সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দুই আসরে সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার জিতেছেন রুপনা চাকমা। দেশকে টানা দুবার চ্যাম্পিয়ন করা, সেই সঙ্গে নিজেকেও সেরার কাতারে রাখা রাঙামাটির এই পাহাড়িকন্যা খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়ে নিজের সাফল্যসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ।
খবরের কাগজ: সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে টানা দুবার চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। আর এই দুই আসরেই আপনি সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার পেয়েছেন। টানা দুইবার দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা হয়ে কেমন লাগছে?
রুপনা: অনুভূতি তো অবশ্যই অনেক ভালো। দল হিসেবে আমরা দুই বার চ্যাম্পিয়ন, সঙ্গে আমি দুই বার সেরা গোলকিপার। খুবই ভালো লাগছে।
খবরের কাগজ: চ্যাম্পিয়ন হয়ে নেপাল থেকে দেশে ফেরার পর দিনগুলো কেমন কাটছে?
রুপনা: ভালোই যাচ্ছে…
খবরের কাগজ: আপনাকে কিন্তু অনেক কষ্টে পাওয়া গেল। কাঠমান্ডুতে তো সাক্ষাৎকার চাওয়ায় এক রকম দৌড়ে পালালেন…
রুপনা: (হাসি) আসলে কি, আমি বেশি কথা বলতে পছন্দ করি না। সে জন্য আমি চলে যাই। খেলার সময় আমাকে সতীর্থরা বলে, রুপনা সামনে যাও না কেন? আমি বলি, আমি গোলকিপার, আমি তো সব সময় পেছনেই থাকব। আমার পেছনে থাকাটাই দরকার। সামনে গেলে হবে না। তাই আমি সব সময় পেছনেই থাকতে চাই। পেছনে থেকে অনেক কিছু করতে চাই।
খবরের কাগজ: পোস্টে আপনি থাকলে দল তো বড় ভরসা পায়। এটা নিশ্চয়ই চাপের। চাপটা সামলান কীভাবে?
রুপনা: এখানে আসলে আমার টিমমেটরা আমাকে অনেক সাপোর্ট করে। সবাই বলে, রুপনা তুই যদি ভালো খেলিস, তাহলে আমরা সবাই ভালো খেলব। তুই তো সবই জানিস, সবকিছু বুঝিস। অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছিস। এখন তুই যদি একটা সেভ দিস, তাহলে দলের সবাই ভালো করবে।
খবরের কাগজ: এই যে এত শক্তিশালী আক্রমণভাগের বিপক্ষে খেলেন, ভয় কাজ করে না?
রুপনা: একটু তো ভয় করেই। ভয় সবারই হয়। যখন আপনি ফাইনালে যাবেন, ফাইনালে গিয়ে কীভাবে খেলবেন, টেনশন তো একটু থাকবেই। এবার নেপালের বিপক্ষে ফাইনালের আগে আমি খুব টেনশনে ছিলাম। রাতে ঘুমাতে পারছিলাম না। কীভাবে খেলব, কীভাবে দলকে জিতাব, এসব মনের মধ্যে কাজ করছিল। ম্যাচের আগের দিন রাতে ডিনারে ঠিকমতো খেতে পারছিলাম না। সাবিনা আপুকে বলেছি, আমার না অনেক ভয় করছে, যে কীভাবে খেলব। তখন আপু বলেছে, রুপনা তুমি কেন চিন্তা করছ? তুমি শুধু বারে দাঁড়াও, একটা ভালো সেভ দাও, অবশ্যই আমরা ভালো খেলব। এ রকম করে অনেক সাহস দিয়েছে।
খবরের কাগজ: গতবার সেরা গোলরক্ষক হয়েছিলেন। এবারও সেরা হলেন। নিজের পারফরম্যান্স ধরে রাখা কতটা চ্যালেঞ্জের ছিল?
রুপনা: কঠোর পরিশ্রমই এখানে আসল। ২০২২ সালে যখন আমি প্রথম সেরা গোলকিপার হই, তখনই বলেছিলাম যদি আমি আমার খেলাটা ধরে রাখতে পারি, তাহলে অবশ্যই সামনে আরও ভালো জায়গায় যেতে পারব। আমি আমার খেলাটা ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। সামনে এভাবেই এগিয়ে যেতে চাই। আমার খেলা যদি ভালো থাকে, অবশ্যই আমি পারব।
খবরের কাগজ: নিজেকে ধরে রাখার জন্য এবং আরও উন্নতি করার জন্য আপনি কী কী করেন?
রুপনা: এখানে আমার কোচ মাসুদ আহমেদ উজ্জ্বল স্যারের কথা আগে বলব। আমি দুবার সেরা গোলরক্ষক হলাম। দুবারই কিন্তু স্যার আমাদের গোলকিপার কোচ ছিলেন। উজ্জ্বল স্যার আমাকে অনেক হেল্প করেন। আমি খেলার সময় স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘স্যার আমি কি সেরা গোলকিপার হতে পারব, নাকি পারব না?’ স্যার বলেছিলেন, ‘তুমি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখ। আর আমার ওপর বিশ্বাস কর। অবশ্যই তুমি পারবা।’ আমি উজ্জ্বল স্যারের সঙ্গে আমার খেলার সবকিছু শেয়ার করি। যখনই খেলা হয়, কীভাবে খেললে ভালো হবে, এগুলো নিয়ে কথা হয়।
খবরের কাগজ: তার মানে এবারের সাফে যাওয়ার আগেই সেরা গোলরক্ষক হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন?
