প্রকল্পের অনেক কাজ অসমাপ্ত রেখে ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে গাজীপুর পর্যন্ত অংশে ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটারের বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প আংশিক চালু করে দিয়েছে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেড। আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে এই করিডরে বিআরটিসির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসি বাস যাত্রীসেবা দিতে শুরু করবে। ইতোমধ্যে গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল শুরু করেছে এই করিডরে।
রাজধানীবাসীর জন্য একটি সুলভ ও নিরাপদ গণপরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১১ সালে রিভাইজড স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান-২০১৬ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ওই বছরই এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রকল্পের প্রাথমিক সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করে। পরে ২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর একনেকের সভায় বিআরটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তবে নির্মাণ-জটিলতায় টঙ্গী থেকে গাজীপুর অংশে এই প্রকল্প সড়ক-মহাসড়ক বিভাগের গলার কাঁটা হয়ে গেছে।
বিআরটি প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ)। প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। শুরু থেকেই প্রকল্পের কাজে গতি ছিল না। চলতি ডিসেম্বরে উদ্বোধনের কথা থাকলেও সপ্তম দফায় পিছিয়ে গেছে এই প্রকল্প। প্রকল্পের সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয় ৪ হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। দফায় দফায় পেছানোয় গত সাত বছরে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৮ কোটি ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।
গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্টের ব্যবস্থাপক-১ আব্দুর রহমান নাহিয়ান গত মে মাসে খবরের কাগজকে জানিয়েছিলেন, এই বছরের ডিসেম্বরে পুরোপুরি খুলে দেওয়া হবে বিআরটি করিডর। কিন্তু প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রকল্প এখনই চালু হচ্ছে না পুরোদমে। এই করিডরে দুটি ফ্লাইওভার ও সড়ক অবকাঠামো নির্মাণের কাজ এ বছর শেষ হচ্ছে না।
ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ এখনো চলমান রয়েছে। আরও কিছুদিন সময় লাগবে।’
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘৫ আগস্টের আগে ও পরে বিআরটি প্রকল্পের কিছু জিনিস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবার ঠিকাদারের সঙ্গেও কিছু ঝামেলা আছে। আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে এই খাতে। এগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি। আসলে সড়ক খাতে এত বড় বিনিয়োগে এখন মানুষ কিছুই পাচ্ছে না।’
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘এখন যাত্রীসেবার কথা বিবেচনা করে এই করিডরে বিআরটিসি বাস চলাচল করবে। ব্যক্তিগত গাড়িও চলাচল করতে পারবে।’
তবে বিআরটি প্রকল্প নিয়ে টঙ্গী, বোর্ডবাজার এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগের শেষ নেই। তারা বলছেন, ফুটপাত বন্ধ করে বিআরটি স্টেশনের স্থাপনা নির্মাণ, বিশেষ লেনের দুই পাশে বিভাজক না রাখায় চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। বিস্তর অভিযোগের মুখে এ বছর ঈদুল ফিতরের আগে প্রকল্পের ৯টি ফ্লাইওভারের ৭টি খুলে দেয় কর্তৃপক্ষ। এতে যানজট কিছুটা নিরসন হলেও ব্রিজের নিচের অংশ বেহাল থেকেই গেছে।
টঙ্গী বাজার, ফায়ার সার্ভিস গেট, টঙ্গী স্টেশন রোড, চেরাগ আলী, বোর্ডবাজার, বাইপাস ও চৌরাস্তা এলাকার বিআরটি ব্রিজের নিচে অবৈধভাবে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট লেগেই থাকছে। মহাসড়কের তিন লেনের রাস্তা কমে দুই লেনে দাঁড়িয়েছে। বিআরটি প্রকল্পে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে শিববাড়ী মোড় পর্যন্ত সাত কিলোমিটার সড়কের কোথাও এক ইঞ্চিও ফুটপাত রাখা হয়নি। দীর্ঘ পথে কোথাও নেই ইউটার্ন। সমস্যা সমাধানে সড়ক মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। তবে গত আট মাসেও কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানান প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা।
বিশেষায়িত বাসসেবা নিয়ে নানা জটিলতা
প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফ্রান্সের ঋণ সহায়তায় বিআরটি প্রকল্পের জন্য ১৩৭টি বাস কেনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে বাস কেনার এই প্রক্রিয়া গত দুই বছরেও শেষ হয়নি। একবার দরপত্র আহ্বান করা হলেও সেটি বাতিল হয়।
জানা যায়, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক সড়ক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী ১৩৭টি বাস কেনার জন্য পছন্দের প্রতিষ্ঠান দিয়ে দরপত্র আহ্বান করেছিলেন। সেই দরপত্রের কারসাজি অভ্যন্তরীণ অডিটে ধরা পড়লে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান বাদ পড়ে। এরপর ‘কার্যকর প্রতিযোগিতা’ না হওয়ার কারণ দেখিয়ে দরপত্র বাতিল করা হয়। পরে নতুন করে দরপত্র ডাকা হয়, যেখানে প্রথমবার ছয়টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিলেও দ্বিতীয় দফায় মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে।
সেখানেই জটিলতার শেষ হয়নি। ২০২৩ সালের ১৮ এপ্রিল মূল্যায়ন কমিটি চারটি প্রতিষ্ঠানকে বাছাই করে। চীনের হাইগার বাস কোম্পানি লিমিটেডকে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে সুপারিশ করা হয়। তবে একই ব্যবসায়ী গ্রুপের আরও একটি প্রতিষ্ঠানও একই দরপত্রে অংশ নেয়। এটি বেআইনি হওয়ায় ওই দুই প্রতিষ্ঠানকেই অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এরপর নতুন করে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়।
মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘বাস এখনো কেনা হয়নি। কারণ দরপত্রের এখনো নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (এনওএ) কার্যাদেশ পাঠানো হয়নি। কার্যাদেশ পাঠানো হলে এরপর বাস আসবে। কার্যাদেশ পাঠানোর পাঁচ থেকে ছয় মাস পর বাস আসতে পারে। এবারের দরপত্রে অংশ নিয়েছে দুটি ভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে দুটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক মূল্যায়ন চলমান রয়েছে। মূল্যায়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানকে দরপত্র কার্যাদেশ দেওয়া হবে।’
বাস কেনা নিয়ে জটিলতা থাকায় আপাতত বিআরটিসি বাস দিয়ে বিআরটি রুট চালু করা হয়েছে। যতদিন বিশেষায়িত বাস আসবে না, ততদিন বিআরটিসির বাস চলবে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে বিআরটিসির ১০টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস গাজীপুরের শিববাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত চলবে। বিআরটি রুট ব্যবহার করে এই বাসটি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে চলাচল করবে। শিববাড়ী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত রুটের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪০ টাকা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘শুরুতে আর্টিকুলেটেড বাস চলার কথা ছিল বিআরটি করিডরে। এই বাসগুলো ১৪০ জন করে যাত্রী ধারণ করতে পারে। এখন বিশেষায়িত বাসসেবা চালুর বদলে বিআরটিসির বাস নামানো হয়েছে। এতে করে আসলে বোঝা যাবে না বিআরটি করিডর কতসংখ্যক যাত্রীকে পরিবহনসেবা দিতে পারে।’
সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘বিশেষায়িত বাস চলাচলের জন্য একটি সফটওয়্যার লাগবে। সেটি চালু করতে সময় লাগবে কিছুটা।’