
নোয়াখালী জেলা আধুনিক তথ্য কমপ্লেক্স ভবনের কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কার্য সম্পাদনের জাল সনদে ২০২৩ সালে প্রায় ১৫ কোটি টাকার এই কাজ বাগিয়ে নেয় আওয়ামী লীগের একটি সিন্ডিকেট। এখন তারাই প্রভাবশালীদের হাত করে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে যেনতেনভাবে দায়সারাভাবে কাজ করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার আধুনিক এ কমপ্লেক্স (টেন্ডার আইডি-৮৬৬০৬৪) নির্মাণে ২০২৩ সালের ৩০ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করে গণপূর্ত বিভাগ। পরে ঠিকাদারদের দাখিল করা কার্য সম্পাদনের কাগজপত্র সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই না করে ওই বছরের ২ অক্টোবর যৌথ মালিকানাধীন মোস্তফা কনসোর্টিয়ামকে ১০ শতাংশ কমমূল্যে ১৩ কোটি ৩৮ লাখ ৪৯ হাজার ৬১৫ টাকায় ভবনটি নির্মাণের কার্যাদেশ প্রদান করেন কর্মকর্তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড সন্স, মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশন মিলে গঠন করে মোস্তফা কনসোর্টিয়াম। এই কনসোর্টিয়াম কাজটি পায়। কিন্তু কাজ পাওয়ার শর্ত হিসেবে শেষোক্ত দুই প্রতিষ্ঠানের দাখিল করা ১২টি কার্য সম্পাদন সনদের (ওয়ার্ক কমপ্লিশন সার্টিফিকেট) সব কটি ইতোমধ্যে ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। এ ঘটনায় নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে বাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কর্মরত) সা’দ মোহাম্মদ আন্দালিব ও উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. এমদাদুল হক মিয়ার জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, তথ্য ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না নোয়াখালী-৪ (সদর-সুবর্ণচর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ এবং মেসার্স সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশনের মালিক লুৎফুল লাহিল মাজিদ রাসেল নোয়াখালী-৩ (বেগমগঞ্জ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বেগমগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশিদ কিরণের ঘনিষ্ঠ। গোলাম মর্তুজা মুন্না গত ১৮ সেপ্টেম্বর সুধারাম মডেল থানায় দায়ের হওয়া বিস্ফোরক মামলার (নম্বর-২৭) এজাহারভুক্ত আসামি।
এদিকে জেলার আধুনিক এই কমপ্লেক্সের টেন্ডার পেতে কনসোর্টিয়ামের দুই ঠিকাদারের ছলচাতুরীর প্রমাণ মিলেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজ চার অর্থবছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ২১ কোটি ২৪ লাখ ৭৬ হাজার ২৫১ টাকার কাজ করেছে বলে কার্য সম্পাদনের সাতটি ভুয়া সনদ জমা দেয়।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফুল লাহিল মাজিদ রাসেলের মেসার্স সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশন তিন অর্থবছরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ৫৪ কোটি ৯৭ লাখ ৫৯ হাজার ২৭১ দশমিক ৭৭ টাকার কার্য সম্পাদনের পাঁচটি জাল সনদ জমা দেয়।
খবরের কাগজের হাতে আসা এসব কার্য সম্পাদন সনদে দেখা যায়, আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের দাখিল করা বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সনদের প্যাড ও লেখায় অসংখ্য ভুল। এ ছাড়া সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশনের দাখিল করা ২০২০ সালের ৫ জুলাইয়ের সনদে কর্মকর্তার স্বাক্ষর ওই বছরের ১৬ জানুয়ারি লেখা এবং ২০২০ সালের ৬ জুলাইয়ের সনদে আগের মাস জুনের ২৮ তারিখে স্বাক্ষর করা।
অন্যদিকে দাখিল করা এসব কার্য সম্পাদন সনদ ভুয়া এবং সঠিক নয় বলে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক (পূর্ত) মো. নজরুল ইসলাম, নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের (সাবেক আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজ) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. উজিরে আজম খান, বেগমগঞ্জ উপজেলার সাবেক প্রকৌশলী মো. হাফিজুল হক ও চৌমুহনী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক।
