ঢাকা ১২ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫
English
রোববার, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

বিএসএমএমইউ থেকে চাকরি হারাচ্ছেন ৬০ জন

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৫ এএম
আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৩ এএম
বিএসএমএমইউ থেকে চাকরি হারাচ্ছেন ৬০ জন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বিভিন্ন অপরাধে চাকরি হারাতে পারেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অন্তত ৬০ জন। এদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী। আপাতত সাময়িক বরখাস্ত করা হবে ১৫১ জনকে।

বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে ৯৪তম সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এ ছাড়া এই সভায় আরেকটি বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সিন্ডিকেট। তা হলো ফেল করা ১৩ জনকে রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনা পাওয়া সাপেক্ষে ভর্তির সুযোগ দেওয়া।

সূত্র জানিয়েছে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন শাস্তি পেতে হতে পারে আরও বেশকিছু চিকিৎসক, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। তবে আপাতত সহিংসতার ঘটনায় কোনো মামলা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও সহিংসতায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণাসহ মামলা করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল বিএসএমএমইউর বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ।

সূত্রটি জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় শ শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এই দেড় শ জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। পরে তাদের অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তির সিদ্ধান্ত নেবে বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা কমিটি।

ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট বিএসএমএমইউতে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। তাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষক ও চিকিৎসক অংশ নেন। আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও ভস্মীভূত করা হয়। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মামলা করার দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট মামলার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। তবে এই সিন্ডিকেট সভায় চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাতে ৫০ থেকে ৬০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হতে পারে। এ ছাড়া আরেকটি অংশ আছে যাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হতে পারে।

অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ জনের বিরুদ্ধে ওই দিনের হামলায় একজনের নিহতের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। ২২ জন হেলমেট মাথায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। তারা সবাই শিক্ষক ও চিকিৎসক। ৮১ জন কর্মচারী মিছিলসহ নানা ধরনের বিশৃঙ্খলায় জড়িত ছিলেন। ২০ জন চিহ্নিত হয়েছেন মাস্টারমাইন্ড হিসেবে। তারা পেছনে থেকে আন্দোলন নস্যাতের পরিকল্পনা করেছেন।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, অপরাধীরা সবাই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এই ১৫১ জনের মধ্যে এক অংশের স্থায়ীভাবে চাকরি চলে যাবে, এক অংশের বিরুদ্ধে মামলা হবে, এক অংশের পদাবোনতি হবে ও আরেক অংশের সময় মেয়াদি শাস্তি হবে।

গত ৩১ অক্টোবর বিএসএমএমইউর শহিদ ডা. মিলন হলে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও বিএসএমএমইউর অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার-১ ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন টিটো ১০টি দাবি তুলে ধরেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি দাবি ছিল, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকার ও বাধা প্রদানকারী বিএসএমএমইউর চিকিৎসকদের বিএমডিসি নিবন্ধন বাতিল করার। আরেকটি ছিল, গত ৪ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সহিংসতায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণাসহ মামলা দায়ের করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন টিটো বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সাবেক উপাচার্যের একান্ত সচিব এবং সাবেক প্রক্টরের নেতৃত্বে একদল আওয়ামীপন্থি শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারী পরিকল্পিতভাবে শাহবাগে আন্দোলনকারীদের আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রসহ আক্রমণ করে বহু ছাত্র-জনতাকে হতাহত করে। আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোটি টাকার সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও ভস্মীভূত করে। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণাসহ মামলা দায়ের করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 

ফেল করা ১৩ শিক্ষার্থী চায় ভর্তির সুযোগ
এদিকে সিন্ডিকেট সভা চলাকালে ঘটে এক ভিন্ন ঘটনা। এমএস/এমডি কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারা ১৩ জন চিকিৎসক ভর্তির দাবিতে উপাচার্যসহ সিন্ডিকেট সদস্যদের অবরুদ্ধ করেন।

বিএসএমএমইউর একটি সূত্র জানায়, এই ১৩ জন ড্যাবের সাবেক আহ্বায়ক ও বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারের অনুসারী। তারা হট্টগোল শুরু করলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হাসানের অনুসারীরা এসে অবস্থান নিলে তারা চলে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এমএস/এমডি কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারলেও ভর্তির সুযোগ চান ১৩ জন চিকিৎসক। তারা এই দাবি বেশ কয়েকদিন ধরে করে আসলেও বৃহস্পতিবার সিন্ডিকেট সভা চলাকালে শুরু করেন হট্টগোল। উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলমসহ সিন্ডিকেট সদস্যদের অবরুদ্ধ করেন। এরপর তাদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনা পাওয়া সাপেক্ষে তাদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হবে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এমএস/এমডি কোর্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোর্সে ফেল করার পর ভর্তির নজির নেই। কিভাবে তারা এই সুযোগ চান, লজ্জাও করে না! এটা চিকিৎসকদের জন্য লজ্জার। এদের ভর্তি করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে। নাম্বার পর্যন্ত কমানো হয়েছে। তারপরও তারা ফেল করেছেন। তবুও তারা নাছোরবান্দা। প্রতিদিনই ভিসি কার্যালয়ে এসে বসে থাকে। তাদের বোঝালেও বোঝে না। তাদের দাবি, তারা বঞ্চিত, তাই তাদের সুযোগ দিতে হবে।’

সংকটেও ঢাকায় ‘বিলাসী সার্কিট হাউস’

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০২:৪৫ এএম
সংকটেও ঢাকায় ‘বিলাসী সার্কিট হাউস’
প্রতীকি ছবি।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের অনেক অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা প্রকল্প বাতিল করেছে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ে হিমশিম খেলেও দেশের অর্থনৈতিক সংকটের এই দুঃসময়ে ‘ঢাকায় বিলাসী সার্কিট হাউস’ প্রকল্প বাতিল করা হয়নি।

