![নানা দলে নানা মত](uploads/2025/01/10/kk-1736490595.jpg)
অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এমন পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ দলই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়। তবে ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি ও জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ কয়েকটি দল আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল এ প্রশ্নে এখনো তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, দলটি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না। সংসদের আগে স্থানীয় নির্বাচনে জোর দেওয়া, প্রশাসক নিয়োগ করা ছাত্র নেতৃত্বের রাজনৈতিক দল গঠনকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার লক্ষণ বলে তারা মনে করে। তাদের মতে, অতীতে দেখা গেছে সরকারি সুবিধার আশায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সরকার-সমর্থিত নতুন রাজনৈতিক দলে ভিড়েছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস খবরের কাগজকে বলেন, অবশ্যই জাতীয় সরকার নির্বাচন আগে হতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এর কোনো নজির নেই। যত অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেছে কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেয়নি।
দলটির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় খবরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে পারে না। তাদের কাজ হলো- জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তোড়জোড় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হতে পারে। এতে হয়তো কিছু দল ও ব্যক্তি বেনিফিশিয়ারি হবে। কিছু রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
বিএনপির নেতাদের অভিমত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল হওয়ায় নির্বাচন ঘিরে সহিংসতা, নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার আশঙ্কার কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচনের বিরোধী বিএনপি।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগে চাই। আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে ভোট ভালো হবে না। কারণ সারা দেশে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীদের এখনই মাঠে নামতে দেওয়া হচ্ছে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ব্যাপারেও আমরা সন্দিহান। অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর থেকে জনগণের ভরসা কমে যাচ্ছে।’
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গত ১৯ আগস্ট দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে। এরপর সব সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর, ৬১ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য এবং ৪৯৫ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। অপসারণ করা হয় ৩৩১ পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরদেরও। শুধু ৪ হাজার ৫৭৮টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের বহাল রাখা হয়। কিন্তু তারাও বেশির ভাগ অনুপস্থিত ও পলাতক। আদালতের রায়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে বিএনপির শাহাদাত হোসেন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু বাকি সব জায়গায় জনপ্রতিনিধি শূন্য। সরকারি কর্মকর্তারা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করলেও নাগরিকসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। এ যুক্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে কেউ কেউ।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, সব রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন আগে চায়। কেউ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলেনি। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে দূরত্ব ও বিভেদ তৈরি হতে পারে। নতুন কোনো এজেন্ডা এনে সরকার জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করছে কি না, এমন প্রশ্ন উঠছে। তারা বিশেষ কোনো দলকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে কি না? ক্ষমতাকে প্রসারিত করার চেষ্টা করছে কি না? এসব প্রশ্ন নিয়ে জনমনে সন্দেহ শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, গত ১৬ বছর জনগণ তার পছন্দের দল ও জনপ্রতিনিধিকে ভোট দিতে পারেনি। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত সময়েই জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হতে হবে। এখানে অন্যকিছু (স্থানীয় সরকার) যোগ করলে জনমনে নানা সন্দেহ বাসা বাঁধতে শুরু করবে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন হয়ে গেছে। ভোটার তালিকা প্রস্তুতির কাজও চলছে। তাই ২০২৫ সালেই জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে ঘোষণা করতে হবে।
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, কোনো অবস্থাতেই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন মেনে নেব না। যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে ততই দেশের জন্য মঙ্গল। অতীতে দেশে নির্বাচিত সরকারই স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করেছে। সব সংস্কার করতে গিয়ে যেন লেজেগোবরে অবস্থা না করে ফেলে, তারা যে কাজটা করতে এসেছে সেই কাজটাই করা উচিত।
তিনি বলেন, ৩০০ আসনে জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষভাবে করাই বড় চ্যালেঞ্জ। এখন সাড়ে ৪ হাজার ইউনিয়নের পাশাপাশি পৌরসভা-উপজেলা নির্বাচন করতে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। কিংস পার্টিকে সহযোগিতা ও ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য স্থানীয় সরকার নির্বাচন সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘সর্বপ্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তার আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা মনে করি, স্থানীয় সরকার নির্বাচন কাঠামোর সংস্কার জরুরি। কারণ স্থানীয় সরকারের পুরো সিস্টেমই ভেঙে পড়েছে। তাই নির্বাচিত সরকারই স্থানীয় সরকারব্যবস্থা সংস্কার করবে এবং দক্ষ ও আর্থিক শক্তিশালী কাঠামো চালু করবে।’
তিনি বলেন, আগামী ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না দিলে দেশে নানা অপশক্তির উত্থান হতে পারে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করতে হবে।
পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও গণ অধিকার পরিষদ
জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী এখনো তার অবস্থান স্পষ্ট করছে না। যদিও রাজনৈতিকভাবে দলটি এখন কিছুটা বিএনপির বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে কি না, তা স্পষ্ট না করায় এখনো জামায়াতে ইসলামী ও গণ অধিকার পরিষদ কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক গোলাম মিয়া পরওয়ার বলেন, প্রধান উপদেষ্টা কোন নির্বাচন আগে হবে- তার বক্তব্য তা স্পষ্ট করেনি। সুতরাং স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হবে নাকি পরে হবে- এটি পরিষ্কার হওয়ার পরই জামায়াত তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে।
গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আলোচনা জরুরি। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিনক্ষণ ঘোষণা করল কিন্তু কোনো দল অংশ নিল না। তাই সবার সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আপত্তি নেই
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আপত্তি নেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির। ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমির সৈয়দ ফয়জুল করিম শায়েখ চরমোনাই খবরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে ভালো হবে, তাতেও আপত্তি নেই। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের ক্ষেত্রে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ভিন্ন দৃষ্টি ও সুবিধা-অসুবিধা থাকতে পারে। তবে জাতীয় নির্বাচন আগে হলেই দেশের জন্য মঙ্গলজনক।
এবি পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে কোনো সমস্যা নেই। সারা দেশে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে সরকার ও ইসি জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতিও সারতে পারবে।
নাগরিক কমিটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলেন, দুটি কারণে স্থানীয় নির্বাচন আগে হওয়া উচিত। প্রথমত, স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধি দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের লোকজন। তারা এখন ঠিকমতো কাজ করছেন না। এতে নাগরিক সেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। এ দায় সরকারই বহন করছে। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার আদৌ কাজ করছে কি না, প্রশাসন প্রভাবমুক্ত হয়েছে কি না, তা যাচাই করতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলো।