কথিত রয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা তাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করেন। আর এই পছন্দকে কাজে লাগিয়ে তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন জেলা কমিটি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের পদ-পদবি পাইয়ে দিয়ে কয়েক শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তাদের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ছিল। এই সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে ছিলেন তিনিসহ কয়েকজন। এদের দ্বারাই পছন্দমতো পদ-পদবি বিক্রি হতো। বিভিন্ন অভিনয়, নাটক সাজিয়ে তারা সৃষ্টি করতেন গল্পের নায়ককে। আর নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সঙ্গে কথা বলে সেই নায়ককে পাইয়ে দিতেন বড় পদ। এ ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হতো ত্যাগী নেতা-কর্মীদের।
এর মধ্যে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ নিয়ে ব্যাপক কানাঘুষা রয়েছে। প্রবাসী শামীম হককে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ পাইয়ে দিতে তিনিসহ তার সিন্ডিকেট নেন কয়েক কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বেকায়দায় পড়েন ত্যাগ-তিতিক্ষায় থাকা নেতা-কর্মীরা।
বলছি ফরিদপুর-১ আসনে (মধুখালী-বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা) আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ও দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আবদুর রহমানের কথা। মঞ্চ কাঁপানো বক্তব্য দিয়ে পছন্দের তালিকায় চলে যান আওয়ামী লীগ সভাপতির। আর এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে তিনি ব্যাপক চাঁদাবাজিসহ অপকর্ম করে গেছেন অবলীলায়। নিজস্ব কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান না থাকলেও শত শত কোটি টাকার মালিকবনে যান দল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। বোয়ালমারী উপজেলার ছোট্ট একটি গ্রামে কৃষক পরিবারে তার জন্ম। ফরিদপুরের সরকারি ইয়াসিন কলেজে পড়াশোনার সময় জেলা ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ঢোকেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে বাগিয়ে নেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ। এরপর আর তাকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
গত নির্বাচনের সময় তার দেওয়া হিসাবে বলা হয়েছে, বর্তমানে তার বার্ষিক আয় ২৮ লাখ ১১ হাজার ৬২৪ টাকা। তার নিজের নামে নেই কোনো ফ্ল্যাট। নিজগ্রাম কামালদিয়ায় রয়েছে একটি বাড়ি। তবে তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ৪টি ফ্ল্যাট। এসব কথা বলা হলেও তার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীর নামে রয়েছে ব্যাপক সম্পদ। নিজ আসন বোয়ালমারী মধুখালীতে রয়েছে অনেক জমিজমাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এরই মাঝে এসব সম্পদের খোঁজে নেমেছে দুদুক।
গত নির্বাচনে হলফনামায় আবদুর রহমান আয়ের উৎস জানিয়েছেন, কৃষি খাত থেকে ১ লাখ ১৫ হাজার ২৫০ টাকা, ব্যবসা থেকে ৬ লাখ ২৭ হাজার ৪০০ টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংক আমানত থেকে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭২ টাকা, চাকরি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে পারিতোষিক প্রাপ্তি) ৪ লাখ টাকা, জমি বিক্রয় থেকে মূলধনি লাভ ৩ লাখ ৬৭ হাজার ৬০২ টাকা এবং মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও পারিতোষিক হিসেবে ৪ লাখ ৬৭ হাজার টাকা বার্ষিক আয় করেন তিনি।
হলফনামা অনুযায়ী অস্থাবর সম্পদের মধ্যে বর্তমানে আবদুর রহমানের নিজ নামে নগদ ২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৯২ টাকা, স্ত্রীর নামে ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮১০ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজ নামে জমা ৫ লাখ ৮ হাজার ৮৬২ টাকা, স্ত্রীর নামে ৭৮ লাখ ২৭ হাজার ৮৮৩ টাকা। বন্ড, ঋণপত্র ও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত ও তালিকাভুক্ত নয় এমন কোম্পানির শেয়ারের মধ্যে রয়েছে এ আর সি সিকিউরিটিজের ৭১ লাখ ৪৩ হাজার ৭ টাকা, সিডিবিএলের ৬২ লাখ ৫৪ হাজার ৮৮২ টাকা, আইসিবির ১০ লাখ টাকা। স্ত্রীর নামে সিডিবিএল ৮ কোটি ৭ হাজার ৯৯৫ টাকা। পোস্টাল, সেভিংস সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ নিজ নামে ৩৯ লাখ ৮১ হাজার ৭০৯ টাকা, স্ত্রীর নামে পরিবার সঞ্চয়পত্র ২৫ লাখ টাকা।
এ ছাড়া ৭০ লাখ ২৫ হাজার ৪০৫ টাকার জিপগাড়ি, স্ত্রীর নামে ২৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকার প্রাইভেট কার। নিজ নামে ৩০ তোলা স্বর্ণ, ৬৪ হাজার ৩৫০ টাকা রয়েছে।
