বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশ আজ এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে খেলে যাচ্ছে। খেলছে তিন ফরমেটের ক্রিকেটই। আইসিসির ইভেন্টেও খেলছে নিয়মিত। অথচ একসময় আইসিসির ইভেন্ট খেলা ছিল সোনার হরিণ! অনেক চেষ্টা-সাধনার পর ষষ্ঠবার ১৯৯৯ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। তখন আইসিসি টুর্নামেন্ট বলতেই ছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ। আর বাংলাদেশ প্রতিবার সেখানে অংশগ্রহণ করেছে ঢাকা প্রিমিয়ার বিভাগ (তখন ছিল প্রথম বিভাগ) ক্রিকেট লিগ খেলে। এরপর ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদাও পায় বলা যায় ঢাকার ক্রিকেট লিগকে কেন্দ্র করেই। কারণ জাতীয় ক্রিকেট লিগ শুরুই হয়েছিল ১৯৯৯-২০০০ মৌসুমে। আবার টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার আগে বাংলাদেশে যেসব বিদেশি দল খেলতে এসেছে, তাদের বিপক্ষে বাংলাদেশ যে ওয়ানডে ও প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছে, সেখানে জাতীয় দল গড়াও হতো এই ঢাকা লিগকে কেন্দ্র করেই। বলা যায়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থানের ‘বীজ’ বপনই হয়েছে ঢাকার লিগ থেকে। যে কারণে বিসিবির পরিচালনা পর্ষদেও ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের সংগঠকদের প্রাধান্য বেশি। এবার ঢাকা লিগের ক্লাব কর্মকর্তাদের অধিকার হরণও কমিয়ে আনার পাঁয়তার চলছে।
বিসিবির গঠনতন্ত্রে অনুচ্ছেদ ১৩-এ পরিচালনা পর্ষদ গঠন প্রসঙ্গে ১৩.২ (খ) ২-এ বলা হয়েছে, ক্যাটাগরি-২ হতে সিসিডিএম (ঢাকা মেট্রোপলিটন ক্লাব প্রতিনিধি) হতে ১২ জন পরিচালক নির্বাচত হবেন। কিন্তু বিসিবির নতুন খসড়া গঠনতন্ত্রে সেটিকে কমিয়ে মাত্র ৪ জন রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে কাউন্সিলরশিপও কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে যেখানে ৭৬ জন কাউন্সিলর আছেন, সেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে ৩০ জন। এ নিয়ে ফুঁসে উঠেছে ঢাকার ক্লাবগুলো। ইতোমধ্যে তারা মতবিনিময় সভা করে বিসিবিকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ডাক দিয়েছে লিগ বয়কটের। তাদের লিগ বর্জনের কারণে শুরু হতে পারেনি প্রথম বিভাগ লিগ। হুমকির মুখে আছে প্রিমিয়ার বিভাগ লিগও।
প্রিমিয়ার বিভাগ ক্রিকেট লিগের শক্তিশালী প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব আবির্ভাবের পর একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবারই তারা জাতীয় দলের একাধিক ক্রিকেটার নিয়ে শিরোপা জেতার মতো দল গড়ে। সেই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বিসিবির সাবেক পরিচালক তানজিল চৌধুরী এ রকম প্রস্তাবনায় যারপরনাই অবাক হয়েছেন। তিনি এ রকম প্রস্তাবনাকে ‘হিপোক্রেট’ বলে মন্তব্য করেছেন। তানজিল চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেট মনিটাইজেশন হোক। আমরা বিপিএলকে আইপিএলের সঙ্গে তুলনা করি। কিন্তু বিপিএলে ঠিকমতো টাকা দিতে পারছে না। যেভাবে করা হচ্ছে, সেটা বরং কোনো কিছুই হচ্ছে না। কেউ কোটি কোটি টাকা খরচ করবে। বিনিময়ে সে কিছুই পাবে না। রাইটস নেই, কাউন্সিলরশিপ নেই। যে কারণে বারবার ফ্র্যাঞ্চাইজি বদল হচ্ছে। ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটও অনেকটা সে রকম।’ তিনি বলেন, ‘অপ্রিয় হলেও সত্যি, সিসিডিএম যেহেতু ঢাকাকেন্দ্রিক। তাই এখান থেকেই সব কিছু হচ্ছে। ক্লাবগুলো যদি কোনো কিছু না পায়, তা হলে তারা কেন কোটি কোটি টাকা খরচ করবে? প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্রে বিভাগগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এটা সত্যি, বিভাগগুলো থেকেই খেলোয়াড়রা আসে ঢাকায়। ঢাকায় আসার পর ক্লাবগুলোতে খেলে তারা আর্থিক বেনিফিট পেয়ে থাকে। ক্লাবগুলো না খেললে তারা খেলবে কোথায়? তাই গঠনতন্ত্রে ক্লাবগুলোকে গুরুত্ব না দেওয়া হাস্যকার। এটা যারা করেছে তারা হিপোক্রেট। ক্রিকেট সম্বন্ধে তাদের ভালো ধারণা নেই।’
