ঢাকা ৫ মাঘ ১৪৩১, রোববার, ১৯ জানুয়ারি ২০২৫

ডনের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া দেলো-মোজো

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২০ পিএম
আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:২২ পিএম
ডনের প্রশ্রয়ে বেপরোয়া দেলো-মোজো
মোজাহার হোসেন মোজো ও দেলোয়ার হোসেন দেলো

খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জেড এ মাহমুদ ডন। শহরের দোলখোলা মোড়-বানিয়াখামার-ইসলামপুর-রায়পাড়া এলাকায় তার কথাই শেষ কথা! 

অপরাধজগতের কথিত গডফাদার ডনের সব অপকর্মের দোসর ছিল দোলখোলা এলাকার দুই ভাই দেলোয়ার হোসেন দেলো ও মোজাহার হোসেন মোজো। একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী ও কিশোর গ্যাং রয়েছে দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। এসব সন্ত্রাসীর কাছে রয়েছে অবৈধ অস্ত্র। বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে গেলে দেলো-মোজোর নেতৃত্বে চলত মাদক ব্যবসা। ডনের সব অপকর্মের দোসর হিসেবে ‘ছায়া শাসক’ হয়ে ওঠেন তারা। 

খুলনার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় দুই ভাই ভাঙারির ব্যবসা করতেন। কখনো বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ভারতীয় শাড়ি বিক্রি করেছেন। তাদের বাবা আবুল হাসেম নৈশপ্রহরী ছিলেন ও বোনেরা পরের বাড়িতে কাজ করতেন। ডনের সঙ্গে সখ্য গড়ে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন দুই ভাই। এর পরই মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসীদের সিন্ডিকেট গড়ে তোলা, ভূমি দখল, মাছ ফ্যাক্টরি দখল, বিভিন্ন খাতে চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এর মাধ্যমেই গড়ে তোলেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়। 

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের সঙ্গে ডন শাসনের অবসান হয়। ওই দিন খুলনার নিরালা আবাসিক এলাকা থেকে ডনকে নিয়ে পালিয়ে যান দেলো। বর্তমানে তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাড়িগুলোতে রয়েছে দিনরাত সতর্ক প্রহরা। ক্যাডার বাহিনীর সদস্যরা ধরা না পড়ায় এখনো মানুষ দেলো-মোজোর অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পান। গত ১২ নভেম্বর এই অপরাধীদের গ্রেপ্তারের জন্য পূর্ব বানিয়াখামারে একটি বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। কিন্তু সেখানে তাদের পাওয়া যায়নি।

মেট্রোপলিটন পুলিশে প্রায় দুই বছর কর্মরত ছিলেন, এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, খুলনার মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী বাহিনী, জমি দখল, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করত দেলো-মোজো চক্র। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে নিজ দলের নেতা-কর্মীকেও খুনের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ২০২২ সালে মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান সাগরের মৃত্যুর সঙ্গেও দেলো জড়িত বলে প্রচার আছে। গত ৮ জুলাই ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আলামিনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দেলোকে আসামি করা হয়েছে। 

এ ছাড়া ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মিছিলে প্রকাশ্যে শটগান দিয়ে গুলি করেছেন দেলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুবলীগের একজন সিনিয়র নেতা জানান, এলাকায় ভয়ে আতঙ্কে তাদের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলত না। দোলখোলা মোড়ে দেলো রাত হলেই বাড়িতে সন্ত্রাসী ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ নেতাদের নিয়ে মদের আসর বসাতেন। এই বাড়িটি সন্ত্রাসীদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাও এখানে মদ্যপানে বিভোর থাকতেন। ৫ আগস্টের পর বিক্ষুব্ধ লোকজন দেলোর বাড়ি ভাঙচুর করেন। এরপরই বিএনপি নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন সুকৌশলী দেলো।

বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি: ডনের মাধ্যমেই দেলোয়ারের পরিচয় হয় শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই সাবেক এমপি শেখ জুয়েল ও শেখ সোহেলের সঙ্গে। তাদের আশীর্বাদে মাছ বিক্রি থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন দেলোয়ার। তার রয়েছে মাছের কোম্পানি, পণ্যবাহী জাহাজ, একাধিক বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ অঢেল সম্পত্তি। জানা যায়, খুলনা শহরে দেলোর বিলাসবহুল বাড়ি রয়েছে ১০-১২টি। রায়পাড়া রোডের ইসলামপুর মসজিদের পাশে একটি ৫ তলা, নবারূণ সংসদের কাছে একটি ৬ তলা, রাজ্জাকের গলির মধ্যে একটি ৬ তলা, একটি ৪ তলা, ২টি দোতলা ও ৩টি জমি, রায়পাড়া মেইন রোডের মেট্রো ক্লিনিকের সামনে এক বিঘার ওপরে সিদ্দিক মঞ্জিলের জমি, মুসলমান পাড়া মেইন রোডের খোকা মোল্লা লেনে ৩ কাঠার একটি জমি ও আব্দুল গনি বিদ্যালয় লেনে ৫ কাঠার একটি জমি রয়েছে।

এ ছাড়া ডুমুরিয়া মৌজায় নামে-বেনামে ৪০ থেকে ৫০ বিঘা জমি রয়েছে। যেখানে গড়ে তোলা হয়েছে বাগানবাড়ি। সেখানে মাঝেমধ্যে আয়োজন করা হয় পিকনিকের নামে মাদক সেবন ও জলসা। দেলোর ভাই মোজোর বাড়ি, হ্যানিমেন ফার্মেসি ভবনে দোকান রয়েছে। তাদের ৭-৮টি গাড়ি রয়েছে, যা দিয়ে মাঝেমধ্যে শহরে মহড়া দিত। 

