বলেন, গত ৫ আগস্টের পর দেশে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এর সুযোগে কিছু মানুষ ফাঁদ পেতেছে। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলোতে এমন কিছু মানুষের নাম আসছে আসামির তালিকায়, সাধারণ মানুকেও আসামি করা হচ্ছে এসব মামলায়। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত। এসব নিয়ে বাণিজ্য চলছে। জেনেছি এসব বন্ধে সরকার পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। এখনই এসব বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, এখন নামগুলো আসছে মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে। এখানে বাদী আসামিকে সেভাবে না জেনেও আসামি করতে পারেন। তবে মূলত মামলার কার্যক্রম শুরু হবে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন আসার পর। তবুও বলব, এভাবে না দিয়ে নাম সুনির্দিষ্টভাবে দেওয়া উচিত।

ব্যাটারিচালিত রিকশা: ব্যবসা মালিকের, পেট চালকের

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৪৩ পিএম
ব্যাটারিচালিত রিকশা: ব্যবসা মালিকের, পেট চালকের
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক- কারও জন্য বেঁচে থাকার অবলম্বন, কারও কাছে লক্ষ-কোটি টাকার বাণিজ্য। ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ এই বাহন ঘিরে এখন নগরবাসীর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। লাখ লাখ মানুষের রুটি-রুজির সঙ্গে জড়িয়ে গেলেও তিন চাকার এ বাহনে যেসব সরঞ্জাম ব্যবহৃত হচ্ছে সেগুলো আইনের চোখে অবৈধ। এই বাহনে ব্যবহার করা হয় সিসাযুক্ত বা পাউডার ব্যাটারি (লিড অ্যাসিড ব্যাটারি) এবং বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশন। এর কোনোটি ব্যবহারের আইনগত বৈধতা নেই। বিআরটিএ বা সিটি করপোরেশন এই বাহনের কোনো লাইসেন্সও দেয় না। ইজিবাইকের বেপরোয়া গতি এবং কাউকে ‘কেয়ার না করার’ বিষয়টি নগরবাসী আর পুলিশের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাহনটি বন্ধের উদ্যোগও সফল হয়নি। 

বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করে জানা গেছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় পুলিশ ও ক্ষমতাধর নেতাদের ম্যানেজ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইকের চলাচল শুরু হয়। প্রথমে তা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় চলাচল শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে তা ঢাকার শহরতলি বা রাজধানীর উপকণ্ঠে দেখা গেছে। এখন অল্প সময়ের ব্যবধানে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান বা ইজিবাইক রাজধানীর অলিগলি ছাপিয়ে মূল সড়কে দাপটের সঙ্গে চলছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে এটি রাজধানীতে চলাচলের অনুমতি দেওয়ার পর থেকে ব্যাপক হারে বেড়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল। সুযোগটা লুফে নিয়েছেন রিকশা গ্যারেজের মালিক-ব্যবসায়ীরা। কোনো কোনো গ্যারেজ মালিকের দেড় শ থেকে দুই শ পর্যন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে। এগুলো ভাড়ায় চলে। ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক দরিদ্র চালকও তিন চাকার এই গাড়ির আয় দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, এই বাহনকে এখন আর রুখতেও পারছেন না ট্রাফিক পুলিশ বা দায়িত্বশীলরা। এরই মধ্যে দাবি আদায়ের জন্য আবারও সংঘবদ্ধ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইক-সংক্রান্ত শ্রমিক সংগঠনগুলো।

যা বলছেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরা
মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন পাবনার সাইদুর রহমান। কয়েক দিন আগে বাংলামোটর মোড়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে অবস্থানকালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘ছয় মাস আগে ঋণ করে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছি। মাঝখানে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিলে চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। সপ্তাহে ৬ হাজার টাকা কিস্তি, পরিবারের সবার ভরণ-পোষণ- সবকিছু এখন রিকশার চাকার ওপর নির্ভর করে। সামনে কী হবে, তা নিয়ে টেনশনে আছি। আমরা গরিব মানুষ, বয়সও প্রায় ৬০ বছর। এ অবস্থায় প্যাডেলচালিত রিকশা চালানোর মতো শক্তি-সামর্থ্য আমার নেই। সরকার একটা ব্যবস্থা (নীতিমালা) করে দিলে বেঁচে যাই।’