শেখ হাসিনার অনুমোদন করা সেই প্রকল্প ‘ঢাকা জেলায় বিদ্যমান সার্কিট হাউস ভবনের স্থলে নতুন অত্যাধুনিক সার্কিট হাউস ভবন নির্মাণ’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। গোসল করার জন্য পাঁচ তারকা হোটেলের মতো সুইমিংপুল তৈরি করা হবে। তাতে খরচ করা হবে ৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা। শুধু তা-ই নয়, গার্ডরুম তৈরি করতেও খরচ করা হবে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এভাবে আসবাবপত্র কেনা থেকে শুরু করে বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে ৩৩৪ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

এ ব্যাপারে সরকারের শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘অর্থনীতিতে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তা মোকাবিলা করতে এই সরকার আগের সরকারের অনেক অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী প্রকল্প বাতিল করেছে। তাই এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছাড়া এ ধরনের বিলাসী প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের নীতিমালা গ্রহণ করা জরুরি।’ 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি গত ১৯ আগস্ট পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া এবং কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাতিল করা হবে। তার এই নির্দেশনার পর ভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রকল্পের তালিকা তৈরি শুরু করে। তার পরই ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা জাতীয় মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণের জন্য ‘ভূমি অধিগ্রহণ প্রকল্প, ঢাকার নবাবগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়নসহ অসংখ্য প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।

কিন্তু দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক পর্যায়ে চলে গেলেও ঢাকায় সার্কিট হাউস নির্মাণের মতো বিলাসী প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। গত বছরের ৯ মে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা প্রকল্পটির অনুমোদন দেন। সম্পূর্ণ সরকারি খরচে ১৩ তলা ভবন নির্মাণসহ অন্যান্য কাজে খরচ ধরা হয়েছিল ৩৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০২৪-এর জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত। 

সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) শুরুতেই অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট মাসে দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। অনেক শিল্প-কারখানায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে যায়। ফলে সরকারের রাজস্ব আদায়ও কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প কার্যকর করতে যাচ্ছে। এই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আশীষ কুমার সাহা গত ৫ জানুয়ারি প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছেন। 

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রাজধানীর বেইলি রোডের পুরোনো সার্কিট হাউসের জায়গায় নির্মাণ করা হবে নতুন সার্কিট হাউস ভবন। এতে থাকবে আধুনিক নানা সুযোগ-সুবিধা। পাঁচ তারকা মানের হোটেলে যা যা থাকে, তার সবটাই পাওয়া যাবে এখানে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আনা সরকারি কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সাময়িক রাত্রিযাপনের জন্য ভবনটি ব্যবহৃত হবে। নতুন সার্কিট হাউসে দুটি বেজমেন্টসহ একটি ১৩ তলা এবং আরেকটি ৮ তলা ভবন নির্মাণ করা হবে। এতে খরচ ধরা হয়েছে ২৩৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। 

সার্কিট হাউস ভবনের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জায় ব্যবহার করা হবে অত্যাধুনিক সব পণ্য। এতে খরচ করা হবে ১৭ কোটি টাকা। এ ছাড়া সুইমিংপুলও নির্মাণ করা হবে। এতে খরচ হবে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা খরচে জিমনেসিয়ামও করা হবে। অতিথিদের পাহারা দেওয়ার জন্য একটি গার্ডরুম নির্মাণে খরচ করা হবে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে প্রকল্প পরিচালকের দুটি গাড়ির জন্য খরচ করা হবে ৬০ লাখ টাকা। এ ছাড়া এসি, লিফট, বাউন্ডারি ওয়াল, অভ্যন্তরীণ রাস্তা, স্যুয়ারেজ সিস্টেম, জেনারেটর এবং বিদ্যুৎবাবদ বাকি টাকা খরচ হবে। স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও (এসটিপি) নির্মাণ করা হবে। তাতে খরচ করা হবে ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এভাবে সব কাজ করতে ৩৩৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা খরচ করা হবে। 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অংশ নিতে দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ঢাকায় আসতে হয়। তাদের সাময়িক রাত্রিযাপনের জন্য ঢাকা জেলা সার্কিট হাউসটি ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বিদ্যমান সার্কিট হাউসটি অনেক পুরোনো। চাহিদা অনুযায়ী স্থান-সংকুলান সম্ভব হয় না। আবার পুরোনো সার্কিট হাউসটিতে তেমন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নেই। এ ছাড়া রাষ্ট্রের ভিভিআইপি অতিথিদের রাত্রিযাপনের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত রেস্টহাউস নেই। তাই কর্মকর্তাদের ঢাকায় সাময়িক আবাসন সুবিধা বাড়ানোর জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন নতুন সার্কিট হাউস নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যাতে তারা নিরাপদে থাকতে পারেন। এতে সরকারেরও রাজস্ব আয় বাড়বে।

সিফাত/

লুটপাটে শতকোটি টাকার মালিক খালেক

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩০ এএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩১ এএম
লুটপাটে শতকোটি টাকার মালিক খালেক
খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক

২০০৮ থেকে ২০২৪। ১৬ বছর। এই সময়ে খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের নগদ টাকা বেড়েছে প্রায় ৮৩২ গুণ। ২০০৮ সালের সিটি নির্বাচনের সময় তার কাছে নগদ টাকা ছিল মাত্র ৫৭ হাজার ৫৫০ টাকা। ২০২৩ সালে তার কাছে নগদ টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪ কোটি ৭৯ লাখ। চারটি ব্যাংকে তার জমা ছিল আরও ১ কোটি ১৮ হাজার টাকা।

জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকা অবস্থায় নিয়ম ভেঙে ঠিকাদারি ব্যবসার সঙ্গে জড়ান তিনি। খুলনার বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে থেকে অর্থ লোপাটের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। কয়েক বছরের মধ্যেই ঢাকা, খুলনা, বাগেরহাটে কৃষি-অকৃষি জমি, মৎস্যঘের, রাজউকের পূর্বাচল, কেডিএ ময়ূরী আবাসিক ও গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মুজগুন্নি আবাসিকে প্লটসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে তালুকদার আব্দুল খালেক ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ হয়ে ওঠেন।

