ক্যারিয়ারে তখন ফর্মের চূড়ায় তিনি। প্রথম বিভাগ হকি লিগে সদ্যই শিরোপা জিতেছেন সাধারণ বিমার হয়ে। ১৯৮৪ সালে মালয়েশিয়ায় জুনিয়র বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন, সেটি প্রায় চূড়ান্ত। কিন্তু নিমিষেই কি থেকে কি হয়ে গেল। চোখে মারাত্মক এক আঘাত পেলেন। জুনিয়র জাতীয় দলের প্রাথমিক ক্যাম্পের চৌকাঠেই ফজলুল হকের স্বপ্নের মৃত্যু! আসলেই কি তাই? আরেক স্বপ্নের শুরু হলো তো সেখানেই। নিজের না পারার দুঃখ ঘোচাতে পুরান ঢাকার তরুণ নেমে পড়লেন খেলোয়াড় তৈরির সংগ্রামে। যেখানে আলোর ফেরিওলা হয়ে ফজলুল হক থেকে হয়ে উঠলেন- ‘ওস্তাদ ফজলু’।
দেশের হকির সুপারস্টার রফিকুল ইসলাম কালাম, মাকসুদ আলম হাবুল, রাসেল মাহমুদ জিমি থেকে হালের নাঈম-আরশাদরা ওঠে এলো তার ধরেই।
আশির দশকে যে স্বপ্নের শুরু, তা চলছিল অবিরাম। ৫০ পেরিয়েও ওস্তাদ ফজলুর কোনো ক্লান্তি ছিল না। কিন্তু আজ বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) হঠাৎই সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন তিনি। হকির নিবেদিত প্রাণ এই ক্রীড়া সংগঠককে হারিয়ে কাঁদছে পুরো ক্রীড়াঙ্গনই।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলা হাই স্কুল প্রাঙ্গণে প্রতিদিন নিয়ম করে বাচ্চাদের হকি শেখাতেন ওস্তাদ ফজলু। সাহেব বাজারের নাবালক মিয়া লেনের এই বাসিন্দা বাড়ি বাড়ি থেকে বাচ্চাদের ধরে এনে হকি স্ট্রিক হাতে তুলে দিতেন। এরপর তাদের হকির প্রাথমিক পাঠ দেওয়া তো বটেই, খেলাটার প্রতি বুনে দিতেন ভালোবাসার বীজ।
তার হাতে হকি শিখে নিয়মিত বিকেএসপি, জাতীয় দলের দরজা খুলেছে অসংখ্য খেলোয়াড়। কত জনের জীবন চাকাও যে ঘুরে গেছে।
এক সময় পথে পথে চা বিক্রি করে কাটানো বাচ্চু গাজী ও সোহাগ গাজীকে ধরে এনে হকি শিখিয়েছেন। সেই দুই ভাই এরপর খেলোয়াড় কোটায় চাকরি পেয়ে যান বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে।
দ্বিতীয় শ্রেণির বাচ্চাদের নিয়ে কাজ শুরু করতেন ওস্তাদ ফজলু। বেশিরভাগ গরীব ঘরের ছেলেরাই আসতেন হকি খেলতে। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়। কিন্তু অধিকাংশেরই স্ট্রিক-বুটসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কেনার সাধ্য থাকে না। সে দায়িত্বও নিজের কাঁধে তুলে নিতেন তিনি। সাহেব বাজারের পুরোনো জিনিস পত্রের দোকান থেকে সংগ্রহ করতেন বুট সহ অন্যান্য সরঞ্জাম।
কোনো দিন কোন শিষ্যের কাছ থেকে পারিশ্রমিক নেননি। সেই আশাও করেননি কখনো। হকি শেখানো যে ফললুল হকের কাছে ইবাদত তুল্য।
বাচ্চাদের শেখানোর সময় বলতেন, ‘আকাশের সবচেয়ে বড় তারাটা হতে হবে তোকে।’ সেই বাচ্চারা যখন সাফল্যের শেখরে পৌঁছান, ওস্তাদ ফজলুর মন তখন প্রশান্তিতে ভরে যেত। তৃপ্তি নিয়ে ‘ওস্তাদ ফজলু’ বলতেন, ‘আমি জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারিনি। কিন্তু আমার হাতে গড়া অনেক শিষ্য জাতীয় দলকে প্রতিনিধিত্ব করছে আজ।’
জাতীয় দলে কখনো খেলা না হলেও ঘরোয়া হকিতে ‘ওস্তাদ ফজলু’ খেলেছেন ২০০৫ সাল পর্যন্ত। ‘হকির টাইগার’ খ্যাত আব্দুর রাজ্জাক সোনা মিয়ার হাত ধরে ১৯৭৭-৭৮ সালে প্রথম বিভাগ দিয়ে শুরু হয়েছিল তার যাত্রা। নিজের ‘ওস্তাদ ফজলু’ হয়ে ওঠার পেছনে সোনা মিয়াকেই কৃতিত্ব দিতেন তিনি। বিশ্বাস করতেন, গুরুকে ভক্তি করেছেন বলেই আজ নিজে সম্মান পাচ্ছেন, সাফল্য হচ্ছেন কাজে।
চার ভাই-এক বোনের মধ্যে খেলার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ছিলেন একমাত্র তিনিই। হকি নিয়ে পড়ে থেকে বিয়ের কথাও ভুলে গিয়েছিলেন। খেলা ছাড়ারও ৫ বছর পর বিয়ে করেন। স্ত্রী সালমা ইসলাম ও তার সংসারে এক কন্যা- নাদিয়া ইসলাম।
হকির জাগরণের স্বপ্ন বুকে ধারণ করে নিভৃতেই কাজ করে যাচ্ছিলেন ফজলুল হক ওরফে ‘ওস্তাদ ফজলু’। সব সময় বলতেন, ‘স্বপ্ন দেখি দেশের হকিটা চূড়ায় চলে যাক। জাতীয় দলের খেলোয়াড় তৈরি করব এই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি আমাদের হকি একদিন একটা পর্যায়ে যাবেই ইনশা আল্লাহ।’
কিন্তু হকির সুদিন আর দেখা হলো তার। ‘ওস্তাদ ফজলু’ চলে গেলেন অকালেই। তবে এদেশের হকি যতদিন থাকবে, একজন ‘ওস্তাদ ফজলু’ অমর হয়েই থেকে যাবেন।