পাহাড়, সমুদ্র কিংবা ঝরনা দেখার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত মৌসুম হচ্ছে বর্ষা। প্রতিবছর বর্ষাকালে তাই এসব পর্যটন স্পটে উপচে পড়া ভিড় থাকে। ব্যস্ত জীবনে বেশি সময় বের করাটাই কঠিন। কিন্তু মাত্র এক দিনেই যদি পাহাড়, সমুদ্র আর ঝরনা দেখার সুযোগ মেলে, তা হলে কেমন হয়? ঢাকা থেকে এক দিনের ভ্রমণে একসঙ্গে সবকিছু দেখার গল্প শোনাচ্ছেন মোহনা জাহ্নবী
বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতে ঢাকা শহর সেদিন জলে টইটুম্বুর। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত কেউ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরই হয় না। কিন্তু আমার ভ্রমণপিপাসু মন কোনো বাধা মানল না। মাইলের পর মাইল হাঁটুজল, কোমরজল পেরিয়ে কিছু পথ সিএনজি, কিছু পথ রিকশায় করে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছলাম। গন্তব্য সীতাকুণ্ড।
আমাদের পরিকল্পনা ছিল যাওয়ার সময় মেইল ট্রেনে যাব, ফেরার সময় বাসে ফিরব। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী মেইল ট্রেন ছাড়ে রাত পৌনে বারোটায়। সেদিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণেই কি না জানি না, ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসতে দেরি করল। ছাড়ল আরও দেরিতে। তবে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে মন্দ লাগছিল না।
ট্রেন ছাড়ল রাত দেড়টায়। স্টেশনের বাইরের হোটেল থেকে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম। আর ট্রেনে খাওয়ার জন্য রুটি, কলা সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। পুরোটা পথ কখনো বৃষ্টি, কখনো বৃষ্টি শেষের নিটোল আবহাওয়া পেলাম। যখন ভোরের আলো ফুটছিল, তখন ট্রেনের জানালা দিয়ে বৃষ্টিভেজা সবুজ প্রকৃতি, পাহাড় দেখতে বেশ ভালো লাগছিল! এ ভ্রমণ যেন বৃষ্টির সঙ্গে এক অনিন্দ্য সুন্দর পথচলার গল্প।
সকাল সাড়ে আটটায় আমরা সীতাকুণ্ড নামলাম। সীতাকুণ্ড বাজারের এক হোটেল থেকে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাশতা সেরে নিলাম। আমাদের প্রথম গন্তব্য বাঁশবাড়িয়া সমুদ্রসৈকত। সিএনজি করে চলে গেলাম সেখানে। সকালের নরম আলোতে নিরিবিলি সমুদ্রসৈকত দেখতে খুব প্রশান্তি লাগছিল। এ সৈকতটি এখনো একদম প্রাকৃতিক অবস্থায় আছে। কোথাও কোনো কৃত্রিমতার ছোঁয়া লাগেনি বলেই হয়তো বেশি সুন্দর লাগছিল। মানুষও খুব কম ছিল। তাই সমুদ্রযাপন আরও উপভোগ্য হয়ে উঠেছিল। একপাশে সবুজ ঘাসের আস্তরণ, গাছের শ্যামলিমা; অন্যপাশে সমুদ্রের অথৈ জলরাশি। একটা বড় সাঁকোও রয়েছে সেখানে। যখন প্রবল জোয়ারে সবকিছু প্লাবিত হয়ে যায়, তখন সাঁকো ব্যবহার করে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন পর্যটকরা। আমরা যখন যাই, তখন জোয়ার কম ছিল। তাই খালি পায়ে হেঁটেই সমুদ্র দেখেছি। মাটির গায়ে কাঁকড়ার নকশা বোনা দেখেছি।
আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল ইকোপার্ক। জনপ্রতি ৫০ টাকা টিকিট দিয়ে আমরা ইকোপার্কে প্রবেশ করলাম। ইকোপার্ক থেকে সিএনজি ভাড়া করে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার সুযোগ আছে। এ ছাড়া সুপ্তধারা ঝরনা, সহস্রধারা ঝরনা, শালটিলা, গোধূলি চত্বর, বিমানবাহিনী ক্যাম্প, দুটো পিকনিক স্পট, ক্যাকটাস হাউস, র্যাব ক্যাম্প, হৈমন্তী চত্বর, গোলাপ চত্বর- এসবও দেখতে পারবেন। আমরা ইকোপার্কের ভেতরের খাবার হোটেলে ব্যাগ জমা রেখে দুপুরের খাবার অর্ডার দিয়ে পোশাক বদলে নিলাম। এক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে সুপ্তধারা পয়েন্টে এসে ৯১ ফুট নিচে নামলাম। তারপর আরও প্রায় এক কিলোমিটার দুর্গম ঝিরি পথ পাড়ি দিয়ে দেখা মিলল প্রকৃতির রানী সুপ্তধারা ঝরনার। প্রচুর বৃষ্টিপাতের দরুন সেখানে পৌঁছানোর পথটা আরও একটু কঠিন হয়ে উঠেছিল পর্যটকদের জন্য। তবে পৌঁছে ঝরনার রূপ দেখেই মন ফুরফুরে হয়ে গেল। ঝরনার শীতল পানিতে এক ঘণ্টা ইচ্ছেমতো আনন্দস্নান করে আবার ফেরার পথ ধরলাম।