দেলো-মোজোর ‘অবিশ্বাস্য’ উত্থান: ১৯৭৪ সালে কাজের সন্ধানে গোপালগঞ্জ থেকে খুলনায় চলে আসেন দেলো-মোজোর বাবা আবুল হাসেম। দিনে রিকশা চালাতেন ও রাতে নৈশপ্রহরীর কাজ করতেন। ছেলেমেয়েসহ ৯ জনের সংসারে অভাব-অনটনের মধ্যে তার দুই বোন পরের বাড়িতে কাজ নেন। একসময় বড়বাজারে কাপড়ের দোকানে সামান্য বেতনে কাজ শুরু করেন দেলো। পরে তিনি ভাঙারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেখান থেকে নতুন বাজারে মাছ বিক্রি করতেন। পরবর্তী সময়ে মাছ কোম্পানির গ্রেডারের কাজ পান। গ্রেডার থেকে তিনি সাতক্ষীরা কালীগঞ্জ এলাকায় রোজেলা ফিশের মালিক বনে যান। জানা যায়, ২০১০ সালে চার বন্ধুর যৌথ মালিকানায় মাছ কোম্পানিটি চালু করেন। পরবর্তী সময়ে শেখ পরিবারের দাপটে তিন বন্ধুকে হটিয়ে নিজেই মালিক বনে যান। অভিযোগ রয়েছে, মাছ ব্যবসার অন্তরালে চলত তার মাদকের ব্যবসা। কক্সবাজার থেকে মাছের আড়ালে আসত ইয়াবা। আর সেই ইয়াবা নগরীতে বিক্রি করতেন তার ভাই মোজাহার হোসেন মোজো। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করতেন প্রভাবশালী নেতারা। অবৈধ আয়ের একটি অংশ পেতেন প্রশাসন থেকে শুরু করে দলের শীর্ষ নেতারা। 

অনুগত ক্যাডার বাহিনী, মূর্তিমান আতঙ্ক: খুলনার একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনী ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতেন দেলোয়ার হোসেন দেলো। অল্প সময়ে শেখ বাড়ির ছত্রচ্ছায়ায় তারা হয়ে ওঠেন খুলনায় মূর্তিমান আতঙ্ক। তাদের কাছে মজুত ছিল বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর তাকে খুলনা বসুপাড়ায় মাদ্রাসায় দাফন না দিতে প্রকাশ্যে শটগান ও সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে মাদ্রাসার মূল ফটকে অবস্থান নেন দেলো।

এ ছাড়া ২০২২ সালে মহানগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান সাগরের মৃত্যুর সঙ্গেও দেলো জড়িত আছে জানাজানি হলেও ভয়ে সাগরের পরিবার এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি হয়নি। তবে সাগরকে ওই রাতে ডনের অফিসে ডেকে এনে দেলোর নেতৃত্বে মারধর করার পর একটি রিকশায় তুলে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অনেকে। অপরদিকে আরেক যুবলীগ নেতা আমিন শেখ হত্যা মামলার বাদী শেখ মো. জাহাঙ্গীর জানান, ৮ জুলাই রাত ৯টার দিকে সাবেক কাউন্সিলর ডনের নির্দেশে দেলোসহ কয়েকজন পরিকল্পিতভাবে আল আমিনকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে। তিনি বলেন, আল আমিনের ভাই তৌহিদ থানায় মামলা করতে গেলে ডন তার মুখে পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যায় জড়িত নয়, এমন লোকদের নামে মামলা দিতে নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময় তারা ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ডন ও তার দোসর দেলোসহ ৯ জনের নাম আসামি হিসেবে এজাহারে যুক্ত করার জন্য আদালতে আবেদন করেন। ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে থাকায় এসব অভিযোগের বিষয়ে দোলোয়ার হোসেন দেলো ও তার ভাই মোজাহার হোসেন মোজোর বক্তব্য পাওয়া যায়নি। 

উদ্বোধনের অপেক্ষায় রেলসেতু যমুনা সেতুতে বছরে আয় কমবে কোটি টাকা

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৫১ পিএম
যমুনা সেতুতে বছরে আয় কমবে কোটি টাকা
ছবি : খবরের কাগজ

উদ্বোধনের অপেক্ষায় যমুনা রেলসেতু। তারিখ না হলেও চলতি জানুয়ারি শেষের দিকে বা ফেব্রুয়ারিতে সেতুটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের কথা রয়েছে। ইতোমধ্যে সেতু দিয়ে পরীক্ষামূলক ট্রেন চলাচল উদ্বোধন করা হয়েছে। উদ্বোধন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু দিয়ে আর ট্রেন চলবে না। এতে সেতু কর্তৃপক্ষের আয় কমবে বছরে কোটি টাকা।

যমুনা রেলসেতু প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আল ফাত্তাহ মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি খুব দ্রুত রেল সেতুটি চালু করতে পারব। সেতুটি চালু হলে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর চাপ অনেকটা কমে যাবে।’
 
বর্তমানে উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৩টি জেলার সঙ্গে রাজধানীর ঢাকা ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগের একমাত্র সংযোগস্থল টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতু। সেতুটি ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন উদ্বোধন করা হয়। বর্তমানে সেতুটির ওপর দিয়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ হাজার যানবাহন এবং ৩০-৩৮টি ট্রেন পারাপার হচ্ছে। সেতুর পূর্ব প্রান্ত টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও পশ্চিম প্রান্তে সিরাজগঞ্জের সংযোগস্থল। 

২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুতে ফাটল দেখা দিলে ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ৩০ থেকে ৩৮টি ট্রেন ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে সেতু পারাপার হচ্ছে। সমস্যা সমাধানে সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা একটি রেলসেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।
 
২০২০ সালের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি রেল সেতুর নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২১ সালের মার্চে পিলার নির্মাণের জন্য পাইলিং শুরু হয়। সেতুর ৩০০ মিটার অদূরে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের দীর্ঘতম ৪.৮০ মিটার ‘যমুনা রেলসেতু।’

বঙ্গবন্ধু সেতু সাইট অফিস সূত্রে জানা য়ায়, রেলসেতু উদ্বোধনের পর বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল সংযোগ থাকলেও চলবে না কোনো ট্রেন। এতে করে বঙ্গবন্ধু সেতু কর্তৃপক্ষের বছরে কোটি টাকা আয় কমবে। তবে সেতুতে স্থাপিত রেল লাইন অপসারণ করে যান চলাচলের রাস্তা প্রশস্ত করা হবে।

