দেশের রেল ও সড়কপথে যোগাযোগের পাঁচটি মেগা প্রকল্প- পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, কক্সবাজার-দোহাজারী রেলপথ এবং মেট্রোরেল প্রকল্পে বিপুল অর্থ অপচয়ের খতিয়ান উঠে এসেছে অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ১২ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি জানিয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লুটপাট, দুর্নীতির কারণে এই পাঁচ মেগা প্রকল্প নির্মাণের আগে-পরে ব্যয় বেড়েছে ৫৬ হাজার ৬০৩ কোটি ৮৩ লাখ টাকা।
গত ১ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে কমিটির সদস্যরা এ প্রতিবেদন জমা দেন। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে। অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পাঁচ প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল ৭৭ হাজার ৪৩৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। হিসাব বলছে, প্রাথমিক ব্যয়ের তুলনায় ২৩৭ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এসব প্রকল্পে।
শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, এই পাঁচ প্রকল্পে কেনাকাটায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর) মেনে চলা হয়নি। প্রকল্পের কেনাকাটায় অস্বচ্ছতা ও অতিরিক্ত ব্যয়ের অভিযোগও উঠেছে একাধিকবার। অনেক ক্রয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান না করে সরাসরি বরাদ্দ দেওয়ার নজির রয়েছে। এতে করে প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় লাগা ও টাকা খরচ হওয়া একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় পরিকল্পনা পরিবর্তন এবং সঠিক পূর্বাভাসের অভাবে এই ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে। সংশোধিত ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজালে (ডিপিপি) সময় ও ব্যয়ের পরিবর্তনগুলো উল্লেখ থাকলেও প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় প্রকৃত অর্থে এই ব্যয় আরও বৃদ্ধি পায়। শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়, সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন না হওয়া, অদূরদর্শী নীতি এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাবে প্রকল্পগুলোর ব্যয় ক্রমাগত বেড়েছে।
শ্বেতপত্রের বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘এখন প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ও সময় বৃদ্ধি এটা নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। খুব প্রয়োজন না হলে ব্যয় বৃদ্ধি করা হবে না। আবার বৃদ্ধি হলে সেটা যেন যুক্তিসংগত হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হচ্ছে। শুধু ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটের কারণে যে ব্যয় বৃদ্ধি সেটিই করা হচ্ছে। এর বাইরে ভূমি অধিগ্রহণে যে ব্যয় বৃদ্ধি এটাও বিবেচনা করা হচ্ছে।’
পদ্মা সেতু ও দোহাজারী-কক্সবাজার রেল সংযোগ প্রকল্পে সংশোধনীর প্রভাব রয়েছে বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে পরবর্তী সময়ে রেল সংযোগ এবং নতুন সংযোজন হিসেবে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা রেলপথ যুক্ত করা হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার-দোহাজারী রেল প্রকল্পে প্রাথমিক ডিজাইনের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেল প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ হাজার ৮৫২ কোটি ৩ লাখ টাকা, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৫ লাখ টাকা। এই বৃদ্ধির পরিমাণ প্রায় ৮৪৭ শতাংশ।
পদ্মা সেতু প্রকল্পেও একই চিত্র দেখা গেছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, ২০১০ সালে অ্যাপ্রোচ রোড (সংযোগ সড়ক) এবং টোলপ্লাজার জন্য বরাদ্দ ছিল ১২৭ কোটি টাকা। এই অর্থ ২০১৫ সালে পুনরায় সংযোজনের মাধ্যমে ২ হাজার ১০৯ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। এই অতিরিক্ত ব্যয় কেবল প্রকল্প বাস্তবায়নকে জটিল করেনি, বরং দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।
বাংলাদেশের বড় নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে ব্যয়ের তুলনায় কাজের মান নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে। শ্বেতপত্র কমিটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে চার লেনের সড়ক নির্মাণে যে ব্যয় হয়, তা ভারতের তুলনায় ৪ দশমিক ৪ গুণ এবং পাকিস্তানের তুলনায় প্রায় আড়াই গুণ বেশি। উদাহরণ হিসেবে রংপুর-হাটিকুমরুল চার লেন সড়কে প্রতি কিলোমিটার নির্মাণে খরচ হয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে খরচ ধরা হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দরপত্র প্রক্রিয়ায় নানাবিধ অনিয়মের পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে ভূমি অধিগ্রহণে। ভূমির দাম প্রায় সব ক্ষেত্রেই বাস্তবের তুলনায় অনেক বেশি ধরা হয়েছে। এতে প্রকল্প ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে।
শ্বেতপত্র কমিটির দাবি, ভূমি অধিগ্রহণের অতিরিক্ত মূল্যায়নের সুবিধাভোগী একটি স্বার্থান্বেষী মহল। তাদের কারণে প্রকল্পের ব্যয় যেমন বেড়েছে, তেমনি সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়নও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিবেদনে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পের উদাহরণ টেনে বলা হয়, প্রকল্পটি বারবার সংশোধনের ফলে ব্যয় প্রাক্কলনের তুলনায় ১২ গুণ বেড়েছে। এই ধরনের সংশোধন শুধু অর্থনৈতিক নয়, বরং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
কমিটি বলছে, পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে সুশাসনের জন্য নানা নিয়ম ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। কর্ণফুলী নদীর টানেলের নির্মাণ ব্যয় ২০১৫ সালের ডিপিপি থেকে ২০২২ সালের সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (আরডিপিপি) পর্যন্ত ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও আর্থিক বিশ্লেষণের মূল সূচকে (উপকারিতা-ব্যয় অনুপাত এবং অভ্যন্তরীণ রিটার্ন রেট) কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের সময়কালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবহন খাতের ৩২৯টি উন্নয়ন প্রকল্পের ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশে সময় ও ব্যয় দুই-ই বেড়েছে। ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ প্রকল্পে সময় বা ব্যয় বেড়েছে। গড়ে প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় ২৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সময় ৯৪ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রবণতা সরকারি বিনিয়োগের প্রত্যাশিত হার কমিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘শ্বেতপত্রে উল্লিখিত অভিযোগগুলো প্রায় প্রমাণিত হয়েছে। আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে প্রকল্পের খরচ অনেক বেশি বলে বেরিয়ে এসেছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশে অনেক প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। কিছু প্রকল্প শেষের পথে। এখন সরকারের সামনে সুযোগ রয়েছে। তারা প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের থেকে কিছু টাকা পুনরুদ্ধার করতে পারে, যারা এসব অপচয়ের জন্য দায়ী। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এত বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের পর যদি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া না যায়, তা হলে এটি দেশের জন্য আরও বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।’