
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতের প্রকৃত ক্ষত আড়াল করতে জোরপূর্বকভাবে ব্যাংক মার্জারের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। এ জন্য একটি নীতিমালাও তৈরি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। পদ্মা-এক্সিমসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক মার্জারের প্রাথমিক চুক্তিও করা হয়েছিল। তবে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটা না হওয়ার অভিযোগে এবং সরকার পরিবর্তনের পর সেই উদ্যোগ আর আলোর মুখ দেখেনি। এ সময় ব্যাংক খাতের আরও গভীর ক্ষত সামনে চলে এসেছে। বাস্তবতা বিবেচনায় গভর্নর ১১টি ব্যাংকের পর্ষদ পরিবর্তনসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের ফরেনসিক অডিট পরিচালনার কাজ শুরু করেন। কাজ চলাকালেই আবারও আলোচনায় এসেছে ব্যাংক মার্জার প্রসঙ্গ।
সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘স্পেশাল রেজল্যুশন অ্যাক্ট অনুযায়ী কাজ চলছে, কিছু ব্যাংক মার্জ করা হবে। আরও অনেক কিছু করা যাবে, করা হবে।’
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, ‘সেমিনারে অনেক কিছু মাথায় রেখে অনেক সময় আগে থেকেই অনেক উদ্যোগের ঘোষণা দেওয়া হয়। তারই অংশ হিসেবে হয়তো গভর্নর এমন কথা বলেছেন। তবে বেশ কয়েকটি ব্যাংকে নিরীক্ষা কার্যক্রম চলছে। সেটা শেষ হলে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক চিত্র পাওয়া যাবে। তারপর ব্যাংক মার্জারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের ব্যাংকগুলোর ঝুঁকিভিত্তিক সমন্বিত নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার লক্ষ্যে যোগ্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি বিশেষ বিধান প্রণয়ন করেছে। এই বিধানবলে ব্যাংক কোম্পানি ও ব্যাংকিং নীতিমালার উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেছে, যারা নির্দিষ্ট ব্যাংকে গভীর নিরীক্ষা চালাবে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ ব্যাংক স্পেশাল রেজল্যুশন অ্যাক্ট চালু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আইন অনুযায়ী এই বিশেষ বিধান চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দেশের প্রায় ১২টি ব্যাংকে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা সংস্থার মাধ্যমে বিশেষ নিরীক্ষা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে।
রেজল্যুশন অ্যাক্টে বলা হয়েছে, ব্যাংকের সমন্বিত নিরীক্ষা বা তার অংশ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যোগ্য আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করবে। সমন্বিত নিরীক্ষাকাজের জন্য তফসিলি ব্যাংকগুলো যাতে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তাদের গ্রাহকদের বিষয়ে তথ্য জানায়, সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ এই বিধানের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে সাধারণ অনুমতি দিয়েছে। তফসিলি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম সমন্বয় করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট বিভাগকে দায়িত্ব দেবে। চুক্তি অনুসারে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। এরপর গভর্নর পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ওই প্রতিবেদন পরিচালনা পর্ষদের কাছে পেশ করবেন।
বিশেষ বিধানে সমন্বিত নিরীক্ষার সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে ঝুঁকিভিত্তিক বিস্তারিত নিরীক্ষা করা হবে, যার মধ্যে থাকবে সম্পদের মান পর্যালোচনা, করপোরেট সুশাসন পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং ব্যাংকের নীতি, পদ্ধতি, প্রক্রিয়া এবং আইন ও নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিবিধানের পরিপালন বিষয়ে পর্যালোচনা। এই বিধান জারি করার কারণ সম্পর্কে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও দেশের বেশ কিছু ব্যাংক বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। বিশেষ করে সম্পদের মান, করপোরেট সুশাসন, নীতিমালা এবং আইন ও বিধিবিধানের পরিপালনের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ফলে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সাধারণভাবে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি পুরো ব্যাংকিং খাতের বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘ব্যাংক মার্জার হচ্ছে একটা বিকল্প। সে রকম আরও অনেক বিকল্প রয়েছে। ব্যাংক মার্জ করা হবে, নাকি বিলুপ্ত করা হবে, নাকি যেভাবে আছে সেভাবেই চলবে, তা নির্ভর করবে ব্যাংকগুলোতে সম্পদের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য যে নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে, তার ফলাফলের ওপর। কেননা এর পরই ব্যাংকগুলোর প্রকৃত আর্থিক চিত্র পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে ব্যাংক মার্জার আইন এবং আমানতকারীদের সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে হবে। এগুলোর কাজ চলছে। ফলে নিরীক্ষা কার্যক্রম এবং আইন প্রণয়ন না করে ব্যাংক মার্জারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়।’
এদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) মতে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ব্যাংক অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে কিছু ব্যাংক খুবই নাজুক দশায় রয়েছে। এগুলোর অপ্রত্যাশিত ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা নেই। তাই এগুলোকে বন্ধ করার সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ব্যাংক অনুমোদন পেয়েছে। মূলত রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালিত কিছু ব্যাংক নাজুক দশায় রয়েছে। এসব ব্যাংক লাইফ সাপোর্টে, গ্রাহকরা ঝুঁকিতে। এসব ব্যাংকের অপ্রত্যাশিত ধাক্কা সামলানোর সক্ষমতা নেই। এ জন্য সার্বিক দিক বিবেচনায় লাইফ সাপোর্টে রাখা ব্যাংক বন্ধ করা যেতে পারে।’