বঙ্গবন্ধু সেতু সাইট অফিসের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসানুল কবীর পাভেল খবরের কাগজকে বলেন, ‘সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নতুন রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। রেল সেতুটি চালু হলে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। ফলে বছরে সেতু কর্তৃপক্ষের কোটি টাকা আয় কমবে। ট্রেন চলাচল বন্ধ হলে সেতুর ওপর চাপও কম থাকবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে সেতুটির ঢাকা ও উত্তরবঙ্গ লেনের প্রস্থ রয়েছে ৬ মিটার, যেখানে সেতুর প্রস্থ কমপক্ষে ৭.০৩ মিটার থাকা প্রয়োজন। রেল লাইন অপসারণ করা হলে এটি ৮.০৫ মিটার হবে। যান চলাচলে রাস্তা প্রশস্ত (লেন) হবে। সেতু থেকে রেল লাইন অপসারণের জন্য ২০২৩ সালে সেতু মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে।’

নবনির্মিত যমুনা রেলসেতু দিয়ে সম্প্রতি ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার গতিতে একসঙ্গে একজোড়া লোকোমোটিভ ট্রেন পৃথক লাইনে পরীক্ষামূলক চালানো হয়েছে। 

২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নকশা প্রণয়নসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। তবে পরবর্তী সময় এর মেয়াদ ২ বছর বাড়ানোর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা দাঁড়ায়। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ দেশীয় অর্থায়ন এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) ঋণ দিয়েছে বলে জানায় যমুনা রেলসেতু প্রকল্প।

বরিশালে প্রভাবশালীদের বাড়ি পরিত্যক্ত

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩৯ পিএম
আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৪৫ পিএম
বরিশালে প্রভাবশালীদের বাড়ি পরিত্যক্ত
বরিশাল নগরীর কালীবাড়ি রোডে সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাদ সাদিক আবদুল্লাহ ভবন বায়েঁ। ঝালকাঠি শহরের রোনালসে রোডে সাবেক এমপি আমির হোসেন আমুর বাড়ি। ছবি : খবরের কাগজ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের কৃষি ও ভূমিমন্ত্রী ছিলেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত। তিনি সম্পর্কে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফা। বরিশাল মহানগরীর কালীবাড়ি রোডে ও আগৈলঝাড়া উপজেলার সেরল গ্রামে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের দুটি পৈতৃক বাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে সেরলের বাড়িতে অবস্থান করতেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। আর মহানগরীর ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের কালীবাড়ি রোডের সেরনিয়াবাত ভবনে থাকতেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। তিনি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত এ দুই বাড়ি হতে বরিশাল মহানগর ও বরিশাল বিভাগ আওয়ামী লীগের সব কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ হতো।
 
তবে সেরনিয়াবাত ভবনটি গত ৫ আগস্ট ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও বাড়ির মালামাল লুট করেন বিক্ষুব্ধরা। অগ্নিসংযোগের পর বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত। 

অপরদিকে সেরলের বাড়িটির প্রধান ফটকে গত প্রায় ৮ মাস ধরে তালাবদ্ধ রয়েছে। শুধু বরিশালের সেরনিয়াবাত ভবনই নয়। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে অধিকাংশ নেতার বাড়ির প্রধান ফটক এখন তালাবদ্ধ। আবার কোনো কোনো নেতার পোড়াবাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ গত ১৬ বছর ‘ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে পরিচিত ছিল ওই বাড়িগুলো। ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ, চাকরিতে নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্রীড়াঙ্গনসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো এসব বাড়ি থেকে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন এমনকি পেশাজীবী সংগঠনগুলো চলত এসব বাড়ি থেকে দেওয়া নির্দেশনা অনুসারে। 

হাসানাতের বাড়ির প্রধান ফটকে তালা
আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সেরল গ্রামের বাড়িটির কোনো নাম নেই। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে স্থানীয়দের কাছে বাড়িটি ‘দরবার শরীফ’ হিসেবে পরিচিত ছিল।

স্থানীয়রা জানান, গত ১৬ বছর ধরে হাসানাতের বাড়িটি বরিশালের ‘ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে পরিচিত ছিল। ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ, চাকরিতে নিয়োগ ও বদলি, ব্যবসা-বাণিজ্যনসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ হতো এই বাড়ি থেকে। আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলো গঠন হতো তার নির্দেশে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ জেলা-উপজেলার আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন এমনকি পেশাজীবী সংগঠনগুলো চলতো এই বাড়ির নির্দেশনায়। এ ছাড়া সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বরিশালে বদলি হয়ে এসে হাজিরা দিতেন হাসানাতের বাড়িতে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত উপজেলা নির্বাচনের পর থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি হাসানাত আবদুল্লাহ এই বাড়ি ত্যাগ করেন। সে থেকে বাড়ির প্রধান ফটকে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। 

পোড়াবাড়ি হিসেবে পরিচিত সেরনিয়াবাত ভবন
কালী রোডের বাড়িতে থাকতেন আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বড় ছেলে বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ ও পরিবারের সদস্যরা। গত বছরের ৫ আগস্ট বিকেলের দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা এ বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সেই থেকে বাড়িটি পোড়াবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সেরনিয়াবাত ভবনের সমানের দোকানিরা জানান, ৫ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত এ বাসায় সাদিক আবদুল্লাহর পরিবারের সদস্যসহ শতাধিক নেতা অবস্থান করছিলেন। বিক্ষুব্ধ জনতা বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পালিয়ে যান। ওই সময় পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান সাবেক মেয়র সাদিক ও তার পরিবারের সদস্যরা। তবে ওই রাতে সেরনিয়াবাত ভবনের দ্বিতীয় তলা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি গাজি নঈমুল ইসলাম লিটুসহ তিনজনের অগ্নিদগ্ধ লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। 

স্থানীয়রা বলেন, এখান থেকে মহানগরসহ জেলার ১০ উপজেলার রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হতো। সে সময় সাধারণ মানুষ বাড়ির গেটেও ঢুকতে পারত না। অথচ এটি এখন ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। 

ঝালকাঠিতে আমুর বাড়ির সামানে ব্যানার-পোস্টার
ঝালকাঠিতে শহরের প্রাণকেন্দ্র রোনালসে রোডে সাবেক এমপি ও ১৪ দলের মুখপাত্র আমির হোসেন আমুর বাড়ি। গত ৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ জনতা সেই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। জুলাই-আগস্ট গণহত্যার ঘটনায় একাধিক মামলার আসামি আমির হোসেন আমুকে ৬ নভেম্বর ঢাকার ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি এখন কারাগারে। 