গত মঙ্গলবার রাতে পান্থপথ স্কয়ার হাসপাতালের সামনে কথা হয় ব্যাটারিচালিত আরেক রিকশার চালক সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। নওগাঁর মান্দা উপজেলার এই চালক থাকেন ঢাকার রায়েরবাজারে। সিরাজুল বলেন, ‘৭০ হাজার টাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেছি মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকার সরোয়ার মোল্লার গ্যারেজ থেকে। বর্তমানে ওই গ্যারেজে প্রতিদিন ১০০ টাকা চার্জ খরচ দিতে হয়।’ রাতেই বেশি রিকশা চালান তিনি। সব খরচ বাদ দিয়ে ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা প্রতিদিন আয় হয়। এভাবেই ‘করে খেতে চান’ তিনি।

অবৈধ বাহন হিসেবে সমস্যায় পড়তে হয় কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এখন তো কেউ কিছু বলে না। আগে লোকাল পুলিশ ও নেতাদের টাকা দিয়ে চলতে হতো। বিনিময়ে একধরনের টোকেন দিত। আপাতত সমস্যা হচ্ছে না। তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য নীতিমালা করে আমাদের চলাচলের বৈধতা দিলে ভালো হয়।’

অপর একজন রিকশাচালক আজিজুল ইসলামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী। মঙ্গলবার রাতে পান্থপথ সিগন্যালে আলাপকালে তিনি খবরের কাগজকে জানান, মোহাম্মদপুর স্লুইসগেট এলাকার হারুন মোল্লার গ্যারেজ থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশাটি ভাড়ায় নিয়ে চালাচ্ছেন। আজিজুল বলেন, ‘মূলত গড়ে ছয় মাস গ্রামে থাকি, ছয় মাস ঢাকায় এসে রিকশা চালাই। একবার এলে দুই-তিন সপ্তাহ টানা রিকশা চালিয়ে গ্রামে যাই। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে এবারে ছেলে এসএসসি পরীক্ষার্থী। তাদের জন্যই মূলত এ কষ্ট করছি। আমি কোনো আন্দোলনের মধ্যে নেই। এ নিয়ে বড় বড় রিকশা গ্যারেজের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা কাজ করেন।’

যেখানে তৈরি হয় ব্যাটারিচালিত রিকশা
জুরান আলী সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের বাসিন্দা। থাকেন ঢাকার রায়েরবাজারে শিকদার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে জনৈক শুভর গ্যারেজে। গত মঙ্গলবার ওই এলাকায় আলাপকালে জুরান জানান, শুভর গ্যারেজটি মূলত ব্যাটারিচালিত রিকশা তৈরির কারখানা। সেখান থেকে তিনি নিজেও ৬৫ হাজার টাকায় দুই মাস আগে তার রিকশাটি কেনেন। শুভর গ্যারেজে শতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশা আছে। কেবল শুভর গ্যারেজ নয়, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় শত শত এমন রিকশার গ্যারেজ আছে। এসব গ্যারেজেই বর্তমানে তৈরি হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।

অন্য একজন রিকশাচালক এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘কমলাপুর স্টেডিয়াম এলাকা থেকে আমার ব্যাটারিচালিত রিকশাটি কিনেছি। ওখানে (কমলাপুর স্টেডিয়াম এলাকা) ব্যাটারি দিয়ে রিকশা তৈরি করা হয়। এর বাইরে আরও অনেক জায়গায় এ জাতীয় রিকশা কেনাবেচা হয় বলে শুনছি।’

এদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানীর চারপাশের সব এলাকাতেই এখন ব্যাটারিচালিত রিকশার শত শত গ্যারেজ ও কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় অবৈধ বৈদ্যুতিক চার্জিং স্টেশনও স্থাপন করা হয়েছে। এসব রিকশায় ব্যবহৃত হয় ১২-২৪ অ্যাম্পিয়ারের সিসার ব্যাটারি।

যা বলছেন গ্যারেজ মালিক-ব্যবসায়ীরা
মো. জসিম উদ্দিন অর্ধশতাধিক ব্যাটারিচালিত রিকশার মালিক। রাজধানীর দক্ষিণখান থানার আজমপুর কাঁচাবাজারের ৩৭৪ নম্বর বাড়িতে রয়েছে তার রিকশার গ্যারেজ। পাশাপাশি সেখানে গড়ে তুলেছেন ব্যাটারি চার্জ দেওয়ার স্টেশন। জসিম উদ্দিন মুঠোফোনে খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমার গ্যারেজের সামনে কিছুদিন ধরে রাস্তার কাজ চলছে। এ জন্য ব্যবসা-বাণিজ্য (ভাড়ায় দেওয়া রিকশা) বন্ধ হয়ে আছে। গ্যারেজে চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, তবে সেটাও রাস্তার কারণে আপাতত বন্ধ।’ এক প্রশ্নে জসিম বলেন, ‘সরকার একটা নীতিমালা করে আমাদের বৈধভাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর বা ব্যবসা করার সুযোগ করে দিলে সব ঝামেলা মিটে যাবে।’