রুপনা: হ্যাঁ, এবারও লক্ষ্য ছিল এবং ওভাবে প্র্যাকটিস করেই গেছি।
খবরের কাগজ: আগেরবারও এরকম লক্ষ্য ছিল?
রুপনা: আগেরবার নিজে জানতাম না যে, আমি সেরা হতে যাচ্ছি। এবারও কিন্তু একই রকম হয়েছে। খেলা শেষে মাইকে যখন নাম বলছিল, তখন চিন্তা করছিলাম, আমি হব, কি হব না? নেপালের গোলরক্ষকও তো অনেক ভালো খেলেছেন। ভালো ভালো সেভ দিয়েছেন। আমিও দিয়েছি। তবে আসলেই কি হব, এমন চিন্তা করছিলাম। আমার সতীর্থরা অবশ্য আমার নাম ধরে চিৎকার করছিল। পুরস্কার অনুষ্ঠানে যখন আমার নাম ঘোষণা হলো, তখন একটু রিল্যাক্স হয়ে গেলাম। এর আগে পর্যন্ত খুব টেনশনে ছিলাম, আমাকে ডাকবে কি ডাকবে না।
খবরের কাগজ: আরেকটু বিস্তারিত বলুন। বিশেষ করে ওই মুহূর্তটার কথা?
রুপনা: ওই মুহূর্তটা আমি আপনাকে বোঝাতে পারব না। কতটা যে খুশি হয়েছি আমি…
খবরের কাগজ: আপনার উঠে আসাটা অনেক সংগ্রামের। খেলোয়াড়ি জীবনেও অনেক বাধা পাড়ি দিতে হয়েছে। একটা সময় তো আপনার উচ্চতা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠত। এই সীমাবদ্ধতা জয় করে এগিয়ে চলার গল্পটা জানতে চাই।
রুপনা: একটা কথা কি ভাইয়া, উচ্চতা দেখে কিছু হয় না। সবকিছু নিজের ওপরে। আপনারাই দেখেন- লম্বা মানুষ কী করে, আর খাটো মানুষ কী করে। মানুষ অনেক কিছুই ভাবে, তবে মেনে নিতে হয়। সবকিছু তো আর পাওয়া যায় না।
খবরের কাগজ: এগুলো নিয়ে যখন সমালোচনা হতো, তখন কি কষ্ট লাগত?
রুপনা: আমার কোনো কষ্ট লাগত না। আমি বলি, আমি খাটো হয়েছি কী হয়েছে? আমি অনেক কিছু করতে পারব। আমার বরং ভালো লাগত। মানুষ তো বলবেই। খারাপ লাগার কী আছে। আমাকে সৃষ্টিকর্তা যেটা দিয়েছে, এটা তো মেনে নিতে হবে। আমার ওদের (সমালোচক) সঙ্গে রাগ করার তো কোনো কারণ নেই।
খবরের কাগজ: মা কতটা খুশি আপনার সাফল্যে?
রুপনা: আমি ফাইনালের আগের দিন ফোন জমা দেওয়ার আগে মার সঙ্গে কথা বলি। মাকে বলেছি, কালকে আমাদের ফাইনাল, আমার জন্য দোয়া কইরো যেন আমরা ভালো খেলতে পারি এবং চ্যাম্পিয়ন হতে পারি। আমার মা বলেছে, ‘তুমি যদি ভালো খেলো, অবশ্যই জিতবে। আমি সব সময় তোমার জন্য দোয়া করি, এবারও যেন চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসতে পার’ এরকম বলেছে। ফাইনাল শেষে যখন ফোন দিয়ে বলেছি, আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ও আমি সেরা গোলরক্ষক হয়েছি, তখন মা অনেক খুশি হয়েছে।
খবরের কাগজ: এখন মা নিশ্চয়ই অপেক্ষায় আছেন কবে বাড়ি যাবেন?
রুপনা: হ্যাঁ। মা অপেক্ষা করে আছেন। বলেছি, এখন তো পারছি না। কয়েকটা দিন দেরি হবে।
খবরের কাগজ: আপনারা দুইবার চ্যাম্পিয়ন হলেন। আপনি দুইবার সেরা গোলরক্ষক। সরকারের কাছে কি চাওয়া আপনার?
রুপনা: সরকারের কাছে চাইব, রাঙামাটিতে আমাদের বাড়িতে যাওয়ার যে রাস্তাটা, সেটা যেন ভালোভাবে করে দেন। এ ছাড়া ঢাকায় যখন আমাদের খেলা হয়, তখন পরিবারের সদস্যরা খেলা দেখতে ঢাকায় আসেন। কিন্তু ঢাকায় তাদের কোনো থাকার জায়গা থাকে না। ঢাকাতে যদি কোনো ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করা হয় আমাদের জন্য, তাহলে খুব উপকার হয়।
খবরের কাগজ: মাত্র ২০ বছর বয়স আপনার। এর মধ্যেই সাফে দুইবার সেরা গোলরক্ষক হলেন। সামনে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন কী?
রুপনা: আমি বাইরের দেশের লিগে খেলতে চাই। এই মুহূর্তে এটা একটা বড় চাওয়া।
খবরের কাগজ: এখন তো অনেকে রুপনার মতো গোলকিপার হতে চায়। তাদের জন্য কী বলবেন?
রুপনা: সবার জন্যই শুভকামনা থাকবে আমার। যেন আমার মতোই ভালো খেলতে পারে, সেরা গোলকিপার হয়ে আসতে পারে। আমার সঙ্গে জুনিয়র যারা আছে, তাদের জন্যও আমার শুভকামনা।