সাহস ও একতার অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বাংলাদেশের তরুণরা সম্প্রতি পরিবর্তনের শক্তিশালী এজেন্ট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গত এক দশকে তরুণরা বেশ কয়েকটি প্রতিবাদের নেতৃত্ব দিয়েছে, যা জাতিকে তার নিষ্ক্রিয় মনোভাবের মূলে নাড়া দিয়েছে এবং উল্লেখযোগ্য সংস্কার চাইতে বাধ্য করেছে। কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ এবং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে গণতান্ত্রিক সংস্কারের বৃহত্তর আহ্বান বাংলাদেশের ইতিহাস পরিবর্তনকারী মুহূর্ত ছিল।
কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আহ্বানে ২০১৮ সালে শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির জন্য একটি ন্যায্য এবং আরও মেধাভিত্তিক ব্যবস্থার দাবি করেছিল। এই আন্দোলন একটি অন্যায্য হিসেবে বিবেচিত সিস্টেমের ওপর হতাশা থেকে শুরু হয়, যা দ্রুত দেশব্যাপী সমর্থন লাভ করে। ২০২৪ সালের কোটা আন্দোলন শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত হলেও পরে তা বৃহত্তর এবং জাতীয় আন্দোলনে রূপ নেয়। এই আন্দোলনের অন্যতম শক্তি ছিল কিশোর-কিশোরীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের কিশোর-কিশোরীরা ব্যাপক বিক্ষোভের আয়োজন করে, যা সারা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
শুধু প্ল্যাকার্ড, স্মার্টফোন এবং দৃঢ়সংকল্পকে পুঁজি করে কিশোর-ছাত্ররা রাস্তায় সমাবেশের আয়োজন করে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সমবয়সীদের সাথে সমন্বয় করে এবং অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে মিডিয়া ও সরকারের কাছে তাদের সমর্থন তুলে ধরে। শুধু ঢাকায় নয়, সারা বাংলাদেশের শহর ও শহরের রাস্তায় কিশোর-কিশোরীরা সংহতির তরঙ্গ তৈরি করে, যা উপেক্ষা করা অসম্ভব ছিল।
কেন তারা এই আন্দোলনকে নিজেদের করে নিলেন, এ প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ নৌবাহিনী কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী সাব্বির, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী মেহেরুন্নেছা, দিনাজপুর পুলিশ লাইনস উচ্চ বিদ্যালয়ের শিমুলসহ একাধিক কিশোর-কিশোরী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন শুরু করেছিল তা শুধু তাদের একার জন্য ছিল না। আমাদের জন্যও ছিল। আমরা কিছুদিন পর একই বৈষম্যের শিকার হতাম। ওরা আমাদের জন্য লড়াই করে আমাদের পথ পরিষ্কার করেছে- যেন আমরা মেধার ভিত্তিতে চাকরি করতে পারি। দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মৌনতা আক্তার মৌ বলেন, আন্দোলন শুরু হয়েছিল কোটা না মেধা নিয়ে, আমরা সবাই জানি যে কোটার জন্য মেধা চাপা পড়ে যাচ্ছে। বড় ভাইয়ারা এটি বুঝতে পেরেছিল, এজন্য তারা শুরু করেছে। আবু সাঈদ ভাইয়া যে বুক পেতে দিয়েছেন, তিনি তো নিজের কথা ভাবেন নাই, পরবর্তী প্রজন্মের কথা, আমাদের কথা ভেবেছেন। কত ভাইবোন মারা গেছে, আমরা কীভাবে বসে থাকতাম!
