শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ বিভিন্ন অপরাধে চাকরি হারাতে পারেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অন্তত ৬০ জন। এদের মধ্যে রয়েছেন চিকিৎসক, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী। আপাতত সাময়িক বরখাস্ত করা হবে ১৫১ জনকে।
বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে ৯৪তম সিন্ডিকেট সভায় এই সিদ্ধান্ত হয় বলে একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এ ছাড়া এই সভায় আরেকটি বিতর্কিত বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে সিন্ডিকেট। তা হলো ফেল করা ১৩ জনকে রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনা পাওয়া সাপেক্ষে ভর্তির সুযোগ দেওয়া।
সূত্র জানিয়েছে, শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন শাস্তি পেতে হতে পারে আরও বেশকিছু চিকিৎসক, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীকে। তবে আপাতত সহিংসতার ঘটনায় কোনো মামলা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। যদিও সহিংসতায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণাসহ মামলা করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল বিএসএমএমইউর বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ।
সূত্রটি জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় শ শিক্ষক, চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এই দেড় শ জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। পরে তাদের অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তির সিদ্ধান্ত নেবে বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা কমিটি।
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট বিএসএমএমইউতে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। তাতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিক্ষক ও চিকিৎসক অংশ নেন। আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও ভস্মীভূত করা হয়। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে মামলা করার দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট মামলার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসেনি। তবে এই সিন্ডিকেট সভায় চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাতে ৫০ থেকে ৬০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হতে পারে। এ ছাড়া আরেকটি অংশ আছে যাদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হতে পারে।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে চার ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৫ জনের বিরুদ্ধে ওই দিনের হামলায় একজনের নিহতের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। ২২ জন হেলমেট মাথায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। তারা সবাই শিক্ষক ও চিকিৎসক। ৮১ জন কর্মচারী মিছিলসহ নানা ধরনের বিশৃঙ্খলায় জড়িত ছিলেন। ২০ জন চিহ্নিত হয়েছেন মাস্টারমাইন্ড হিসেবে। তারা পেছনে থেকে আন্দোলন নস্যাতের পরিকল্পনা করেছেন।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, অপরাধীরা সবাই আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এই ১৫১ জনের মধ্যে এক অংশের স্থায়ীভাবে চাকরি চলে যাবে, এক অংশের বিরুদ্ধে মামলা হবে, এক অংশের পদাবোনতি হবে ও আরেক অংশের সময় মেয়াদি শাস্তি হবে।
গত ৩১ অক্টোবর বিএসএমএমইউর শহিদ ডা. মিলন হলে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষক-চিকিৎসক, কর্মকর্তা-নার্স ও কর্মচারী ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও বিএসএমএমইউর অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার-১ ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন টিটো ১০টি দাবি তুলে ধরেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি দাবি ছিল, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসাসেবা দিতে অস্বীকার ও বাধা প্রদানকারী বিএসএমএমইউর চিকিৎসকদের বিএমডিসি নিবন্ধন বাতিল করার। আরেকটি ছিল, গত ৪ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সহিংসতায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণাসহ মামলা দায়ের করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ডা. মো. দেলোয়ার হোসেন টিটো বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সাবেক উপাচার্যের একান্ত সচিব এবং সাবেক প্রক্টরের নেতৃত্বে একদল আওয়ামীপন্থি শিক্ষক, চিকিৎসক, কর্মকর্তা, নার্স ও কর্মচারী পরিকল্পিতভাবে শাহবাগে আন্দোলনকারীদের আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্রসহ আক্রমণ করে বহু ছাত্র-জনতাকে হতাহত করে। আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে কোটি টাকার সরকারি সম্পদ ধ্বংস ও ভস্মীভূত করে। এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে ক্যাম্পাসে অবাঞ্চিত ঘোষণাসহ মামলা দায়ের করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ফেল করা ১৩ শিক্ষার্থী চায় ভর্তির সুযোগ
এদিকে সিন্ডিকেট সভা চলাকালে ঘটে এক ভিন্ন ঘটনা। এমএস/এমডি কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারা ১৩ জন চিকিৎসক ভর্তির দাবিতে উপাচার্যসহ সিন্ডিকেট সদস্যদের অবরুদ্ধ করেন।
বিএসএমএমইউর একটি সূত্র জানায়, এই ১৩ জন ড্যাবের সাবেক আহ্বায়ক ও বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারের অনুসারী। তারা হট্টগোল শুরু করলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হাসানের অনুসারীরা এসে অবস্থান নিলে তারা চলে যায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, এমএস/এমডি কোর্সের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হতে পারলেও ভর্তির সুযোগ চান ১৩ জন চিকিৎসক। তারা এই দাবি বেশ কয়েকদিন ধরে করে আসলেও বৃহস্পতিবার সিন্ডিকেট সভা চলাকালে শুরু করেন হট্টগোল। উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলমসহ সিন্ডিকেট সদস্যদের অবরুদ্ধ করেন। এরপর তাদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, রাষ্ট্রপতির প্রমার্জনা পাওয়া সাপেক্ষে তাদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এমএস/এমডি কোর্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ কোর্সে ফেল করার পর ভর্তির নজির নেই। কিভাবে তারা এই সুযোগ চান, লজ্জাও করে না! এটা চিকিৎসকদের জন্য লজ্জার। এদের ভর্তি করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করা হয়েছে। নাম্বার পর্যন্ত কমানো হয়েছে। তারপরও তারা ফেল করেছেন। তবুও তারা নাছোরবান্দা। প্রতিদিনই ভিসি কার্যালয়ে এসে বসে থাকে। তাদের বোঝালেও বোঝে না। তাদের দাবি, তারা বঞ্চিত, তাই তাদের সুযোগ দিতে হবে।’