তুরাগের বাউনিয়া এলাকার অপর একজন গ্যারেজ মালিক মো. আশরাফুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমানে আমার ২৯টি ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক আছে। আগে আরও বেশি ছিল। কিছু গরিব মানুষ রিকশা চালিয়ে সংসার চালাচ্ছেন, কাজেই এটা বন্ধ না করে বা জটিলতা সৃষ্টি না করে বিষয়টি মানবিকভাবে দেখা দরকার।’ কারখানা বা চার্জিং স্টেশন আছে কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে আশরাফুল বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার গ্যারেজে সব ব্যবস্থা আছে।’

যা বলছেন শ্রমিক সংগঠনের নেতারা
রিকশা ও ব্যাটারিচালিত ভ্যান-ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য জনার্দন দত্ত নান্টু খবরের কাগজকে বলেন, ‘সারা দেশে কতগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশা বা ইজিবাইক আছে তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। তবে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে এ ধরনের তিন চাকার বাহন (রিকশা, ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক) বা এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় উঠে এসেছিল, প্রতি রিকশার বিপরীতে চালক বা শ্রমিকের সংখ্যা ১ দশমিক ৫ জন। অর্থাৎ একটি রিকশা পালাক্রমে একাধিক ব্যক্তি চালাচ্ছেন।’

বৈধ-অবৈধতার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ঢাকায় বড় বড় গ্যারেজ বা একক মালিকানায় কারও কারও অনেক রিকশা আছে। এটা তাদের ব্যবসা। তবে অনেকেই আছেন যারা কেবল জীবন-জীবিকা ও সংসার চালাতে ঋণের টাকায় রিকশা কিনে চালাচ্ছেন। এদের সংখ্যাই বেশি। এ রকম পরিস্থিতিতে বাস্তবভিত্তিক নীতিমালা করা হলে সব জটিলতার অবসান হবে।’

একই বিষয়ে রিকশা-ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আব্দুল্লাহ কাফি রতন খবরের কাগজকে বলেন, ‘আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পর থেকে পুলিশ কমিশনারসহ ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে দুই দফায় আমাদের আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পুলিশ যেভাবে বলছে তাতে সমস্যার অবসান হবে না। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইক প্রধান সড়কে উঠতে পারবে না। এই প্রধান সড়ক বলতে তারা বলছেন যে রোডে বাস চলাচল করে সেই সব রাস্তার কথা। কিন্তু ঢাকার প্রায় সব রাস্তায় এখন বাস চলাচল করে। তাহলে সমাধানটা কী হবে? এভাবে বললে সংকট আরও বাড়বে।’

নতুন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত
রিকশা ও ব্যাটারিচালিত ভ্যান-ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য জনার্দন দত্ত নান্টু জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইকের চালক বা মালিকদের দাবিগুলো নিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে নতুন কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৫ থেকে ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘প্রচারপক্ষ’ পালন করা হবে। এ ছাড়া আগামী ১৮ ডিসেম্বর নানা শ্রেণি-পেশার নাগরিকদের নিয়ে ঢাকায় মতবিনিময়ের আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সংখ্যা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যা বলছে পুলিশ
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসান এ প্রসঙ্গে খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক যা-ই বলি, সবই অবৈধ। অবৈধ বাহন হওয়ায় এর কোনো সংস্থা বা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান নেই। সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। তবে আমরা ধারণা থেকে বলতে পারি, ঢাকা শহর ঘিরে কমবেশি প্রায় তিন লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশা রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ঢাকার চারপাশে বিভিন্ন পয়েন্টে বহুসংখ্যক অবৈধ চার্জিং স্টেশন রয়েছে। আমরা রাস্তার ট্রাফিকব্যবস্থা দেখি, অবৈধ এসব স্টেশন আমাদের আওতায় নেই। অনেক সময় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও সেভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশ কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে খোন্দকার নজমুল হাসান বলেন, ‘আমরা শুধু দেখব প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা যাতে না চলে।’

কী কারণে ব্যাটারিচালিত রিকশা অবৈধ
সিসাযুক্ত বা পাউডার ব্যাটারি (লিড অ্যাসিড ব্যাটারি) মূলত এসব রিকশা-ভ্যান বা ইজিবাইকে ব্যবহৃত হয়। এসব ব্যাটারিতে প্রায় ৬০ শতাংশ সিসা থাকে। আগুনে পোড়ানোর সময় সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করা না হলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতিসাধিত হয়। সিসা পোড়ানোর ফলে অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসারের মতো ব্যাধির শঙ্কা তৈরি হয়। এ ছাড়া খোলা জায়গায় সিসা পোড়ানো এবং নাড়াচাড়া করার ফলে দ্রুত পরিবেশের সঙ্গে মিশে গিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।