অভিযোগ রয়েছে, খুলনা সিটি করপোরেশনে মেয়র হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি থাকায় সবকিছু একক নিয়ন্ত্রণে ছিল তালুকদার আব্দুল খালেকের। অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার আর লুটপাটের মাধ্যমে শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। 

সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২১ জানুয়ারি দুদকের খুলনার উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে অনুসন্ধান টিম গঠন করে সংস্থাটি। এর মধ্যে তালুকদার খালেক ও তার স্ত্রী হাবিবুন নাহারের আয়কর রিটার্ন, কর নির্ধারণী আদেশসহ সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র, তার ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে পরিচিত ঠিকাদারদের তথ্য, মেয়র হয়ে রামপাল-মোংলায় যাতায়াতের জন্য কেসিসির গাড়ি ব্যবহার, নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অর্থ আত্মসাতের বিষয়েও অনুসন্ধান করছেন দুদক কর্মকর্তারা।

জানা যায়, খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র হয়েও প্রায়ই তিনি ব্যক্তিগত কাজে খুলনা থেকে মোংলা ও রামপাল যেতেন। তিনি খুলনার নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার স্ত্রী হাবিবুন নাহার ছিলেন ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ২০১৮ ও ২০২৩ সালে দুটি নির্বাচনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈঠক করে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খালেক তালুকদার তার পক্ষে প্রচার চালাতে বাধ্য করেন। প্রচারকাজে ব্যয় মেটাতে প্রচুর টাকা তোলা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে।

সিটি করপোরেশনে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, তাজুল এন্টারপ্রাইজ ও আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের সঙ্গে খালেক তালুকদারের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ঠিকাদারি কাজের যাবতীয় তথ্য ও পরিশোধিত বিলের পরিমাণ জানতে চেয়ে দুদকের পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ কাজ পেয়েছেন খালেকের আস্থাভাজন ঠিকাদাররা।

২০০৮ সালের নির্বাচনে তার কাছে নগদ ৫৭ হাজার ৫৫০ টাকা থাকার তথ্য দেন। এর মধ্যে কৃষি খাত থেকে আয় ২ লাখ ১০ হাজার, ব্যাংকের সুদ থেকে আয় ২ লাখ ১৮ হাজার, বাড়ি ভাড়া থেকে আয় ১ লাখ ৯১ হাজার, সঞ্চয়পত্র থেকে আয় ৬ লাখ ৮২ হাজার, ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও ১৮ লাখ টাকার পোস্টাল এফডিআর। তার দুটি গাড়ি, ২৩ বিঘা কৃষিজমি, তিন কাঠা অনাবাদি জমি আছে। জমিসহ নগরীর কাস্টমঘাটের একটি বাড়ির অর্ধেকের মালিক তিনি, যার দাম ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। 

৫ আগস্টের পর থেকে তালুকদার খালেক আত্মগোপনে রয়েছেন। দুর্বৃত্তরা তার বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালিয়েছে। বর্তমানে তিনি কোথায় তা কেউ জানে না। কাস্টমঘাটের বাড়ি দখল, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। হলফনামা অনুযায়ী, ২০২৩ সালে খালেকের নগদ টাকা ছিল ৪ কোটি ৭৯ লাখ। চারটি ব্যাংকে জমা ছিল ১ কোটি ১৮ হাজার টাকা। তবে এই টাকা তিনি কীভাবে আয় করেছেন পলাতক থাকায় তার কাছ থেকে জানা যায়নি। 

সচেতন নাগরিকদের সংগঠন খুলনা নাগরিক সমাজের সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, বিগত সরকারের সময় যে বা যারা কালোটাকার মালিক হয়েছে, দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনতে হবে। সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও তার স্ত্রী হাবিবুন নাহারসহ তাদের সহযোগীদের দুর্নীতি-অনিয়মের ব্যাপারে দুদক যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাকে নাগরিক সংগঠন স্বাগত জানায়। একইভাবে প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদধারী ব্যক্তি তালুকদার খালেক কীভাবে ঠিকাদারি সিন্ডিকেটে জড়িত হলেন এবং তার সহযোগী আরও যারা এভাবে আয়বহির্ভূত বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, প্রত্যেকের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটনে কাউকে ছাড় দেওয়া যাবে না।

দুদকের খুলনার উপপরিচালক আবদুল ওয়াদুদ খবরের কাগজকে জানান, সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। তার ও সহযোগীদের আর্থিক সংশ্লিষ্টতার তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি দেওয়া হয়েছে।

রাজশাহীতে বিদ্যালয় ঘেঁষে ইটভাটা, শ্বাসকষ্টে ভুগছে শিক্ষার্থীরা

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২০ এএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:২২ এএম
রাজশাহীতে বিদ্যালয় ঘেঁষে ইটভাটা, শ্বাসকষ্টে ভুগছে শিক্ষার্থীরা
গোদাগাড়ী কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সীমানা ঘেঁষেই ইটভাটার কালো ধোঁয়া উড়ে আসছে। ছবি : খবরের কাগজ

