সুনামগঞ্জের প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠাপানির জলাভূমি টাঙ্গুয়ার হাওর। অথই পানি, জলাবন, নীল আকাশ, পাহাড় ও চোখ জুড়ানো সবুজ এই হাওরকে অপরূপ সাজে সাজিয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওরের মোট আয়তন ৬,৯১২ একর। তবে বর্ষাকালে এই হাওরের আয়তন বেড়ে প্রায় ২০,০০০ একর পর্যন্ত হয়ে থাকে। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ১৪০ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির ব্যাঙ এবং ১৫০ প্রজাতির বেশি সরীসৃপের সমন্বয়ে জীববৈচিত্র্য গড়ে উঠেছে। শীতকালে এই হাওরে প্রায় ২৫০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে।
টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখা যায়। মেঘালয় থেকে প্রায় ৩০টি ছোট-বড় ঝর্ণা টাঙ্গুয়ার হাওরে এসে মিশেছে। এই হাওরে একটি ওয়াচ টাওয়ার রয়েছে। এর আশপাশের পানি খুবই স্বচ্ছ হওয়ায় ওপর থেকে হাওরের তলা দেখা যায়। টাঙ্গুয়ার হাওরে ছোট-বড় প্রায় ৪৬টি দ্বীপের মতো ভাসমান গ্রাম বা দ্বীপ গ্রাম আছে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে Ecologically Critical Area (ECA) হিসেবে ঘোষণা করে।
টাঙ্গুয়ার হাওরে কখন যাবেন
বর্ষাকাল টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে হাওর ভ্রমণ করা ভালো। বছরের অন্য সময় সাধারণত পানি অনেক কম থাকে। তবে ভিন্ন এক পরিবেশের টাঙ্গুয়ার হাওর এবং সেই সঙ্গে অতিথি পাখি দেখতে চাইলে শীতকালেই যেতে হবে আপনাকে।
হাওর ভ্রমণে কী কী দেখবেন টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ শুধু হাওর দেখা নয়, সঙ্গে আরও কিছু স্পট সাধারণত সবাই ঘুরে দেখে থাকে। টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ প্যাকেজের সঙ্গে ছোট ছোট সোয়াম্প ফরেস্ট, ওয়াচ টাওয়ার, শহীদ সিরাজ লেক (নীলাদ্রি লেক), শিমুল বাগান, বারিক টিলা, যাদুকাটা নদী, লাউড়ের গড়সহ আরও বেশকিছু স্পট ঘুরে দেখা যায়।
টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার উপায়
দেশের প্রায় সব জেলা থেকে সুনামগঞ্জে বাসে আসা যায়। সুনামগঞ্জ হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে চাইলে আপনাকে প্রথমেই সুনামগঞ্জ জেলা শহরে আসতে হবে।
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ: প্রতিদিন সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে মামুন ও শ্যামলী পরিবহনের বাস সরাসরি সুনামগঞ্জের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। মহাখালী থেকে ছেড়ে যায় এনা পরিবহনের বাস। সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘণ্টা সময় লাগে।
সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ: সিলেটের কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার লোকাল ও সিটিং বাস আছে। যেতে দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। অথবা শাহজালাল মাজারের সামনে থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার লাইট গাড়িতে করে যাওয়া যায়।
সুনামগঞ্জ থেকে টাঙ্গুয়া: সুনামগঞ্জ থেকে লেগুনা/সিএনজি/বাইক করে তাহিরপুরে সহজেই যাওয়া যায়। তাহিরপুরে নৌকা ঘাট থেকে সাইজ এবং সামর্থ্য অনুযায়ী নৌকা ভাড়া করে বেড়িয়ে আসুন টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে। তবে শীতকালে পানি কমে যায় বলে লেগুনা/সিএনজি/বাইকযোগে যেতে হবে সোলেমানপুর। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে নিতে পারবেন।
হাউসবোট ও নৌকা ভাড়া
