গায়ে পুলিশের জ্যাকেট। পরনে ট্রাউজার। পায়ে স্যান্ডেল। হ্যাঁ, ক্যাছে গিয়ে কথা বলে জানা যায় তিনি পুলিশসদস্য। গুলিস্তানের ফুটপাতে এসেছেন স্ত্রীর জন্য শীতের পোশাক কিনতে। কিনছেন পুরোনো পোশাক। পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ভাই নারীদের জন্য বেছে কেনা কষ্টকর। অনেক বাছাবাছি করা লাগে। দেখেন তো এটা কেমন? কালারটা ভালো না?
এরই মধ্যে দোকানদার বলে উঠলেন স্যার, দেখতেছেন ভালো কথা। দাম কিন্তু ছয় শ’র কম হবে না। পছন্দ করে কম দিতে চাইবেন তা কিন্তু হবে না। তখন ওই পুলিশসদস্য বললেন, ভাই আগে পছন্দ করি। তারপর তো দরদাম। পছন্দ না হলে দাম করে কী করব। এরপর নিচ থেকে আরেকটি টেনে বের করে এ প্রতিবেদকে বললেন, ভাই এটা কেমন হয়? প্রতিবেদক মাথা ঝুলিয়ে সায় দিলেন। এটা ভালো। কিন্তু এটার হাতাটা একটু কেমন ঢিলাঢিলা মনে হচ্ছে। এটা যদি আরও ঢিলে হয়ে যায় তখন পরতে সমস্যা হবে। পুলিশসদস্য বললেন- এটা আর ঢিলে হবে না, যা ঢিলে হওয়ার হয়েছে। এটা সেকেন্ড হ্যান্ড। কারও ব্যবহার করা। তাই যতটুকু ঢিলে হওয়ার হয়েছে।
পোশাক পছন্দ হয়েছে। এবার দরদামের পালা। দোকানদারকে বললেন, ভাই এবার বলেন কত দেব। স্যার ছয় শ। এর নিচে পারি না। তবে আপনাকে ৫০ টাকা সম্মান করতে পারি। আপনি ৫৫০ টাকা দেন। পুলিশসদস্য বললেন, না ৫৫০ টাকা পারব না। ৪০০ টাকা হলে দেন। তাহলে নিয়ে যাই। আর না পারলে অন্য দোকান দেখি। দোকানদার বললেন, না পারি না। আপনি পাঁচশই দেন। তখন পুলিশসদস্য বললেন আপনার লস হলে আপনি রেখে দেন। আমি অন্য দোকান দেখি। এই বলে তিনি অন্য দোকানে হাঁটা শুরু করেন। কয়েক কদম গেলে দোকানদার ডাক দেন। স্যার চলে যান কেন? শোনেন। আপনাকে আরও ৫০ টাকা সম্মান করছি। ৪৫০ টাকা দেন। পুলিশসদস্য বললেন আমি ৪০০ টাকার বেশি পারব না। আপনার লস হলে রেখে দেন। তখন দোকানদার বললেন, ঠিক আছে স্যার দেন। চারশই দেন। তখন তিনি দুটি ২০০ টাকার নোট দিয়ে পুরোনো ওই পোশাকটি কিনে নিয়ে জিপিওর দিকে রওনা হন। তার বুকের নেমপ্লেটে নাম নেই।
এ প্রতিবেদক তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকেন। সামনে গিয়ে আরেক দোকানে আরেকটি পোশাক দেখতে শুরু করেন। তখন সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা হয় ওই পুলিশসদস্যের সঙ্গে। দুজনের কথোপকথন শুনে পাশের এক দোকানদার বলে ওঠেন, পুলিশের কি আর ফুটপাত থেকে কেনা লাগে! পুলিশের কি টাকার অভাব!
