
‘এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার পরও সিরিয়াল পাচ্ছিলাম না। এদিকে অফিসের সময় ঘনিয়ে আসছিল। পরে বেলা ৩টায় পাই কম দামের টিসিবির পণ্য। চাল, ভোজ্যতেল ও ডালের ৪৮০ টাকার প্যাকেজ। ভালোই লাগছে। তবে পরিমাণে বেশি হলে আরও ভালো লাগত।’
টিসিবির ট্রাকসেলের সামনে দাঁড়িয়ে কম দামে পণ্য পেয়ে এভাবেই একাধারে ভোগান্তি ও সন্তুষ্টির কথা জানান আগারগাঁও মেট্রোরেল স্টেশনে কর্মরত নাজমুল হাসান।
নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের জন্য কম মূল্যে এই পণ্য বিক্রি করছে সরকার। তবে মধ্যবিত্তরাও লজ্জা ভুলে দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। ভোক্তাদের অভিযোগ, অনেকক্ষণ দাঁড়ানোর পর যা পাওয়া যাচ্ছে তা সামান্যই। আবার ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার কারণে একই পরিবারের কয়েকজন লুফে নিচ্ছেন কম দামের এসব পণ্য। ডিলাররাও বলছেন, কর্তৃপক্ষের সঠিক নির্দেশনার অভাবে শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না।
বুধবার (১৩ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁও পরিকল্পনা কমিশন চত্বরসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকসেলে এই চিত্র দেখা গেছে। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের ট্রাকসেলেও একই চিত্র দেখা গেছে।
টিসিবির তেজগাঁও অঞ্চলের কর্মকর্তা ও মুখপাত্র হুমায়ুন কবির খবরের কাগজকে বলেন, ‘নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারকে ডিলারের মাধ্যমে দোকান থেকে আমরা তিনটি পণ্য দিচ্ছি। অক্টোবর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে প্রতিদিন ৫০টি ট্রাকে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে।’
ট্রাকে পণ্য বিক্রির সময় ছোটখাটো ভুলত্রুটির কথা স্বীকার করে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিশৃঙ্খলার কারণে গতকাল দয়াগঞ্জ মোড়, যাত্রাবাড়ী বউবাজার ও গেন্ডারিয়া থানার পাশে পাঠিয়েও গাড়ি ফেরত আনা হয়েছে। আগে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা পাওয়া যেত। এখন পাওয়া যাচ্ছে না। তাই বিশৃঙ্খলার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। ডিলারদের টোকেনের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করতে বলা হয়েছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ৩০০ টোকেন দেওয়ার পর যেন পণ্য বিক্রি শুরু করা হয়। নিজ এলাকায় পণ্য বিক্রির সুযোগ দিলে ডিলাররা পরিচিত লোকজনের কাছে তা বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ আসে। তাই তাদের ভিন্ন এলাকায় বিক্রির জন্য বলা হয়েছে।’
মূল্যস্ফীতির কারণে কয়েক মাস ধরে পণ্যমূল্য সাধারণের লাগামের বাইরে। অন্তর্বর্তী সরকার নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারের জন্য ঢাকা মহানগরে টিসিবির মাধ্যমে ৫০টি ট্রাকে তেল, ডাল ও চাল বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেয়। ভর্তুকি মূল্যে এই তিন পণ্যের বিক্রি ২৩ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে।
টিসিবি থেকে জানানো হয়, ১০০ টাকায় এক লিটার ভোজ্যতেল, ৬০ টাকায় এক কেজি মসুর ডাল এবং ৩০ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি করা হচ্ছে। একজন ক্রেতা সর্বোচ্চ দুই লিটার তেল, দুই কেজি ডাল ও পাঁচ কেজি চাল কিনতে পারছেন।