আমুর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ইটের অবকাঠামো ছাড়া তিনতলার বাড়িতে কিছু নেই। আগুন দেওয়ার কারণে দেয়ালের রং কালো হয়ে গেছে। প্রধান ফটক তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। আর বাড়িটির প্রধান ফটকের সীমানা প্রাচীরে ঝালকাঠির বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের ব্যানার-ফেস্টুনসহ বিভিন্ন প্রচারপত্র লাগানো রয়েছে। 

পটুয়াখালীতে আফজালের বাড়ি 
সাবেক এমপি ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেনের পটুয়াখালী পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়ি গত ৫ আগস্ট ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। বাসার নিচতলা থেকে ৫ তলা পর্যন্ত আগুনে পুড়ে যাওয়ার চিহ্ন রয়েছে। এটি এখন পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। 

এ ছাড়া পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল, তার মেঝো ভাই সহসভাপতি পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেক, সেজো ভাই সদর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুজিবর রহমান খালেক, তার স্ত্রী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সালমা রহমান হ্যাপী, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি শ ম রেজাউল করিম, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আক্তারুজ্জামান ফুলু, ইন্দুরকানী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জিয়াউল আহসান গাজী, নাজিরপুর উপজেলার সাবেক চেয়ানরম্যান এস এম নুরে আলম সিদ্দিকী শাহিন, ভাণ্ডারিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম ও তার বড় ভাই পিরোজপুর-২ আসনের সাবেক এমপি মহিউদ্দিন মহারাজ, বরগুনার সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মোতালেব মৃধাসহ প্রায় শতাধিক নেতা-কর্মীর বাড়ি ৫ আগস্ট আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তবে বেশির ভাগ জেলা-উপজেলার নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে আত্মগোপনে থাকায় বাড়িগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। 

সংকটে জর্জরিত ফেনীর ২৫০ শয্যার হাসপাতাল

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩১ পিএম
সংকটে জর্জরিত ফেনীর ২৫০ শয্যার হাসপাতাল
ছবি : খবরের কাগজ

জনবল-সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ফেনীর ২৫০ শয্যার হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসাসেবা নিতে এসে অনেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। হাসপাতালের অবকাঠামো, চিকিৎসক ও জনবল-সংকট, আইসিইউ, সিসিইউ বিকল অবস্থায় পড়ে থাকায় বিঘ্নিত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা। এ ছাড়া হাসপাতালের দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ আর মশা-মাছির অত্যাচারে অতিষ্ঠ রোগীরা।

আশপাশের জেলাগুলোর যোগাযোগব্যবস্থা ভালো থাকায় মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য, চিকিৎসাসেবাসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিতে এই জেলা শহরে আসেন। বিশেষ করে নোয়খালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়িসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলার মানুষ ফেনী ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু কাগজে-কলমে ২৫০ শয্যার হলেও এখনো ১৫০ শয্যার জনবল দিয়ে চলছে জেলার গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতাল।

ফলে হাসপাতালের গুরুত্ব বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি। জানা গেছে, প্রতিদিন বহির্বিভাগে ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ রোগী সেবা নিতে আসেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ডে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ রোগী ভর্তি থাকেন। এসব রোগীর কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের।

সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার সকালে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, বহির্বিবিভাগ ও জরুরি বিভাগে অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা হিমশিম খাচ্ছেন। বহির্বিভাগে সহস্রাধিক সেবাপ্রত্যাশীকে সাতজন মেডিকেল অফিসার সেবা দিচ্ছেন। হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চেম্বারের সামনে রোগীদের দীর্ঘ সারি দেখা গেলেও চিকিৎসকরা তখন ওয়ার্ডে রাউন্ডে ছিলেন। এতে রোগীদের অপেক্ষা আরও বাড়তে থাকে।

রোগী ও স্বজনদের অভিযোগ, গত কয়েক বছরেও ফেনী জেনারেল হাসপাতালের সেবার মান বাড়েনি। এমনকি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করা হয়নি। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর চিকিৎসকরা অনিয়মিত, নার্সের সংখ্যাও কম। রয়েছে কর্মচারী-সংকট। দন্ত, চর্ম চিকিৎসাসহ অনেক রোগের পরীক্ষা করানো যায় না। প্রায়ই মেশিন নষ্ট কিংবা অপারেটর নেই শুনে রোগীদের ফিরে যেতে হয়।

সকিনা আক্তার রুনা নামে এক রোগী বলেন, হাসপাতালের পরিবেশ খুব খারাপ। সবখানে অপরিচ্ছন্ন আর দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশ। মশা-মাছির জন্য স্বস্তি পাওয়া যায় না। বসে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ যেখানে সুস্থ হবে, সেখানে এসে বরং উল্টো অসুস্থ হয়ে পড়ে।

মর্জিনা আক্তার নামে এক রোগী জানান, জরায়ুর সমস্যা নিয়ে তিনি চার দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসক ও নার্সদের সময়মতো পাওয়া যায় না। যে সমস্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন, সেই সমস্যার সমাধান হয়নি। 

মুন্নি নামের এক রোগী জানান, তার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে। অনেক কষ্টে দিন পার করছেন। টাকার অভাবে প্রাইভেট হাসপাতালে অপারেশন করাতে পারছেন না। তাই তিনি সদর হাসপাতালে এসেছেন অপারেশন করাতে। কিন্তু তার সিরিয়াল পড়েছে সাত মাস পর। এতদিন দেরি কেন জানতে চাইলে বলেন, চিকিৎসক নেই।