হলফনামা অনুযায়ী স্থাবর সম্পদ হিসেবে রয়েছে ২৪ লাখ ১১ হাজার ৪২২ টাকা মূল্যের কৃষি জমি, স্ত্রীর নামে ২ কোটি ২২ লাখ ৪১ হাজার ৫৩ টাকা মূল্যের কৃষি জমি। এ ছাড়া ৩৯ লাখ ৬৩ হাজার ১২ টাকা মূল্যের অকৃষি জমি এবং স্ত্রীর নামে ১ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার ৮৪২ টাকার অকৃষি জমি। নিজগ্রাম কামালদিয়ায় ৫০ লাখ ৮০ হাজার ৬২৫ টাকার একটি দালান রয়েছে। নিজের নামে অ্যাপার্টমেন্ট না থাকলেও স্ত্রীর নামে ৩ কোটি ৩৩ লাখ ১২ হাজার ৮০৯ টাকার ৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে।
আবদুর রহমান ফরিদপুর-১ আসন থেকে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। প্রথমবার এমপি হওয়ার পর থেকেই তার সম্পদ বাড়তে থাকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন। তবে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ থাকায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি। আর গত নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী হন। আবদুর রহমানের সঙ্গে স্ত্রী ও মেয়ের জামাইরাও শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর আগে ২০০২ সালে এক লাফে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। আর বর্তমানে তিনি দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য।
মধুখালী উপজেলার কামালদিয়া ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জন্ম নেওয়া আবদুর রহমান পৈতৃক সূত্রে ভিটেবাড়িসহ কয়েক বিঘা জমির মালিক হলেও এমপি হওয়ার পর পরই বাড়তে থাকে তার সম্পদ। তার সঙ্গে স্ত্রী রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. মির্জা নাহিদা হোসেন বন্যারও সম্পদের পরিমাণ কম নয়। তার নামে-বেনামে ঢাকার পূর্বাচলে জমি এবং ধানমন্ডি, উত্তরা ও পরীবাগে একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে। রয়েছে কয়েকটি ভিআইপি গাড়ি। নিজ ইউনিয়ন কামালদিয়ার টাকদিয়া মাঠ, কামালদিয়া মাঠ, বোয়ালমারী উপজেলার কাদিরদী পোস্ট অফিসের পাশে, কাদিরদী কলেজের সামনে, মুজুরদিয়া ঘাটসংলগ্ন জমি এবং কানখরদী ও বেড়াদীর বিলে আছে কয়েক শ বিঘা জমি। এ ছাড়া কানখরদীর জমিতে ‘রাজ অটো ব্রিকস’ দেখিয়ে জনতা ব্যাংক থেকে কয়েক শ কোটি টাকা লোন নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনি এলাকায় নিজের বলয় তৈরি করতে গিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়েন তিনি। তবে ক্ষমতাধর এই নেতার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করতে পারেননি কেউ। ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগে সভাপতি পদে নিজের পছন্দমতো নেতা বসিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। নিজের তৈরি করা কমিটিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বড় একটি অংশ তার কথায় চলত।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা বলেন, আবদুর রহমানকে টাকা দিয়ে সহজেই যেকোনো পদ নেওয়া যেত। অর্থলোভী এই নেতাকে টাকা দিয়ে যেকোনো কাজ করানো যেত বলে তিনি জানান। ঘুষ হিসেবে যেকোনো অঙ্কের টাকা তিনি অবলীলায় নিয়ে নিতেন। টাকা দেখলে তার মাথা নষ্ট হয়ে যেত বলেও তিনি জানান।
ফরিদপুর-১ আসনের তিনটি উপজেলায় একচ্ছত্র ‘রাজত্ব’ ছিল আবদুর রহমানের। তার বিরুদ্ধে রয়েছে দখলদারির অভিযোগ। নিজ নামে এবং ছেলেমেয়ের নামে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশে ব্রাহ্মণকান্দায় ‘আবদুর রহমান টেকনিক্যাল কলেজ’ ও ‘আয়েশা-সামি’ জেনারেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সরকারি জায়গায় প্রভাব খাটিয়ে কলেজের নাম দেন। কাদিরদী এলাকায় সরকারি অর্থায়নে গড়ে তোলা একটি কারিগরি কলেজের নাম তার মা ও বাবার নামে করার চেষ্টা চালান। মধুখালী নরকোনা কলাগাছিতে রয়েছে আবদুর রহমান নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়।
আবদুর রহমানের মুক্তিযোদ্ধা হওয়া নিয়ে রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। তিনি কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা হলেন, সেটি নিয়ে খোদ মুক্তিযোদ্ধারাও হাসাহাসি করেন।
ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় কৃষক দলের সহসভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম বলেন, আবদুর রহমানের ছত্রচ্ছায়ায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা তিন উপজেলায় মাদক দিয়ে সয়লাব করে দিয়েছিলেন। তিনি সরকারি জায়গা দখল করে তার বাবা, ছেলে ও মার নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়েছেন।
এদিকে আবদুর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুদক।
গত ৫ আগস্টের পর থেকেই আবদুর রহমান আত্মগোপনে। সরকার তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিলেও শোনা যায়, দেশ ছেড়ে পাশের দেশ বা অন্য কোনো রাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।