নুসাইবা ইসলাম (ছদ্মনাম) এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। এ সময় পড়াশোনার বাড়তি চাপ থাকা সত্ত্বেও ছবি আঁকার জন্য সময় বের করতে ভুল করে না সে। তবে ছবি আঁকার এই অভ্যাসকে শুধু শখের কাজ হিসেবেই দেখতে নারাজ নুসাইবা। বরং তার কাছে এটি হলো দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ কমানোর মাধ্যম। শখের ছবি আঁকা বা আর্ট থেরাপিই হতে পারে মানসিক সুস্থতার উপায়।
ছবির ভাষায় মনের কথা
প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষের যোগাযোগের জন্য কোনো ভাষা ছিল না এ কথা তোমরা নিশ্চই জানো। ইশারা, ধ্বনি আর গুহার দেয়ালে ছবি এঁকেই প্রকাশ করা হতো আনন্দ, বেদনা আর ভাবনার কথা। তাই পৃথিবীর প্রাচীনতম ভাষা হিসেবে ধরা হয় ছবি আঁকাকে। আধুনিক সময়ে এসেও আঁকার মাধ্যমে মনের কথা জানানোর প্রয়োজন কিন্তু মোটেই ফুরিয়ে যায়নি। আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা কিংবা মতামতগুলো কখনো কখনো কথায় প্রকাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। কিশোর বয়সে ভাষাগত দক্ষতা কম থাকায় তারা প্রায়ই মুখোমুখি হয় এমন অনুভূতির। বিশেষত যারা অন্তর্মুখী স্বভাবের টিনএজার- রঙ-তুলির আঁচড়ে তারা সহজেই ফুটিয়ে তোলেন মনের অন্তর্নিহিত ভাবনাগুলো।
মানসিক চাপের রঙিন ওষুধ
কিশোর বয়সে পড়াশোনার চাপ বেড়ে যাওয়া, নতুন নতুন সামাজিক অভিজ্ঞতা ও হরমোনাল পরিবর্তনের কারণে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বেড়ে যায়। গবেষণা জানায়, সারা বিশ্বে প্রতি ৭ জনে ১ জন টিনএজার বিষণ্ণতা ও মানসিক চাপে ভুগে থাকেন। কিশোর-কিশোরীদের এই মানসিক চাপ কমাতে আর্ট থেরাপি বেশ জনপ্রিয়। এই থেরাপির জন্য এক টুকরো ছবি আঁকার কাগজ, রঙ আর তুলিই যথেষ্ট। মানসিক চাপ অনুভব করার সময়ে রঙ, তুলির খেলা উদ্দীপিত করে আমাদের মস্তিষ্কে থাকা কর্টিসল হরমোনকে। ফলে ছবি আঁকার মাধ্যমে দ্রুত মানসিক চাপ নিরসন হয়ে মন শান্ত ও ইতিবাচক হয়ে ওঠে।
মেডিটেশনের বিকল্প
নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে ফোকাস করার মাধ্যমে মনের নিয়ন্ত্রণ করাই মূলত মেডিটেশন। বয়ঃসন্ধিকালের চঞ্চলতায় মেডিটেশন করা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। তবে ছবি আঁকা হতে পারে ধ্যান বা মেডিটেশনের বিকল্প। ছবি আঁকার উজ্জ্বল রঙ, বিন্যাস, পেন্সিলে ফুটে ওঠা নানা অবয়ব খুব সহজেই কিশোর-কিশোরীদের দৃষ্টিকে এর ভেতর পুরোপুরি নিবদ্ধ করতে পারে। এ সময় মস্তিষ্কের নিউরনগুলোও ধীর গতিতে কাজ করতে শুরু করে। ফলে নিয়মিত ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে মেডিটেশনের মতোই ধৈর্য, স্থিরতা, প্রশান্তি; সর্বোপরি মানসিক নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রশমিত হয়।
মস্তিষ্কের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে
কাগজে কোনো ছবি আঁকার আগে সাধারণত আমাদের মস্তিষ্কে সেই ছবি ফুটে ওঠে। পরে রঙ ও তুলির ছোয়াঁয় আমরা মস্তিষ্কের কল্পনার সেই ছবিরই পুনরাবৃত্তি করি। পুনরাবৃত্তির এই প্রক্রিয়া মস্তিষ্কের স্মরণশক্তি বাড়াতে ও ভারসাম্য রক্ষা করতেও সাহায্য করে। গবেষণা জানায়, যাদের কম বয়স থেকেই ছবি আঁকার অভ্যাস রয়েছে, তারা বৃদ্ধ বয়সে ডিমেনশিয়া বা আলঝেইমারের মতো স্মরণশক্তি কমে যাওয়ার রোগে কম আক্রান্ত হন। তা ছাড়া কিশোর বয়সে মস্তিষ্ক বিকাশের সময়ে ছবি আঁকার বিভিন্ন প্রক্রিয়া স্মরণশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।
সমস্যা সমাধানে দক্ষতা বাড়ায়
নিজের মনের মতো কোনো ছবি আঁকতে চাইলে সেটি সম্পন্ন করতে গেলে পূরণ করতে হয় বেশ কয়েকটি ধাপ। ছবির চরিত্রগুলো কেমন আকৃতির হবে, কী ধরনের কাগজ ও তুলির ব্যবহার হবে, কোন কোন রঙ ব্যবহার করলে ছবিটি দেখতে সামঞ্জস্যপূর্ণ লাগবে- এ সবকিছু সমাধানের মধ্য দিয়েই ক্যানভাসে ফুটে ওঠে মনের মতো চিত্র। ছবি আঁকার সময় বিভিন্ন ধাপে যাচাই করা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার এই প্রক্রিয়া মস্তিষ্কের সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। কিশোর বয়সে সমস্যা সমাধানে দক্ষতা বাড়াতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশ নেওয়া, বয়সের তুলনায় কঠিন কাজ করার অভিজ্ঞতা হিতে বিপরীত পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। তাই বিশেষজ্ঞরা ছবি আঁকার মতো বিভিন্ন সৃজনশীল ও সুকুমার বৃত্তির কাজের পরামর্শ দেন।
আত্মবিশ্বাস ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ
বয়ঃসন্ধিকাল থেকে ছেলে-মেয়েদের চিন্তা ও যুক্তি দিয়ে কোনোকিছু দেখার ক্ষমতা অর্থাৎ বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটতে শুরু করে। এ সময় ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে শুধু নিজের কল্পনার প্রতিচ্ছবিই ঘটে না। বরং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনা ও কোনো কিছুকে সূক্ষ্মভাবে দেখার ক্ষমতা তৈরি হয়। এতে করে পরিণত বয়সে যৌক্তিক ও দৃঢ় পর্যবেক্ষণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথ সুগম হয়। আবার কিশোর বয়সে সামান্য ভুলেও ছেলে-মেয়েরা হীনম্মন্যতায় ভোগে। ঠিক এভাবেই নতুন কিংবা কঠিন কোনো কাজ সম্পন্ন করতে পারলে সহজেই ইতিবাচক ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল কাজে দক্ষতা তাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষা কিংবা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সময় কিশোর বয়সের এই আত্মবিশ্বাসী মনোভাব সাহস জোগায় ও কাজে দক্ষতা বাড়ায়।