ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর দেশজুড়ে শুরু হয় আওয়ামী লীগ হঠাও অভিযান। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং মতাদর্শের ব্যক্তিদের পদত্যাগের দাবি ওঠে। এই দাবি নিয়ে কোথায়ও হাজির হয়েছিলেন ছাত্র-ছাত্রীরা, কোথায়ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মরতরা। আবার কোথায়ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিশেষ করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বাদ যায়নি ক্রীড়াঙ্গনও। ক্রীড়াঙ্গনে এই চাওয়া ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতিদ্বয়ের পদত্যাগ।
নাজমুল হাসান পাপন পদত্যাগ করলেও আন্দোলনকারীদের চাওয়া ছিল সভাপতির পাশাপাশি বিসিবির পরিচালকদেরও পদত্যাগ। ২৫ সদস্যের পরিচালনা পরিষদের অর্ধেকেরও বেশি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকায় তারাও বিসিবিতে আসা বন্ধ করে দেন। যে কারণে আন্দোলনকারীরা দাবি তুলেছিলেন যেহেতু আইসিসির বিধি-নিষেধের কারণে জোর করে পদত্যাগ করানো যাবে না, তাই যারা অবশিষ্ট আছেন, তারা নিজ থেকে পদত্যাগ করলে পরিচালনা পরিষদ ভেঙে যাবে। তারপর সেখানে নতুন করে কমিটি গঠন করা হবে। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের মাঝে অন্যতম ছিলেন সাবেক ক্রিকেটার ও ক্রিকেটার ওয়েলফোয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (কোয়াব) সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পাল। ছাত্র জীবনে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। তার এই বিপ্লবী চরিত্র অনেককেই অবাক করে। কারণ তিনি নাজমুল হাসান পাপন সভাপতি থাকাকালীন বিসিবি থেকে লাখ লাখ টাকার সুবিধা নিয়েছেন। বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা অফিসে উপ-পরিচালক পদে চতুর্থ গ্রেডের বেতন স্কেলে স্থায়ী চাকরি করলেও বিসিবিতে মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতনে ম্যাচ রেফারি কো-অর্ডিনেটর পদে চুক্তিভিত্তিক চাকরিও করেছেন। পরে তার বেতন বেড়ে হয়েছিল ৬০ হাজার টাকা।
নাজমুল হাসান পাপন সভাপতি থাকাকালীন বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পারিবারিক সখ্যের কারণে নাজমুল হাসান পাপন সেই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিসিবিতে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। নাজমুল হাসান পাপনের আগে সভাপতি ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। সে সময় বিভিন্ন অনিয়মের বিরুদ্ধে কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দেবব্রত পাল খুবই সোচ্চার ছিলেন। এজিএমে তিনি একাই অর্ডিয়েন্স গরম করে তুলতেন। কিন্তু নাজমুল হাসান পাপনের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেবব্রত পাল ছিলেন নীরব দর্শক। তার এ রকম নীরব থাকার কারণ বিসিবি থেকে পাওয়া বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। যেখানে তিনি শুধু চুক্তিভিত্তিক চাকরিই করতেন না, ম্যাচ রেফারি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করে লাখ লাখ টাকার সুবিধা নিয়েছেন। নাজমুল হাসান পাপনের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করলে দেবব্রত পাল এসব সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতেন। তাই তিনি নীরব হয়ে যান। তার নীরবতা এতটাই চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের প্রতিবাদস্বরূপ লালমাটিয়া ক্লাবের বোলার সুজন মাহমুদ ৪ বলে ৯২ রান দিয়েছিলেন। এই কারণে বিসিবি সুজন মাহমুদকে ১০ বছরের জন্য সাসপেন্ড করেছিল। কিন্তু কোয়াবের সাধারণ সম্পাদব হওয়ার পর এ নিয়ে কোনো প্রতিবাদ করেননি দেবব্রত পাল।
প্রশ্ন আসতে পারে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকার পরও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিসিবিতে দেবব্রত পাল কীভাবে এত সুযোগ-সুবিধা পেলেন? তাকে আসলে এই সুযোগ করে দিয়েছিলেন সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয়। জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক কোয়াবেরও সভাপতি। সেই হিসেবে দেবব্রত পাল দুর্জয়ের খুবই ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠেন। আর দুর্জয়ও তাকে বিসিবি থেকে এইসব সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিতে সহায়তা করেন। যা বাস্তবায়ন করেন নাজমুল হাসান পাপনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ক্ষমতাধর পরিচালক ডা. ইসমাইল হায়দার মল্লিক। বিসিবিতে ইসমাইল হায়দার মল্লিক এতটাই ক্ষমতাধর ছিলেন যে তিনি যা বলতেন নাজমুল হাসান পাপনও তাই শুনতেন।
