রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
কবি ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতার প্রথম দুটি চরণ যেন টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের দুই যুগ পূর্তিকেই ইঙ্গিত করছে।
২০০০ সালের ২৬ জুন লর্ডসে আইসিসির সভায় বিশ্বের দশম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটের বনেদি পরিবারের সদস্য হয়েছিল। সে বছরই ১০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে খেলেছিল নিজেদের অভিষেক টেস্ট। কালের চক্র ঘুরে আজ আবার সেই ১০ নভেম্বর। মাঝে পেরিয়ে গেছে ২৪টি বছর। দুই যুগ। এই সময়ে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটে যতটা এগোনোর ছিল, তার কিছুই হয়নি। যেই তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। আলোর দেখা পায়নি। এখনো আসমান ভরা মেঘে। মাঝে মাঝে আসে এক একটি জয়। যে জয়কে অমৃত মনে করেন সবাই, যার রস পান করে অপার সুখ পাওয়ার চেষ্টা করেন! ফুলে-ফেপে করে তোলেন রঙিন। কিন্তু এ সবই যেন মরীচিকা?
ভারতের বিপক্ষে নিজেদের অভিষেক টেস্টে বাংলাদেশের শুরু দেখে সবাই আশান্বিত হয়ে উঠেছিলেন। এর পেছনে যৌক্তিক কারণও ছিল। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের সংগ্রহ ছিল পুরোপুরি ৪০০। আমিনুল ইসলাম বুলবুল করেছিলেন সেঞ্চুরি। তার ব্যাট থেকে এসেছিল ১৪৫ রানের ইনিংস। বল হাতে অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দূর্জয় ১৩২ রানে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। যদিও দ্বিতীয় ইনিংসে ৯১ রানে অলআউট হয়ে বাংলাদেশ হেরেছিল ৯ উইকেটে। কিন্তু এই হারের মাঝেও ছিল আশার আলো। কারণ বাংলাদেশের ৪০০ রান ছিল অনেক বড় একটি অর্জন। একমাত্র জিম্বাবুয়ে ছাড়া আর কোনো দেশই তাদের অভিষেক টেস্টে ৪০০ বা তদোর্ধ্ব রান করতে পারেনি। ১৯৯২ সালে হারারেতে ভারতের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ে করেছিল ৪৫৬ রান। টেস্টটি তারা ড্র করতে পেরেছিল। আবার আমিনুল ইসলাম বুলবুলের ১৪৫ রানও ছিল মাইলফলক। তার ওপরে আছেন অস্ট্রেলিয়ার চার্লস ব্যানারম্যান। তিনি মেলবোর্নে ১৮৭৭ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের অভিষেকে করেছিলেন ১৬৫ রান। টেস্ট ক্রিকেটে সেটি ছিল প্রথম টেস্টও। আবার ভারতের বিপক্ষে জিম্বাবুয়ের ডেভিড হাটন করেছিলেন ১২১ রান। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ডাবলিনে পাকিস্তানের বিপক্ষে আয়ারল্যান্ডের অভিষেক টেস্টে তাদের পল স্টার্লিং ১১৮ রান করেছিলেন।
এদিকে নাঈমুর রহমান দূর্জয়ের ১৩২ রানে ৬ উইকেট ছিল দেশের অভিষেক টেস্টে সেরা। আর কেউ দেশের হয়ে অভিষেক টেস্টে ৬ উইকেট নিতে পারেননি। তবে ৫ উইকেট করে নেওয়ার কীর্তি আছে আরও বেশ কয়েকটি। অভিষেক টেস্টের বাংলাদেশের প্রথম ইনিংসের এই কীর্তি টেস্ট শেষ হতে না হতেই আকাশে মিশে যায়। সামনে চলে আসে দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৯ রানে অলআউট হওয়াটা! কারণ এরপর বাংলাদেশ দল আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। টেস্ট খেলতে নেমেছে যেন হারকে মেনে নিয়েই। তা কখনো ইনিংসের ব্যবধানে, কখনো বড় রান বা বেশি উইকেটের ব্যবধানে। সঙ্গে ছিল ৩ দিনে টেস্টের সমাপ্তি। এই ধারার ব্যত্যয় ঘটিয়ে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় নিজেদের ৩৫তম টেস্টে। ২০০৫ সালে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে তাদের প্রতিপক্ষ ছিল জিম্বাবুয়ে। জিতেছিল ২২৬ রানে। এর মাঝে মাত্র ৩টি টেস্ট ড্র করতে পেরেছিল। অন্য দলগুলোর বিবেচনায় এই জয় বাংলাদেশ পেয়েছে আবার অনেক বিলম্বে। বাংলাদেশের চেয়ে বেশি টেস্ট খেলে জয় পেয়েছে শুধু নিউজিল্যান্ড। তাদের লেগেছিল ৪৫ টেস্ট।
২৪ বছরের পথ-পরিক্রমায় বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত টেস্ট খেলেছে ১৪৮টি। যেখানে জয়ের পাল্লা খুবই নিম্নগামী মাত্র ২১টি। বিপরীতে হার ১১৯টি। ২১ জয়ের মাঝে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই সবচেয়ে বেশি ৮টি। এখানেও কিন্তু আছে। একসময় জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী থাকলেও ক্রমে শক্তি হারাতে হারাতে এখন তারা ক্ষয়িষ্ণু।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাওয়া ৪ জয়ও জিম্বাবুয়ের মতোই। আগের সেই দুর্ধর্ষ শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ এখন ইতিহাসের পাতায়। নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তানের বিপক্ষে পাওয়া ২টি করে কিংবা ইংল্যান্ডে-অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১টি করে জয় এলেও সেখানে ছিল না ধারাবাহিকতা। যেমন মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৮ উইকেটে জয়ের পর ক্রাইস্টচার্চে পরের টেস্টে হার ছিল ইনিংস ও ১১৭ রানে। আবার অস্টেলিয়ার বিপক্ষে ২০ রানে জেতার পর পরের টেস্টে হেরেছিল ৭ উইকেটে। এমনকি পাকিস্তানকে তাদের মাটিতে ২ টেস্টের সিরিজে হোয়াইটওয়াশ করার পরও বাংলাদেশ টেস্টে ধারাবাহিক হতে পারেনি। এরপর তারা ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২টি করে চার টেস্ট খেলে খুবই বাজেভাবে হেরেছে। মান এতটাই নিম্নগামী হয়েছে, ২০১৭ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া আফগানিস্তানের কাছেও প্রথম দেখায় হারতে হয়েছে। যেটি ছিল আবার আফগানদের দ্বিতীয় টেস্ট। অথচ এই আফগানিস্তান ঘরের মাঠে খেলতে পারে না কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ। তারা খেলে যাচ্ছে পরবাসী ক্রিকেট। মোট কথা, টেস্ট ক্রিকেটে এই ২৪ বছরে বাংলাদেশ কখনোই ধারাবাহিক হতে পারেনি। ধারাবাহিক হতে আর কত বছর লাগবে, তা রাডারে ধরা পড়ছে না।