এ সময় ওই পুলিশসদস্য তার পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, কি আর বলব ভাই। আমি আছি অন্য চিন্তায়। আপনি আছেন আপনার চিন্তায়। সবার চিন্তা সবার কাছে। আমার ছেলে এইট থেকে এবার নাইনে ভর্তি হবে। জানুয়ারিতে ভর্তি করতে হবে। ভর্তিতে লাগবে ছয় হাজার টাকা। মাসে মাসে দিতে হবে আট হাজার করে। ঝালকাঠিতে একটি মাদ্রাসায় পড়ত। জানুয়ারিতে বরিশালে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করাব। আমি আছি সেই চিন্তায়। সংসারে কি পরিমাণ খরচ হয়, বেতনের টাকায় খুব হিসাব করে চলা লাগে। পেরে উঠি না। বেতনের বাইরে একপয়সার সুবিধা কারও কাছ থেকে নিই না। যদি নিতাম তাহলে বউয়ের জন্য এই পুরোনো পোশাক কিনতে আসতাম না। নতুন কিনতাম। কিন্তু আমার নতুন পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই। নতুন একটা পোশাক কিনতে গেলে কোনো মার্কেটে ১৫০০ টাকার নিচে হবে না। তাই এখানে কিনতে এসেছি।
এই পুলিশসদস্যের বাড়ি বরিশালের ঝালকাঠি জেলায়। বাড়িতে স্ত্রী আর ছেলে থাকে। তিনি একা থাকেন ঢাকার রাজারবাগে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়ি যাবেন। তাই স্ত্রীর জন্য শীতের পোশাক কিনতে এসেছেন। তার তেমন একটা শীতের পোশাক নেই। ছেলের জন্যও কিছু ভালো চোখে পড়লে কিনবেন।
শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠেছে রাজধানীর ফুটপাতের শীতকাপড়ের দোকানগুলো। বিশেষ করে গুলিস্তান এলাকা।এসব দোকানে ভিড় করছেন ক্রেতারা। গতকাল গুলিস্তান ঘুরে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, সরকারি ও বেসরকারি চাকরিজীবীদের কেউ কেউ বাসায় ফেরার সময় কিনছেন শীতের পোশাক। কেউ কেউ যাচ্ছেন গ্রামে। চলতি পথে কিনে নিচ্ছেন শীতের পোশাক। দোকানগুলোতে চলছে হাঁকডাক। কোনো কোনো দোকানি মুখে হ্যান্ড মাইক লাগিয়ে ক্রেতা ডাকছেন।
গুলিস্তান হল মার্কেটের কোণে সজিবের দোকানে রেকর্ড বাজিয়ে ক্রেতা আকৃষ্ট করা হচ্ছে। গেঞ্জি নিলে ৩০০, হুডি নিলে ৪০০। কথা হয় সজিবের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখান থেকে যারা কেনেন তারা চলতি পথের বেশি। গ্রামে যাচ্ছেন, কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ অফিস করে বাসায় ফিরছেন, কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন শ্রেণির কাস্টমার আসেন। সবাইকে তো দেখে চেনা যায় না। বোঝাও যায় না। মাঝে মাঝে পুলিশের লোকরাও সিভিল পোশাকে কিনতে আসেন। সিভিলে আসলে আপনি বোঝেন কীভাবে? সজিব বলেন, হাতে ওয়াকিটকি দেখে বুঝি।
আরেক দোকানদার বলেন, এক শ্রেণির কাস্টমার আছেন, তারা প্রায়ই আসেন। এক্সপোর্ট কোয়ালিটির ভালো কিছু এলেই তারা কিনে নিয়ে যান। তারা বোঝেন কোনগুলো ভালো। তারা বেশির ভাগই চাকরিজীবী। অফিস থেকে ফেরার পথে দেখতে দেখতে যান। ভালো কিছু পেলেই কিনে নিয়ে যান। হোক নিজের জন্য বা ছোটদের জন্য কিংবা পরিবারের অন্য কারও জন্য। গুলিস্তানে ঘুরে এদিন শিশুদের পোশাকের দোকানগুলোয় বেশ ভিড় লক্ষ্য করা যায়। অফিস থেকে বাসায় ফিরছেন এমন ক্রেতাই বেশি চোখে পড়ে।