আত্মহত্যা হচ্ছে নিজেকে নিজে হত্যা করা। মানসিক রোগ বা অন্য কোনো কারণে নিজের জীবনকে শেষ করে দেওয়া। আত্মহত্যা দুই ধরনের, নির্ধারিত বা পরিকল্পিত, যা সাধারণত বিষণ্নতাসহ বিবিধ মানসিক রোগের কারণে হয়ে থাকে। আত্মহত্যার আরেকটি ধরন হচ্ছে ইমপালসিভ বা হঠকারী আত্মহত্যা। এটা সাধারণত আন্তব্যক্তিক সম্পর্কের টানাপড়েন (ইন্টার পারসোনাল কনফ্লিক্ট) থেকে হয়। স্টামফোর্ড চিলড্রেন্স হেলথ অবলম্বনে লিখেছেন ফখরুল ইসলাম
পৃথিবীতে প্রতিবছর ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ আত্মহত্যা। বিভিন্ন গবেষকের প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার শিকার। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ২৮ জন আত্মহত্যা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী আর এদের বেশির ভাগের বয়স ১১ থেকে ২৫-এর মধ্যে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
আত্মহত্যা কেন?
কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? এসব মানুষের কাছে যাপিত জীবনটি কেন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়- এ প্রশ্ন নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও মনোচিকিৎসকদের গবেষণার শেষ নেই। নিঃসহায় হওয়ার যাতনা আর আশাহত হওয়ার বেদনা থেকে রেহাই পেতে আত্মহননের পথ বেছে নেয় কেউ কেউ। কিন্তু মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে মুক্তির স্বাদ যারা পেতে চায়, তারা তো আসলে পরাজিত হয় নিজেরই কাছে।
টিনএজ আত্মহত্যা কেন?
বিষণ্নতা, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার ইত্যাদি রোগ আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণ। আর এই রোগগুলো বেশির ভাগ সময়ই টিনএজ বা তরুণ বয়সে দেখা দেয়। আবেগ নিয়ন্ত্রণ, আইডেন্টিটি ক্রাইসিস ইত্যাদি কারণে ইন্টারপারসোনাল কনফ্লিক্ট হয়। ফলে টিনএজারদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
এদের মধ্যে মাদকে বেশির ভাগ আসক্তি। ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপরিমিত, অযৌক্তিক ব্যবহার। পড়ালেখা, পারিবারিক সম্পর্ক, প্রেমের জটিলতা। প্রেম আর পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়া। শৈশব বা কৈশোরে শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার বা উত্ত্যক্ত হলেও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। সামাজিক দক্ষতা খানিকটা কম থাকলে, মানসিকভাবে পীড়িত হলে ও মানহানিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় অনেকে। টিনএজারের মধ্যে যাদের নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা (হাত-পা কাটা, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খাওয়া, হাত-পা পোড়ানো) থাকে বেশি, তারা আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।
পরিবারে যদি কারও আত্মহত্যার ইতিহাস থাকে, তবে অন্য সদস্যদের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না হলে, সমাজ ও পরিবার যথেষ্ট সহায়ক না হলে বা বিচ্ছিন্ন পরিবারের সদস্য হলে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটতে পারে।
যাদের ছোটবেলা থেকে সিদ্ধান্ত নিতে শেখানো হয়নি, যারা দৈনন্দিন সমস্যার সমাধান নিজে নিজে করতে অপারগ, তারা সহজেই হতাশ হয়ে পড়ে এবং আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকে। প্রচারমাধ্যমে আত্মহত্যার ঘটনাকে মহিমান্বিত করা হলে, আত্মহত্যাকারীকে মহান বানিয়ে তাকে অত্যধিক হাইলাইট করা হলে, আরেকজনের মধ্যে ‘মরে গিয়ে মহৎ’ হওয়ার চেষ্টা বা ‘কাউকে শায়েস্তা করতে হলে মরতে হবে’- এমন মনোভাব থেকে আত্মহত্যা ঘটে থাকে।
যৌন পরিচয় নিয়ে যাদের মধ্যে টানাপড়েন আছে- যারা ট্রান্সজেন্ডার, ট্রান্স সেক্সুয়াল বা যাদের যৌন আচরণ আর বিশ্বাস খানিকটা আলাদা (এলজিবিটি), তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে।
টিনএজ আত্মহত্যা: কিছু ইঙ্গিত
আত্মহত্যার আগে সব ক্ষেত্রে না হলেও বেশির ভাগ সময়ই আত্মহত্যাপ্রবণ কিশোর-কিশোরী কিছু ইঙ্গিত দিয়ে থাকে। মা-বাবা, প্রিয়জন আর শিক্ষকরা যদি এই ইঙ্গিতগুলো আগে ধরতে পারেন, তবে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যেতে পারে।
সাধারণ কথোপকথনে যারা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রায়ই মৃত্যুর কথা বলে, মরে যেতে চায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করে। আত্মহত্যা বা মৃত্যুবিষয়ক কবিতা-গান বেশি বেশি লেখা, শোনা বা পড়া। প্রায়ই হাত-পা কাটে, ঘুমের ওষুধ বেশি খায়। বিষণ্নতার লক্ষণ (মনমরা হয়ে থাকে, সব কাজে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে, নিজেকে সব বিপর্যয়ের জন্য দোষী মনে করে)।
মাদকাসক্তির লক্ষণ (চিন্তা আর আচরণের পরিবর্তন, রাতে জেগে থাকা, দিনের বেলা পর্যন্ত ঘুম, মিথ্যা বলা, টাকার চাহিদা বেশি, আগ্রাসী আচরণ করা ইত্যাদি)। বন্ধুবান্ধব, পরিবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়, সামাজিকতা এড়িয়ে চলে।
