অফুরন্ত দমের এক ফুটবলার শামসুন্নাহার সিনিয়র। মূলত ডিফেন্ডার হলেও রক্ষণ সামলানোর পাশাপাশি ফরোয়ার্ডদের বল জোগানের কাজটাও করেন তিনি নিপুণভাবে। বাংলাদেশের টানা দুটি সাফ শিরোপা জয়ে তার রয়েছে অগ্রগণ্য ভূমিকা। দুই আসরেই সবগুলো ম্যাচ খেলেছেন পুরো ৯০ মিনিট। সম্প্রতি খবরের কাগজের মুখোমুখি হয়েছিলেন কলসিন্দুরের কৃতী এই কন্যা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিবেদক তোফায়েল আহমেদ।
খবরের কাগজ: আপনি তো নিয়মিতই দুর্দান্ত পারফর্ম করেন। কিন্তু সব সময় কেমন যেন আড়ালে থেকে যান…
শামসুন্নাহার সিনিয়র: ভাইয়া, এ রকমটা না। আপনি যদি ওই চোখে দেখেন যে আড়ালে আছি, তাহলে আপনার কাছে আড়ালে মনে হবে। আর যদি আপনি ভাবেন, আড়ালে নেই, তাহলে আপনার কাছে এমন মনে হবে না।
খবরের কাগজ: আপনি বিষয়টা আসলে কীভাবে দেখেন। আপনার মনের কথাটা বলুন তো…
শামসুন্নাহার সিনিয়র: আমি বিষয়টা খারাপ চোখে দেখি না। ভালো চোখেই দেখি। সব সময় আড়ালে থাকতেই আমার বেশি পছন্দ। আড়ালে থেকে যদি ভালো কিছু করতে পারি, এটা আমার জন্য ভালো।
খবরের কাগজ: কিন্তু কখনো কখনো খারাপ লাগাও তো কাজ করার কথা। অন্য অনেককে নিয়ে যেমন মাতামাতি হয়। আপনাকে নিয়ে সেটা হয় না…
শামসুন্নাহার সিনিয়র: না-না, এ নিয়ে কোনো খারাপ লাগা কাজ করে না আমার মধ্যে। আমি তো ডিফেন্ডার। আমি যতটুকু জানি, ডিফেন্ডাররা এমনিতেই আড়ালে থাকে।
খবরের কাগজ: এই যে পরপর দুটি সাফ শিরোপা এনে দিলেন দেশকে। দুই আসরেই সবগুলো ম্যাচে খেলেছেন ৯০ মিনিট করে। কেমন লাগছে?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: প্রথমবার খুব উপভোগ করেছি। দ্বিতীয়টা সে রকম না। তবে ভালো লাগছে। আসলে যেকোনো কিছুরই প্রথমবারের স্বাদ আলাদাই থাকে।
খবরের কাগজ: কিন্তু এবার শিরোপা ধরে রাখাটা নিশ্চয়ই অনেক কঠিন ছিল?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: হ্যাঁ, যে রকম স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন, ঠিক একই রকম আমাদের দায়িত্ব ছিল চ্যাম্পিয়নশিপ ধরে রাখার। আমরা সেটা করতেও পেরেছি। এটাই আনন্দ।
খবরের কাগজ: কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে এবার?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: এবার ফাইনাল ম্যাচটা একদমই সহজ ছিল না। নেপাল ও ভারতের মধ্যে সেমিফাইনাল ম্যাচটার কথা যদি বলি। ফাইনালের আগে ওটাই শেষ ম্যাচ ছিল। ওই ম্যাচে মাঠের অবস্থা খুব করুণ ছিল। অনেক ঝামেলা হয়েছে। নেপালি দর্শকে পুরো স্টেডিয়ামের গ্যালারি পূর্ণ ছিল। আমাদের ভেতরে একটা ভয় কাজ করেছিল। কারণ ফাইনালেও তো এমন হবে। যেহেতু আমাদের প্রতিপক্ষ স্বাগতিক নেপাল। আমাদের দলে বেশ কজন জুনিয়র খেলোয়াড় ছিল। এ রকম দর্শকের মধ্যে জুনিয়ররা কিন্তু আগে খেলেনি। আমাদের কাছে দ্বিতীয়বার হলেও ওদের কাছে এমনটা প্রথম ছিল। ওদের সঙ্গে আমরা এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি যে ‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এর আগেরবারও আমরা খেলেছি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, আমরা আছি। তোমরা তোমাদের খেলাটা খেলো।’ এর পরও ভয় কাজ করছিল। কিন্তু যখন মাঠে নামলাম, জাতীয় সংগীত শুরু হলো, তখন অন্য রকম একটা শক্তি এসেছে শরীরে। ভয়টা কেটে গেছে। নেপালি দর্শক যখন চিৎকার করছিল, তখন ভেবেছি তারা আমাদের জন্যই চিৎকার করেছে। আমরা ভালো খেলেছি বলে কিন্তু একপর্যায়ে দর্শক চুপও হয়ে গিয়েছিল।