ফিরে পোশাক বদলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাবার আহামরি ভালো মানের ছিল না। তবে সবাই খুব ক্ষুধার্ত ছিল বলে পেট পুরে খেল। খেয়েই আমরা বেরিয়ে পড়লাম শেষ গন্তব্য গুলিয়াখালী সমুদ্রসৈকতে। গুলিয়াখালী যখন পৌঁছালাম, তখন প্রকৃতিতে শেষ দুপুরের সোনা রোদ। আমরা সমুদ্রতীরে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসলাম। সমুদ্রে তখন বেশ জোয়ার ছিল। গুলিয়াখালীর সৌন্দর্য ম্যানগ্রোভ বনের কোলঘেঁষে থাকা অনিন্দ্য সুন্দর সৈকতের মতো। ঢেউ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছিল আমাদের। দেখতে দেখতে পড়ন্ত বিকেল নেমে এলো। আমরা পেয়ারা মাখা খেলাম। খুব মজার ছিল। তারপর কয়েকজন ঘাসের ওপর শুয়ে চোখ বন্ধ করলাম; সমুদ্রের গর্জন শুনব বলে। হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, আমরা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এমন অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে ঘুমাইনি বহুদিন। যখন ঘুম ভাঙল, তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। সৈকতের দোকানগুলোতে আলো জ্বলে উঠল। আমরা সেখানে গিয়ে কালোজিরার ঝালমুড়ি আর চা-কফি খেলাম। আকাশে তখন মায়াবী চাঁদ নিজের অস্তিত্ব জানান দিয়েছে, সাথে হাজার হাজার তারা। এই অপার সৌন্দর্য কোনো শব্দ দিয়েই প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
সন্ধ্যা যাপন শেষে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। তখন গাঢ় অন্ধকার। মেঠোপথে হাঁটছিলাম ফোনের আলো জ্বেলে। হঠাৎ আলো নিভিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চাঁদের আলো পড়েছে পথের পাশে জমে থাকা সমুদ্রের জলে। অদূরে গাছের সারি সমুদ্রকে আড়াল করেছে। তার পেছনে রঙিন আলোকরশ্মি আকাশের সঙ্গে মিশেছে যেন। হয়তো নোঙর করা জাহাজের আলো। চাঁদের আলোর সঙ্গে সেই আলো মিলে এক অলৌকিক সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছে। এক বিমুগ্ধ আবেশে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। জেলেরা সামুদ্রিক মাছ নিয়ে তখন সেই পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল লোকালয়ের দিকে। তাদেরকে থামিয়ে মাছ দেখলাম। বাঁশের পাত্র ভর্তি ইলিশ আর চিংড়ি মাছ। এত ভালো লাগছিল! মনে হচ্ছিল, এই মাটির জীবন ছুঁয়ে থেকে যাই সেখানেই।
কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে ফিরতেই হলো। সিএনজি নিয়ে সীতাকুণ্ড বাজারের অদূরে বিখ্যাত ‘ভাবীর হোটেল’-এ রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। সেখানকার চুইঝাঁল, মুরগির মাংস আর দইয়ের প্রশংসা না করলেই নয়। খাওয়া শেষে হাইওয়ে ধরে এক কিলোমিটার হেঁটে এসে কাউন্টার থেকে বাসের টিকিট সংগ্রহ করলাম। রাত সাড়ে নয়টায় বাস ছাড়ল। ঢাকা পৌঁছালাম প্রায় সাড়ে তিনটায়। একটা আশ্চর্য সুন্দর দিন মনের ডায়েরিতে আঁকা হয়ে গেল।
কীভাবে যাবেন
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে চট্টগ্রামগামী ট্রেনে যেতে পারেন। মেইল ট্রেনের ভাড়া ১৪০ টাকা। অন্যান্য ট্রেনের ভাড়া ৪০০-৯০০ টাকা। এ ছাড়া বাসও এভেলেবল রয়েছে। কলাবাগান, গাবতলী, পান্থপথ, আবদুল্লাহপুর প্রভৃতি স্থান থেকে বাস ছাড়ে। ভাড়া ৪৭০-১৫০০ টাকার ভেতর। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে পর্যটন স্পটগুলোতে যেতে সিএনজি ভাড়া করতে পারেন। তা হলে ভ্রমণ আরামদায়ক হবে। সিএনজি ভাড়া করার সময় দরদাম করে নিন। ভাড়া খুব বেশি নয়।
কোথায় থাকবেন
কেউ যদি এক বা দু-রাত থাকতে চান, সেক্ষেত্রে সীতাকুণ্ড বাজারেই পর্যাপ্ত বাজেটের হোটেল (১০০০-২০০০ টাকা) পেয়ে যাবেন থাকার জন্য। তবে যারা সীতাকুণ্ড ঘুরতে যায়, বেশিরভাগ পর্যটকই একদিনের জন্যই যান।
সতর্কতা
বৃষ্টিভেজা পরিবেশে পাহাড়ে না ওঠাই ভালো। তবু তখন পাহাড় বা ঝরনায় গেলে সতর্ক থাকতে হবে। বৃষ্টির সময় সাপের প্রকোপ বাড়ে। সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। কোথাও কোনো বর্জ্য ফেলবেন না। স্থানীয় মানুষ কিংবা অন্য পর্যটকদের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করবেন। সঙ্গে বাড়তি পোশাক এবং মৌলিক কিছু ওষুধ রাখবেন।
জাহ্নবী