একসময় পরিবারের ভরণ-পোষণ জোগাতেই হিমশিম খেতেন ইয়াছিন আলীর বাবা আব্দুল বারী। অভাবের তাগিদে সরকারি সম্পদ আত্মসাতের দায়ে প্রায় ১১ বছর জেলও খেটেছেন তিনি। বাবার অভাবের সংসারে বড় হওয়া সেই ইয়াছিন আলী হঠাৎ করেই যেন হাতে পেলেন আলাদিনের চেরাগ। শূন্য থেকে বনে গেলেন কয়েক শ কোটি টাকার মালিক।
ইয়াছিন আলীর হঠাৎ এমন বিত্তশালী হওয়া রূপকথার গল্পকেও যেন হার মানায়। এখন তার কাছে রয়েছে প্রচুর নগদ অর্থ। বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক তিনি। তার নামে নিজ উপজেলা, জেলা ও রাজধানীতে একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে। বিদেশেও রয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১০ বছরে শূন্য থেকে কয়েক শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন ইয়াছিন আলী। দিনাজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের আস্থাভাজন ছিলেন তিনি। ইয়াছিন বীরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক। দেশে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসাও রয়েছে তার। মাসে কয়েকবার বিদেশ না গেলে চলেই না তার। বীরগঞ্জ পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের হাটখোলা গ্রামে তাদের বাড়ি।
ইয়াছিনের বাবার মৃত্যুর পর তৎকালীন দিনাজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মনোরঞ্জন শীল গোপালের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। ব্যাপক চাটুকারিতার মাধ্যমে সাবেক এমপি গোপালের বিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন তিনি। এর পরই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক এমপি গোপালের কমিশন-বাণিজ্যের মূল হোতা ছিলেন ইয়াছিন আলী। তার সহযোগিতায় নিয়োগ-বাণিজ্য, টেন্ডারবাজি, সোলার লাইট-বাণিজ্য, বিদ্যুৎ-বাণিজ্য, থানায় তদবির, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণাসহ নানা অপরাধ-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন তিনি।
ইয়াছিন আলীর বিরুদ্ধে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা রয়েছে। ধর্ষণের মামলাটি এখনো অমীমাংসিত। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জগদল পুরাতন জেলখানা এলাকায় তারা মিয়া পাগলার ছেলেকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রভাব খাটানোর ফলে এসব মামলার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। এমপি গোপাল তার পক্ষে থাকায় বীরগঞ্জ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তিনি। তার দাপটে অসহায় ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও।
সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হওয়া প্রতিটি প্রকল্পের বরাদ্দের পরিমাণ, বরাদ্দের কত শতাংশ প্রকল্পে ব্যয় এবং কত শতাংশ লুটপাট ও ভাগ-বাঁটোয়ারা হবে তা ঠিক করে দিতেন ইয়াছিন আলী। সাবেক এমপির আশীর্বাদ নিয়েই ইয়াছিন আলী বীরগঞ্জ হাটখোলা সলিডারিটি ক্লাব এবং উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক, ঘোড়াবান্দা দাখিল মাদ্রাসার সভাপতি হন। এ সময় বেশির ভাগ বরাদ্দ তার পকেটে ঢোকে। সরকারি ভবন মেরামত, টিআর, জিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ প্রত্যেক অর্থবছরে মোটা অঙ্কের বরাদ্দ লুট করাই ছিল তার প্রধান কাজ। এমপি গোপালের মেয়াদকালে কেবল ক্রীড়া সংস্থার নামে বরাদ্দ নিয়ে ১ কোটি টাকা লোপাট করেছেন ইয়াছিন আলী।
একইভাবে ইয়াছিন আলীর সলিডারিটি ক্লাব এবং ঘোড়াবান্দা দাখিল মাদ্রাসার নামে গত ১৬ বছরে সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। বরাদ্দের ৪০ শতাংশের বেশি আত্মসাৎ করা হয়েছে। ইয়াছিন আলী সরকারি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য নিজে কালোবাজার থেকে অর্ধেক মূল্যে কিনতেন, যা ছিল ওপেন সিক্রেট।
জানা গেছে, সাবেক এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল ও ইয়াছিনের অবৈধ প্রভাবে প্রকল্প সভাপতি-সম্পাদকরা কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পেতেন না। প্রকল্পের মালামাল অর্ধেক দামে ইয়াছিনকে দিতে হতো। চলতি বাজারে চালের মূল্য টনপ্রতি ৩০ হাজার টাকা হলেও ইয়াছিন নিতেন ১৫-২০ হাজার টাকায়। অর্থাৎ ২ লাখ টাকার চালের ডিও বিক্রি হতো ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায়।
ইয়াছিন আলীর দাপটে সিংহভাগ টিআর প্রকল্পের মালামাল কালোবাজারে বিক্রি করে প্রায় তার পুরোটাই লোপাট করা হয়েছে। কাবিখা ও কাবিটা প্রকল্প কোথাও অর্ধেক, আবার কোথাও অর্ধেকের কিছু কম বাস্তবায়ন করা হতো।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী অভিযোগ করে বলেন, সাবেক এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল তার মেয়াদকালে ইয়াছিন আলীর সহায়তায় সরকারি প্রকল্পে ন্যূনতম ৭৫-৮০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে তার কথাই ছিল শেষ কথা। বীরগঞ্জ পৌরসভার স্থানীয় বাসিন্দা মুজিবুর রহমান বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে, বিশেষ করে এমপি গোপালের দাপটে সরকারের বিভিন্ন টেন্ডার ছিল ইয়াছিন আলীর নিয়ন্ত্রণে। তার কথার বাইরে গেলেই মামলার আসামি হতে হতো।’
বীরগঞ্জের মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘ইয়াছিন আলী এমপি গোপালের একান্ত আস্থাভাজন হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যেত না। সরকারি সব অফিস তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। বীরগঞ্জ শহরের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে জমি কিনেছেন ইয়াছিন। অনেক জমি জোর করে দখল করারও রেকর্ড রয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলেই প্রকাশ্যে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হতো।
এসব বিষয়ে ইয়াছিন আলীর মন্তব্য জানতে তার মোবাইলে ফোন করা হলে ‘সাক্ষাতে কথা হবে’ বলে লাইন কেটে দেন তিনি। তাই তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।