বর্তমানে নানা ধরনের নানা মানের হাউসবোট, সেমি হাউসবোট কিংবা গতানুগতিক নৌকা পাওয়া যায় টাঙ্গুয়ার হাওর ঘুরে দেখার জন্য এবং প্রয়োজনে রাতে থাকার জন্য। প্যাকেজ অনুযায়ী বিভিন্ন মানের হাউসবোটের ভাড়া একেক রকম। সাধারণত এক রাত থাকা, সব বেলার খাবার ও টাঙ্গুয়ার হাওরসহ আশপাশের সব স্পট ঘুরে দেখার প্যাকেজ প্রিমিয়াম বোটগুলোর ক্ষেত্রে জনপ্রতি ৬,০০০-১০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। মোটামুটি মানের সেমি হাউসবোটগুলোর প্যাকেজ ৪,৫০০-৬,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া পুরো হাউসবোট রিজার্ভ করলে মান ও ধারণক্ষমতা অনুযায়ী ৪০,০০০-৮০,০০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত হাউসবোটগুলোর প্যাকেজে সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত থাকে। তার পরও বুকিং বা ভাড়া করার আগে তাদের প্যাকেজ দেখে নিন, প্রয়োজনে দরদাম করে নিন। শুধু ডে ট্রিপ হলে খরচ কিছুটা কম হবে।
এ ছাড়া খরচ কমানোর জন্য লোকাল বডির নৌকা ভাড়া করতে পারেন। তবে ভাড়া করতে কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ রাখুন। যেমন নৌকায় বাথরুম আছে কি না, বিদ্যুৎ, লাইট ও ফ্যানের ব্যবস্থা ব্যবস্থা আছে কি না। নৌকা ভাড়া করতে দরদাম করে নিন। নৌকা ভাড়া মূলত ৩টি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। নৌকায় ধারণক্ষমতা, নৌকার সুযোগ-সুবিধা, কী কী ঘুরে দেখবেন, রাতে থাকবেন নাকি ড্রে ট্রিপ এবং সিজনের ওপর।
সাধারণত ছোট নৌকা ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা, মাঝারি নৌকা ৩৫০০ থেকে ৪৫০০ টাকা এবং বড় নৌকা ৫০০০ থেকে ১০,০০০ টাকায় সারা দিনের জন্য ভাড়া করা যায়। এক রাত নৌকায় থাকতে চাইলে টাকার পরিমাণ বাড়বে। রান্নার জন্য নৌকার মাঝিকে খরচের টাকা দিলে সে বাবুর্চি নিয়ে যাবে কিংবা নিজেই রান্নার ব্যবস্থা করে ফেলবে। কী করবেন তা অবশ্যই মাঝির সঙ্গে আগে আলোচনা করে দরদাম ঠিক করে নেবেন।
কোথায় থাকবেন
পর্যটকরা সাধারণত হাউসবোটেই রাত যাপন করে থাকেন। এ ছাড়া আপনি চাইলে টেকেরঘাট বাজারে রাতে থাকতে পারবেন। চাইলে সুনামগঞ্জ এসে সেখানের কোনো হোটেলে রাত যাপন করতে পারবেন। তবে টাঙ্গুয়ার হাওর বেড়াতে গেলে হাওরের নৌকায় অন্তত এক রাত থাকা উচিত। এই অভিজ্ঞতা অবশ্যই আপনার ভালো লাগবে।
খাবার ব্যবস্থা
হাউসবোট প্যাকেজ খাবারসহ হয়ে থাকে। নতুবা নিজেদের খাবার নিজেরা ব্যবস্থা করে নিতে হবে। দিনে দিনে ঘুরে চলে এলে তাহিরপুরে খাবার হোটেল থেকে রওনা হওয়ার আগে সকালের ও ফিরে আসার পর দুপুরের খাবার হাওরের প্রায় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে নিজের পছন্দের মাছ দিয়ে আহারপর্ব সেরে ফেলতে পারেন। এ ছাড়া খেতে পারবেন টেকেরঘাটেও।
যদি রাতে থাকার পরিকল্পনা থাকে এবং নিজেরা রান্না করে খেতে চান, তবে তাহিরপুর থেকে নৌকায় ওঠার আগে যে কয়দিন অবস্থান করবেন, সেই কয়দিনের বাজার করে নিতে পারেন। তাজা মাছ কেনার জন্য হাওরের মাঝখানের ছোট বাজারগুলোয় যেতে পারেন। এ ছাড়া সঙ্গে নিতে পারেন দেশি হাঁস কিংবা দারুণ সব শুঁটকি।
টাঙ্গুয়া ভ্রমণের সতর্কতা ও কিছু পরামর্শ
হাওর ভ্রমণকালে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট সঙ্গে নিন। যেকোনো কিছুর জন্য দামাদামি করে নেবেন। একসঙ্গে গ্রুপ করে গেলে খরচ কম হবে। ৪-৫ জন বা ৮-১০ জনের গ্রুপ হলে ভালো। হাওরে বজ্রপাত হলে নৌকার ছইয়ের নিচে অবস্থান করুন। খাবারের অতিরিক্ত অংশ/উচ্ছিষ্ট, প্যাকেট ইত্যাদি হাওরের পানিতে ফেলা থেকে বিরত থাকুন। উচ্চ শব্দ সৃষ্টিকারী মাইক বা যন্ত্র পরিহার করুন। রাতে অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলো উৎপন্ন করবেন না। টাঙ্গুয়ার হাওরের মাছ, বন্যপ্রাণী কিংবা পাখি ধরা বা এদের জীবন হুমকির মধ্যে পড়ে এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন। টাঙ্গুয়ার জলাবনের কোনো ধরনের ক্ষতিসাধন না করার ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
ভ্রমণে সঙ্গে নিন
টর্চ ব্যাকআপ ব্যাটারিসহ পাওয়ার ব্যাংক, ক্যাম্পিং মগ, চাদর, রেইনকোট বা ছাতা, নিয়মিত সেবনীয় ওষুধ, টয়লেট পেপার, ব্যাগ ঢেকে ফেলার মতো বড় পলিথিন, প্লাস্টিকের স্যান্ডেল (চামড়ার স্যান্ডেল পরিহার করা ভালো হবে), সানগ্লাস, ক্যাপ বা হ্যাট, গামছা (যা সহজে শুকাবে), খাবার পানি, হাফ প্যান্ট এবং সহজে শুকায় এমন জামাকাপড়।
জাহ্নবী