ঢাকা ১ চৈত্র ১৪৩১, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
English

স্বাস্থ্যসংস্কার প্রস্তাব রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব বিএনপির, চিকিৎসায় নাগরিক কমিটি

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৬:০০ এএম
আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৫৭ পিএম
রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব বিএনপির, চিকিৎসায় নাগরিক কমিটি
ছবি: সংগৃহীত

দেশে রোগীদের রোগের তথ্য সংরক্ষণে নেই নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা। এক হাসপাতালে দেখানোর পর আরেকটিতে গেলে যাবতীয় কাগজ নিয়ে যেতে হয়। তা না হলে ওই চিকিৎসক জানতেই পারেন না আগের হাসপাতাল থেকে রোগী কী ধরনের চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন, কী কী পরীক্ষা করিয়েছেন। তা ছাড়া দুই বছর, তিন বছর কিংবা আরও আগের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসকের দেওয়া ব্যবস্থাপত্র রোগীরা খুব একটা সংরক্ষণ করে রাখেন না। তথ্য সংরক্ষণ না থাকায় রোগের ইতিহাস জানা যায় না, বারবার পরীক্ষা করতে হয়, সময় নষ্ট হয় এবং চিকিৎসায় ভুলের ঝুঁকি বাড়ে।

ঝুঁকি এড়িয়ে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আধুনিক, সমৃদ্ধ এবং সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিতে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় নাগরিক কমিটি। অগ্রাধিকার দেওয়া সাতটির মধ্যে অন্যতম জাতীয় ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড (ইএইচআর) ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি। বিএনপির স্বাস্থ্য সংস্কার প্রস্তাবেও এ বিষয়টি এসেছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিএনপিও স্বাস্থ্য সংস্কার প্রস্তাব জমা দিয়েছে।

এর আগে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, এনডিএফ, ড্যাবসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে বিভিন্ন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিএনপির প্রস্তাবে রোগ প্রতিরোধের বিষয়টি খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। নাগরিক কমিটির প্রস্তাবে প্রতিরোধের চেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে চিকিৎসার বিষয়টি। বিভিন্ন দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত দেওয়া স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার প্রস্তাবে উপেক্ষিত পুষ্টি ও নারীস্বাস্থ্য।

কমিশনের সদস্যরা মনে করছেন, এই বিষয়গুলোতেও জোর দেওয়া প্রয়োজন। তারা যে প্রস্তাব পেয়েছেন, তাতে যেগুলো বাদ পড়েছে তা যুক্ত করে চলতি মাসেই একটি সুন্দর প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করবেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ড. ইউনূস শপথ গ্রহণ করেন। এরপর খাতভিত্তিক সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। সেই অনুযায়ী সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।

স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদকে প্রধান করে গত বছরের ১৮ নভেম্বর ১২ সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়। ৯০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সব মতামত বিবেচনা করে প্রস্তুত করা প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তরের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সেই অনুযায়ী আগামীকাল ১৭ ফেব্রুয়ারি ৯০ দিন পূর্ণ হবে। তবে এর মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারবে না কমিশন। আরও হয়তো সময় চাইবে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের প্রধান বলছেন, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই প্রতিবেদন হস্তান্তর করবেন। তবে কমিশনের কেউ কেউ মনে করছেন, মার্চের মাঝামাঝির আগে প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে না। কারণ স্বাস্থ্য খাতের পরিসর অনেক বড়। দেশে ১৮ কোটি মানুষের সবাই স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট। তাই এই খাত সংস্কারের কাজটি বেশ সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে।

কমিশনপ্রধান অধ্যাপক এ কে আজাদ বলেন, ‘বহু প্রস্তাব পেয়েছি। সেগুলো গুছিয়ে লেখা হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে না। মেয়াদ বাড়ানোর জন্য দরখাস্ত করছি। তবে এই মাসের মধ্যেই প্রতিবেদন দিয়ে দেব।’

গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডে স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশন কার্যালয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক, স্বাস্থ্য পলিসি এবং অ্যাডভোকেসি সেলের সম্পাদক ডা. তাসনিম জারার নেতৃত্বে ৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল সংস্কার প্রস্তাব জমা দেয়। এই প্রস্তাবে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা জানান তিনি।

সেগুলো হলো জরুরি স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন ও আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স সিস্টেম, একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম চালু করা, স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য উন্নত কর্মপরিবেশ ও ন্যায্য পারিশ্রমিক, সারা দেশে ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা (ইএইচআর) চালু করা, চিকিৎসার জন্য প্রমাণভিত্তিক জাতীয় গাইডলাইন, একটি জাতীয় বায়োব্যাংক স্থাপন ও সরকারি উদ্যোগে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য তথ্য প্ল্যাটফর্ম চালু করতে সুপারিশ করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই সাতটি প্রস্তাবের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ও পুষ্টির বিষয় আসেনি। এখানে রোগ হওয়ার পরে চিকিৎসার বিষয়ে গুরুত্ব পেয়েছে।

বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান ও কমিশন সদস্য অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধের কথাটা আমাদের আগে চিন্তা করা উচিত।’

গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের কার্যালয়ে স্বাস্থ্য সংস্কার প্রস্তাব হস্তান্তর করেছে। এর আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী খোন্দকার ড. মোশাররফ হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় স্বাস্থ্য খাত সংস্কার প্রস্তাব (খসড়া) তুলে ধরেন।

বিএনপির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘একটি পরিকল্লিত স্বাস্থ্যনীতির অনুপস্থিতি, চিকিৎসক-চিকিৎসা প্রার্থীর সম্পর্ক উন্নয়ন, প্রতিরোধই যে প্রতিকারের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ’ এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা।

