
ঢাকার বিভিন্ন সড়কে সরকার নির্ধারিত কোনো বাস কোম্পানির অধীনে বাস পরিচালনা করতে এই বছরের শুরুতে বেশ আগ্রহ দেখালেও এখন আর তাতে রাজি নয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তাতে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) আর দুই সিটি করপোরেশনের বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পটি নিয়ে তাই এখন অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এই প্রকল্প আদৌ বাস্তবায়ন করা যাবে কি না তা নিয়েও নানা সংশয় দেখা দিয়েছে। প্রকল্পটি ভেস্তে গেলে সরকারের ২৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা গচ্চা যাবে।
রাজধানীর সড়ক ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে ৪২টি রুট পুনর্বিন্যাসের কথা বলা হয়েছিল বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পে। ঢাকার ৩৮৮টি রুটকে সমন্বয় করে প্রাথমিকভাবে ৪২টি রুটে পুনর্বিন্যাস করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা। বাস মালিকদের চরম অসহযোগিতায় এই প্রকল্পটি আর আলোর মুখ দেখবে না বলেও মনে করছেন গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকার সড়ক পরিবহন খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে বাস রুট র্যাশনালাইজেশন বা ঢাকা নগর পরিবহন প্রকল্প শুরুতে প্রশংসা কুড়ায় নগরবাসীর। নির্দিষ্ট কাউন্টার থেকে ওঠানামা করার সুবিধার পাশাপাশি বাসে বাসে রেষারেষি বন্ধ, যাত্রী নেওয়ার প্রতিযোগিতা বন্ধ হওয়ায় এ প্রকল্প নিয়ে উচ্চাশা প্রকাশ করেছিলেন বাসযাত্রীরা।
বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাজধানীর বিভিন্ন বাস রুটকে ৯টি ক্লাস্টারে (৯টি ভিন্ন ভিন্ন রঙের) বিভক্ত করার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ২২টি কোম্পানি গঠনের প্রস্তাবও এসেছিল। গোলাপি রঙের গুচ্ছে চারটি, নীল গুচ্ছে চারটি, লাল গুচ্ছে পাঁচটি, কমলা গুচ্ছে ছয়টি, সবুজ গুচ্ছে আটটি, বেগুনি গুচ্ছে ছয়টি, নর্থ গুচ্ছে তিনটি, নর্থ ওয়েস্ট গ্রুপে তিনটি, সাউথ গুচ্ছে দুটি রুট পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
কিন্তু ২০১৯ সালে এসে সেই প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ে। এই প্রকল্পের মডেল রুটগুলোতে বিভিন্ন কোম্পানির বাস চলাচল করায় ঢাকা নগর পরিবহন ক্রমাগত লোকসানে পড়ে। এখন ঢাকা নগর পরিবহনে খোদ বিআরটিসিই বাস পরিচালনা করছে না।
গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে ‘সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা জোরদারকরণ, ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসন এবং বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ’ সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পের আওতায় গ্রিন ক্লাস্টারের ৯টি রুটে বাস চলাচলের ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেন। নগরের পরিবহন খাতকে শৃঙ্খলায় আনতে এ প্রকল্পের গুরুত্বারোপ করেন সড়ক খাত সংশ্লিষ্টরা।
এরপর গত ১২ নভেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বাস রুট র্যাশনালাইজেশন কমিটির ২৮তম সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ডিটিসিএ ২৪, ২৫, ২৭ এবং ২৮ নং রুটে নতুন করে বাস পরিচালনায় আগ্রহী মালিকদের কাছ থেকে আবেদন নেবে। পাশাপাশি ঢাকার অন্য ৩৮টি রুটেও নির্দিষ্ট বাস কোম্পানির অধীনে বাস পরিচালনা করতে আগ্রহী মালিকদের আবেদনপত্র জমা দিতে নির্দেশনা আসে ওই সভা থেকে।
বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকার ৪২টি রুটে ২৫০টিরও বেশি কোম্পানি থেকে বাস পরিচালনার আবেদন পাওয়া গেছে। সম্মিলিতভাবে এসব বাসের সংখ্যা ৩ হাজারের বেশি। এরপর গত ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে এসব বাসের মালিকদের সঙ্গে তিন দফায় সভা করেছে ডিটিসিএ। ডিসেম্বর মাসে একটি গণশুনানিরও আয়োজন করা হয়। গত ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত বাস মালিকরা বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পে বাস চালাতে দারুণ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যায় ১৫ জানুয়ারির পরে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে যে বাস মালিকরা যেসব বাসের আবেদন করেছিলেন, সেসব বাসের অধিকাংশের ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট নেই। রুট পারমিট ও ফিটনেস সনদবিহীন এই সব বাস নিয়ে যখন আপত্তি উঠে প্রকল্পের সভায়, তখন বাস মালিকরাও বেঁকে বসেন। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সভায় ২০ বছরের বেশি বয়সী বাসগুলো ঢাকার সড়ক থেকে তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাস মালিকরা বলেন, হুট করে বললেই এসব বাস সড়ক থেকে তুলে নিলে সড়কে গণপরিবহন সংকট শুরু হবে। আর ঢাকার সড়কে বাস চলাচলের জন্য তারা ঢাকা মেট্রো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির (আরটিসি) অনুমোদন নিয়েছেন।
গত ২১ জানুয়ারি ঢাকা মেট্রো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কমিটির (আরটিসি) সভা শেষে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা সিদ্ধান্ত নেন, ঢাকার বাস মালিকরা কোনো রুটে কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে বাস চালাবেন না। ঢাকা সড়ক পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে। সেই ডিটিসিএর কোনো সিদ্ধান্ত মেনে নিতে অস্বীকৃতিও জানিয়েছেন বাস মালিকরা।
এরপর বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পটি যেন ভেস্তে না যায়, সেজন্য জোর চেষ্টা করছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একাধিক সভায় আহ্বান জানানোর পরেও বাস মালিকদের কেউ আসেননি। কয়েকজন বাস ব্যবসায়ী ব্যক্তিগতভাবে বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বলেন, ‘বাস মালিক সমিতি থেকে আমাদের এখানে আসতে নিষেধ করে দিয়েছে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ মো. হাদিউজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ঢাকার বাস রুটকে শৃঙ্খলায় আনতে এলে কোনো প্রকল্প নয়, দরকার একটি সরকারি গণপরিবহন কর্তৃপক্ষ। ঢাকার সব বাস নির্দিষ্ট রুটে পরিচালনা করা ডিটিসির কাজ নয়। তারা গণপরিবহ5ন চলাচলে যেসব কর্তৃপক্ষ কাজ করে তাদের মধ্যে সমন্বয় ধরে রাখবে। তাদের এত জনবল নেই যে বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকার গণপরিবহনকে শৃঙ্খলায় আনার কাজটি পুরোপুরি রাজনৈতিক। এখানে একটি নতুন বিজনেস মডেল তৈরি করতে হবে; যেখানে বাস মালিকদের লাভ দেখতে হবে।’
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ-ডিটিসির নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, ‘বাস মালিকরা ডিটিসির অধীনে বাস রুট পরিচালনা করতে দেবেন না, ভালো কথা। নিজেরা করতে চাইছেন; তো করুক। তাতে সমস্যা নেই। তবে একটা শৃঙ্খলায় তো আসতে হবে তাদের।’
বাস রুট র্যাশনালাইজেশন প্রকল্পে বাস চালাতে গেলে ভর্তুকির দাবি জানিয়েছেন বাস মালিকরা। এ বিষয়ে নীলিমা আখতার বলেন, ‘প্রকল্পে আমরা সাবসিডির বিষয়টি উল্লেখ করি নাই। সেখানে ব্যাংক লোনের কথা বলা আছে। তবে বাস মালিকদের সরকারের পক্ষ থেকে কীভাবে সাবসিডি দেওয়া যায়, সেটার জন্য একটা আলাদা পরিকল্পনা নিতে হবে।’
প্রকল্পটি যেন ভেস্তে না যায় সে লক্ষ্যে বেসরকারি বাস মালিকদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক মেয়াদকাল রয়েছে, এমন সব বাস চাওয়া হচ্ছে বলেও জানান ডিটিসির নির্বাহী পরিচালক। তিনি আশা করছেন, বাস মালিকদের পাশাপাশি এখন বৃহৎ কোনো দাতা প্রতিষ্ঠান এ খাতে যুক্ত হবেন।