বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের মধ্যমাঠের কাণ্ডারি মারিয়া মান্দা। সিনিয়র ও বয়সভিত্তিক মিলিয়ে দেশের অনেক সাফল্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার নাম। সদ্য সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপাজয়ী দলের সহঅধিনায়কের দায়িত্ব ছিল তার কাঁধে। খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়ে মারিয়া কথা বলেছেন সাম্প্রতিক সাফল্য ও প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিবেদক তোফায়েল আহমেদ
খবরের কাগজ: সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে পর পর দুই আসরে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। দুই বারই দলের সারথি আপনি। এই সাফল্যের অনুভূতি কেমন?
মারিয়া মান্দা: আমরা ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হই। প্রথমবার জেতায় খুব ভালো লেগেছিল। দ্বিতীয়বারের মতো আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। খুব ভালো লাগছে যে, দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি। এটাই আসলে নিজের কাছে স্বার্থকতা। আর আমাদের যে এত এত পরিশ্রম, সেটা কাজে দিয়েছে। এ জন্য আমরা খুবই আনন্দিত।
খবরের কাগজ: এবারের চ্যাম্পিয়নশিপটা নিশ্চয়ই অনেক কঠিন ছিল?
মারিয়া মান্দা: অবশ্যই। কারণ এবার সব দলই অনেক উন্নতি করে এসেছিল। আগে যখন আমরা খেলেছিলাম, তখন মালদ্বীপ, ভুটান একটু অন্য রকম (কম শক্তির) দল ছিল। মানুষ আগে থেকেই বুঝতে পারত যে তাদের বিপক্ষে জয় সম্ভব। এবার কিন্তু সেটা ছিল না। এবার সব দল খুব ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল। সবাই চেয়েছে চ্যাম্পিয়ন হতে। সব দলের মধ্যে এই লক্ষ্যটা ছিল যে, কেউ কাউকে ট্রফি নিয়ে যেতে দিবে না। আমরা নিজেদের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলাম। নিজেদের শতভাগ যদি দিতে পারি, তাহলে কোনো না কোনো ভাবে রেজাল্ট বেরিয়ে আসবে, এই বিশ্বাস আমাদের ছিল। বাকিটা ছিল সৃষ্টিকর্তার ওপরে বিশ্বাস। সৃষ্টিকর্তা চাইলে সবকিছু হবে। আমাদের মনোবল হারানো যাবে না। সেভাবে আমরা লক্ষ্য নির্ধারণ করেছি এবং প্রত্যেকটি ম্যাচ খেলেছি। ঈশ্বরের আশীর্বাদে ফলাফলও পেয়েছি। শুধু পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচটা একটু অন্য রকম হয়েছিল। ১-০ গোলে পিছিয়ে ছিলাম আমরা। হেরে যাওয়ার মতো অবস্থাও তৈরি হয়েছিল। এর পরও ১-১ ড্র করতে পেরেছি আমরা। এ ছাড়া প্রত্যেকটি ম্যাচ আমরা ভালো ব্যবধানে জিতেছি।
খবরের কাগজ: ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় এবার কি বাড়তি চাপ কাজ করেছে?
মারিয়া মান্দা: চাপ বলতে আমরা যেহেতু গতবার চ্যাম্পিয়ন ছিলাম, এবারও চ্যাম্পিয়ন হব, সবাই এই প্রত্যাশা নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। দেশবাসীকে এবারও যেন আমরা চ্যাম্পিয়নশিপ উপহার দিতে পারি, এটা আমাদের মনের মধ্যেও ছিল। চেষ্টা করেছি যে বিগত দিনের সাফল্য যেন আমরা ধরে রাখতে পারি। মনের মধ্যে শুধু এটা ছিল যে, ভালো কিছু করতে হবে।
খবরের কাগজ: শিরোপা ধরে রাখার ব্যাপারে আপনি নিজে কতটা বিশ্বাসী ছিলেন?