বিএনপির প্রস্তাবে রোগ প্রতিরোধের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিএনপি স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে প্রস্তাব দিয়েছে। স্বাস্থ্যের সামগ্রিক বিষয় চলে এসেছে ওই প্রস্তাবে। দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, স্বাস্থ্য পর্যটন উপযোগী একটি আন্তজার্তিক মানের স্বাস্থ্য পরিকাঠানো নির্মাণ করা।

বিগত ১৫ বছর দেশের স্বাস্থ্য খাতে পরিকল্পিত উদাসীনতা ও দুর্নীতির ব্যাপকতার মাধ্যমে অতি সাধারণ চিকিৎসার জন্যও ক্রমবর্ধমান বিদেশ গমনের প্রবণতা, দেশীয় সেবার প্রতি জনগণকে বিমুখ করার ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কারের অগ্রাধিকারের বিবেচনায় রাখারও প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি। সুষ্ঠু তদন্ত ও পর্যালোচনার মাধ্যমে ১৫ বছরের অনিয়ম-দুর্নীতির নিরপেক্ষ অনুসন্ধান ও দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিতের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

বিএনপির প্রস্তাবে সংক্রমক এবং অসংক্রমক রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, কমিউনিকেশন স্কিল বৃদ্ধিতে চিকিৎসা শিক্ষায় বিশেষ জোর দেওয়া, প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্কুলে ফাস্ট এইডের প্রয়োগিকভাবে শিক্ষা এবং পরিবহন শ্রমিকদের জন্য বাধ্যতামূলক ফাস্ট এইড, সিপিআর ও রেসকিউ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।

নাগরিক কমিটির অগ্রাধিকার দেওয়া সাতটি বিষয়ের মধ্যে পাঁচটি বিষয়ের সঙ্গে বিএনপির প্রস্তাবে মিল আছে। রেফারেল সিস্টেম, জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবার নিশ্চয়তা, চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীকে ন্যায্য অধিকার ও সুরক্ষা, ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড ব্যবস্থা চালু ও গবেষণা- এই বিষয়গুলো বিএনপি এবং নাগরিক কমিটি উভয়ের প্রস্তাবে এসেছে।

নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারা বলেছেন, বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থা বিপর্যস্ত। অনেক রোগী সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স পান না, হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই অনেকে মারা যান। সে জন্য একটি আধুনিক জরুরি সেবাব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক থাকবে, যাতে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। এখনকার মতো শুধু রোগী পরিবহনের পরিবর্তে অ্যাম্বুলেন্সেই জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা শুরু হবে, যা মৃত্যুহার কমাতে সাহায্য করবে।

এ ছাড়া সরকারি উদ্যোগে নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্ল্যাটফর্মের প্রস্তাব দিয়েছে নাগরিক কমিটি। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নাগরিক কমিটি জানায়, অসুস্থ হলে অনেকেই গুগল বা সামাজিক মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ খোঁজেন, যেখানে ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি। এর ফলে অনেকে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পান না। এই সমস্যা সমাধানে একটি সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত, নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্ল্যাটফর্ম চালু করতে সুপারিশ করা হয়েছে। 

রোগ প্রতিরোধ, পুষ্টি এবং নারীস্বাস্থ্যের বিষয় তাদের প্রস্তাবে গুরুত্ব পেয়েছে কি না জানতে চাইলে নাগরিক কমিটির সদস্য ডা. মিনহাজুল আবেদীন বলেন, ‘কিছু কিছু কাভার করবে। সবকিছু কাভার করতে পেরেছি এ রকম না। আমাদের চিকিৎসা খাত খুবই অগোছালো। অনেক বিষয় আছে। সে কারণে আমরা চিকিৎসার বিষয়ে জোর দিয়েছি।’

নাগরিক কমিটির সদস্য ডা. আশরাফুল আলম সুমন বলেন, ‘প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদারের মধ্যে রোগ প্রতিরোধের বিষয়টি চলে আসে। সেই বিষয়টি আমাদের প্রস্তাবে আছে।’

কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য-সহায়তা ট্রাস্টের সভাপতি ও স্বাস্থ্য খাত সংস্কার কমিশনের সদস্য ড. আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘রোগ প্রতিরোধ এবং স্বাস্থ্য উন্নয়নে জোর দিতে হবে। যেমন পুষ্টি বা ফ্যামিলি প্ল্যানিং স্বাস্থ্য উন্নয়নের জন্য এগুলো লাগে। যদি স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ঘটাতে পারি আর রোগ প্রতিরোধ করতে পারি এবং নিচের দিকে এগুলোকে যদি ট্যাকল করতে পারি, তাহলে ওপরের দিকে আর যেতে হবে না। আমাদের দরকার নিচের দিকে শক্তিশালী করা।’

বিএনপি, ড্যাব, এনডিএফ, জামায়াত ও নাগরিক কমিটি সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রতিরোধ-প্রতিকারের ওপর বেশ জোর দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুষ্টির বিষয়টা ওইভাবে আসেনি। পুষ্টির বিষয়ে আরেকটু জোর দিতে হবে।’

নির্ধারিত ৯০ দিনে প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মনে হয় না। স্বাস্থ্য, পুষ্টি, পরিবার পরিকল্পনা, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি, ওষুধ, জনবল, প্রাইভেট সেক্টর, পাবলিক সেক্টর। স্বাস্থ্যের পরিসর অনেক বড়। এখনো অনলাইন সার্ভে হচ্ছে। কয়েক দিন মধ্যে হয়তো রিপোর্ট পাব। আমাদের চর এলাকায় এখনো যাওয়া হয়নি। হয়তো এই মাসের মাঝামাঝি আমরা যাব। আমরা গ্রাফটিং শুরু করেছি। কিন্তু মজবুত একটা জিনিস দিতে গেলে আরেকটু চিন্তাভাবনা করা লাগে। আমাদের কেউ কেউ বলছেন, এ মাসের মধ্যে দিতে পারব। কিন্তু আমার মনে হয় না আমরা দিতে পারব। আমি সাজেস্ট করব, কমিশনকে মার্চের মাঝামাঝি দিতে।’

বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান ও কমিশন সদস্য অধ্যাপক ডা. সায়েবা আক্তার বলেন, ‘বিভিন্ন সংগঠন ও দলের কাছ থেকে যে প্রস্তাব এসেছে, তাতে উপেক্ষিত নারীস্বাস্থ্য। নারীস্বাস্থ্য নিয়ে আমরা নিজেরা চেষ্টা করছি। বাকিরা যারা আছে, তারা কেউ নারীস্বাস্থ্যের কথা বলে না। পুষ্টির কিছু বিষয় আসছে। নারীস্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সংস্কার কমিশনে নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলা হচ্ছে। আমরাও প্রস্তাব রেখেছি। নারীস্বাস্থ্য বলতে আমরা সাধারণত মাতৃস্বাস্থ্য বুঝি। কিন্তু এর বাইরেও নারীদের স্বাস্থ্যের অনেক কিছু আছে। সেগুলো কিন্তু অ্যাড্রেস করা হয় না। তা নিয়ে আমরা কথা বলছি। অনেক ধরনের স্পেশালাইজড হসপিটল আছে কিন্তু নারী স্বাস্থ্যের ওপর স্পেশালাইজড হাসপাতাল নেই। এটা মেয়েদের প্রয়োজন এবং অধিকার দুটিই।’

নিহত রিকশাচালকের ৬ মেয়ের দায়িত্ব নেবে কে?

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩৩ এএম
আপডেট: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০৯:৫২ এএম
নিহত রিকশাচালকের ৬ মেয়ের দায়িত্ব নেবে কে?
রিকশাচালক রুহুল আমিনের ছয় মেয়ে। ছবি: খবরের কাগজ

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী পৌর সদরে একটি পূরবী বাসের চাপায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক রুহুল আমিন। তার ঘরে কোনো ছেলেসন্তান না থাকলেও রয়েছে ছয় মেয়েসন্তান। এখন জনমনে প্রশ্ন, অভাব-অনটনের সংসারে বড় হওয়া এ ছয় মেয়েসন্তানের দায়িত্ব নেবে কে? এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্থানীয়দের জনমনে।

এক স্ত্রী ও ছয় মেয়ের ভরণপোষণের একমাত্র ভরসা ছিলেন রুহুল আমিন। সারা দিন পরিশ্রম করে রিকশাচালিয়ে যা আয় হতো তা দিয়ে চলত সংসার ও মেয়েদের পড়ালেখার খরচ। মৃত্যুর আগে ছয় মেয়েকে ঈদের নতুন জামা-কাপড়ও কিনে দিয়ে যেতে পারলেন না তিনি। বাবার মৃত্যুর শোকে ছয় মেয়ের কান্না যেন থামছেই না।

জানা যায়, একটি ছেলেসন্তানের আশায় একের পর এক ছয় মেয়েসন্তানের জন্ম হয়েছে রিকশাচালক রুহুল আমিনের সংসারে। তার ছয় মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে উম্মে সোলতানা চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের একাদশ শ্রেণিতে অধ্যায়নরত। দ্বিতীয় মেয়ে তাসফিয়া সোলতানা রিপা দোহাজারী জামিজুরী গার্লস হাই স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তৃতীয় মেয়ে আলিফা পড়ে জামিজুরী মাদ্রাসার চতুর্থ শ্রেণিতে। চতুর্থ মেয়ে ওয়াকিয়া পড়ে একই মাদ্রাসার দ্বিতীয় শ্রেণিতে। পঞ্চম মেয়ে ফাতেমার বয়স আড়াই বছর ও ষষ্ঠ মেয়েটির বয়স মাত্র ২৫ দিন। এখনো পর্যন্ত ষষ্ঠ মেয়ের নামও রাখা হয়নি।

নিহত রিকশাচালক রুহুল আমিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জরাজীর্ণ দুই কক্ষবিশিষ্ট ছোট্ট একটি সেমিপাকা ঘরে স্ত্রী ও ছয় মেয়ে নিয়ে গাদাগাদি করে বসবাস করে আসছিলেন রিকশাচালক রুহুল আমিন। তার ছয় মেয়ে ঘরের এক পাশে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন বাবার শোকে। কিছু বোঝার বয়স না হলেও অন্য বোনদের কান্নায় বড় বোন উম্মে সোলতানার কোলে অবিরাম কান্না করছে মাত্র ২৫ দিন বয়সী শিশুটিও। আড়াই বছরের শিশু ফাতেমা, দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া ওয়াকিয়া এবং চতুর্থ শ্রেণির আলিফাও কাঁদছে বড় বোন উম্মে সোলতানা ও মেঝো বোন তাসফিয়া সোলতানা রিপার পাশে দাঁড়িয়ে। তারা ছয় বোনের কান্না যেন থামছেই না। তাদের আর বুঝতে বাকি নেই যে সন্তানের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল বাবা তাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

নিহত রিকশাচালক রুহুল আমিনের ছোট ভাই রুহুল কাদের বলেন, ‘আমার বড় ভাই প্রায় তিন বছর ধরে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে পরিবারের ভরণপোষণ ও ছয় মেয়ের পড়ালেখার খরচ বহন করে আসছিলেন। অন্য দিনের মতো গত বৃহস্পতিবারও তিনি যাত্রী নিয়ে দোহাজারী পৌর সদরে গিয়েছিলেন। চট্টগ্রামমুখী একটি পূরবী বাস আমার বড় ভাইয়ের রিকশার পেছন থেকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। তার সংসারে ছয় মেয়ে রয়েছে। এখন তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? তাদের পড়ালেখার খরচ কে চালাবে?’