মোস্তফা নামে এক বয়স্ক রোগী বলেন, সরকারি হাসপাতালে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা থাকলেও ফেনী হাসপাতালে কিছুই নেই। ঠিকমতো ডাক্তারদের পাওয়া যায় না। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো যায় না। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞেস করলে বলে চিকিৎসক নেই। যন্ত্রপাতি নষ্ট। আমাদের কিছু করার নেই।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ফেনী জেনারেল হাসপাতালে বর্তমানে ৩০৬টি পদের বিপরীতে জনবল আছে ২০৬ জন। ৯ জন সিনিয়র কনসালট্যান্ট থাকার কথা থাকলেও আছেন মাত্র পাঁচজন। জুনিয়র কনসালট্যান্ট ১২ জনের জায়গায় আছেন ছয়জন। এক বছরের বেশি সময় ধরে মেডিসিন, শিশুরোগ, রেডিওলজি, প্যাথলজি, সার্জারি, দন্ত, চক্ষু, চর্ম ও যৌন রোগের কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। শিশু বিভাগের চিকিৎসক সংকটও প্রকট।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবুল খায়ের মিয়াজি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালটি ১৫০ শয্যার জনবল দিয়ে চলছে। ঘাটতি পূরণের জন্য সিভিল সার্জন অফিসের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজেলা হাসপাতাল থেকে অ্যাটাচমেন্ট (প্রেষণ) ডাক্তার আনতে হয়। তাদেরও বেশি দিন রাখা যায় না। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের নিয়ে। গত ১০ বছর চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আওতায় অর্ধশতাধিক কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হলেও আট মাস ধরে তাদের বেতন বন্ধ হয়ে আছে। তারা মাঝে মাঝে আন্দোলন করে কাজ বন্ধ রাখেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘অবকাঠামো, জনবল ও চাহিদামাফিক যন্ত্রপাতি পেলে সেবার মান আরও ভালো করা যাবে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ফেনীর ছয় উপজেলার মানুষ এই হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। গুরুত্ব বিবেচনা করে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছি।

সিন্ডিকেটমুক্ত হয়নি গণপরিবহন

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:১৯ এএম
সিন্ডিকেটমুক্ত হয়নি গণপরিবহন
ফাইল ফটো

দেশের গণপরিবহন খাত এখনো জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হতে পারেনি। দেশের পটপরিবর্তনে এক সিন্ডিকেটের বিদায় হলেও আরেক সিন্ডিকেট জেঁকে বসেছে গণপরিবহনে। পরিবহনসংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ট্রেড ইউনিয়নেও পরিবর্তন ঘটেছে। যাত্রীদের জিম্মি করে সেই ভাড়া নৈরাজ্য, টার্মিনাল বা স্ট্যান্ড দখল, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, রুট অনুযায়ী বাস চলাচলে একচেটিয়া প্রভাবসহ নানা অপকর্ম এখনো চলছে। তার মাঝে আবার নতুন এ বছরে বাসের ভাড়া আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ১৬ বছর আওয়ামী সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি ছিল পুরো পরিবহন খাত। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবহন খাতের সিন্ডিকেটেও ঘটেছে পরিবর্তন। আওয়ামী সিন্ডিকেট পালালে এখন সেই জায়গায় আসীন হয়েছেন আওয়ামীবিরোধী পরিবহন ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে কেউ কেউ বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে। তারাও সেই আগের কায়দায় নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি ও একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন। তারা আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের পরিবহন কোম্পানি বা বাসগুলো নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে ভিন্ন নামে পরিচালনা শুরু করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও বিগত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে থাকা পরিবহন খাতের মাফিয়ারা বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবহন ব্যবসায়ীদের ঠিকমতো ব্যবসাও করতে দেননি বলে অভিযোগ আছে। একচেটিয়া প্রভাবের কারণে প্রায় ১৬ বছর আওয়ামী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি ছিল দেশের পরিবহন খাত। কোনোভাবেই দখলদারি, চাঁদাবাজি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের লাগাম টানা যাচ্ছিল না এই সেক্টরে। সিন্ডিকেটের কারণে কয়েক বছরের ব্যবধানে গণপরিবহনের ভাড়াও বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।

সম্প্রতি সরেজমিনে রাজধানীর ইস্কাটনে বহুতল ভবন ইউনিক হাইটসের চতুর্থ তলায় ঢাকা সড়ক পরিবহন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বেশ সুসজ্জিত অফিস। বিগত সরকারের আমলে এখান থেকেই দেশের পরিবহন খাত নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সরকার পতনের পর ১৩ আগস্ট কার্যালয়টির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচিত একাধিক পরিবহন নেতা।

এর আগে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মালিক সমিতির কার্যালয় ছিল মতিঝিলে বিআরটিসি ভবনে। বছর ছয়েক আগে ইউনিক হাইটসে আট হাজার বর্গফুটের এ অফিস নেওয়া হয়। এর সাজসজ্জায় ব্যয় হয়ে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সারা দেশের পরিবহন খাত থেকে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার চাঁদা তোলা হতো। গেট পাস বা জিপি কিংবা সমিতির সদস্য ফিসহ নানা অজুহাতে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট পরিবহন নেতারা সাধারণ বাস-ট্রাকমালিকদের কাছ থেকে দৈনিক, মাসিক ও এককালীন নানা অঙ্কের টাকা চাঁদা হিসেবে আদায় করতেন। 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি মশিউর রহমান রাঙ্গা এবং প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্যাহসহ আরও বেশ কয়েকজনে মিলে ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই সেক্টরে গড়ে তোলেন শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট প্রতিদিন সারা দেশের চলাচল করা গণপরিবহন থেকে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার চাঁদাবাজি করত। চাঁদাবাজির টাকায় ওই তিন ‘মাফিয়া’ বিগত সরকারের আমলে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। খন্দকার এনায়েত উল্যাহর সহযোগী ছিলেন মশিউর রহমান রাঙ্গা। শাজাহান খান গ্রেপ্তার হলেও সরকার পতনের আগেই দেশ ছেড়েছেন এনায়েত উল্যাহ। অন্যদিকে আত্মগোপনে আছেন জাতীয় পার্টির একসময়ের প্রভাবশালী নেতা রাঙ্গা।