পরিবেশের এই ঝুঁকির কারণে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সিসাযুক্ত ব্যাটারি বা পাউডার ব্যাটারি পরিত্যাজ্য বস্তু বলে ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ব্যাটারি ভাঙা বা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে সিসা প্রক্রিয়াজাত করতে পারবে না।

উল্লেখ্য, রাজধানীর সব সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপ করতে গত ১৯ নভেম্বর নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। এর পরই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়াসহ ১১ দাবিতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা। আন্দোলনে পরিস্থিতি বেগতিক হলে চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা এক মাসের জন্য স্থগিত করা হয়।

নীতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের, আদায়ে এনবিআর

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ এএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৭ এএম
নীতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের, আদায়ে এনবিআর
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতিপর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনা হতে পারে। এতে রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং আদায় কার্যক্রম আলাদা থাকবে। 

এনবিআরকে গতিশীল করতে যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, এটি তারই উদ্যোগ। এই উদ্যোগ কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টরা কাজ শুরু করেছেন। 

৫২ বছর ধরে রাজস্ব খাতের নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রমও এনবিআর পরিচালনা করে আসছে।

এনবিআরের একটি সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রম এনবিআরের ওপর থাকলেও রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। 

রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একই প্রতিষ্ঠান নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকলে রাজস্ব খাতে দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি হয়। তারা আরও বলেন, অনেক সময় রাজস্ব আদায় বাড়ানোর স্বার্থে এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা করদাতা ও ব্যবসায়ীদের সক্ষমতার কথা না ভেবেই নীতি প্রণয়ন করে থাকেন। এতে করদাতাদের ভোগান্তি বাড়ে।

অতীতে দেখা গেছে, এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা প্রভাবশালীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সুবিধামতো নীতি প্রণয়ন করেছেন। রাজনৈতিক প্রভাবে রাজস্ব অব্যাহতি দিয়েছেন। এতে ব্যক্তিবিশেষ সুবিধা পেলেও সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে। 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম খবরের কাগজকে বলেন, রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং নীতি- দুটিই এনবিআর পরিচালনা করে থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্ব আদায়ের কাজ আলাদা করার পরামর্শ দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্ব আদায় কে বা কারা করবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। বিষয়টি নিয়ে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে, সে অনুযায়ী সংস্কার করা হবে। 

রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৭৬-এর ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে এনবিআর প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকেই সংস্থাটির মূল কাজ ছিল মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর ও আমদানি শুল্ক আরোপ, আদায় এবং এ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করা। 

আইএমএফের যুক্তি হচ্ছে, রক্ষক ভক্ষক হতে পারে না। যে সংস্থা নীতি প্রণয়ন করবে, সেই সংস্থাকে আদায়ের দায়িত্ব দিলে সেখানে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। তখন থেকে এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল আইএমএফ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময়ে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও বেশি দূর এগোয়নি। এখন নতুন করে এই আলোচনা উঠে এসেছে। 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের চলমান ৪৭০ কোটি ঋণ কর্মসূচির মধ্যে যেসব শর্ত আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করা। সরকার এখন সেই শর্তটি প্রতিপালন করতে যাচ্ছে। 

এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুল করিম খবরের কাগজকে বলেন, এর আগেও রাজস্বনীতি ও আদায় আলাদা করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উদ্যোগটি থেমে যায়। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে প্রতিবছর বড় আকারের ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাজেটের হিসাব মেলাতে এনবিআরের ওপর বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এনবিআর অনেকটা নিরুপায় হয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে আদায় বাড়াতে রাজস্বনীতি প্রণয়ন করে থাকে। অর্থনীতি ও সাধারণের ওপর এর কী প্রভাব পড়ল, তা নিয়ে এনবিআর অতটা চিন্তা করে না। যতটা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে তৎপর থাকে। 

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, রাজস্বনীতি প্রণয়নের আগে অবশ্যই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতির ওপর কী প্রভাব পড়বে তা খতিয়ে দেখতে হবে। সাধারণ মানুষের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তাও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সবার জন্য স্বস্তিদায়ক নীতি প্রণয়ন করা হলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে আদায় বাড়বে। 