টানা আন্দোলন-কর্মসূচিতে অতিষ্ঠ নগরবাসী

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম
টানা আন্দোলন-কর্মসূচিতে অতিষ্ঠ নগরবাসী
ছবি: খবরের কাগজ

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর নানা দাবিতে ২০০-এর বেশি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এসব কর্মসূচি পালনের সময় গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করায় ভোগান্তি বেড়েছে নগরবাসীর। সপ্তাহের অধিকাংশ কর্মদিবসে এসব কর্মসূচির কারণে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন বিভিন্ন পেশার মানুষ। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন দায়িত্ব নেওয়া বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলকে দাবি আদায়ের মোক্ষম সময় বলে মনে করেছেন আন্দোলনকারীরা। 

যৌক্তিক-অযৌক্তিক ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর এসব কর্মসূচি ঘিরে দুর্ভোগও পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। টানা এসব কর্মসূচির কারণে বিরক্ত হয়ে বেসরকারি চাকরিজীবী রাজধানীর খিলক্ষেতের বাসিন্দা মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত সোমবার বনানীতে অবরোধ করা হয়। গুগল ম্যাপে দেখলাম অফিসে যাওয়ার সব রাস্তায় রেড কালার। সর্বত্র যানজট। রোজার দিনে এসব কর্মসূচি আমাদের ভোগান্তিতে ফেলছে।’

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন দাবিতে সরব নানা পক্ষ। চাকরি স্থায়ীকরণ, সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ভাতা বৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, এমপিওভুক্তিসহ নানা দাবি জানাচ্ছেন তারা। সরকারের প্রথম ৪৬ দিনে ঢাকা শহরে ৬৪টি সংগঠনের পক্ষ থেকে ৩৬০টি দাবি উত্থাপন করা হয়। দেশের অন্য বিভাগীয় শহরগুলো বিবেচনায় নিলে দাবির সংখ্যা হাজারের বেশি।

রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি অবরোধ করা হয় শাহবাগ মোড়। গুরুত্বপূর্ণ এ মোড়ের আশপাশে রয়েছে একাধিক হাসপাতাল। কর্মসূচির কারণে এসব হাসপাতালের রোগীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ফেব্রুয়ারিতেই নিয়োগ বাতিল হওয়া প্রাথমিক শিক্ষক, এনটিআরসিএর সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষক, শহিদ পরিবারের সদস্যরা শাহবাগ অবরোধ করেন। চলতি মাসেই ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারীরা অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। চাকরি ফিরে পেতে বিডিআর সদস্যরাও শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন।

রাজধানীর একটি স্পটে অবরোধ করা হলে প্রধান সড়কের পাশাপাশি তার প্রভাব পড়ে অলিগলিতেও। কর্মসূচির কারণে সচিবালয়ে আটকা পড়েন কর্মকর্তারা। দীর্ঘ সময় আটকা পড়ে অনেকে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভোগেন। যান চলাচল বন্ধ হয়ে হওয়ার কারণে অনেকে হেঁটে গন্তব্যে রওনা দেন। যাদের সঙ্গে মালপত্র ছিল, দ্বিগুণ হয় তাদের কষ্ট। বাধ্য হয়ে বাসেই বসে থাকতে হয়। রাতেও প্রায় একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় রাস্তায় বের হওয়া যাত্রীদের। তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের কারণে গুলশান-বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, বিজয় সরণি, জাহাঙ্গীর গেট ও মগবাজার এলাকায় তৈরি হয় ভয়াবহ যানজট। জুলাই আন্দোলনে আহতরাও পঙ্গু হাসপাতালের সামনে সড়ক অবরোধ করেন। তাদের কর্মসূচির কারণে হাসপাতালে আসা রোগীরাও হয়রানির মুখে পড়েন। 

শাহবাগের পরই বেশি কর্মসূচি পালন করা হয় জাতীয় প্রেসক্লাব ও সচিবালয় এলাকায়। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের আশপাশে এসব কর্মসূচি যেমন যানজট তৈরি করে, তেমনি সচিবালয়ে কর্মরতদেরও ভোগান্তিতে পড়তে হয়। একাধিকবার ঘেরাও করা হয় সচিবালয়। এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা তো সচিবালয়ে অবস্থান নিয়ে পরীক্ষা বাতিল করার দাবি মেনে নিতে বাধ্য করে। আবার পরীক্ষার ফলের পর ফেল করা শিক্ষার্থীরা অটোপাসের দাবি জানিয়েও সচিবালয় ঘেরাও করে। অভ্যুত্থানের পর পরই আনসার সদস্যরা সচিবালয় ঘেরাও করলে উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে দেওয়ার দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সচিবালয় অভিমুখে কর্মসূচি পালন করেন। বাদ যাননি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ট্রাস্টি বোর্ডের অনিয়ম বন্ধের দাবিতে কর্মসূচি পালন করেন প্রাইমএশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

জাতীয় প্রেসক্লাবে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, শতভাগ উৎসব ভাতা, সরকারি কর্মচারীদের মতো একই হারে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার দাবিতে টানা আন্দোলন করেন শিক্ষকরা। পরে শিক্ষা উপদেষ্টা তাদের দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। নন-এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও টানা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেন। 

আন্দোলন করেন বিভিন্ন স্তরের শ্রমিকরাও। বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে তারা কর্মসূচি পালন করেন। হাইকোর্টের রায় ঘিরে ব্যাটারিচালিত রিকশার চালকরা ঢাকার একাধিক পয়েন্টে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। এতেও ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয় জনসাধারণকে। প্রধান সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করার দাবিতে প্যাডেলচালিত রিকশার চালকরাও রাস্তায় নামেন। অন্যদিকে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালকরা দুই দফায় ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন। গাড়ির দাম ও দৈনিক জমা কমানোর দাবিতে তারা এই কর্মসূচি পালন করেন। সর্বশেষ মিটারে গাড়ি না চালালে জরিমানার বিধান বাতিলের দাবিতে তারা অবরোধ কর্মসূচি পালন করলে বিআরটিএ সেই বিধান বাতিল করে।