জানা গেছে, দেশে নিবন্ধিত পরিবহন শ্রমিক সংগঠন আছে প্রায় ২৪৯টি। এগুলোর সমন্বয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন নামে জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। এই ফেডারেশনের নেতৃত্ব দিতেন পরিবহনের মাফিয়াখ্যাত শাজাহান খান। শাজাহান, এনায়েত ও রাঙ্গার সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আরও অন্তত এক ডজন প্রভাবশালী পরিবহন নেতা। যারা মূলত সিন্ডিকেট পরিচালনায় ওই তিনজনের মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করতেন। তাদের অনেকে এখন পলাতক। এদের অন্যতম হলেন ওসমান আলী, মুখলেছুর রহমান ও সাদিকুর রহমান হিরু, গাবতলীকেন্দ্রিক মো. আব্বাস, মো. বুলু, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের সভাপতি তালুকদার মোহাম্মদ মনির ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম, বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সভাপতি হাজি মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এই সংগঠনের নেতারা কার্যালয়ে আসেন না। অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন তারা। তবে সেখানে শূন্যস্থান পূরণ করে সংগঠনগুলোর কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্ট আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতারা। গত ৫ আগস্টের পর ওই ফেডারেশন ও পরিবহন মালিক সমিতিসহ অধিকাংশ সংগঠনের নেতৃত্বে এসেছে নতুন মুখ। 

এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির বর্তমান দপ্তর সম্পাদক কাজী মো. জুবায়ের মাসুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘পরিবহন-মালিকদের ব্যবসা সংরক্ষণ ও যাত্রীদের স্বার্থে দায়িত্ব নিয়েছি। সমিতি পরিচালনার জন্য ন্যূনতম যে খরচ দরকার, সেটা তোলা হবে। তবে যত্রতত্র চাঁদাবাজি কিংবা বিশেষ কোনো রাজনৈতিক নেতার জন্য যাতে চাঁদা না তোলা হয়, সেটা নিশ্চিত করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে ও চাঁদাবাজি কমেছে। এ ছাড়া আমরা বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গেও একাধিকবার বসেছি।’ 

এদিকে আওয়ামী সরকারের শাসনামলে কয়েক দফা ভাড়া বাড়ানো হয়। জ্বালানি মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে বা সাধারণ যাত্রীদের বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে ইচ্ছেমতো ভাড়া নৈরাজ্য চালায় পরিবহন খাতের ওই সিন্ডিকেট। আওয়ামী সেই সিন্ডিকেটেরও পতন হয়েছে, কিন্তু ভাড়া কমেনি। বরং নতুন যারা এই খাতের ‘দখল’ নিয়েছেন তারা অল্প সময়ের মধ্যে ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

গত বুধবার রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী ও কলাবাগান টিকিট কাউন্টার ঘুরে ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯-১০ সালে ঢাকা-পাবনা রুটে ‘পাবনা এক্সপ্রেস’ বাসের ভাড়া ছিল ২৬০ টাকা। কয়েক দফায় বেড়ে এখন তা ৫০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার চেয়ারকোচ বাসের ভাড়া ছিল ৭০০ টাকা, যা ২০২২ সালের আগস্টের পর বেড়ে হয়েছে গড়ে ১ হাজার টাকা। এ ছাড়া ঢাকা-বরিশাল রুটের ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা এখন বেড়ে ৬০০ টাকা। 

টিকিট কাউন্টারগুলোর একাধিক যাত্রী জানান, ‘ভাড়া বাড়ানো একটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভুক্তভোগী শুধু সাধারণ মানুষ। এসব দেখার কেউ নেই।’ তবে কাউন্টারের একাধিক কর্মী জানান, তেলের দাম বাড়ানোসহ বিভিন্ন কারণে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। তারা জানান, এসব পরিবহন-মালিকরাই ভালো বলতে পারবেন। 

গণপরিবহনে নৈরাজ্য জীর্ণদশায় চলছে লক্কড়-ঝক্কড় বাস

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৫:১৫ এএম
আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
জীর্ণদশায় চলছে লক্কড়-ঝক্কড় বাস
রাজধানীতে দাপটের সঙ্গে চলছে লক্কড়-ঝক্কড় বাস। ছবি: সংগৃহীত

দেশে গণপরিবহন চলার ক্ষেত্রে এখনো চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। লক্কড়-ঝক্কড় বাস চলছে দাপটের সঙ্গে। যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগে। ভাড়া নিয়েও রয়েছে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের বাড়াবাড়ি। দূরপাল্লার বাসগুলোর মান কিছুটা ভালো থাকলেও রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে যাত্রীসেবা বা যাত্রী অধিকার এখনো উপেক্ষিত। অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা যেন স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। মেনে নেওয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায়ও নেই সাধারণ যাত্রীদের কাছে।

এ ছাড়া ফিটনেসবিহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ ও হাইওয়ে পুলিশ নিয়মিত বা মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও তাতে পরিস্থিতির উন্নয়নে খুব বেশি কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। গত কয়েকদিন সরেজমিনে বাসযাত্রী হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০২৪ সালের হিসেবে, সারা দেশে গণপরিবহনের প্রধান বাহন বাসের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৪৪ হাজার ৫০৯টি। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৫৫টি বড় বাস এবং মিনিবাস ২৮ হাজার ৪৫৪টি। তবে দেশে নিবন্ধিত (রেজিস্ট্রেশন) বাসের সংখ্যা ৫৫ হাজার ৮৪২টি বলেও জানা গেছে। এর মধ্যে কেবল রাজধানী ঢাকায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার বাস চলাচল করে বলে জানিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘গণপরিবহন খাতে যাত্রীসেবা, শৃঙ্খলা-নিরাপত্তাসহ সবকিছুই আগের মতো চলছে। কোথাও সেভাবে পরিবর্তন হয়নি। বরং কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেড়েছে। এর মধ্যে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এখনো বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ ছাড়া পরিবহনকেন্দ্রিক যে চাঁদাবাজি হতো সেগুলোর কেবল হাতবদল হয়েছে।’

