গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাজধানীর সড়কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীর গণপরিবহনকে শৃঙ্খলায় আনতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প তথা ঢাকা নগর পরিবহনকে সক্রিয় করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন।
রাজধানী ঢাকা ও শহরতলি ঘিরে ৩৮৮টি বাস রুটকে ৪২টি রুটে নামিয়ে আনা, তারপর সেই ৪২টি রুটে আলাদা আলাদা বাস কোম্পানি গঠন করে সড়কে বাসের রেষারেষি বন্ধ করা ছিল এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু এতে বাদ সেধেছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
ঢাকার বাসমালিকদের এই সংগঠনটি বলছে, কোনো রুটে কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে যেতে তারা নারাজ। ঢাকায় বাস চালাতে তারা বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটিকে মানতে নারাজ। ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষকে (ডিটিসিএ) রীতিমতো অগ্রাহ্য করে তারা এই সংস্থার প্রায় সব উদ্যোগ ভেস্তে দিতে চলেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা নগর পরিবহনে যুক্ত হতে বাসমালিকদের মধ্যে যারা আবেদন জানিয়েছিলেন, তাদের পরিবহনের অনেক বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে গেছে। আগামী মে মাসের মধ্যে ফিটনেসবিহীন বাসগুলো রাজধানীর সড়ক থেকে উঠিয়ে নিতে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা মানতে একদম নারাজ তারা।
এগিয়ে গিয়েও থমকে গেল বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প
ঢাকা নগর পরিবহন নামে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প শুরু হয় ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর। তখন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) থেকে ৩০টি এবং বেসরকারি অপারেটর ট্রান্স সিলভা থেকে ২০টি বাস চালু করা হয়েছিল। ৫০টি বাসের রুট ছিল কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর থেকে মোহাম্মদপুর, জিগাতলা, শাহবাগ, মতিঝিল হয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর পর্যন্ত। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে ট্রান্স সিলভা পরিবহন তাদের বাসগুলো তুলে নেয়। বিআরটিসিও লোকসানের মুখে প্রথমে বাস কমিয়ে দেয়। পরে একেবারে বন্ধ করে দেয়।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিআরটিসির কোনো বাস ঢাকা নগর পরিবহন রুটে চলাচল করছে না।
এমন পরিস্থিতিতে গত বছরের ১১ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন প্রশাসক ও বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টদের নিয়ে সভার আয়োজন করেন। তিনি জানিয়েছিলেন, বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের আওতাধীন রুটগুলোতে বাস চলতে হলে ঢাকা নগর পরিবহনের আওতায় আসতে হবে।
বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম খবরের কাগজকে জানান, সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক ঢাকা মহানগরের ২৪, ২৫, ২৭ ও ২৮ নম্বর রুটসহ ৪২টি রুটে বাস পরিচালনায় আগ্রহীদের থেকে আবেদনপত্র গ্রহণ করতে শুরু করে ডিটিসিএ। গত বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৪২টি রুটে দুই শতাধিক পরিবহন কোম্পানির মালিক আবেদন জানান। তারা এসব রুটে প্রায় তিন হাজার বাস পরিচালনা করতে চান। আগামী ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকা নগর পরিবহনের সবুজ গুচ্ছে (গ্রিন ক্লাস্টার) আবারও বাস চালু করতে তোড়জোড় শুরু করেছেন তারা।
এই প্রকল্পের কাজ এগিয়ে গেলেও সংকট শুরু হয়েছে গত ২১ জানুয়ারি থেকে। ওই দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলীর সভাপতিত্বে ডিএমপি কার্যালয়ে ঢাকা মেট্রো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির (আরটিসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, ‘আমরা ঢাকা নগর পরিবহনে কোনো বাস দিতে পারব না। ঢাকা নগর পরিবহন চালাতে হলে ডিটিসিএ নিজ উদ্যোগে দুই হাজার বাস এনে চালাক। কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে বাস চালাতে আমরা বাধ্য নই। ঢাকা সড়ক পরিবহনে বাস চালাতে আমাকে বাধ্য করতে পারে না কেউ।’
সাইফুল আলম আরও বলেন, ‘আমি এই সড়কে বাস নামিয়ে কী লাভটা পাব? আমাকে কোনো ফ্যাসিলিটি না সাবসিডি দেওয়া হয়েছে? ডিটিসিএর মতো সংস্থা পরিবহন খাতের জন্য কী করেছে? তারা একের পর এক কনসালট্যান্সির নাম করে সরকারের টাকা খাচ্ছে।’