স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে সরকারি তিতুমীর কলেজের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা ছিল দেশজুড়ে। তারা সড়ক অবরোধের পাশাপাশি মহাখালীতে রেললাইনও অবরোধ করেন। শিক্ষার্থীদের ছোড়া ঢিলে রক্তাক্ত হন শিশুসহ ট্রেনের যাত্রীরা। টানা এই কর্মসূচি ঘিরে নগরবাসীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। পরে সরকার দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে তারা কর্মসূচি স্থগিত করেন। আবার সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল ইস্যুতে সংঘর্ষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা কলেজসহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একাধিকার সংঘর্ষের কারণে যান চলাচল বন্ধ থাকে। ট্রেইনি চিকিৎসকরা তাদের ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে কয়েক দফায় আন্দোলনে নামেন। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইরশাদ মাহমুদ বলেন, রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকা অবরোধ করে সাধারণ মানুষকে একপ্রকার জিম্মি করে ফেলা হচ্ছে। সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া সুশৃঙ্খলভাবে জানানো উচিত।

তবে বিশেষজ্ঞরা দাবি জানানোর বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীনের মতে, মানুষ দীর্ঘদিন দাবি-দাওয়া আদায়ের সুযোগ না পাওয়ায় সরকার পরিবর্তনে এসব বেড়েছে। তাই সরকারকে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

অন্যদিকে জনদুর্ভোগ তৈরি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম। তিনি বলেন, কেউ দাবি আদায়ের নামে রাস্তা আটকাবেন না। সামনে ঈদ, সড়ক অবরোধ করে জনগণের ঈদযাত্রায় ভোগান্তি বয়ে আনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর সরকার

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০১:৩৮ পিএম
আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০২:০৫ পিএম
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর সরকার
সভা-সমাবেশের ওপর ডিএমপি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর রাজধানীর শাহবাগে ডিবি পুলিশের টহল। ছবি: খবরের কাগজ

আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে এবার কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দাবি আদায়ের নামে সড়ক অবরোধ, জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি, পুলিশের ওপর হামলা, ছিনতাই-ডাকাতিসহ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সে অনুসারে ইতোমধ্যেই প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে পুলিশ, র‌্যাবসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।

এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) থেকে রাজধানী ঢাকায় বাংলাদেশ সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।

অন্যদিকে গাজীপুরে শিল্প-পুলিশের একটি অনুষ্ঠানে হুঁশিয়ারি দিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, দাবি আদায়ের নামে রাস্তা অবরোধ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে গত ৯ মার্চ সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে ‘কোর সভা’ শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর যেকোনো আক্রমণ বরদাশত করা হবে না। এখন থেকে কঠোর হস্তে তা দমন করা হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পুলিশের ওপর একের পর এক হামলা-অবজ্ঞা, কথায় কথায় আন্দোলন, দাবি আদায়ের নামে সড়ক অবরোধ, জনভোগান্তি সৃষ্টি, প্রকাশ্যে বেপরোয়া ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনার প্রেক্ষাপটে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতির প্রয়োজনে সর্বোচ্চ কঠোরতা দেখাবে পুলিশ। এরই মধ্যে এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও মাঠপর্যায়ে দেওয়া হয়েছে কড়া নির্দেশনা। 

পুলিশ সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর ২৩০টির বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৭০টির মতো ঘটনা বেশি আলোচনায় আসে। এসব ঘটনার বাইরেও সড়কে পুলিশ সদস্যরা হামলার শিকার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের মিছিল থেকেও পুলিশের ওপর হামলার চেষ্টা হয়। যদিও সেদিন কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেখানে পুলিশকে সহযোগিতার জন্য সেনাবাহিনীও বেশ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার শাহবাগে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন থেকে পুলিশের ওপর হামলা হয়। সেখানেও পরে পুলিশ কঠোর ‘অ্যাকশন’ চালায়। মূলত এখন থেকে ধীরে ধীরে আরও কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের গণমাধ্যম শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর খবরের কাগজকে বলেন, আইনেই বলা আছে- আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে পুলিশের ওপর হামলা বা সরকারি কাজে বাধা দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব অপরাধকারীর বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। আইন অনুযায়ী এসব বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুলিশ যে ধাক্কা (৫ আগস্টের প্রেক্ষাপট) খেয়েছে, সেখান থেকে উঠে আসার জন্য যা করা দরকার তা নানা কারণে পুলিশ করতে পারছে না। তাদের মনোবল একেবারেই ভঙ্গুর। প্রতিনিয়তই তারা বিভিন্নভাবে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। প্রতিনিয়ত এগুলো আমরা দেখছি। এই অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য বাহিনীর সবাই যেভাবে চেষ্টা করছেন, সেই চেষ্টাটা আরও একটু দৃশ্যমান করতে হবে। অপরাধ দমনের জন্য পুলিশের দৃশ্যমান অ্যাকশন এই মুহূর্তে খুব দরকার। এই দৃশ্যমান অ্যাকশনগুলো যদি খুব ভালো হয় বা শক্ত হয় বা কঠিন হয়, তাহলে অপরাধীরা মেসেজ পাবে যে এগুলো আর করা যাবে না।’

তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, গত ৬ মার্চ সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় পুলিশের কাছ থেকে একাধিক মামলার আসামি নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল আলম মুন্নাকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। গত ৪ মার্চ সন্ধ্যায় ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় পুলিশের ওপর হামলা চালিয়ে মো. আকবর হোসেন নামে এক আসামিকে ছিনিয়ে নেন তার পরিবার ও স্বজনরা। ওই হামলায় মো. কামরুল ইসলাম নামে এক এএসআই আহত হন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় চেকপোস্টে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ইউসুফ আলী ১০-১৫ জনের মবের শিকার হন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানার একটি টহল দল কারওয়ান বাজারে মাদক কারবারি শাহীন আলমকে মাদকসহ হাতেনাতে গ্রেপ্তার করলেও মাদক কারবারিরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এই ঘটনার পর পুলিশ একটি মামলা করলে প্রধান দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। 

এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক খবরের কাগজকে বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীকে এখন ঘুরে দাঁড়াতে হবে। যথেষ্ট সময় চলে গেছে, এখন কঠোর হওয়ার বিকল্প নেই। যে পরিস্থিতির জন্য যেমন ভূমিকা দরকার, তেমনই পদক্ষেপ নিতে হবে পুলিশকে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, মব ভায়োলেন্স, ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধের বিষয়ে পুলিশকে কঠোরতা প্রদর্শন করতে হবে।’

সচিবালয়, যমুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে ডিএমপি অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং-III/৭৬)-এর ২৯ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে আজ ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সচিবালয়, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় (হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল মোড়, শাহবাগ মোড়, কাকরাইল মোড়, মিন্টো রোড) যেকোনো প্রকার সভা-সমাবেশ, গণজমায়েত, মিছিল ও শোভাযাত্রা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করা হলো।’

রাস্তা অবরোধ করলে কঠোর ব্যবস্থা: আইজিপি

বৃহস্পতিবার সকালে গাজীপুরে শিল্প-পুলিশ-২-এর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যদের সঙ্গে বিশেষ কল্যাণ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। 

এই সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আইজিপি বলেন, ‘কেউ দাবি আদায়ের নামে রাস্তা আটকাবেন না। সামনে ঈদ, সড়ক অবরোধ করে জনগণের ঈদযাত্রায় ভোগান্তি বয়ে আনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এ ধরনের কার্যক্রম যারা করবেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেব।’

পুলিশকে সহায়তার আহ্বান জানিয়ে আইজিপি জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘পুলিশকে প্রতিপক্ষ ভাববেন না। পুলিশের ওপর আক্রমণ করবেন না। আমাদের দেশের সেবা করার সুযোগ দিন।’ তিনি পোশাককর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কোনো ধরনের গুজবে কান দেবেন না। ভাঙচুর করে নিজেদের কর্মস্থলের ক্ষতি হতে দেবেন না।’

রাতে চলছে ডিএমপির বিশেষ অভিযান

ডিএমপির গণমাধ্যম শাখা জানিয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বুধবার দিবাগত রাতে ৬৬৭টি টহল টিম ও ৭১টি চেকপোস্ট পরিচালনা করা হয়। এই রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত অভিযোগে ২৩৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যার মধ্যে ৭ জন ডাকাত, ১৩ জন পেশাদার সক্রিয় ছিনতাইকারী, ৩ জন চাঁদাবাজ, ১২ জন চোর, ২৩ জন মাদক কারবারি, ৩৭ জন পরোয়ানাভুক্ত আসামিসহ অন্যান্য অপরাধে জড়িত অপরাধী রয়েছেন। এর আগে গত মঙ্গলবার রাতে রাজধানীতে ঢাকা মহানগর পুলিশ ৬৬৭টি টহল টিম ও ৭১টি চেকপোস্ট পরিচালনা করে। সে রাতেও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯৭ জনকে।

এদিকে মাঠপর্যায়ে ডিএমপির একাধিক থানার অফিসার্স ইনচার্জের (ওসি) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের সদস্যরা হামলার শিকার হচ্ছেন। একই সঙ্গে অনেকেই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে আইনি কাজে বাধা সৃষ্টি করছেন। এ বিষয়ে বাহিনী থেকে বলা হয়েছে- পুলিশের ওপর হামলা করা হলে সে যেই হোক, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। একই সঙ্গে সরকারি কাজে বাধা বা আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাধা দিলে আমরা সেই বিষয়েও কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত রয়েছি। এ ছাড়া পরিদর্শক পর্যায়ের কর্মকর্তারাও বলছেন, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় থানাগুলোতে মামলা নেওয়া হচ্ছে। 

এ বিষয়ে সাবেক আইজিপি আব্দুল কাইয়ুম খবরের কাগজকে বলেন, দেশের মঙ্গলের জন্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের জন্য সবার আগে আইনশৃঙ্খলা ঠিক করা দরকার। তার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য সবাইকে একমত হতে হবে। পুলিশকেও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। পাশাপাশি পুলিশকে তার কাজের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এ বিষয়ে জনগণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে পরিষ্কার বার্তা থাকতে হবে। 

একই প্রসঙ্গে আরেক সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা খবরের কাগজকে বলেন, দেশের বর্তমান যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তার উন্নয়ন করতে হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় দৃশ্যমান হতে হবে। প্রতিরোধমূলক গ্রেপ্তার অর্থাৎ ‘প্রিভেন্টিভ অ্যারেস্টের’ ব্যবস্থা করতে হবে। কঠোর পদক্ষেপগুলো দৃশ্যমান হতে হবে। প্রতিরোধ করতে হবে মবসহ বেআইনি কর্মকাণ্ডগুলো। সাধারণ মানুষ যখন দেখবে যে অপরাধী গ্রেপ্তার হচ্ছে, বিচার হচ্ছে, শাস্তি হচ্ছে, তখন অপরাধের মাত্রা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে।

সমুদ্র জয়ের সুফল এখনো অধরা

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১১:০৩ এএম
আপডেট: ১৪ মার্চ ২০২৫, ১১:২৪ এএম
সমুদ্র জয়ের সুফল এখনো অধরা
ছবি: সংগৃহীত