তিনি আরও বলেন, আমাদেরকে দেখে আমাদের ছোটরাও এটা শিখতে পারল। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমটা জাগ্রত থাকবে।
শিক্ষার্থীদের এই সংগঠিত, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের শক্তির প্রমাণ হিসেবে সরকার কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়। হাইকোর্টের রায়ে শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতিফলন থাকলেও, সরকার কর্তৃক শিক্ষার্থী হত্যাসহ নানাবিধ দমন-পীড়নের বিচারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের সুদৃঢ় অবস্থান শেষ পর্যন্ত একটি উল্লেখযোগ্য বিজয়ের দিকে বাংলাদেশকে নিয়ে যায়। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী শিমুল ইসলামের ভাষায়, আমাদের ভাইদের লাগাতার শহিদ হওয়া আমাদেরকে এক দফার দিকে নিয়ে যায়। আমাদের সবার মধ্যে একতা, আবেগ এবং আত্মবিশ্বাস কাজ করেছে।
এই আন্দোলনে একপর্যায়ে বাংলাদেশের কিশোর-তরুণ-যুবাসহ আপামর জনসাধারণ আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘস্থায়ী শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। সরকারকে স্বৈরাচারী আচরণের জন্য অভিযুক্ত করে এবং বৃহত্তর গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার দাবিতে সব বয়সের ছাত্ররা মাঠে নামে। কিশোর-কিশোরীরা যাদের ভাবা হতো মোবাইল ফোন, সোশ্যাল মিডিয়া আর টিকটক প্রজন্ম, তারা রাস্তায় নেমে বাকস্বাধীনতা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচারের জন্য সোচ্চার হয়ে ওঠে।
এই আন্দোলনে কিশোর এবং তরুণ প্রজন্ম তাদের বয়সের বাঁধা পেরিয়ে অসাধারণ নেতৃত্ব এবং সাহসিকতা দেখিয়েছে, বৃহৎ আকারের প্রতিবাদের সমন্বয় সাধন করেছে। তাদের কণ্ঠস্বরকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছে এবং দমন-পীড়নের মুখে পিছিয়ে যেতে অস্বীকার করেছে।
পটুয়াখালীর শিক্ষার্থী নুরসাবা বীথি বলেন, সরাসরি মাঠে নেমে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপ তার এ জীবনে যাবে না। তবে সরব ছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। সক্রিয়ভাবে জনমত গঠনে এবং নিজের মত প্রকাশে সোচ্চার ছিলেন। কোটা আন্দোলনের দাবি নিয়ে সরকারের হাসি-ঠাট্টা তাকে ব্যথিত করেছে। ভাইবোনদের মৃত্যু এবং তাদের প্রতি অত্যাচার বীথি মেনে নিতে পারেননি। তার মতে, কোনো হৃদয়বান মানুষ এমন নৃশংসতা মেনে নিতে পারে না।
এই আন্দোলনের বিজয় শুধু কোটা পদ্ধতির সংস্কারের মতো সুনির্দিষ্ট পরিবর্তনই নয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। সাম্প্রতিক গণতান্ত্রিক সংস্কারের আহ্বান করে তরুণ সমাজ এই বার্তা দিয়েছে যে, একটি জাতির তরুণরা যখন ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তারা আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব যেকোনো কিছু অর্জন করতে পারে। এটি করে তারা কেবল নিজেদের জন্য বিজয় নিশ্চিত করেনি, বরং বাংলাদেশে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা এবং সামাজিক পরিবর্তনের একটি নতুন যুগের মঞ্চ তৈরি করেছে।
আন্দোলনপরবর্তী সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশ নতুনরূপে সেজেছে। কোনো প্রকার সরকারি বরাদ্দ ছাড়াই শুধু তরুণ প্রজন্মের ইচ্ছা ও উদ্যোগে দেশ রঙিন হয়ে উঠেছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে গ্রাফিতি, ক্যারিক্যাচার, দেয়াল লিখন, নান্দনিক সব আর্টওয়ার্ক।