তিনি আরও বলেন, কিন্তু আদায় বাড়ানোকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি প্রণয়ন করা হলে সবার জন্য স্বস্তিদায়ক নাও হতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি না এলে রাজস্ব পরিশোধ কীভাবে হবে। এনবিআর আদায় বাড়ানোর দায়িত্বে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি নীতি প্রণয়নের চেয়ে আদায় করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবে এটাই স্বাভাবিক। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়কে গোটা অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করতে হয়। তাই আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখতে হয়। নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব এনবিআর থেকে আলাদা প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকলে অর্থনীতির জন্য খারাপ হবে না।

তার মতে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য সরকার রাজস্বনীতির ব্যবহার করে থাকে। ফলে অর্থনীতিতে রাজস্বনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তাই আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নীতি প্রণয়ন করলে ভালো ফল আসবে বলে মনে করি। 

আইএমএফের মতে, এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করলে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে। নীতি বিভাগকে এনবিআর থেকে আলাদা করে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।

গতি ফিরছে প্রশাসনে

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৫ এএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ এএম
গতি ফিরছে প্রশাসনে
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের চার মাস পর এখন প্রশাসনে গতি ফিরতে শুরু করেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইন অনুযায়ী কর্মসম্পাদনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে অধস্তনদের অনেকেই এখনো নির্ভার হতে পারছেন না। সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। সাবেক সরকারের ‘অপকর্মের’ সহযোগী শীর্ষ কর্তাদের অনেককেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। গত সরকারের শেষ সময়ে মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের উঠিয়ে এনে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। তা ছাড়া সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত বেশ কিছু কর্মকর্তার দপ্তর বদল করা হয়েছে।

এদিকে গত সরকারের আমলে বঞ্চিত অনেক কর্মকর্তাকে এবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। এক পক্ষ পদোন্নতি পাওয়ায় অন্য পক্ষে অসন্তোষ রয়েছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের নীরবতা রয়েছে, চেনাজানা অনেকেই এখন আর খোলামেলা কথাবার্তা বলছেন না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় আসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এদিন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের ১৭ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও প্রশাসনে কাজের গতি ফেরানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় সরকার। প্রাথমিকভাবে সরকারের নীতি বা কর্মপদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে সারা দেশে প্রশাসন স্থবিরতা শুরু হয়। সেই সময়ে প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয়কে ঘিরে শুরু হয় নানা পক্ষের দাবি-দাওয়া ও দাবি আদায়ের আন্দোলন। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সচিবালয় ঘেরাও এবং অবরুদ্ধ কর্মসূচিও পালন করেন। দাবি আদায়ে অসহিষ্ণু আচরণ করায় গ্রেপ্তার হয়েছেন শতাধিক বিক্ষুব্ধ কর্মচারীসহ বেশ কিছু শিক্ষার্থী। এখন ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিন মাসের কার্যক্রমসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সময়ে (আগস্ট-অক্টোবর) সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ১২ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৫, যুগ্ম সচিব পদে ২২৬, উপসচিব পদে ১২৫, অন্যান্য ক্যাডারে ২২১ এবং নন-ক্যাডারে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ৯ জন ও সহকারী সচিব পদে ৩৭ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ৪৩ জন, গ্রেড-১ পদে ১১, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৭, যুগ্ম সচিব পদে ১৭৩, উপসচিব পদে ৩৯১, বিভাগীয় কমিশনার পদে ৪ এবং অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার পদে ৩ জনকে বদলি করা হয়েছে। তা ছাড়া ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি, ১১৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১৬৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব পদে ৪১৪ জন, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও সহকারী কমিশনার পদে ৮৩ জনসহ মোট ১ হাজার ৮৭০ জনের দপ্তর বদল করার পাশাপাশি ৪ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যায় পর্যন্ত ৮০ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি এবং ১০১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে জনপ্রশাসন।

তবে প্রশাসনের বর্তমান স্থবিরতা নিয়ে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আলোচনা-সমালোচনা থেমে নেই। আলোচনায় প্রায়ই উঠে আসছে সাবেক সরকারের মদদপুষ্ট প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার দুষ্কর্ম। 

এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রশাসনে যেকোনো ধরনের বিভক্তি ও রেষারেশি বাড়লে নোংরা রাজনীতি শুরু হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, সম্প্রতি একটি সরকারের হঠাৎ পরিবর্তনে প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রেই একটা অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, আতঙ্ক কাজ করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাজের গতি কম হবে। কারণ পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় কাজের পরিবেশেরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তা ছাড়া নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বভাবতই গত সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা বুঝতে কিছুটা সময় নিচ্ছে প্রশাসন। এ কারণে এই বিভাগে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত এখন নেই। কিন্তু স্বাভাবিক রুটিন কাজে কোনো ব্যাঘাত হচ্ছে না। তাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে প্রশাসনের কর্মকাণ্ড।