‘মায়ানমার ও ভারতের কাছ থেকে আইনি লড়াইয়ে অর্জিত সমুদ্র সীমানার যথাযথ ব্যবহার হয়নি দীর্ঘদিনেও। কিছু নীতিমালা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে উঠলেও কার্যকর পদক্ষেপের অভাবে তেমন কোনো সুফল পাচ্ছে না দেশ। ফলে সমুদ্র জয়ের কাঙ্ক্ষিত সুফল এখনো মেলেনি। সমুদ্র অর্থনীতির বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমরা আর্থিক সমৃদ্ধি লাভ করতে পারিনি।’

২০১২ সালের ১৪ মার্চ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়ের মাধ্যমে মায়ানমারের সঙ্গে মামলায় বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি সমুদ্র এলাকার দখল পায়। সেই হিসাবে আজ ১৪ মার্চ প্রথমবারের মতো দেশের সমুদ্র বিজয়ের ১৩ বছর হয়েছে। আর এর প্রায় দুই বছর পরে ২০১৪ সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বিরোধপূর্ণ সমুদ্রসীমার আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটারের অধিকার পায় বাংলাদেশ, যা দ্বিতীয় সমুদ্র বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এতে দেশের পর্যটন, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ, প্রাকৃতিক সম্পদ, বাণিজ্য এবং জ্বালানি খাতের বিপুল সম্ভাবনা বাড়লেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি নেই। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ব্লু-ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির মাধ্যমে সমুদ্রতলের গ্যাস, মৎস্যসহ অন্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটনের ক্ষেত্রে যথোচিত কার্যক্রম সম্পন্ন হলে ২০৩০ সাল নাগাদ সমুদ্র থেকে প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব। কিন্তু সমন্বিত জরিপ, কার্যকর সমুদ্রবান্ধব নীতি, দক্ষ জনশক্তি, প্রযুক্তিগত জ্ঞান এবং মেরিন রিসোর্সভিত্তিক পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব সমুদ্র অর্থনীতি বিকাশের পথে অন্যতম অন্তরায় বলে বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ মহল।

বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে সমুদ্রকে ঘিরে। বিশ্বব্যাপী ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের জোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও জীবজন্তু। 

বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি জোন তথা বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র সম্পদের ব্যবহার বাংলাদেশকে যেমন দিতে পারে আগামী দিনের জ্বালানি নিরাপত্তা, তেমনি বদলে দিতে পারে সামগ্রিক অর্থনীতির চেহারা। 

কিন্তু পর্যাপ্ত নীতিমালার ও সঠিক কর্মপরিকল্পনার অভাব, দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব, সম্পদের পরিমাণ ও মূল্য সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব, মেরিন রিসোর্সভিত্তিক পর্যাপ্ত গবেষণা না হওয়া, ব্লু ইকোনমি সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগের অভাবে সমুদ্র অর্থনীতির সুফল ভোগ করতে পারছে না দেশ। 

বাংলাদেশের জিডিপির মাত্র ৪ থেকে ৫ শতাংশ ব্লু-ইকোনমি থেকে আসে। এটার পরিমাণ বার্ষিক প্রায় ৯৬০ কোটি ডলার। অথচ সমুদ্রের মাছ রপ্তানি থেকেই ১০-১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের।

সমুদ্রবিরোধ নিরসনের পরে ‘সেভ আওয়ার সি’-এর প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রতিবছর বঙ্গোপসাগর থেকে ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জেলেরা ধরতে পারছেন মাত্র ৭ লাখ টন মাছ। দেশে বছরে যে পরিমাণ মাছ অহরণ হয়, তার মাত্র ১৫ শতাংশ আসে গভীর সমুদ্র থেকে। উপকূলীয় এলাকার ৫০ লাখের বেশি মানুষের আয়ের প্রধান উৎস সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ। কিন্তু তারা এখনো মূলত প্রচলিত পদ্ধতিতেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে সমুদ্রগামী ট্রলারগুলোর জ্বালানি, পরিচালন, জেলেদের খোরাকি ব্যয়, বরফ, মজুরি মিলিয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে ৭০ শতাংশ। ফলে আহরিত মাছ বেচে ব্যয় তুলে লাভ করা দুরূহ হয়ে পড়ছে। এ খাতে জ্বালানি ভর্তুকি নেই, ব্যাংক ঋণের সুবিধা অবারিত নেই, সরকারি পর্যায়ে জেলেদের বিমা ও মজুরি কাঠামোও নির্ধারণ করা হয়নি। এ ছাড়া গভীর সমুদ্রে মাছ আহরণে প্রয়োজন অত্যাধুনিক ট্রলার ও জাহাজ। সেই সক্ষমতাও বাড়েনি। ফলে দেশের নৌযানগুলো গভীর সমুদ্র থেকে মৎস্য আহরণ করতে পারছে না।

আগামী বাজেট: বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে হবে

প্রকাশ: ১৪ মার্চ ২০২৫, ০৭:৫০ এএম
আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৫, ১১:৫৫ পিএম
জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে হবে
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

জীবনযাত্রার ব্যয় কমছেই না। খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত প্রায় সব খাতেই ব্যয় অনেক বেশি। বাড়ি ভাড়া, যাতায়াত, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বেশির ভাগ খরচ আগের মতোই। এর মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপ অনুভব করছে খাবার খরচ নিয়ে। উচ্চ জনপ্রত্যাশা সত্ত্বেও রমজান মাসে সরকার পণ্যের দাম খুব সামান্যই কমাতে পেরেছে। মাছ, মাংস, দুধ, ভোজ্যতেলসহ প্রায় সবকিছুর দামই এখন অনেক বেশি।

