
আধুনিক জাহাজ, নৌকা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি কিংবা সরঞ্জাম এসবের কিছুই নেই। সামান্য খড়কুটা আঁকড়ে ধরে গভীর সমুদ্রে দিন যাপনের কথা কি ভাবতে পারো? তাও যদি হয় প্রশান্ত মহাসাগর? অসম্ভব এই ঘটনাই সম্ভব করেছিলেন ইন্দোনেশিয়ান কিশোর আলদি নভেল আদিলাং। তাও আবার একদিন, দুদিন নয়। পুরো ৪৯ দিন ভেসে বেড়িয়েছেন মহাসাগরের জলে।
আজ থেকে সাত বছর আগে ২০১৮ সালের ঘটনা। ইন্দোনেশিয়ার সুলাবেসি দ্বীপে বসবাস করতেন ১৯ বছর বয়সী কিশোর আলদি। তিনি কাজ করতেন সমুদ্রে মাছ ধরার নৌকায়। মাছ ধরার জন্য ইন্দোনেশিয়ার ঐতিহ্যবাহী ভেলা ‘রমপং।’ ভেলাগুলো মাছ ধরার জন্য পৌঁছে যেত গভীর সমুদ্রে। আলদি রমপংয়ে বাতি জ্বালানোর কাজ করতেন। মাছকে আকৃষ্ট করতে ব্যবহার করা হতো এই বাতি। ১৬ বছর বয়স থেকেই বাতি জ্বালানোর এই পেশায় নিয়োজিত ছিলেন আলদি। পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ কাজের মধ্যে এই পেশা অন্যতম। কারণ, কুঁড়েঘরের মতো দেখতে এসব ভেলায় মাঝ সমুদ্রে একাকী অবস্থান করতে হয় কয়েক সপ্তাহ। মাছ ধরার মৌসুমে রমপংয়ে করে খাবার-দাবারসহ গভীর সমুদ্রে যাত্রা করেন জেলেরা।
সে বছর জুলাইয়ে আদলির ভেলাসহ আরও ৫০টি ভেলা নোঙরসহ সমুদ্রে মাছ ধরতে যাত্রা করে। উদ্দেশ্য সমুদ্রে অনেক দিন থাকবে এবং মাছ ধরবে। কিন্তু জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ঘটে এক দুর্ঘটনা। সমুদ্রের তলদেশে ফেলে রাখা হতো রমপংয়ের নোঙর। উপকূল থেকে সমুদ্রের ১২৫ কিলোমিটার গভীরে ফেলা ছিল নোঙরটি। হঠাৎ প্রবল ঝড়ে নোঙর ছিঁড়ে ছিটকে যায় আলদির ভেলা। দল থেকে পুরোপুরি আলাদা হয়ে যায় সে। ভগ্ন ভেলায় খড়কুটা আর কিছু খাবার আঁকড়ে ধরে একা ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যায় যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন গুয়াম দ্বীপের কাছে।
সমুদ্রে যখন ভাসছিলেন আলদি তখন তার কাছে ছিল মাত্র কয়েকদিনের খাবার। খাবার শেষ হয়ে গেলে শুরু করেন মাছ ধরা। ভেলায় থাকা কাঠ দিয়ে মাছ পুড়িয়ে করেন খাবারের ব্যবস্থা। তবে সবচেয়ে বিপদে পড়েন খাবার পানি নিয়ে। চারপাশে অথই সাগর। তবে পুরোটাই লবণাক্ত। বেঁচে থাকতে গেলে প্রয়োজন খাবার উপযোগী পানি। এ সময় নিজের গায়ের কাপড় দিয়েই করেন পানি ফিল্টার করার ব্যবস্থা। সমুদ্রের পানি জামায় নিয়ে লবণ যতটা সম্ভব ছেঁকে নিতেন। এভাবেই নিজের খাবার ও পানির ব্যবস্থা করে চলছিলেন আলদি।

এর ভেতর সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় আলদির ভেলার পাশ দিয়ে চলে যায় অন্তত ১০টি জাহাজ। আলদি কাপড় নেড়ে চিৎকার করে আপ্রাণ চেষ্টা করেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে। তবে নজর দেয়নি কেউ। প্রচণ্ড ভয় আর হতাশায় একসময় সিদ্ধান্ত নেন সমুদ্রের জলে ডুবে মরবেন। কিন্তু সে সময় মনে পড়ে নিজের বাবা-মায়ের কথা। বিপদের সময় প্রার্থনা করতে আর সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চাওয়ার পরামর্শ দিতেন বাবা-মা। সেই মতোই প্রচণ্ড মনোবল আর সাহস সঞ্চার করে আবার সংগ্রাম শুরু করেন আলদি। বাবা-মাকে আরও একবার দেখতে পাওয়ার আশাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল সে সময়।
অবশেষে সাগরে ভেসে থাকার ৪৯ দিন পরে এমভি আরপেজিও নামে একটি জাহাজ দেখতে পান তিনি। আলদি প্রথমে কাপড় নেড়ে জাহাজের ক্রুদের দৃষ্টি আকর্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কেউ তাকে দেখেনি। তারপর সে তার রেডিও থেকে একটি জরুরি সংকেত পাঠায় জাহাজে। আলদির জানা একমাত্র ইংরেজি শব্দ ‘হেল্প’ ‘হেল্প’ বলে চিৎকার করছিলেন তিনি। একসময় জাহাজের লোকজন তাকে দেখতে পেয়ে উদ্ধার করে। দুর্বল এবং পানিশূন্য আলদিকে নিয়ে জাহাজটি রওনা দেয় জাপানে। পরে ইন্দোনেশিয়ার কর্মকর্তারা তাকে বাড়ি ফিরে যেতে সাহায্য করে। আলদির এই বেঁচে ফেরার লড়াই সেসময় বিস্মিত হতবাক করে দেয় সবাইকে। মনোবল, দক্ষতা আর নিজের প্রতি বিশ্বাস থাকলে মৃত্যুর দুয়ার থেকেও যেন ফিরে আসা যায়। তার জলজ্যান্ত উদাহরণ আলদির ঘটনা।