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সরকারের দুটি প্রতিষ্ঠান ঢাকার সড়কে যানবাহন চলাচলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। একটি বিআরটিএ, অন্যটি পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ। এর মধ্যে বিআরটিএ ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। বত্রিশটি বিষয় পর্যবেক্ষণের পর তাদের ফিটনেস সনদ দেওয়ার কথা থাকলেও জীর্ণদশার ভাঙাচোরা বাসগুলো নিয়মিত সনদ পেয়ে যাচ্ছে ! আবার রাস্তায় নামার পর লক্কড়-ঝক্কড় বা ফিটনেসহীন বাস জব্দ করার কথা থাকলেও ট্রাফিক বিভাগ থেকেও সেটি খুব একটা দেখা যায় না। বরং ট্রাফিক পুলিশের সামনে দিয়েই বীরদর্পে চলছে এসব বাস। তবে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ নিয়মিত বাস ও মোটরবাইকসহ নানা ধরনের যানবাহনে মামলা ও জরিমানার কাজগুলো করে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ফিটনেসবিহীন ও নানা অনিয়মে চলাচলকারী বাস, মিনিবাস, প্রাইভেটকার ও বাইকসহ এ ধরনের যানবাহনের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা বা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি রাজধানীর ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষায় ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ নিয়মিতভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। রাজধানীতে গত দুই দিনে (১৬ ও ১৭ জানুয়ারি) ৩ হাজার ২৫১টি মামলা করেছে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। এ ছাড়াও অভিযানকালে ১০২টি গাড়ি ডাম্পিং ও ৪৩টি গাড়ি রেকার করা হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

সরেজমিনে বাসযাত্রায় অভিজ্ঞতা:

গত শুক্রবার বিকেল পৌনে চারটা। ফার্মগেট স্ট্যান্ডে তখন শহরের বিভিন্ন রুটের পাঁচটি যাত্রীবাহী বাস অপেক্ষমাণ। হেলপাররা ডেকে ডেকে যাত্রীদের উঠাচ্ছিলেন। এ প্রতিবেদকের গন্তব্য ফার্মগেট থেকে বাংলামোটর। এ সময় মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে আসা ‘আয়াত’ পরিবহনের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৩৩৭২) উঠতেই ভেতরে বিশ্রি অবস্থা দেখা যায়। সিটগুলোতে নরম কোনো গদি হয়তো কোনোকালে ছিল, কিন্তু এখন প্রায় সবই কঙ্কালসার বডি নিয়ে আছে। সিটের ওপরে লালচে বর্ণের মোটা কাপড়ের কাভারে দেওয়া। কিন্তু সেই কাভারের ওপরে যেন ইঞ্চি পরিমাণ কালচে ধুলাবালির আবরণ ছিল। প্রায় সব সিটেই যাত্রী বসা, তবুও দাঁড়ানো যাত্রীর জন্য বাইরে চলছিল হাঁকডাক। প্রায় ৮ মিনিট পর বাস ছাড়লেও চাকা মাত্র ২০০-৩০০ গজ ঘুরতেই রাস্তার ওপর হঠাৎ থামিয়ে দেওয়া হয়। দেখা গেল- সেখানে দুজন যাত্রী বাসে উঠলেন। একইভাবে কারওয়ান বাজার মোড় পর্যন্ত যেতে মাত্র এক-দেড় কিলোমিটার সড়কে অন্তত চার স্থানে বাসটি যাত্রীর জন্য দাঁড়ায়। কেবল তাই নয়, কারওয়ান বাজারের মোড়ে যখন সব গাড়ি সিগন্যাল ছাড়ার পর মোড় অতিক্রমে ব্যস্ত, তখন এই বাসটি সিগন্যাল পড়ার অপেক্ষায় থেমে থাকে। যথারীতি সিগন্যালে আটকে গেলে তখন যাত্রীরা ভেতর থেকে হইচই শুরু করেন। চালকের তখন সাফ কথা- ‘কারও এত তাড়া থাকলে নেমে অন্য গাড়িতে যান, আমার আরও যাত্রী লাগব।’ এর আগে ফার্মগেটে অবস্থানকালেই এয়ারপোর্ট রোডের আরেকটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব-১৩-১২২৮) কিছু সময়ের জন্য উঠলে ভেতরে সেই আয়াতের বাসের মতোই নোংরা ও জীর্ণ অবস্থা দেখা যায়। কেবল আয়াত বা এয়ারপোর্ট রোডের বাস নয়, বেশ কিছু সময় অবস্থানকালে অধিকাংশ যাত্রীবাহী বাসে করুণ দশা দেখা গেছে। এ ছাড়া ফার্মগেট-কারওয়ান বাজার ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের অধিকাংশের সারা শরীরে (বডি) যেন ধাক্কাধাক্কির ক্ষত চিহ্ন।

এদিকে রাজধানীতে চলাচল করা প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহন দুটি একই রুটে চলে। কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর মিরপুর হয়ে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত যায় এই দুটি পরিবহনের অন্তত ১২০টি বাস। সরেজমিনে দেখা গেছে, বেশির ভাগ বাসেরই রং চটে গেছে, কিছু বাস ভাঙাচোরা। এ ছাড়া বেশির ভাগ বাসের ভেতরটা নোংরা ধুলাবালিতে ঠাঁসা, ফ্যান নষ্ট। নিয়মের তোয়াক্কা না করে বেশি সংখ্যক সিট বসানো হয়েছে। আবার অনেক সিট ছিড়ে লোহা বের হয়েছে। এমনকি বসার স্থানেও ফোম বের হয়ে গেছে।

এদিকে গাবতলি থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলাচল করা গাবতলি লিংক (প্রাঃ) লিঃ (সাবেক ৮ নম্বর বাস) বাসের বেশির ভাগই বহু পুরোনো। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীতে এই বাস চলে ১০০টির বেশি। এই ব্যানারের বেশির ভাগ বাসেরই জরাজীর্ণ অবস্থা। আবার ধাক্কা বা ঘষায় ঘষায় রঙ উঠে গেছে। অনেক সময় রঙ করে রাস্তায় নামানো হয়। দেওয়া হয় জোড়াতালি।

গত বুধবার দুপুরে গাবতলি লিংক (প্রাঃ) লিমিটেডের একটি বাসে (ঢাকা মেট্রো-ব ১২-০০৩৬) উঠে দেখা যায়, বাসের সামনে অংশের সব মিটার থেকে শুরু করে সব বক্স নষ্ট। বিভিন্ন ধরনের তার ঝুলে আছে। বাসের সিটগুলো নোংরা-হাড্ডিসার।