মারিয়া মান্দা: আমাদের কাছে আসলে টিম বন্ডিংটাই মুখ্য। টিম বন্ডিং ছাড়া কখনো কোনো রেজাল্ট হয় না। দলের মধ্যে সব সময় আমাদের আলোচনা হয়। কার কি সমস্যা, সবকিছু নিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলি। এবারের আসর নিয়ে যখন আমরা কথা বলেছি, তখন এই জিনিসটিই আমরা ফিল করতে পেরেছি, আমরা যদি একসঙ্গে শতভাগ দিয়ে খেলি, তাহলে অবশ্যই আমরা পারব। এই বিশ্বাসটা আমাদের সবার মধ্যে ছিল।
খবরের কাগজ: এবার তো টুর্নামেন্ট চলাকালে নানা বিষয়ে অনেক সমালোচনাও হচ্ছিল। এগুলো সামলানো কতটা কঠিন ছিল?
মারিয়া মান্দা: আসল কথা কি, খেলা চলাকালে আমাদের সব মনোযোগ খেলার মধ্যেই থাকে। বাকি যেগুলো আছে, সেগুলো আমাদের নিজেদের ভালো থাকার জন্য, খুশি থাকার জন্য। অনেকে আছে না, ঘুরতে পছন্দ করে, খেতে পছন্দ করে, ওই রকম একটা জিনিস। আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও করি, টিকটক করি, এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু ভিডিও বলেন, টিকটক বলেন, ঘুরতে যাওয়া বলেন, খেলাধুলার বাইরে মন ভালো রাখার জন্য এগুলো তো থাকেই। সেগুলো ধরে যদি খেলোয়াড়দের ওপর নানা দায় চাপানো হয়, তাহলে কেমন না? আপনি দেখেন, পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা থাকা উচিত, এরকম কথা বলি আমরা। আমরা খেলোয়াড়দেরও খেলার পাশাপাশি মন ভালো রাখার জন্য কিছু করে থাকি। এখানে তো দোষের কিছু থাকার কথা নয়। একটা কথা- জাতীয় দলে খেলার মধ্যে আমরা এসব বিষয়ে অ্যাফোর্ড দেই না। খেলার দিকেই আমাদের সব মনোযোগ থাকে।
খবরের কাগজ: এসব সমালোচনাকে একপাশে রেখেই তো চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। নেপাল থেকে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরার পর কেমন লাগছে?
মারিয়া মান্দা: চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফেরার পর তো বাফুফে ভবনেই আছি। এখনো বাসায় যেতে পারিনি। বুধবার নতুন সভাপতি আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। সব মিলিয়ে ভালোই কাটছে সময়।
খবরের কাগজ: বাড়ি যাওয়ার জন্য কি মন ব্যাকুল হয়ে আছে?
মারিয়া মান্দা: ব্যাকুল বলতে কি, যেহেতু চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। আমাদের তো এখন আরও ভালো কিছু করার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। এগুলোই টার্গেট। সামনে ক্রিসমাস আসছে। তখন তো বাড়ি যাবই।
খবরের কাগজ: এবারের ক্রিসমাসের আনন্দ নিশ্চয়ই অন্য রমম হবে? সাফে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন বলে কথা?
মারিয়া মান্দা: হ্যাঁ, সেটা তো হবেই… (হাসি)।
খবরের কাগজ: এখন আগামী আসরে নিশ্চয়ই হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়নশিপে চোখ থাকব? আর এ জন্য কি প্রয়োজন বলে মনে করেন?