এ বিষয়টি পরে খবরের কাগজকে নিশ্চিত করেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। এ সমিতির দপ্তর সম্পাদক কাজী জুবায়ের মাসুদ বলেন, ‘আমরা বাস রুট রেশনালাইজেশনের আওতায় থাকতে চাচ্ছি না। আমরা পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মহোদয়ের সহযোগিতায় সড়কে বাস চালাব।’
ঢাকা নগর পরিবহনের প্রকল্পটি যেন ভেস্তে না যায়, সে জন্য জোর প্রচেষ্টা করছে ডিটিসিএ। সংস্থাটির পরিচালক নীলিমা আখতার খবরের কাগজকে বলেন, ‘বাসমালিকরা এগিয়ে গিয়েও আবার পিছিয়ে গেছেন। আমরা তাদের নিয়ে আরও দু-তিনটি সভা করব। এরপরে কিছু ভালো খবর পাবেন।’
রুট পারমিট, ফিটনেস নেই, তবু বাসমালিকরা সেসব গাড়িই আনতে চান এই প্রকল্পে
বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্প তথা ঢাকা নগর পরিবহনে যুক্ত হতে গেলে আধুনিক, মানসম্পন্ন বাস দিতে হবে বাসমালিকদের। কিন্তু এই বাসমালিকদের বড় অপকর্ম ধরা পড়ে ডিএমপির একটি পরিসংখ্যানে।
সেই পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, আঞ্চলিক পরিবহন কমিটি (আরটিসি) অনুমোদিত ঢাকার ১১০টি সচল রুটে এখন বাস চলছে ৪ হাজার ৫৪৬টি। এর মধ্যে ফিটনেসবিহীন বাসের সংখ্যা ১ হাজার ৫৩টি। এসব রুটে অনুমোদিত গাড়ির সংখ্যা ৭ হাজার ৪৩।
ডিএমপি, বিআরটিএর নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো কোনো পরিবহনের ৯০-৯৫টি বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল (২০ বছরের বেশি) ফুরিয়ে গেছে অনেক আগে। যেমন: এ-২২২ রুটে গাজীপুর পরিবহনের ব্যানারে বাসের সংখ্যা ২০৫। তবে বৈধ রুট পারমিটধারী বাসের সংখ্যা ১১০। এ পরিবহনে ২০ বছরের বেশি বয়সের বাস রয়েছে ৯৫টি।
এ-২২০ রুটে প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন লিমিটেডের বাসের সংখ্যা ১১৮। এর মধ্যে বৈধ রুট পারমিটধারী বাসের সংখ্যা ১০০। মেয়াদোত্তীর্ণ বাসের সংখ্যা ১৮। অথচ এ পরিবহনের মালিক নতুন করে ২৬টি বাসের রুট পারমিটের জন্য আবেদন করেছেন।
বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, নিজেদের রুট পারমিটবিহীন বাসের পাশাপাশি বিভিন্ন রুটে চলমান রুট পারমিটবিহীন বাসগুলোকেও নিজস্ব ব্যানারে পরিচালনার তোড়জোড় শুরু করেছে এসব পরিবহন কোম্পানি। যেমন- দুলদুল পরিবহনের ২৯টি বাসের সবগুলোর রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি বাস তারা অন্য কোম্পানির ব্যানারে পরিচালনা করছে। এসব বাস নিজেদের ব্যানারে ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি অন্য রুটের ১৩টি বাসসহ মোট ৩৮টি বাস নিয়ে পুনরায় দুলদুল সার্ভিস চালু করতে তোড়জোড় করছেন মালিক। অনাবিল পরিবহনের ৫১টি বাসের মধ্যে ৪২টির রুট পারমিট নেই। তারাও নানা রুট থেকে বাস এনে এখন ৮৩টি বাস পরিচালনা করতে চাণ। এমন মালিকদের সংখ্যা ৫১ জন।
ঢাকা নগর পরিবহন প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলেন, ‘এই প্রকল্পে কোনোভাবেই যখন এসব বাসমালিককে ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানানো হয়েছে, তখন তারা আমাদের প্রকল্প নিয়ে নানা বিতর্ক তৈরি করেছেন। সমন্বিত বাস পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আসবেন না বলে এখন আরটিসি সভায় গিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটাতে চাইছেন।’
সমাধান তবে কোথায়
ঢাকা মহানগরীতে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে হলে সরকারি পরিবহনব্যবস্থা চালু করতে হবে বলে মনে করেন পরিবহন খাত বিশেষজ্ঞরা।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আরটিসির রুট আর ঢাকা নগর পরিবহনের রুট বিদ্যমান থাকায় এখন সংকট তৈরি হয়েছে। এ দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় না হলে সড়কে বিশৃঙ্খলা থেকেই যাবে। একই সড়কে তো দুই ধরনের ব্যবস্থাপনা চলতে পারে না।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, বেসরকারি বাসমালিকদের ওপর ভরসা করে সড়ক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানো যাবে না। তাদের লক্কড়ঝক্কড় বাস দিয়ে কোনো গণপরিবহনব্যবস্থা চলতে পারে না। সরকারকে এখন অন্তত চার হাজার নতুন বাস আনতে হবে।
তিনি বলেন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত সেসব বাস সড়কে নামলে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমবে। এতে সড়কে যানজট কমবে, বাসের ট্রিপের সংখ্যা বাড়বে, আয়ও হবে বেশি। এই ব্যবস্থাটি এই সরকারকে শুরু করে দিয়ে যেতে হবে। তার পরের সরকারকে এই ব্যবস্থা চলমান রাখতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে রাজধানীতে বেসরকারি মালিকদের গাড়ি চলে না। আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা শুরু করতে না পারলে কোনো উন্নতি দেখি না।
সিফাত/