রাজশাহীর গোদাগাড়ী কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একতলা ভবনটি ছিমছাম, পরিপাটি। শুধু তাই নয়, এর সীমানাপ্রাচীর থেকে শ্রেণিকক্ষ- সব স্থানেই নান্দনিকতার ছাপ রাখা হয়েছে। শিশুদের বিনোদনের মাধ্যমে পড়ালেখা শেখার সব আয়োজন রয়েছে। ক্লাসরুমের দেয়ালে আঁকা রয়েছে বিভিন্ন চিত্র। লাল ইটের প্রাচীরঘেরা বিদ্যালয়ের ভেতরে সুবজ খেলার মাঠ। রয়েছে দোলনাসহ খেলাধুলার নানা উপকরণ। চত্বরে লাগানো হয়েছে নানা ধরনের ফল-ফুলের গাছ। অথচ শিশুপার্কের মতো সুন্দর এই বিদ্যালয়টির পেছনের সীমানা ঘেঁষেই দাউ দাউ করে জ্বলছে ইটভাটার আগুন। আর সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে সড়কে চলছে ইট ও মাটির ট্রাক। এ ছাড়া ইট ও মাটি রাখা হচ্ছে বিদ্যালয়টির দেয়াল ঘেঁষেই। এতে ভাটায় ইট পোড়ানোর কালো ধোঁয়া আর উড়ে আসা ধুলাবালি বিদ্যালয় ভবনে ঢুকে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। পাশাপাশি জীবনের প্রথম পাঠের স্থানে এসে দিন দিন শ্বাসকষ্টসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে কোমলমতি শিশুরা।

ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন) ২০১৯ অনুযায়ী, বিশেষ কোনো স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রেলপথ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুরূপ কোনো স্থান বা প্রতিষ্ঠান থেকে কমপক্ষে এক কিলোমিটার দূরে ইটভাটা স্থাপন করতে হবে। অথচ সেই আইন না মেনে কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির পেছনে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে পশ্চিম পাশে মেসার্স এম এস ব্রিকস্ নামে একটি ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে ইট। আবার প্রায় সমান দূরত্বে উত্তর পাশেও রয়েছে মুন হাওয়া ব্রিকস নামে অপর একটি ভাটা। সব মিলিয়ে এ বিদ্যালয়কে মাঝখানে রেখে দুটি ভাটায় অবাধে পোড়ানো হচ্ছে ইট। 

প্রাথমিক বিদ্যালয়টির শিক্ষকরা জানান, ইটভাটার দূষণ থেকে পরিবেশ রক্ষা এবং শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকির দিক বিবেচনা করে ভাটার বিষয়ে উপজেলা শিক্ষা দপ্তরে লিখিত অভিযোগ জানানো হয়েছে। তবে সেখান থেকে এখনো কোনো প্রতিকার মেলেনি।

সরেজমিনে দেখা যায়, ২০০০ সালে স্থাপিত গোদাগাড়ীর কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ভাটায় দিনে-রাতে সমানতালে ইট পোড়ানো হচ্ছে। ভাটার কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালি থেকে বাঁচতে বিদ্যালয়ের চারটি শ্রেণিকক্ষেই জানালা বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন শিক্ষকরা। আবার ক্লাস শেষ হলেই শিশুরা বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলায় মেতে উঠছে। ফলে দিন দিন শিক্ষার্থীরা শ্বাসকষ্টসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে অসুস্থ হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ইট পোড়ানোর চুল্লির ধোঁয়া, ইট কাটার মাঠের (ফরাস) ধুলা এবং মালামাল আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত ট্রলি গাড়ির শব্দে ভারী হয়ে ওঠে স্কুল কম্পাউন্ডের পরিবেশ। ফলে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের পাঠদান।

চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী হুমাইরা আফরিন বলেন, ‘ভাটার কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালির কারণে আমাদের বিদ্যালয়ের জানালাগুলো সব সময় বন্ধ রাখা হয়। এতে আলো-বাতাস না পেয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। আবার, জানালা খুললে চোখ মেলে চলাফেরা করা যায় না। কালো ধোঁয়া এসে শ্রেণিকক্ষে গন্ধ ছড়ায়। বেঞ্চে কালি হয়ে যায়। আমরা অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করছি।’ 

তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র আবু সাঈদ বলেন, ‘স্কুলের পাশে ভাটা থাকায় বাতাসে ধুলাবালি ও কালো ধোঁয়া আমাদের নাক-মুখে ঢুকে যাচ্ছে। এতে অনেকের হাঁচি-কাশিসহ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।’ 

স্কুলের শিক্ষিকা কামরুন নেসা বলেন, ‘স্কুলটি প্রত্যন্ত এলাকায় হওয়ায় এখানকার প্রায় সব শিক্ষার্থীই দরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। তারা এখানে পড়ালেখা করতে এসে ভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আবার অর্থের অভাবে তাদের চিকিৎসা নিতেও কষ্ট হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে দ্রুত সমাধান হওয়া জরুরি।’ 

স্কুলটির প্রধান শিক্ষক ইমাম হোসেন বলেন, ‘ভাটাগুলো একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি করছে। অন্যদিকে স্কুলের কোমলমতি শিশুদের জন্য অত্যন্ত স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। শুধু তাই নয়, স্কুল এক-দুই দিন বন্ধ থাকার পর খুললেই চেয়ার-টেবিলসহ সব আসবাবপত্র ধুলাবালি ও কালির আস্তরণে পরিত্যক্ত ভবনের মতো হয়ে যায়। এই বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বারবার আবেদন জানিয়েও কোনো প্রতিকার মেলেনি।’ 

এ বিষয়ে মুন হাওয়া ব্রিকস নামে ভাটার মালিক মো. আফজাল হোসেনের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে মেসার্স এমএস ব্রিকসের মালিক ওবাইদুল্লাহ দাবি করে বলেন, ‘ভাটা স্থাপনের পর স্কুলটি নির্মাণ করা হয়েছে। তাই এ বিষয়ে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) (সংশোধন)-২০১৯ এর ব্যত্যয় ঘটেনি।’ তবে ভাটা কত সালে নির্মাণ করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি উত্তর না দিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোনটি কেটে দেন। পরে আবারও কল করা হলে তিনি আর ফোন ধরেননি। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) আবুল হায়াতকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল ধরেননি। এতে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

তবে রাজশাহী পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. কবির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘কাদিপুর-২ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ওই দুটি ভাটা সম্পর্কে আমরা অবগত আছি। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন ভাটার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এই দুটির বিষয়েও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ 

দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে মত-ভিন্নমত

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪২ এএম
আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১০:৪৭ এএম
দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে মত-ভিন্নমত
খবরের কাগজ ইনফোগ্রাফ

দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা উপযোগী কি না, এ নিয়ে আলোচনা চলছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত একাধিক সংস্কার কমিটি বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনতে কাজ করছে। এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিষয়টির বাস্তবায়ন হলে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো তথা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা গঠিত হবে। গত ২০ বছরে নির্বাচনি ইশতেহারসহ নানা সভা-সেমিনারে রাজনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে মত দিয়েছেন। আবার দেশের আয়তন, জাতি ও ভাষাগত বড় পার্থক্য না থাকায় অনেকেই এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।

এ বিষয়ে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি এটার সঙ্গে একমত নই। কারণ এটা ব্যয়বহুল হবে। আমাদের দেশটা ছোট আর এত বৈচিত্র্য নেই। এটি বহু সমস্যা তৈরি করবে। এমনিতে আমাদের দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে সমস্যা। আরও নির্বাচনি প্রতিনিধি সৃষ্টি মানে আরও সমস্যা সৃষ্টি করা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. দিল রওশন আরা জান্নাত খবরের কাগজকে বলেন, ‘এটি একটি অবাস্তব পরিকল্পনা। এত ছোট একটা দেশে কোন ক্রাইটেরিয়াতে দেশটা ভাগ হবে? ভাগ করতে হলে একটা ক্রাইটেরিয়া লাগে। আমাদের দেশ তো একসঙ্গে লাগানো। এখানে তো দূরত্বের কিছু নেই। মানুষের মধ্যেও বিভেদ নেই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতির সংখ্যা এক ভাগের নিচে।’

তিনি বলেন, ‘বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রদেশ করার দরকার পড়ে না। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করলে এমনিতেই করা যায়। আমাদের যে কাঠামো সেখানে যদি উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করি, ইউনিয়নকে শক্তিশালী করি, অটোমেটিকালি বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে যায়। প্রদেশ করার বিষয়টি অদূরদর্শী পরিকল্পনা।’

বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায়ও। দলটির নেতারাও এটাকে অবাস্তব হিসেবে দেখছেন। প্রদেশ করলে আঞ্চলিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হতে পারে, যা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এ রকম উদাহরণ রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংবিধান অনুযায়ী বণ্টন করা থাকে। যুক্তরাজ্যের লেখক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আলবার্ট ভেন ডাইসির মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এমন এক কাঠামো, যেখানে জাতীয় সরকারের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকারের অধিকারের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়।’ এই ক্ষমতার বণ্টনটা এমনভাবে হয়, প্রত্যেকেই নিজ এলাকায় স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে। সেখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত থাকে। বাকি বিষয়গুলো স্ব স্ব প্রাদেশিক সরকারের কাছে থাকে।’

পৃথিবীর ৭টি বৃহৎ ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও আর্জেন্টিনা। এই দেশগুলোতে ফেডারেল ধরনের সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সুলতানী আমল, মোগল, ব্রিটিশ আমলেও এ ধরনের প্রাদেশিক সিস্টেম চালু ছিল। বর্তমান ভারতে ২৮ রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে। যেখানে জনসংখ্যা ১৪৬ কোটির বেশি। আয়তন ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ২৬৩ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে বাংলাদেশের চেয়ে কম আয়তন ও জনসংখ্যার দেশ নেপালেও সাতটি প্রদেশ রয়েছে। আমাদের দেশের শাসনকাঠামো বা প্রশাসনিক স্তর নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন- এসব ভাগে বিভক্ত। আর ৬৪ জেলা ৮ বিভাগের আওতাধীন। এতে উন্নয়নের সুষম বণ্টন হয় না বলে মনে করেন অনেকে। অধিকাংশ কার্যক্রম রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৪৪ হাজার ৫০০ লোকের বসবাস।

প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক রবিউল ইসলাম। বিভিন্ন দেশের সংবিধান অধ্যয়ন এবং উচ্চতর ডিগ্রি ও গবেষণার সূত্রে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বিশদ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করেন বাংলাদেশ একটা ছোট স্টেট (রাষ্ট্র) আর ভারত একটা বড় স্টেট (রাষ্ট্র)। ছোট স্টেটে ফেডারেল স্ট্রাকচার থাকতে পারে না। এটা একটা প্রাথমিক ধারণা। আসলে সুইজারল্যান্ডের মতো ছোট দেশ, যেখানে লোকসংখ্যা অল্প, সেখানেও ভাগ (ক্যানটন) আছে। একটা রাষ্ট্র মানুষকে শাসন করে, তার ভূমিকে নয়। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। ফেডারেল স্ট্রাকচারে ভাগ না করলে কখনো সুশাসন দেওয়া যাবে না। আজকে না করলেও আগামী ২০ বছর পরে হলেও এটা করতে হবে। এটা লাগবেই।’ 

তিনি বলেন, ‘ফেডারেল স্ট্রাকচার এক জিনিস, বিকেন্দ্রীকরণ আরেক জিনিস। বর্তমান কাঠামোতে দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ আছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আমরা ২০০০ সাল থেকে দেখে আসছি যারা ক্ষমতায় যায় তারা একচেটিয়া যায়। এর অন্যতম কারণ পলিটিক্যাল ফেয়ার কম্পিটিশন হয় না। যদি ফেডারেল গভর্নমেন্ট থাকত, তাহলে নর্থ বেঙ্গলের জন্য আলাদা অনেক স্ট্রং পলিটিক্যাল পার্টি হতো। সেই পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে সেন্ট্রাল পার্টির ফাইট করে জিততে হতো। এটা সেন্ট্রাল লেভেলে পার্টিকে স্ট্রং করত, জবাবদিহির জায়গা বাড়ত। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করলে জবাবদিহি তৈরি হতো। দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ করলে জবাবদিহির জায়গা থাকে না। সেন্ট্রালের (কেন্দ্রের) হাতে সব ক্ষমতা থাকলে সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না।’