খবরের কাগজ: নেপালের সাবিত্রা ভান্ডারিও তো বড় হুমকি ছিল। তাকে নিয়ে আপনাদের কী পরিকল্পনা ছিল?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: আমাদের পরিকল্পনা ছিল তার সঙ্গে একজন না একজন সব সময় থাকবে। তাকে একা ছাড়া যাবে না। একা ছাড়লে সেটা আমাদের ডিফেন্ডারদের জন্য বিপদ।
খবরের কাগজ: ফাইনালে শেষ গোলটা তো হলো আপনার থ্রোয়িং থেকে। এই যে অ্যাসিস্ট করা, সব সময় ওভারল্যাপ করে খেলা, এটাই কি আপনার খেলার স্টাইল?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: ২০১৪ সালে আমি প্রথমবার বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে ঢুকি। তখন থেকেই আমি এভাবে খেলে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আর আমি জুনিয়র দলে কিন্তু উইংয়ে (লেফট উইং) খেলতাম। সিনিয়র দলে একটু দায়িত্ব নিয়ে খেলতে হয়, তাই ডিফেন্ডার হিসেবে খেলি। আর যেটা বললেন, ওভারল্যাপ করে খেলা, ওইটা আমার হয়ে যায়।
খবরের কাগজ: তার মানে রক্ষণ সামলানোর সঙ্গে সঙ্গে গোল করারও ইচ্ছা কাজ করে?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: গোল করার থেকে গোল করানোর ইচ্ছাটা বেশি কাজ করে আমার।
খবরের কাগজ: সাফ জিতে ফেরায় এখন তো চারদিক থেকে অনেক অভিনন্দন পাচ্ছেন। সামনে আরও ভালো করতে কী চাওয়া থাকবে আপনাদের?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: যেভাবে আমরা এখন আছি, মানে আমাদের একসঙ্গে ক্যাম্প চলছে, এভাবে যদি থাকতে পারি, তাহলে আমাদের নিজেদের জন্য ভালো। দেশের জন্যও ভালো। এভাবে একসঙ্গে ক্যাম্পিংয়ের মধ্যে থাকলে আমরা দেশকে ভালো কিছু উপহার দিতে পারব, এশিয়ার ভেতর ভালো কিছু করতে পারব। সেই সঙ্গে নিয়মিত বেতনটা যদি আমরা পাই, লিগটা যদি নিয়মিত হয়, তাহলে সেটা আমাদের জন্য ভালো হয়। আরেকটা ব্যাপার, যেকোনো টুর্নামেন্টের আগে আমাদের প্রীতি ম্যাচ থাকা দরকার। এবার যেমন প্রীতি ম্যাচ ছিল না। এ জন্য আমাদের বেশ ভুগতে হয়েছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে যেমন করুণ অবস্থা ছিল আমাদের। যে পাকিস্তানকে আমরা ৬-৭ গোল দিতাম, এবার তাদের সঙ্গে হারতে হারতে ড্র (১-১) করেছি।
খবরের কাগজ: প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা হয়নি বলেই ওই ম্যাচটা এত কঠিন হয়েছে বলছেন?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: হ্যাঁ, প্রস্তুতি ম্যাচ হলে আমরা আমাদের ভুলত্রুটিগুলো ধরতে পারতাম, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে পারতাম। পাকিস্তান ম্যাচে যেমন ভুলত্রুটি হয়েছে। কিন্তু ভারতের বিপক্ষে পরের ম্যাচে সেটা আর হয়নি। ভালো ভালো দলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ খেলে যেতে পারলে পাকিস্তানের সঙ্গে হয়তো অমনটা হতো না। আর এখানে একটা মিসটেকও ছিল।
খবরের কাগজ: কী সেটা?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: কোচের বিষয়টা…। কোচ একটু উল্টাপাল্টা কাজ করেছেন। জুনিয়রদের নামিয়েছেন। ওরা ভালো খেলেনি এমনটা না। ওরাও সুপার খেলোয়াড়। তবে অভিজ্ঞতাটা দরকার ছিল। কারণ এটা সিনিয়র টিম, এটা জুনিয়র টিম ছিল না। পরে আমরা কয়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড় এই বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছি। এরপর তো দ্বিতীয় ম্যাচে দেখেছেন, ম্যাচ কীভাবে ঘুরে গেছে।