নোয়াখালী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. উজিরে আজম খান খবরের কাগজকে বলেন, ঠিকাদারের দাখিল করা কার্য সম্পাদন সনদগুলোর বিষয়ে মেডিকেল কলেজের রেকর্ডপত্র যাচাই করে এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
চৌমুহনী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মোজাম্মেল হক খবরের কাগজকে বলেন, কার্য সম্পাদন সনদগুলো যাচাই করে সঠিক পাওয়া যায়নি। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, এই কাজটি সম্পন্ন করার সর্বশেষ সময়সীমা ছিল গত বছরের ২ ডিসেম্বর। সরেজমিনে নির্মাণাধীন তথ্য ভবনে গিয়ে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকার বিল তুলে নেওয়া হলেও কাজের তেমন অগ্রগতি হয়নি। মেয়াদ শেষের পর গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভবনের প্রথম তলার ছাদ ঢালাই দেওয়া হয়েছে। তাও এতে গণপূর্তের কাজের নিয়ম ভেঙে স্টিলের সেন্টারিংয়ের পরিবর্তে বাঁশের সেন্টারিং ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্মাণকাজে নিম্নমানের এনজিএস সিমেন্ট, এসএস রডসহ নিম্নমানের ইট, পাথর, বালু, কণা ব্যবহার করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গণপূর্ত বিভাগের একাধিক ঠিকাদার বলেন, নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. এমদাদুল হক অনিয়ম করে অদক্ষ ঠিকাদারকে এ কাজ পেতে সহযোগিতা করেছেন। এখন তার তত্ত্বাবধানে চলা এই কাজে ব্যাপক অনিয়ম হলেও তিনি দেখেও না দেখার ভান করছেন।
যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মোস্তফা কনসোর্টিয়ামের মেসার্স মোস্তফা অ্যান্ড সন্সের মালিক মো. শহীদুল ইসলাম কিরণ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি এ কাজের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমি নির্মাণেও নাই, অর্থনৈতিক লেনদেনেও নাই। মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না কাজটি পাওয়ার স্বার্থে আমার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ব্যবহার করেছেন। কাগজে-কলমে আমার অনুমোদন নিয়ে তিনিই এখন সবকিছু দেখাশোনা ও লেনদেন করছেন।’
মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘বন্যার কারণে কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। তা ছাড়া স্টিলের পরিবর্তে বাঁশের সেন্টারিং ব্যবহার করা হয়েছে, বিষয়টি সত্য। আমরা গণপূর্ত বিভাগের কাছে বাঁশের সেন্টারিংয়ের বিল দাবি করব।’ নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
অন্যদিকে জাল সনদের বিষয়ে জানতে নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী (বর্তমানে বাহ্মণবাড়িয়া জেলায় কর্মরত) সা’দ মোহাম্মদ আন্দালিব, মেসার্স আল-আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক গোলাম মর্তুজা মুন্না ও মেসার্স সামছুন নাহার কনস্ট্রাকশনের মালিক লুৎফুল লাহিল মাজিদ রাসেলকে বারবার ফোন দিলেও তারা কেউ ধরেননি।
নোয়াখালী গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) মো. এমদাদুল হক মিয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঠিকাদারের কাজ পেতে সহযোগিতা করার বিষয়টি সঠিক নয়। আধুনিক ভবন নির্মাণে স্টিলের পরিবর্তে বাঁশের সেন্টারিং গণপূর্ত বিভাগ কখনোই অনুমোদন করে না। এ বিষয়ে ঠিকাদারদের বারবার সতর্ক করা হয়েছে। তারপরও তারা কথা শোনেননি। এ ব্যাপারে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’
গণপূর্ত বিভাগের নোয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. কামরুল হাছান খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমি আসার আগেই এ কাজের কার্যাদেশ (ওয়ার্ক অর্ডার) দেওয়া হয়েছে। এখন কার্য সম্পাদনের জাল সনদ, বাঁশের সেন্টারিং ও নিম্নমানের কাজের বিষয়গুলো প্রমাণিত হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। নির্দেশনা অনুযায়ী বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’