দেবব্রত পাল ম্যাচ রেফারি হিসেবে বিপিএলে ১৮টি, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে ৩৪টি, এনসিএলে ৪ দিনের ম্যাচ ১টি, এক দিনের ম্যাচ ৯টি, বিসিএলে ৪ দিনের ম্যাচ ২টি, ১ দিনের ম্যাচ ৩টি, প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে ৪টি ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের ৩টি এক দিনের, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা এইচপি দলের ১টি ৪ দিনের ম্যাচ, বাংলাদেশ ও ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ১টি ৪ দিনের ম্যাচ, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ১টি ১ দিনের ম্যাচেও তিনি ছিলেন ম্যাচ রেফারি। এসব ম্যাচের ম্যাচ ফি ছিল সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন ৬ হাজার টাকা। এ ছাড়া ছিল টিএ-ডিএ। বিপিএলে ছাড়া বাকি ম্যাচগুলোতে ডিএ ছিল আড়াই হাজার টাকা করে। বিপিএলে প্রতিদিন পেতেন ৫০ ডলার করে। ডিএ ছাড়াও ঢাকার বাইরে ম্যাচ হলে উন্নতমানের আবাসিক হোটেল ও বিমানে যাতায়াত করতেন। আর্থিক এসব সুযোগ-সুবিধা বর্তমান হিসেবের। আগে আর কম ছিল। ক্রমান্বয়ে তারা বেড়েছে। এ ছাড়াও তিনি একবার জাতীয় দলের ও দুইবার অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। এখানেও তিনি ক্রিকেটারদের সমান দৈনিক ডিএ পেতেন। ২০১৭ সালের জুন মাস থেকে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত চাকরি করাকালীন বেতন ও এসব সুযোগ-সুবিধা থেকে প্রায় অর্ধকোটি টাকার ওপরে সুবিধা নিয়েছেন দেবব্রত। এরপর তিনি চাকরি ছেড়ে দেন নিজ ইচ্ছায়। এই চাকরি ছাড়ার পেছনে তিনি একটি নাটকও সাজিয়েছিলেন। অতীতে তাকে বিএনপির আন্দোলেন খুব একটা দেখা যায়নি। কিন্তু গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার একটা রব উঠেছিল। তখন দেবব্রত একটি মিছিলে যোগ দিয়ে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। এ নিয়ে বিসিবির সভাপতি অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন এবং তার কাছে এর কৈফিয়ত জানতে চাইবেন বলে জানান। এরপরই দেবব্রত নিজ থেকে পদত্যাগ করেন। তবে তিনি পদত্যাগ করলেও তার এসব সুযোগ-সুবিধা শুধু প্রমাণ করে তিনি কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন নাজমুল হাসান পাপনের সময়। কারণ এ সময় নাজমুল হাসান পাপনের সঙ্গে মতের অমিল থাকায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল ও তার অনুসারীরা বিসিবির কোনো কমিটিতেই ঢুকতে পারেননি।
জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক গোলরক্ষক আমিনুল হক বিএনপির ক্রীড়া সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার লাঞ্ছিত হয়েছেন। জেলেও গিয়েছেন। একবার তাকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে জেলে নেওয়া হয়েছিল। সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের সময়ও আমিনুলকে জেলে যেতে হয়েছে। কিন্তু ছাত্রদলের সাবেক ডাকসাইটে নেতা হওয়ার পরও দেবব্রতকে কখনো এ রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়নি। কারণ তিনি ছিলেন বিসিবির সুবিধা নিতে ব্যস্ত। আবার কোয়াবের সাধারণ সম্পাদক পদেও তিনি এক যুগ পার করে দিয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী চাকরি করার পরও দেবব্রত কি করে আরেকটি চাকরি করেন? যেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির প্রবিধানমালায় রয়েছে অন্যত্র চাকরি করা যাবে না। বিভিন্ন টুর্নামেন্টের খেলায় ম্যাচ রেফারি এবং জাতীয় দল ও অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দেবব্রতকে প্রায় সময়ই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকতে হয়েছে। এ ব্যাপার জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ব বিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা অফিসের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বেগম নাছরিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে খবরের কাগজকে তিনি বলেন, ‘আমি সর্বোচ্চ ৭ দিন পর্যন্ত ছুটি দিতে পারি। এর বেশি হলে রেজিস্টারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়।’ বিসিবিতে চাকরি করা প্রসঙ্গে তিনি কিছু বলতে পারবেন না জানিয়ে রেজিস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু রেজিস্টার আবু হাসান পদত্যাগহ করায় তার মতামত জানা যায়নি। এ ব্যাপারে দেবব্রত পাল বলেন, ‘আমি যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই বিসিবিতে কাজ করেছি। চাইলে আমি আপনাকে অনুমতি পত্রও দেখাতে পারব।’ বিসিবি থেকে সুযোগ-সুবিধা নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি দুর্জয়ের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে বিসিবিতে আসিনি। সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে এসেছি।’ রাজনীতির কারণে আমিনুল লাঞ্ছিত ও জেলে গেলেও তার ক্ষেত্রে এ রকম কোনো কিছু না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি গেলে আপনি খুশি হতেন। আসলে আমি কোনো পদে ছিলাম না, তাই’।