দেশের বর্তমান ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বণ্টন হয় না উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন জাকের পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও অর্থনীতির অধ্যাপক সায়েম আমির ফয়সাল। ২০২২ সালের ১৪ জুন এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘দেশের সব মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমানভাবে নিশ্চিত করতে হলে প্রাদেশিক সরকার চালু করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা গত অর্থবছরে বরাদ্দ হলেও সমানভাবে কি দেশের ৬৪ জেলায় বণ্টন হয়েছে? আমার জেলা ফরিদপুরে ব্যয় করা হয়নি, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। ফরিদপুরে সমবণ্টন হলে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হতো, তাহলে ১০-১৫টি আইসিইউ বেড করা যেত, হাসপাতালের মানোন্নয়ন করা যেত। কিন্তু সেটা হয়নি।’

জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একসময় এ নিয়ে একটা রূপরেখা দিয়েছিলেন। তার দল জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকটি নির্বাচনি ইশতেহারেও প্রদেশ করার কথা বলা হয়েছে। দলের সর্বশেষ ইশতেহারে উত্তরবঙ্গ প্রদেশ, বরেন্দ্র প্রদেশ, জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশ, জাহানাবাদ প্রদেশ, জালালাবাদ প্রদেশ, চন্দ্রদ্বীপ প্রদেশ, ময়নামতি প্রদেশ, চট্টলা প্রদেশের কথা বলা হয়েছে। সরকার কাঠামো হবে দুই স্তরবিশিষ্ট। কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হবে ফেডারেল সরকার। থাকবে ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য। আর প্রদেশ চালাবে প্রাদেশিক সরকার। থাকবে প্রাদেশিক সংসদ সদস্য। প্রতিটি উপজেলা কিংবা থানাকে প্রাদেশিক সরকারের আসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ঢাকা থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সদর দপ্তর প্রাদেশিক রাজধানীতে স্থানান্তর করা হবে বলে ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল। 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। নিজের একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে দুটি করে চারটি প্রদেশ ও বৃহত্তর ঢাকাকে নিয়ে আরেকটি প্রদেশ করা যেতে পারে। কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, সীমান্ত ও সমুদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো থাকবে। বাকি বিষয়গুলোতে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধান থাকলেও প্রদেশগুলো ব্যবস্থাপনায় থাকবে। 

এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তার মতে, বাংলাদেশকে প্রদেশে বিভক্ত করা হলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে। এ জন্য প্রাদেশিক সরকার ও কেন্দ্রের জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন হবে। এসব না করে বর্তমান কাঠামোকে শক্তিশালী করে জনগণকে সুশাসন উপহার দেওয়া যাবে।

অপরিষ্কার টয়লেটে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:২০ এএম
আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৪৭ পিএম
অপরিষ্কার টয়লেটে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
রাজধানীর একটি হাসপাতালের টয়লেট। ছবি: সংগৃহীত

এক হাতে দরজা আর অন্য হাতে নাক চেপে দাঁড়িয়ে আছেন এক নারী। আর বলছেন, ‘মা আমি দাঁড়ানো আছি। তুমি চিন্তা করো না।’ কিছুক্ষণ পরই সংকেত পেয়ে ওই নারী ধরে রাখা দরজা ছেড়ে দেন। ভেতর থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে আসে। মেয়েটিকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ওই নারী বলছিলেন, ‘এটা হাসপাতালের টয়লেট! এত নোংরা। কেন হাসপাতালের টয়লেট এত নোংরা থাকবে? প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখানে আসে। টয়লেটের অবস্থা যদি এমন হয়, তাহলে মানুষজন কোথায় যাবে।’

এ ঘটনা গত ১৮ জানুয়ারির। তখন দুপুর ১২টা ৪০ মিনিট। কথা হয় হেলেনা নামের ওই নারীর সঙ্গে। তিনি রাজধানীর ওয়ারী থেকে চিকিৎসক দেখাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বহির্বিভাগে এসেছেন। মেয়ের টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে বিভিন্ন জায়গায় টয়লেট খুঁজতে থাকেন। একজনের কাছে জানতে পারেন প্রবেশ গেটের দুই পাশে টয়লেট রয়েছে। একটিতে প্রবেশ করতে ৫ টাকা করে দিতে হয়। অন্যটিতে কোনো টাকা লাগে না। এটি প্রবেশ গেট থেকে বের হওয়ার আগে বাম পাশে। মেয়েকে নিয়ে তিনি সেখানে যান। কিন্তু ব্যবহার অনুপযোগী দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হন।

হেলেনা বলেন, ‘এটা কি কোনো মানুষ ব্যবহার করতে পারে? টিস্যু না থাকুক, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা তো থাকবে।’ কথা বলার সময় নারীদের টয়লেট দেখিয়ে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ওটায় গিয়ে দেখে আসেন। বমি চলে আসবে।’

এই টয়লেটের ভবনটির পুরুষ লেখা অংশে দুটি টয়লেট এবং দুটি প্রস্রাবের জায়গা রয়েছে। প্রস্রাবের জায়গা দুটিতে প্রস্রাব জমে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। টয়েলেটের অবস্থা খুবই খারাপ। দরজার ছিটকিনি ভাঙা। নারীদের যে দুটি টয়লেট তার ভেতরে যাওয়ার পরিবেশ নেই। ওপরেই জমে আছে মলমূত্র। বাধ্য হয়ে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই পুরুষ লেখা টয়লেট দুটিতে প্রবেশ করেন।

প্রতিদিন ঢামেকের বহির্বিভাগ এবং জরুরি বিভাগে অন্তত পাঁচ হাজার রোগী আসেন। রোগীর সঙ্গে অন্তত এক-দুজন স্বজন থাকেন। সেই অনুযায়ী নেই পর্যাপ্ত টয়লেট। নেই হাত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা। তাই প্রতিদিন স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা মানুষদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। ঢামেকের ইনডোরে গড়ে ৪ হাজার ২০০ জন করে রোগী ভর্তি থাকেন। তাদের সঙ্গেও এক-দুজন স্বজন থাকেন।