বিসিবিতে ১৯৮৩ সাল থেকে বিভিন্ন সময় দায়িত্ব পালন করা আবাহনীর ক্রিকেট কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান আহমেদ সাজ্জাদুল আলম ববি মনে করেন শুধু ক্রিকেট নয়, বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনই ক্লাবনির্ভর। বাংলাদেশের ক্রিকেটে ক্লাবগুলোর অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গত ৬০-৭০ বছর ধরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন পুরোপুরি নির্ভরশীল ঢাকার ক্লাবগুলোর ওপর। বিশেষভাবে ক্রিকেটের কথাই যদি বলি, তাদের বাজেট ১০০ কোটির কাছাকাছি। এই বিনিয়োগটা হয়েছে কিন্তু ক্রিকেটের ভালোর জন্য, ক্রিকেটারদের ভালোর জন্য। এই সব কিছুই কিন্তু আমি বিনিয়োগ হিসেবে দেখব। এখন অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করেছেন যে, তৃতীয় বিভাগের একটা দল আর একটা জেলা দল কি একই মর্যাদার? এটা আসলে হওয়ার কথা না। তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, জেলার সংগঠন বিভিন্ন বাস্তবতার কারণে তারা সেই সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এখন যখন একটা অংশ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে তারা বিনিয়োগ করে ক্রিকেটকে একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, তাদের তো নিরুৎসাহিত করতে পারি না। আজকে যদি আমি ৩০ জনের কাউন্সিলর বা চারজন পরিচালক নিয়ে আসি, এই বিনিয়োগটা তো না-ও হতে পারে।’ বিসিবিতে যে সংস্কারের কথা বলছে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সবাই সংস্কার সংস্কার বলছেন। সংস্কার শব্দটা অতিমাত্রায় ব্যবহার হতে হতে এর ভুল-ব্যবহার হচ্ছে বলে আমি মনে করি। যদি সংস্কারই করতে হয় তাহলে জেলা সংস্থাগুলোর ক্লাবগুলো একদম বৈধ এবং নিয়মিত আয়ের উৎস থাকতে হবে। তাহলে ক্লাবগুলো বা জেলার সংস্থাগুলো সন্দেহজনক ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়ালা লোকদের কাছে ধরনা দিতে হবে না টাকার জন্য। এমন সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া। পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচনকে মাথায় রেখে কারও কারও ব্যক্তিগত স্বার্থে নিজেদের নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়ার জন্য এটা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইন্ধন জোগাচ্ছে আবার চিহ্নিত একটা গোষ্ঠী। ক্লাবগুলো যেভাবে রি-অ্যাক্ট করেছে, আমি মনে করি একটু কমই করেছে, আরেকটু হওয়া উচিত ছিল। এটা নিয়ে গঠনতন্ত্র কমিটি যদি আরও অগ্রসর হয়, তাহলে কিন্তু তারাই দায়ী থাকবে যে কোনো পরিণতির জন্য।’ তিনি গঠনতন্ত্র কমিটির সমালোচনা করে বলেন, ‘এমন ব্যক্তিরা এই প্রক্রিয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, যারা না ক্লাব, না জেলা কোনো জায়গারই সংগঠক নন। কিন্তু সুকৌশলে তারা ক্লাব ও জেলার সংগঠকদের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু আমরা একে অপরের পরিপুরক। এখানে বিভাজনের সুযোগ নেই।’ ক্লাবগুলোর পক্ষ থেকে পরিচালক পদ ১২ থেকে বাড়িয়ে ১৬টি করার প্রস্তাবকে সমর্থন করে তা মেনে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক।
লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের কর্ণধার লুৎফুর রহমান বাদল, ‘বিষয়টি আমরা যখন জানতে পেরেছি, আমরা ক্লাবগুলো একাত্মতা ঘোষণা করে সভা করি। আমাদের সিদ্ধান্ত বিসিবিকে জানিয়ে দিই। কারণ তৃতীয় বিভাগ থেকে প্রিমিয়ার বিভাগ পর্যন্ত প্রতিবছর আমরা প্রায় ১০০ কোটি টাকার মতো খরচ করে থাকি। এটি যদি বিসিবি আমাদের মূল্যায়ন না করে, তা হলে আমরা ক্রিকেট বর্জন করব। অলরেডি কিন্তু আমরা বর্জনের মধ্যেই আছি। প্রথম বিভাগ লিগ আমরা খেলছি না। আমরা বিসিবি সভাপতিকে স্মারকলিপি দিয়েছি। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। জানিয়েছেন এই খসড়া তিনি নিজেও পাননি। যাই হোক আমরা আমাদের কাজ করেছি। এখন ক্লাবগুলোর সুযোগ-সুবিধা যাতে বাদ না হয়,সেটাই দেখার বিষয়।’ তিনি গঠনতন্ত্র কমিটির সমালোচনা করে বলেন, ‘যারা ক্লাব ক্রিকেট চালায় না, ক্রিকেট আইন সম্বন্ধে যাদের কোনো ধারণাই নেই, তাদের কাছে বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব।’
এ ব্যাপারে গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক বিসিবির পরিচালক নাজমুল আবেদীন ফাহিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘একটা জিনিস সাবমিট করলে তখন দেখা যাবে। তার আগে তো আলাপ করার সুযোগ নেই।’ ক্লাবগুলো তার পদত্যাগ চাওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় তাদের কাছে সে রকম কোনো তথ্য গিয়েছে, যা তাদের মনোপুত হয়নি। তারা রি-অ্যাক্ট করতেই পারে।’
এদিকে গতকাল বিসিবির পরিচালনা পর্ষদ এক জরুরি সভায় বসে গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটি স্থগিত করেছে।