নিজের পছন্দের জিনিসগুলো ভাই-বোন বা বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে থাকা। পড়ালেখা, খেলাধুলা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেওয়া, ঘুমের সমস্যা দেখা দেওয়া, কোনো কাজে মনোযোগ দিতে না পারা।
টিনএজারদের আত্মহত্যা প্রতিরোধে করণীয়
মানসিক রোগ শনাক্ত ও চিকিৎসা: বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, ব্যক্তিত্বের বিকার, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানাবিধ মানসিক রোগের দ্রুত শনাক্তকরণ ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারলে আত্মহত্যা বহুলাংশে কমানো যায়। মানসিক রোগের অপচিকিৎসা বন্ধেও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেকোনো ধরনের মানসিক রোগ বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। কাউন্সেলিং আর প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে।
আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্তি রোধ করা: লাইসেন্সের মাধ্যমে কীটনাশকের বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং কৃষকের বাড়িতেও তা এমন জায়গায় রাখতে হবে, যাতে সহজে কেউ এসবের নাগাল না পায়। সেই সঙ্গে প্রেসক্রিপশন ছাড়া সব ধরনের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করার কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।
মিডিয়ার ভূমিকা পরিবর্তন: আত্মহত্যার কৌশল ও মাধ্যম নিয়ে ফলাও করে পত্রিকায় বা টিভিতে সংবাদ প্রচার হলে, আত্মহত্যাকারীকে মহিমান্বিত করা হলে পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যার হার বেড়ে যায়। আত্মহত্যার সংবাদ মিডিয়ায় কীভাবে প্রকাশিত বা প্রচারিত হবে, সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি নীতিমালা রয়েছে, যা মেনে চলা সব প্রচারমাধ্যমের জন্য জরুরি।
স্কুল মেন্টাল হেলথ: প্রতিটি স্কুল, কলেজে মানসিক নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার একটি ব্যবস্থা করা উচিত। জেলার মেডিকেল কলেজ থেকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে একটি টিম নিয়মিত জেলার সব স্কুল-কলেজ পরিদর্শন করবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মানসিক রোগ শনাক্তে দক্ষ হয়ে উঠবেন। শিক্ষার্থীর সঙ্গে কী ধরনের আচরণ শিক্ষকরা করবেন, সে বিষয়টি শিক্ষক প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে।
অভিভাবকদের প্রশিক্ষণ: প্রশিক্ষণ প্রয়োজন মা-বাবারও। শুধু জিপিএ-৫ আর ভালো ফলের জন্য সন্তানকে চাপ না দিয়ে তাকে সামাজিকভাবে দক্ষ হতে সহায়তা করতে হবে। সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতাও যে জীবনের অনুষঙ্গ, তা তাদের বোঝাতে হবে। মা-বাবাদের উচিত, নিজেদের জীবনেও নৈতিকতা আর সততার চর্চা অব্যাহত রাখা।
ঝুঁকিপূর্ণ শ্রেণির প্রতি বিশেষ সহায়তা: মাদকাসক্ত ব্যক্তি, মানসিক রোগী, অভিবাসী, বেকার ও সাংস্কৃতিকভাবে শ্রেণিচ্যুতদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। এ কারণে তাদের প্রতি বিশেষ সহায়তা কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। যেসব টিনএজারের মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকি রয়েছে, তাদের একা থাকতে না দেওয়া।
পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন বৃদ্ধি: নানা কারণে ভাঙছে পারিবারিক কাঠামো আর কমছে সামাজিক বন্ধন। পারিবারিক বন্ধন বাড়ানো, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, অনেকে মিলে খেলা যায় এমন খেলাধুলার সুযোগ বৃদ্ধি, সেই সঙ্গে ধর্মাচরণ মেনে চললে আত্মহত্যার প্রবণতা কমানো যায়।
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: বিভিন্ন ধর্মে ও সংস্কৃতিতে আত্মহত্যাকারী বা আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর পরিবার সামাজিকভাবে হেয় হয়। এ কারণে যাদের মধ্যে আত্মহত্যার ইচ্ছা আছে, তারা কোনো সাহায্য নিতে এগিয়ে আসতে দ্বিধাবোধ করে। ফলে বাধ্য হয়ে একসময় আত্মহত্যা করে ফেলে। যদি আত্মহত্যার বিষয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়ে সবাইকে বিশ্বাস করানো যায় যে আত্মহত্যার ইচ্ছা একটি ভুল মানসিক প্রক্রিয়া এবং এ থেকে বাঁচার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন, তবে অনেক ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সার্বক্ষণিক বিশেষ পরামর্শসেবা: জাতীয় পর্যায়ে সার্বক্ষণিক টেলিফোনে সাহায্য পাওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। কারও মধ্যে আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জন্মালে বা জীবনে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটলে, সে যেন এই বিশেষ নম্বরগুলোয় ফোন করে সুপরামর্শ পায় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
জাহ্নবী