খবরের কাগজ: তার মানে ভারত ম্যাচের আগে সিনিয়র খেলোয়াড়দের খেলানো নিয়ে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আপনাদের আলোচনা হয়েছে?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমরা এ নিয়ে কথা বলেছি ওনাদের সঙ্গে। ওনারা তো ওনাদের কাজ করবেই। কিন্তু আমরা আমাদের কথাটা বলেছি। কারণ দেশ আমাদের। বাটলার (প্রধান কোচ পিটার বাটলার) তো সব সময় থাকবেন না। আমাদের দায়িত্বটা আমাদের নিতে হবে।
খবরের কাগজ: ওনি নাকি আপনাদের চ্যালেঞ্জও ছুড়ে দিয়েছিলেন?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: হ্যাঁ, আমরা চ্যালেঞ্জ নিয়েই খেলেছি সত্যি কথা। আমরা আমাদের নিজেদের জন্য, দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য খেলেছি।
খবরের কাগজ: ভারতের বিপক্ষে সেই চ্যালেঞ্জ জয়ের পরই তো সব বদলে গেল…
শামসুন্নাহার সিনিয়র: আমাদের টার্গেট ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে যে ভুলগুলো হয়েছে, সেগুলো অতিক্রম করে ভালো কিছু করার। ভারত ম্যাচের আগে আমরা নিজেরা কথা বলেছি, যেভাবেই হোক ম্যাচটা আমাদের জিততে হবে। গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। এটা আমরা করতে পেরেছি।
খবরের কাগজ: একটু পেছনে ফিরে যাই। আপনার উঠে আসার কথাটা ছোট করে বলুন?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: ২০১২ সালে বঙ্গমাতা আন্তপ্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে আমার খেলা শুরু। পরিবার থেকে তখন খুব একটা সাপোর্ট দিত না। আমার আব্বু শুধু আমাকে সাপোর্ট করতেন। সানজিদা, তহুরারা খেলত, আমি শুধু বসে বসে দেখতাম। আমার খেলার ইচ্ছা ছিল, আগ্রহ ছিল। পরে আমাদের কলসিন্দুরের মফিজ স্যারকে (মজিফ উদ্দিন) বলেছি, আমি খেলতে ইচ্ছুক। আমার আব্বু আমাকে নিয়ে যান তার কাছে। এভাবেই শুরু। আমাদের গ্রামের অনেক মানুষই নানা ধরনের কথাবার্তা বলত তখন। সেগুলো অতিক্রম করেই এই জায়গায় এসেছি। ২০১৪ সালে প্রথমবার বয়সভিত্তিক জাতীয় দলে ডাক পাই। ২০১৬ সালে প্রথমবার সিনিয়র সাফে খেলি। সেবার অনেক ছোট ছিলাম। এগুলো নিয়ে সাংবাদিকরা অনেক কথা বলেছেন, যে এত ছোট মেয়ে কীভাবে খেলবে (হাসি)। কিন্তু আমাদের তখনকার কোচ ছোটন স্যার (গোলাম রব্বানী ছোটন) বলেছিলেন, না পারবে ওরা (হাসি)।
খবরের কাগজ: তো, মা-বাবা কতটা খুশি আপনার সাফল্যে?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: মা-বাবা অনেক খুশি। ফাইনালে আমরা যখন একটা গোল খেয়েছি অনেক মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তাদের। আমাদের থেকে ওনারাই বেশি উত্তেজিত থাকেন।
খবরের কাগজ: কতজন ভাইবোন আপনারা?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: আমরা চার বোন, এক ভাই। আমি চার নম্বর। আমার বাবা কৃষিকাজ করেন। মা গৃহিণী।
খবরের কাগজ: শেষ প্রশ্ন। শামসুন্নাহার ভবিষ্যতে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
শামসুন্নাহার সিনিয়র: অবশ্যই সব ফুটবলারের স্বপ্ন থাকে, ভালো খেলবে। ইউরোপের লিগে খেলবে। নিজের দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। আমিও এমন স্বপ্ন দেখি।