ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দা গল্প মানেই অপরাধ ও তার যুক্তিগ্রাহ্য সমাধানের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়াস। চাইলেই যে কেউ গোয়েন্দা গল্প লিখতে পারেন না। এখানে কল্পনার চেয়ে বরং রহস্যের বাতাবরণ তৈরি ও তার যৌক্তিক সমাধানের বিষয়টি পাঠকের সামনে মনোগ্রাহী করে ফুটিয়ে তুলতে হয়। আবেগের স্থলে সেখানে মগজ খাটানোর বিষয়টি বেশি থাকে। প্রসঙ্গত বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন পাঁচকড়ি দে। অবশ্য ১৮৯৩ সালে গিরিশচন্দ্র বসুর ‘সেকালের দারোগার কাহিনী’ শিরোনামে লেখা গল্পকেও কেউ কেউ প্রথম গোয়েন্দা গল্পের সম্মান দিয়ে থাকেন। তবে সবচেয়ে বেশি সফল ও চিত্তাকর্ষক গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন সত্যজিৎ রায়। তার ফেলুদা চরিত্রটি রহস্য-রোমাঞ্চপ্রিয় পাঠকের কাছে বিশেষভাবে সমাদৃত।
আর যদি ইংরেজি সাহিত্যের কথা বলি, তাহলে সবার আগে যার নাম করতে হয় তিনি হলেন- এডগার অ্যালান পো। তাকে ইংরেজি ভাষায় প্রথম আধুনিক গোয়েন্দা গল্পের রচয়িতা হিসেবে মান্য করা হয়। ‘দ্য মারডার্স ইন দ্য রু মর্গ’-এর মাধ্যমে অ্যালান পো গোয়েন্দা সাহিত্যের শুভসূচনা করেন। বলাই বাহুল্য, তখনো বাংলা ভাষায় সেভাবে কোনো গোয়েন্দা গল্প লিখিত হয়নি। ১৯০২ সালে আর্থার কোনান ডয়েলের ‘দ্য হাউন্ড অব বাস্কারভিলস’ প্রকাশের মাধ্যমে গোয়েন্দা সাহিত্য ভিন্নমাত্রা পায় এবং সবাই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হন যে, রহস্য-রোমাঞ্চ ও গোয়েন্দা গল্পের প্রতি পাঠকের বিশেষ রকম আগ্রহ রয়েছে। তাই একে কোনোভাবেই ব্রাত্য বা অ-সাহিত্যসুলভ রচনা বলবার অবকাশ নেই।
আর্থার কোনান ডয়েলের গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস প্রায়শ বলতেন, ‘হাউ ক্যান আই লিভ উইদ আউট ব্রেনওয়ার্ক!’ অর্থাৎ রহস্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ জন্মগত। দৈনিক পত্রিকায় যেসব খবর প্রকাশিত হয় তার মধ্যে খুনোখুনি, অপরাধ বা রহস্য ধাঁচের খবরটিই আমরা সবার আগে পড়ি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রহস্য বা ক্রাইমের প্রতি আমাদের এত আকর্ষণ কীসের! গোয়েন্দা গল্প পড়লে আদতে কী হয়! যারা নেতিবাচক ভাবনায় অভ্যস্ত; তারা হয়তো বলবেন এসব ছাইপাঁশ পড়ে আমাদের তরুণ সমাজ উচ্ছন্নে যাচ্ছে। ক্রাইম প্যাট্রল দেখে নাকি কিশোররা নিত্যনতুন অপরাধ করছে।
আমি বলি কী, ঘটনা মোটেও তা নয়। যে স্বভাবে খুনি, সে খুন করবেই। তাকে অন্য কারও গপ্প বা উদাহরণ অনুসরণ করতে হয় না। অপরাধপ্রবণতা মানুষের রক্তে মিশে আছে। বরং গোয়েন্দা গল্প পড়লে আমাদের শিশু-কিশোর ও উঠতি প্রজন্ম আবেগ এবং বুদ্ধিমত্তার মাঝে এক রকম সুসমন্বয় গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স’। ইদানীং দেখবেন কোনোকিছু মনের বিরুদ্ধে গেলে বা আবেগের পিঠে মামুলি চোট পেলেই ছেলেমেয়েরা অমনি আত্মহননের মতো মারাত্মক কাজ করে বসে। এসবের কারণ কী! কারণ ওরা এখনো বুঝে উঠতে পারছে না, ধ্বংসাত্মক আবেগকে আসলে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। অন্যদিকে গোয়েন্দা গল্প পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা ঘটনার যৌক্তিক বিশ্লেষণ করতে জানে, তাদের মস্তিষ্ক ইতিবাচকভাবে সচল থাকে এবং তারা এ-ও বোঝে, কোন কাজটা করলে তার পরিণাম কী হতে পারে।
ফেলুদাকেই দেখুন। প্রায়ই তিনি বলেন, ‘দেখ তোপসে, জীবনটাকে সব সময় পজিটিভলি দেখবি। জীবনের সবকিছুই যে তোর মনের মতো হবে বা ভালো লাগবে, তা তো নয়। বরং বাস্তবে হয় সব উল্টো। কিন্তু তোকে মগজ খাটিয়ে বুঝেশুনে প্রয়োজনে নিজেকে বদলাতে হবে, পরিবেশ নয়।’
কত সুন্দর কথা ভাবুন! পাখি ড্রেস পায়নি, অমনি মেয়েটা বিষ খেল। রেজাল্ট ভালো হয়নি বলে ছেলেটা অমনি বাড়ির ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একবারও ভাবল না, এটা আদতে কোনো সমাধান নয়। জীবনের ব্যাপ্তি অনেক বিশাল। দু-একটি পরীক্ষায় খারাপ করলে তাতে কিচ্ছু এসে-যায় না। বিল গেটস তো গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করেই হার্ভার্ড ছেড়েছিলেন। তাতে কি তিনি জীবনে কিছু কম পেয়েছেন! তার প্রতিষ্ঠানে দুনিয়ার বাঘা বাঘা সব ইঞ্জিনিয়ার কাজ করছেন এখন।
একজন ঝানু গোয়েন্দা বিলক্ষণ জানেন, জীবনকে কীভাবে যুক্তির আলো ফেলে দেখতে হয়। তিনি জানেন, ‘দেয়ার ইজ নো স্মোক উইদাউট ফায়ার।’ অর্থাৎ চলার পথের প্রতিটি বাঁকে মগজ ঘামাতে হবে, তা হলেই আমরা ধোঁয়ার কুণ্ডলি দেখে আগুনের আঁচ পাব। বিপদ আসার আগেই সতর্ক হওয়ার ফুরসত মিলবে। ক্রাইম-কুইন আগাথা ক্রিস্টি বলতেন, ‘গোয়েন্দা গল্প না পড়লে নাকি মানুষের জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন হয় না।’ মাছির মতো অনেকগুলো চোখ দিয়ে দেখতে হয়। ডিটেকটিভ স্টোরি পড়লেই কেবল দেখার সেই চোখ খোলে।
জাহ্নবী