শুধু বহির্বিভাগেই নয়, ইনডোরের অধিকাংশ ওয়ার্ডের টয়লেটগুলো নোংরা। টয়লেটের ভেতর সাবান থাকা তো দূরের কথা, নেই সাবান রাখার ব্যবস্থাও। 

শুধু ঢামেক নয়; ঢাকার সব সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও ওয়ার্ডের টয়লেটগুলোর বেশির ভাগের অবস্থাই এমন। তবে এদিকে কর্তৃপক্ষের নজর খুবই কম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অকার্যকর এবং অপরিষ্কার টয়লেটের ব্যাপকতা হাসপাতালের স্যানিটেশন চ্যালেঞ্জকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সাবান বা হাত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা না থাকায় টয়লেট ব্যবহারের পর তিনি যেখানে যা ধরছেন, তাতেই জীবাণু লাগছে। আর সেখানে যখন অন্য কেউ স্পর্শ করছেন, সেই জীবাণু তারও হাতে লাগছে। এভাবে একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে যাচ্ছে রোগ-জীবাণু। অপর্যাপ্ত এবং অপরিষ্কার টয়লেটের কারণে অনেকেই প্রস্রাব আটকে রাখেন। আর এ কারণে অনেকের কিডনি জটিলতা দেখা দিচ্ছে।

কোভিড-পরবর্তী ঢাকার ১৩টি হাসপাতালের টয়লেট পরিস্থিতি জানতে একটি সমীক্ষা চালায় আইসিডিডিআরবি। এতে অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সহযোগিতা করে, যা গত বছর প্লাস ওয়ান জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ২ হাজার ৮৭৫টি টয়লেটের মধ্যে ২ হাজার ৪৫৯টি টয়লেট পরিদর্শন করে গবেষক দল। রোগীর টয়লেটের সংলগ্ন হাত ধোয়ার বেসিনের মাত্র ২৬ শতাংশে হাত ধোয়ার জন্য একসঙ্গে পানি এবং সাবান পাওয়া যায়। বাকি ৭৪ শতাংশে একসঙ্গে সাবান-পানি পাওয়া যায়নি। টয়লেটগুলোর একটিতেও রোগীর ব্যবহারের জন্য টয়লেট পেপার সরবরাহ করেনি। ২ হাজার ৮৭৫টি টয়লেটের মধ্যে ৪১৬টি অর্থাৎ ১৪ শতাংশ টয়লেট পর্যবেক্ষণ করতে পারেনি গবেষক দল। কারণ এর ১০ শতাংশে তালাবদ্ধ থাকা বা প্রবেশের অনুমতি না পাওয়া।

সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, সরকারি হাসপাতালের টয়লেটের ৬৮ শতাংশ এবং বেসরকারি হাসপাতালের ৯২ শতাংশ টয়লেট কার্যকর ছিল। সরকারি হাসপাতালে মাত্র ৩৩ শতাংশ টয়লেট পরিষ্কার ছিল। বাকি ৬৭ শতাংশ টয়লেট ছিল অপরিষ্কার। বেসরকারি হাসপাতালে ৫৬ শতাংশ টয়লেট পরিষ্কার ছিল।

আইসিডিডিআরবির সহযোগী বিজ্ঞানী এবং গবেষণার প্রধান তদন্তকারী ডা. মো. নুহু আমিন বলেন, ‘হাসপাতালের ইনডোরে রোগী অনুপাতে রেশিও ঠিক থাকলেও বহির্বিভাগে রোগী অনুযায়ী টয়লেট খুব কম পাওয়া যায়। স্ট্যান্ডার্ড হচ্ছে ৩০ জনের ব্যবহারের জন্য একটি টয়লেট থাকবে। কিন্তু বাস্তবে বহির্বিভাগে গড়ে ২১৪ জনের ব্যবহারের জন্য মাত্র একটি, কোনো এক প্রতিষ্ঠানে ৯০০ জনের জন্য একটি টয়লেট পাওয়া গেছে। আর বেসরকারি হাসপাতালে ৯৪ জনের জন্য একটি টয়লেট। মাত্র ৩ শতাংশ টয়লেটে স্যানিটারি প্যাড ফেলার বিন ছিল এবং ১ শতাংশেরও কম টয়লেটে প্রতিবন্ধীদের জন্য সুবিধা ছিল।’

ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, অপরিচ্ছন্ন টয়লেট উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে, কলেরা ও টাইফয়েডের মতো রোগ ছড়াতে পারে। তবু টয়লেটের দিকে কর্তৃপক্ষের নজর কম। নজর কম থাকার কারণও জানতে পেরেছে আইসিডিডিআরবির গবেষক দল।

যেসব হাসপাতালের টয়লেট অপরিষ্কার ছিল, সেসব হাসপাতালের পরিচালকদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তারা বলেছেন, শীর্ষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয় রোগীর চিকিৎসায়, যন্ত্রপাতি স্থাপন এবং সেগুলো নষ্ট হলে রক্ষণাবেক্ষণে। চিকিৎসায় অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যু হলে জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চাকরি চলে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। কিন্তু টয়লেটের বিষয়ে কেউ কখনো কিছু জিজ্ঞেস করে না। সে জন্য এই বিষয়ে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তারা বলেছেন, ‘এটার গুরুত্ব বুঝলেও বিবেচনা করেন না। গুরুত্ব দেন সেবা প্রদানের বিভিন্ন বিষয়ে।’

গত ১৯ জানুয়ারি ঢামেকের বহির্বিভাগের নিচতলায় সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে রোগী গিজগিজ করছে। যেন তিল ধারণেরও জায়গা নেই। নিচতলায় রয়েছে সার্জারি বিভাগ, মেডিসিন বিভাগ, স্ত্রীরোগ বিভাগ। কোথাও রোগীদের ব্যবহারের জন্য টয়লেট নেই। এমনকি গর্ভকালীন সেবা ও প্রসব-পরবর্তী সেবা বিভাগে ভেতরের টয়লেটেও তালাবদ্ধ। দ্বিতীয় তলায় রয়েছে নাক-কান-গলা, মানসিক রোগ, ইউরোলজি, চক্ষু এবং যৌন ও চর্ম বিভাগ। ঢামেকের যৌন ও চর্ম বিভাগে দুটি টয়লেট থাকলেও তা শুধু এমও, এইচএমও এবং মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ব্যবহারের জন্য। অর্থাৎ এখানে রোগী আর সেবা প্রদানকারীদের মধ্যে বৈষম্য দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে ডা. মো. নুহু আমিন বলেন, এটা কমিয়ে আনা সম্ভব। একজন সহযোগী অধ্যাপকের জন্য একটি টয়লেট রাখার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। শিক্ষকদের কয়েকজনের জন্য একটি টয়লেট রাখা যেতে পারে। 

একটি সূত্র জানায়, যেকোনো প্রতিষ্ঠানেই ভর্তি রোগীদের জন্য যতসংখ্যক টয়লেট থাকে, হাসপাতালের স্বল্পসংখ্যক চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্সসহ স্টাফদের জন্য সেই সংখ্যক টয়লেট থাকে। এই বৈষম্য কমিয়ে আনতে পারলে রোগীদের দুর্ভোগ কমবে।

ঢামেকের নাক-কান-গলা বিভাগে দুটি টয়লেট থাকলেও একটি তালাবদ্ধ। অন্যটি রোগীদের ব্যবহারের জন্য। তার ভেতরে সাবান থাকা তো দূরের কথা, সাবান রাখার জায়গাও নেই। এই টয়লেটটি নারী-পুরুষ সবাই ব্যবহার করেন। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রস্রাব ও মলত্যাগের সময় বেশি স্থান, গোপনীয়তা এবং সময়ের প্রয়োজনের কারণে নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট  থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে তাদের মাসিকের কথা বিবেচনা করে।

আইসিডিডিআরবির গবেষণায় সরকারি ও বেসরকারি উভয় হাসপাতালেই পুরুষ ও মহিলা উভয় রোগীদের জন্য উল্লেখযোগ্যসংখ্যক টয়লেট ছিল। বিশেষত সরকারি হাসপাতালে ৭৯ শতাংশ টয়লেট মিশ্র-লিঙ্গের, ১১ শতাংশ পুরুষদের এবং ১০ শতাংশ নারীদের জন্য।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, এখানে ৭০০-এর মতো টয়লেট আছে। এত টয়লেট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য যেসংখ্যক জনবল প্রয়োজন তা নেই। যারা আছেন তারাও আন্তরিক না। যে কারণে কর্তৃপক্ষ যেভাবে চাচ্ছে, টয়লেট থেকে শুরু করে ওয়ার্ডগুলো সেভাবে পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব হচ্ছে না। 

তিনি বলেন, ‘হাত জীবাণুমুক্ত করার উপকরণ টয়লেটে রাখা যায় না। চুরি হয়ে যায়। বালিশ, চাদর, ট্রলি পর্যন্ত চুরি হয়ে যায়। রোগীদের অনেকেই সচেতন নন। তারাও কমোডে টিস্যুসহ বিভিন্ন জিনিস ফেলে রাখেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য পর্যাপ্ত দক্ষ ও আন্তরিক জনবল প্রয়োজন।’ 

বিশিষ্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘হাসপাতালের টয়লেটে যদি সাবান না থাকে, রোগীরা যেন নিজের জীবনের স্বার্থে নিজ দায়িত্বেই হাত জীবাণুমুক্ত করেন। সে জন্য বাইরে বের হলে সঙ্গে সাবান বা স্যানিটাইজার রাখার পরামর্শ দেন তিনি। হাসপাতালে নেই বলে করবেন না, তা মোটেও ঠিক হবে না। কারণ আপনার সুরক্ষা নিয়ে সবার আগে আপনাকেই ভাবতে হবে।’

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাবান চুরি হয়ে যায় বলে অভিযোগ তুলে থাকে। সে ক্ষেত্রে স্থায়ী ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কেউ সাবান নিয়ে যেতে না পারে। দেয়ালে স্থায়ীভাবে লিকুইড সাবান রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। চাপ দিয়ে লিকুইড নিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবে। এটা সবাই নাও জানতে পারে। দেয়ালে নির্দেশিকা লিখে লাগিয়ে রাখতে হবে। চুরি হয়ে যায় এই অজুহাতে টয়লেটে সাবান রাখা বন্ধ থাকবে, তা হতে পারে না।’

হাসপাতালের টয়লেট অপরিচ্ছন্ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পর্যাপ্ত ক্লিনার নিয়োগ দিতে হবে। সারা দিন একজন ক্লিনার দিয়ে পরিষ্কার করালে হবে না। হাসপাতালে প্রতি ২ ঘণ্টা পরপর পরিষ্কার করতে হয়। বিমানবন্দরের টয়লেট যদি সব সময় পরিষ্কার রাখতে পারি, তাহলে হাসপাতালের মতো স্পর্শকাতর স্থান কেন পারব না।’ 

আইসিডিডিআরবির সহযোগী বিজ্ঞানী এবং গবেষণার প্রধান তদন্তকারী ডা. মো. নুহু আমিন বলেন, পর্যাপ্তসংখ্যক স্যানিটেশনকর্মী নিশ্চিত করে এবং এইচসিএফগুলোয় স্যানিটেশন সুবিধাগুলো উন্নত করার জন্য টয়লেট হাইজিন এবং আইপিসি সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। বাংলাদেশের হাসপাতাল এবং এলএমআইসিতে টয়লেটের প্রাপ্যতা, কার্যকারিতা এবং পরিচ্ছন্নতা আরও বিস্তৃতভাবে উন্নত করার জন্য মাল্টিসেক্টরাল পন্থা এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নের পরিকল্পনা জরুরিভাবে প্রয়োজন।