আসছে বাজেটে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর পরামর্শ দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কম আয়ের মানুষের কষ্ট কমাতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিত্যপণ্যের আমদানি ও উৎপাদন ব্যয় কমাতে হবে। জ্বালানি, শিক্ষা, চিকিৎসা ব্যয় কমাতে শুল্ক-কর-ভ্যাট মওকুফ সুবিধা বাড়াতে হবে। এসব খাতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়িয়ে কম আয়ের মানুষের মধ্যে সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। শহরের পাশাপাশি গ্রামের জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। সাধারণ মানুষের করমুক্ত সীমা বাড়ানো ও ন্যূনতম করের পরিমাণ কমানোর কথাও বলেছেন তারা। কর্মসংস্থানের আওতা বাড়াতে হবে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান খবরের কাগজকে বলেন, ‘ধনী প্রভাবশালীরা অতীতে বাজেট প্রণয়নের আগেই সরকারের উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করে নিজেদের সুবিধামতো ইস্যু বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাজেট হয়ে উঠেছিল ধনীদের সুবিধা দেওয়ার একটি প্রক্রিয়া। সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন আগের বাজেটগুলোতে নেই বললেই চলে। এবার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার এসেছে। অতীতের মতো এবার উচ্চাভিলাষী বাজেট দেখতে চাই না। বর্তমান সরকার জনমানুষের সরকার। এটা ধরে নিয়েই বলছি, আসছে বাজেটে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষপ নিতে হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘জীবনযাত্রার ব্যয় নতুন সরকার কমাবে- এমন আশা অনেকের। সরকার দাম কমাতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তা কতটা কার্যকর খতিয়ে দেখতে হবে। অন্যদিকে সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পাঁচ মাস পরই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে অনেক কিছুর খরচ বাড়িয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ বেড়েছে। এখন সরকারের উচিত, আগামী অর্থবছরের বাজেটে বছর তিনেক থেকে বেড়ে চলা খরচের লাগাম টানা।’

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার ও জ্বালানি তেলের দাম কমলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কৃষিপণ্য উৎপাদন ও অন্য পণ্য সরবরাহে ব্যয় কমার সম্ভাবনা রয়েছে। আমদানি ব্যয় নির্বাহে ব্যবহৃত বৈদেশিক মুদ্রার মান ধরে রাখা প্রয়োজন এবং রাজস্ব ও মুদ্রানীতি ঠিক রাখা আবশ্যক। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে একই সময়ে চালের দাম ২৪ দশমিক ১৯ শতাংশ কমলেও গত এক বছরে দেশের বাজারে চালের দাম ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ হারে বেড়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর চাল আমদানিতে বিভিন্ন শুল্ক-কর প্রত্যাহার করলেও ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) বহাল রয়েছে। বর্তমানে ছোলা, ডালে কোনো শুল্ক-কর ছাড় নেই। গত এক বছরে ছোলার দর দেশের বাজারে ৩৫ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়েছে।

গত ৯ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপন জারি করে প্রায় শত পণ্যের সম্পূরক শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি খরচও বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি খরচের কারণে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে। ওষুধের দাম কমেনি। শুধু তা-ই না, চিকিৎসা খাতের খরচও এখন অনেক বেশি। শিক্ষা উপকরণের দাম কমেনি। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেতন বেড়েই চলেছে।

এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘জাতীয় বাজেটের মোট খরচের ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশই আসে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে। সরকার শুল্ক-কর-ভ্যাট আরোপ করে এই অর্থ আয় করে থাকে। এই আয় দিয়ে সরকার খরচ চালায়। শুল্ক-কর-ভ্যাট আরোপ করা হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে। জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে পদক্ষেপ নিতে হলে শুল্ক-ভ্যাট-কর কমাতে হবে। এতে সরকারের আয় কমে যাবে। আয় কমে গেলে সরকার খরচ চালাবে কীভাবে? আগামী বাজেটে সরকারকে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে শুল্ক-কর-ভ্যাট আরোপ না করেই আয় বাড়াতে হবে। আগামী বাজেটে সরকারকে এ চ্যালেঞ্জ নেওয়ার পরামর্শ দেব।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণ মানের দুই রুমের পাকা ভবনের বাসার ভাড়া রাজধানীতে গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বা তার বেশি। ভালো পরিবেশে তিন রুমের পাকা ভবনের বাসার ভাড়া গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। চার সদস্যের সাধারণ পরিবারের খাবার খরচ গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা বা তার বেশি। এ পরিবারের শিক্ষা, চিকিৎসা, যাতায়াত, জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচে চলে যায় ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

বেসরকারি চাকরিজীবী আহসান আল মাহমুদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করে চার সদস্যের পরিবার নিয়ে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে উন্নত জীবনযাপন করা কখনো সম্ভব না। সরকারের কাছে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য তিন বেলা পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়ার দাবি করছি।’

জীবনযাত্রার ব্যয় চালাতে হিমশিম খাওয়া সাধারণ মানুষের ওপর রয়েছে কর পরিশোধের চাপ। বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ এক করবর্ষে একজন ব্যক্তির আয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলেই তাকে কর পরিশোধ করতে হবে। হিসাব কষে দেখা যায়, এক মাসে নিট আয় ২৯ হাজার ১৬৭ টাকার বেশি হলেই কর দিতে হবে। বছর বছর বাজেটের আকার বাড়লেও বাড়ানো হয়নি করমুক্ত আয়সীমা।

এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সাধারণ করদাতাদের করমুক্ত সীমা বাড়ানো হলে সরকারের আয় গড়ে ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা কমবে। অথচ বড় মাপের একজন কর ফাঁকিবাজের কাছে সরকারের হাজার কোটি টাকাও পাওনা থাকে। তাই সাধারণ মানুষকে ছেড়ে বড় মাপের করদাতাদের কাছ থেকে পাওনা আদায় করতে হবে। আগামী বাজেটে সে পথেই সরকারকে হাঁটতে হবে।’