কেন এই গ্রাফিতি? উত্তরে তরুণদের বক্তব্য- আন্দোলনের সময় দেয়ালে অনেক গ্রাফিতি করা হয়েছিল, এর ফলে দেয়াল খারাপ দেখাচ্ছিল। আমরা চেয়েছি দেয়ালে দেয়ালে ইতিহাস তুলে ধরতে, যেন সবাই জানতে পারে। গ্রাফিতিগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম সবাই দেখুক এবং তা ইতিহাস হয়ে থাকুক। আমরা দেশকে নতুনরূপে প্রকাশ করেছি। দেশটিকে অনেক সুন্দর আর গোছানো লাগে এখন।
আন্দোলনে পাওয়া এই দেশের কী কী পরিবর্তন দেখতে চাই?- এ প্রশ্নের উত্তরে মেহেরুন্নেছা বলেন, দুর্নীতিমুক্ত দেশ চাই, চাই সবাই আইন মেনে চলবে, স্বাধীনভাবে কথা বলবে, রাজনীতি নিয়ে কথা বলবে, নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলবে। আমাদের স্বৈরশাসন দরকার নাই। আমাদের কেউ জোর করতে পারবে না। আমি একজন সাধারণ ছাত্র এবং সাধারণ নাগরিক হিসেবে সুষ্ঠু-সুন্দর অপরাধমুক্ত দেশ চাই।
শিমুল ইসলাম বলেন, আমরা ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ করে দেখিয়েছি। এক সপ্তাহের মধ্যে সব কন্ট্রোলে চলে আসছে। রাস্তাঘাট সব পরিষ্কার। সরকার পরিবর্তন হয়েছে, দেশও ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়ে যাবে। আমি শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন চাই।
মৌনতা আক্তার মৌ বলেন, বিজয় অর্জন করার পর এখন আর মেধায় আমরা আটকে নেই। আমরা সত্যিকারের স্বাধীনতা চাই। মন খুলে কথা বলতে চাই। একদিনে সব সম্ভব নয়। আস্তে আস্তে সব হবে। আগের কাজ আর এখনকার কাজে অনেক পার্থক্য আছে। আপনারা দেখেন, আমরা যখন রাস্তায় ছিলাম তখন সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমে গেছে। বাকস্বাধীনতাটা বেশি জরুরি। কোনো অন্যায় হলে যেন মানুষ রুখে দাঁড়াতে পারে; প্রতিবাদ করতে পারে। কারও ভয়ে যেন চুপ হয়ে না থাকে- এইটাই বড় চাওয়া। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে, এতে গরিব ও মধ্যবিত্তরা ভালো থাকবে। যাতায়াতের ভাড়াটাও এমন নিয়ন্ত্রণ চাই। আমি আশা করি, বাংলাদেশ আরও অনেক ভালোভাবে এগিয়ে যাবে। আমরা আছি আমাদের দেশের সাথে।
নুরসাবা বীথি বলেন, বাংলাদেশকে দুর্নীতিমুক্ত দেখতে চাই। সরকার থেকে যে সেবা আমার প্রাপ্য, তা যেন আমাকে ঘুষ দিয়ে নিতে না হয়। সম্প্রতি মেট্রোরেলের উদাহরণ টেনে বীথি বলেন, আমরা প্রথমে শুনলাম মেট্রোরেল মেরামতে ৩০০ কোটি টাকা লাগবে, যা এখন ৫০ কোটিতে সম্ভব। এই যে ২৫০ কোটি টাকার গরমিল হিসাব- এটা আমরা দেখতে চাই না। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন চাই। শুধু সার্টিফিকেট নয়, সঠিক শিক্ষা চাই। আরও চাই প্রকৃত ইতিহাস বইয়ে থাকুক আর মিথ্যা সব দূর হয়ে যাক। শিক্ষার্থীদের জন্য পার্টটাইম কাজের সুযোগ থাকা দরকার। এতে দরিদ্র শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে মেয়েরা শিক্ষা সমাপ্ত করতে পারবে। চাকরির ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতাও তৈরি হবে।
তরুণ এ প্রজন্ম প্রমাণ করেছে যে, তারা এমন একটি শক্তি- যাকে অগ্রাহ্য করা সবচেয়ে বড় বোকামি। তারা যেকোনো শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম এবং আরও ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক সমাজের পক্ষে।
জাহ্নবী