অন্যদিনের মতো গতকালও টিসিবি রাজধানীর ৫০টি স্থানে ট্রাকসেলের মাধ্যমে এসব পণ্য সুলভ মূল্যে বিক্রি করেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশন চত্বরে দেখা যায়, মেসার্স চাঁদপুর জেনারেল স্টোর নামের ডিলারের ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ লাইন। দুপুর ১২টার দিকে ৩০০ জন ক্রেতার জন্য ৭০০ কেজি ডাল, ৭০০ লিটার তেল ও ১ হাজার ৭৫০ কেজি চাল আনা হয়। পণ্য কম দামের হওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও আলাদাভাবে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ান। চাঁদপুর জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী মো. তরিকুল ইসলাম এসব পণ্য বিক্রি শুরু করলে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের ভিড় বাড়তে থাকে।
লাইনে দাঁড়ানো মেট্রোরেল-৬-এ কর্মরত নিজামুল হোসেন বলেন, ‘আমরা ছয়জন এসেছি। কম দামে এসব পণ্য পাওয়া যাচ্ছে জেনে ভালোই লাগছে। কিন্তু পরিমাণে বেশি হলে আরও ভালো লাগত। কারণ একবারে নেওয়া পণ্যে সংসারের সারা মাস চলে না। বারবার লাইনে দাঁড়াতে মানসম্মানে লাগে।’
একই কথা বলেন রাজধানীর একটি বেসরকারি আইটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ফানসুরও। তিনি বলেন, ‘লাইনে দাঁড়াতে লজ্জা লাগে। তাই একবার এসে বেশি পণ্য নিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।’ এ সময় সুমনা নামে এক গৃহিণী বলেন, ‘স্বামী ড্রাইভার। তার আয়ে তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে চলা মুশকিল হয়ে গেছে। তাই লজ্জা ঠেলেই লাইনে দাঁড়িয়েছি। ৪৮০ টাকায় চাল, ডাল ও তেল নিলাম। অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে পাওয়ার পর ভালো লাগছে।’
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান ও প্রেসক্লাবের সামনেও দেখা গেছে একই চিত্র। ডিলাররা ট্রাক আনার আগে থেকেই কম দামে পণ্য পাওয়ার আশায় দীর্ঘ লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকেন ভোক্তারা। দুপুর ১২টার দিকে ট্রাকভর্তি পণ্য এলেই শুরু হয়ে যায় হুড়োহুড়ি। সবার চেষ্টা থাকে কে কার আগে পাবেন।
শুধু টিসিবির ট্রাকসেলেই নয়, কৃষি বিপণন অধিপ্তরের ট্রাকসেলেও দেখা গেছে মধ্যবিত্তসহ নিম্ন আয়ের মানুষের দীর্ঘ লাইন। তারা ১০ অক্টোবর থেকে রাজধানীতে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে ডিম, আলু, পেঁয়াজ, পেঁপে, লাউ, কাঁচা মরিচ ২০টি এলাকায় খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) করছে। নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গতকাল বেলা ১১টায় মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের পাশে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র সোহান আলী খবরের কাগজকে বলেন, ‘আধা ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অবশেষে টিপসই দিয়ে ৪৮০ টাকার প্যাকেজে এক কেজি পটোল, এক ডজন ডিম, পাঁচ কেজি আলু, দুই কেজি পেঁয়াজ ও এক কেজি কচু পেলাম। ভালোই লাগল।’ এ সময় সুমা নামে এক গৃহিণী বলেন, ‘স্বামী বেকার। আয়-রোজগার নেই। বাধ্য হয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি। কম দামে ডিমসহ কয়েক পদের পণ্য পেলাম। বাচ্চাদের নিয়ে কয়েক দিন খাওয়া যাবে।’
এ সময় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা টি এম মাহবুব হাসান বলেন, ‘৯৭ হাজার ৯৫০ টাকার পণ্য আনা হয়েছে। ৩০০ পরিবারের কাছে বিক্রি করা হবে। কর্তৃপক্ষ প্রতিদিন এভাবে পণ্য সরবরাহ করে। আমরা একেক দিন একেক স্পটে বিক্রি করি।’