উচ্চতা ছয় ফুট। সুদর্শন। মুখে লম্বা দাড়ি। রমনীরা প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে যেতে পারেন। দৈহিক সৌন্দর্য্যের সঙ্গে যদি যোগ হয় তারকাখ্যাতি। তাহলে তো কথাই নেই। রীতিমতো লাইমলাইটে তখন বসবাস। অর্থ, যশ, খ্যাতি- এ তিনটি জিনিস কেউ পেয়ে থাকলে জীবন চলার পথে মাঝেমধ্যে পা হড়কানোর শঙ্কা থাকে। অনেকে উঠে আসেন নেতিবাচক খবরের শিরোনামেও। কিন্তু মঈন আলী সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এক মানুষ। তারকা ক্রিকেটার হয়েও যিনি পা মাড়াননি বিপথে। জীবনে প্রায় সব কিছু পেলেও হননি আদর্শচ্যুত। মনে-প্রাণে পালন করে গেছেন ইসলাম ধর্মের রীতিনীতি। মগজে-মননে বয়ে বেড়িয়েছেন শুদ্ধাচার ও সরলতা।
জন্মেছেন ইংল্যান্ডে। সেখানেই বেড়ে ওঠা। সময়ের আবর্তে ইংল্যান্ড জাতীয় ক্রিকেট দলের তারকা অলরাউন্ডার তিনি। ডান হাতি স্পিনার। ঘূর্ণি বলে কাবু করেছেন নামিদামি সব ব্যাটারকে। আবার লোয়ার অর্ডারে নেমে ব্যাট হাতে খেলেছেন অনেক ক্যামিও ইনিংস। ইংল্যান্ডের হয়ে দুটি বিশ্বকাপ জেতা সেই মঈন আলী সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকেই বিদায় বলেছেন। যদিও অনেকে বলছেন, তার এই বিদায়ের পেছনে কাজ করছে বড় অভিমান। বয়স ৩৭ হলেও আরও দু-এক বছর জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারতেন তিনি। তবে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজে স্কোয়াড থেকে বাদ পড়ার পরই তিনি বুঝতে পারেন, সময় এখন বিদায় বলার। সেই সিদ্ধান্তের কাজটিই তিনি করেছেন বেশ পরিপক্বতার সঙ্গে।
মঈন আলীর বিদায়ের পর তাকে নিয়ে সরব মিডিয়া। যতটা না তার পারফরম্যান্স তার চেয়ে জীবন দর্শন নিয়ে। ক্রিকেটের সঙ্গে ফিক্সিং ও অ্যালকোহল শব্দ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু এই দুটি জিনিস থেকে আজীবন দূরে থেকেছেন মঈন আলী। কখনো স্পর্শ করেননি মদ কিংবা শ্যাম্পেইন। ফিক্সিং কাণ্ড তার গোটা ক্যারিয়ারজুড়ে ছিল অস্পর্শ। কারণ খেলোয়াড়ি জীবনের পাশাপাশি তিনি ছিলেন ইসলামি রীতিনীতি পালনে প্রবল সচেষ্ট।
২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ইংল্যান্ড। শিরোপা উদযাপনের পর আলোচিত ছিলেন মঈন আলী। ইংল্যান্ডের অঘোষিত একটা রীতি, শিরোপা মঞ্চে শ্যাম্পেইনের বোতল খুলে আনন্দ-উল্লাস করা। ২০১৯-এ তা হয়েছিল। তবে মঈন আলী ও আদিল রশিদকে ছাড়া। রশিদও মঈনের মতো ইসলাম ধর্মের অনুসারী। শিরোপা নিয়ে ছবি তোলার পরই মঈন ও আদিল সরে যান মঞ্চ থেকে। এরপর মরগান শিবির উল্লাস করে শ্যাম্পেইন ছিটিয়ে।
মঈন ও রশিদের এ কর্মকাণ্ড মুসলমানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মাদকবিরোধী সংগঠন ও স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ব্যাপক প্রশংসা করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক-টুইটারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তারা উচ্ছ্বসিত প্রতিক্রিয়া দেখান। এর আগে ২০১৪ সালে ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে মঈন আলী ‘সেভ গাজা’ ও ‘ফ্রি ফিলিস্তিন’ লেখা রিস্টব্যান্ডস পরার কারণে মুসলিম বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছিলেন। ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড তখন মঈন আলীর পক্ষ নিলেও আইসিসি এটাকে ‘মানবিকতার চেয়ে রাজনীতি’ হিসেবেই বর্ণনা করেছিল।
২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ঘটেছিল একই ঘটনা। মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রবল আধিপত্য দেখানো দলকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছিল ইংল্যান্ড। সতীর্থরা আনন্দ ভাগ করলেও শেষ মুহূর্তে মঞ্চ ছেড়ে যান মঈন আলী। কারণ একটাই, শ্যাম্পেইন থেকে দূরে থাকা।
আইপিএলের গত আসরে বাংলাদেশের মোস্তাফিজুর রহমান খেলেছিলেন চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে। কিন্তু দলটির দেওয়া জার্সিতে আপত্তি ছিল তার। জুয়াসংশ্লিষ্ট এক প্রতিষ্ঠানের লোগো ছিল জার্সিতে। সেটি বাদ দিয়ে জার্সি পরেছিলেন মোস্তাফিজ, যা নিয়ে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন ফিজ। চেন্নাইয়ে খেলার সময় ঠিক একই কাজ করেছিলেন মঈন আলীও। জুয়া, ফিক্সিং কিংবা কোনো ধরনের অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে তার ছিল অটল অবস্থান।
ইংল্যান্ড ক্রিকেট দল থেকে মঈনের বিদায়টা আরও সুন্দর হতে পারত। তা নিয়ে খুব বেশি আক্ষেপ না থাকলেও আছে কিছুটা অভিমান। এ প্রসঙ্গে মঈন ডেইলি মেইলকে বলেন, ‘আমার বয়স ৩৭। এই মাসের অস্ট্রেলিয়া সিরিজের জন্য আমাকে দলে নেওয়া হয়নি। আমি ইংল্যান্ডের হয়ে অনেক ক্রিকেট খেলেছি। আমাকে বলা হয়েছিল, এটা পরবর্তী প্রজন্মের সময়। আমি অনুভব করেছি যে, সময়টি সঠিক ছিল। আমি আমার ভূমিকা পালন করেছি। আমি খুব গর্বিত।’
৬৮ টেস্টে মঈনের শিকার ২০৪ উইকেট। ১৩৮ ওয়ানডেতে সেখানে উইকেট নিয়েছেন ১১১টি। ৯২ টি-টোয়েন্টিতে উইকেট পেয়েছেন ৫১টি। কেন তিনি অলরাউন্ডার তা ব্যাটিংয়ের দিকে তাকালে স্পষ্ট। টেস্টে রান ৩ হাজারের ওপর, ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৫৫ অপরাজিত। আছে ৫ সেঞ্চুরি ও ১৫টি হাফ সেঞ্চুরি। ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান ১২৮। ৩ সেঞ্চুরির পাশাপাশি করেছেন ৬টি ফিফটি। টি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ রান অপরাজিত ৭২। সেঞ্চুরি নেই, ফিফটি ৭টি।