মারিয়া মান্দা: ভালো কিছু করতে গেলে তো অবশ্যই ভালো কিছু প্রয়োজন। যেমন প্র্যাকটিসের জন্য আমাদের ভালো ভেন্যু দরকার। এবার যেমন ঘাসের মাঠে খেলা ছিল। তাই আমরা বসুন্ধরা কিংসে গিয়ে ঘাসের মাঠে প্র্যাকটিস করতাম। বাফুফে থেকে সেটা অনেক দূর ছিল। ধারে-কাছে আমাদের এ ধরনের মাঠ দরকার। যে ধরনের ভেন্যুতে খেলা থাকে, সেই ভেন্যু অনুযায়ী যদি আমরা প্র্যাকটিস করতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য ভালো। আর প্রত্যেকবারই ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হবে-হবে করে বাতিল হয়ে যায়। যদি ঘন ঘন ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলা হয়, তাহলে আমাদের উন্নতির জন্য ভালো হবে। কারণ আমাদের অনেক ভুল-ভ্রান্তি থাকে। ফ্রেন্ডলি ম্যাচ হলে সেগুলো আমরা বুঝতে পারি। কীভাবে সেখান থেকে আমরা বের হতে পারি, নিজেরা সেই চেষ্টাটা তখন করতে পারি। প্রীতি ম্যাচ না হলে সেগুলো আমরা ধরতে পারি না। নিজেরা-নিজেরা খেলা হলে অতটা ভুল-ত্রুটি বের হয় না। একসঙ্গে ক্যাম্পিং করা, প্রীতি ম্যাচ খেলা, এগুলো খুবই জরুরি। এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয় আছে। যেমন- জিমের কথা বলবেন। আমাদের জিমে কিন্তু অনেক কিছুই নেই। দুয়েকটা যা আছে, সেগুলো আসলে কাজে দেয় না। খুব গুরুত্বপূর্ণ যেগুলো, অন্তত সেগুলো যদি থাকে, সেটা আমাদের খেলার জন্য আরও শক্তিশালী করে তুলবে।
খবরের কাগজ: মেয়েদের লিগটা ভালোভাবে আয়োজিত হোক, এটাও নিশ্চয়ই চাইবেন?
মারিয়া মান্দা: লিগ নিয়মিত হলে তো সেটা আমাদের জন্য অনেক ভালো। বয়সভিত্তিক বলেন, সিনিয়র পর্যায় বলেন, অনেক ভালো খেলোয়াড় এর মাধ্যমে উঠে আসবে।
খবরের কাগজ: নিয়মিত বেতন না হওয়াটাও তো আপনাদের বড় একটি সমস্যা…
মারিয়া মান্দা: আমাদের যে সমস্যাগুলো ছিল, আমাদের সভাপতি চেষ্টা করবেন সমাধানের। যেগুলো প্রয়োজনীয় সেগুলো নিশ্চয়ই তারা দেবেন।
খবরের কাগজ: দেশে ফেরার পর প্রধান উপদেষ্টা আপনাদের সংবর্ধনা দিয়েছেন। শুনেছি, আপনারা নিজেদের জন্য ঢাকায় একটি করে ফ্ল্যাট চেয়েছেন?
মারিয়া মান্দা: আমাদের সবার চাওয়া এটি। কারণ যখন আমাদের পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসতে চাই, তখন পরিবারকে রাখার জন্য কোনো জায়গা থাকে না। ঢাকার শহরে তো এরকম পরিস্থিতি নেই যে, আমাদের পরিবারকে রাখব। সেই হিসেবে যদি সরকার আমাদের প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জন্য একটি করে ফ্ল্যাট দেয় তাহলে আমাদের জন্য খুব ভালো হয়।
খবরের কাগজ: আপনার মার তো অনেক অবদান। অনেক ত্যাগ তার। মা কতটা খুশি এবারের সাফল্যে?
মারিয়া মান্দা: মা তো অনেক বেশি খুশি। শুধু সফল হয়েছি বলেই না, মা সব সময়ই খুশি থাকে আমাকে নিয়ে। মা সব সময় বলে, খেলার মাঠে নামার আগে ঈশ্বরের কথা মনে করবি। প্রার্থনা করে মাঠে নামবি। আমি সেই চেষ্টাটা সব সময় করি।
খবরের কাগজ: নিজের কাছে কি চাওয়া আপনার? মারিয়া ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
মারিয়া মান্দা: আমরা যেন দেশের জন্য আরও ভালো কিছু করতে পারি। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বলি, আমারও ইচ্ছে দেশের বাইরে লিগ খেলার। ভুটানের ক্লাবের হয়ে একবার খেলেছিও। যেন দেশের বাইরে লিগ আরও বেশি খেলতে পারি এবং দেশকে যেন আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।