মিরপুর-১২ থেকে যাত্রাবাড়ী চলাচল করা বিকল্প পরিবহনের বেশির ভাগ বাসেরও জরাজীর্ণ অবস্থা। বাসের বডির রঙ উঠে গেছে। এই পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১১-৭৪০৪) পেছনটা ভেঙে গেছে। ভেতরের পরিবেশ নোংরা, সিটগুলো জরাজীর্ণ নোংরা তেলচিটচিটে। একই চিত্র দেখা গেছে সাভার থেকে সাইনবোর্ড রুটে চলাচল করা এমএম লাভলী পরিবহনের। এই পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-০১৩৮) পেছনের অংশ ভেঙে ঝুলে ছিল। বাসটি পুরোনো হওয়ায় পেছনের অংশের ঝালাইও ফেটে গেছে। বাসের ভেতরের অবস্থাও করুণ। একই পরিবহনের আরেকটি বাসেও (ঢাকা মেট্রো-ব-১৫-৩৬৭২) প্রায় একই অবস্থা দেখা গেছে।

যাত্রী ও বাসসংশ্লিষ্টরা যা বললেন:

গত শুক্রবার বিকেলে ফার্মগেট এলাকার বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা সুবীর বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি খবরের কাগজকে বলেন, ‘অফিস থেকে বাসসহ ঢাকা শহরে আমাকে সবসময় বাসেই চলাচল করতে হয়। এমনিতেও যানজটের ভোগান্তি থাকে, তার মাঝে আবার বাসের যে করুণ অবস্থা, চিন্তা করা যায় না। ময়লাযুক্ত বা নোংরা সিট, অধিকাংশ জানালা ভাঙা, লক্কড়-ঝক্কড় অবস্থাসহ অধিকাংশ বাসই ব্যবহারের অযোগ্য। এর মধ্যে হেলপার ও চালকদের আচরণও থাকে অনেক সময় মাস্তানের মতো। যাত্রীরা কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করলে অনেক সময় গাড়ির লোকজনও সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করে থাকে। সাধারণ যাত্রীরা যে কতটা অসহায় বোধ করেন, সেটা যারা এসব বাসে চলাচল করেন তারাই ভালো বুঝবেন।’

পরিস্থান পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো-ব-১৩-০৪০৫) কন্ডাক্টর মো. কালু মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাস নোংরা বা সিটের সমস্যার বড় কারণ হচ্ছে বাস মালিকেরা ঠিকঠাকভাবে এটা তদারকি করেন না। আবার কোম্পানির ব্যানারে বা সংগঠনের মালিকানায় খুব অল্পসংখ্যক বাস চললেও বেশির ভাগই কোম্পানির ব্যানারে ব্যক্তি মালিকানার বাস চলে। কোম্পানির ব্যানার ভাড়া নিয়ে বা বাস ভাড়া দিয়ে এসব রাস্তায় নামানো হচ্ছে। বাস মালিকরা ওই কোম্পানিকে একটা নির্দিষ্ট টাকা বাস ভাড়া হিসেবে দেন। এই বাস থাকে ড্রাইভার ও কন্ডাক্টরদের হাতে। তারাও বাস পরিষ্কার রাখেন না।

বাসে নিয়মের বেশি সিট থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা বাস মালিকদের কাজ। এ ছাড়া ভাড়ার প্রশ্নে কালু মিয়া বলেন, সরকারের নির্ধারিত মূল্যেই যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়।

গাবতলী লিংক পরিবহনের একটি বাসের চালক মো. আমিনুর বলেন, ‘সাধ্যমতো বাস পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করি। সব সময় করা হয় না।’ তবে বাসের অন্যান্য ফিটনেসের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি আর কোনো উত্তর দেননি।

শনিবার (১৮ জানুয়ারি) ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে একটি বাস থেকে নামা যাত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, মোহাম্মদপুর থেকে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডে কর্মসূত্রে বাসেই নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু এসব বাসের কথা বলে কী লাভ ? কে দেখে এসব ? কেউ তো ব্যবস্থা নেয় না। ভাড়া ঠিকই নিচ্ছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি নিচ্ছে, কিন্তু যাত্রীসেবা কোথায়? এত নোংরা-অব্যবস্থাপনা সত্ত্বেও উপায় না থেকে চলতে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক কাজী মো. জুবায়ের মাসুদ খবরের কাগজকে বলেন, পরিবহন মালিকদের ব্যবসা সংরক্ষণ ও যাত্রীদের স্বার্থে আমরা বেশ কিছু দায়িত্ব নিয়েছি। বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে প্রশাসনের সঙ্গেও একাধিবার বসেছি। উচ্চস্বরে হর্ন বাজানো বন্ধ করা ও দুর্ঘটনা রোধে চালকের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করার দাবি জানিয়েছি আমরা। আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এই সেক্টরে শৃঙ্খলা ফেরানোর চেষ্টা করছি। বাস ভাড়া ভাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানিয়ে জুবায়ের মাসুদ আরও বলেন, ‘বর্তমানে ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে তেলের দামের সঙ্গে আমাদের ভাড়ার বৈষম্য আছে। এ জন্য নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধির কথা আমরা বিআরটিএসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করছি। ইতোমধ্যে একটি সুপারিশও জমা দেওয়া হয়েছে।’

গণপরিবহনে শৃঙ্খলার বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান সরকার অনেক খাতেই সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, এটা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ, কিন্তু গণপরিবহনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সেভাবে কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। গণপরিবহনের শৃঙ্খলা, যাত্রীদের অধিকার সুরক্ষা ও আধুনিকায়নের জন্য সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

মে মাস থেকে পুরোনো-ফিটসেনবিহীন বাস অপসারণ: এ প্রসঙ্গে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঢাকায় লক্কড়-ঝক্কড় বাসগুলো তথা ২০ বছরের পুরোনো ও ফিটসেনবিহীন বাস আগামী মে মাসের মধ্যে সড়ক থেকে অপসারণ করা হবে। নতুন বাস প্রতিস্থাপনের জন্য মালিকদের অনেকবার বলা হয়েছে বিআরটিএর পক্ষ থেকে। কিন্তু তারা কালক্ষেপণ করছেন। এটি আর মেনে নেওয়া হবে না। মে মাসের মধ্যে কোনো মালিক সড়ক থেকে বাস না তুললে আমরা আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাস প্রতিস্থাপনে কোনো ধরনের ব্যাংক ঋণের সহায়তার প্রয়োজন হলে সে ক্ষেত্রেও সরকার সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।’