ঢাকার উপকণ্ঠে ধামরাই এলাকা। শহরঘেঁষা হলেও কিন্তু এই উপজেলাটির নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। বর্ষা, শরৎ কিংবা শীতে সবসময়ই এর সৌন্দর্য ভিন্ন ভিন্ন। বিশেষ করে ধামরাইয়ের কাজিয়ালকুণ্ড, সিঁতী আড়ালিয়া, মাখুলিয়া, কানারচর ও মাধবপট্টি গ্রামের সৌন্দর্য অসাধারণ। এসব গ্রামের মধ্যে কয়েকটিতে রয়েছে প্রচুর হিজল কড়চ গাছ, যা ভ্রমণপিপাসুদের মনে হাওরের অনুভূতি এনে দেয়।
বংশী ও ধলেশ্বরী নদী ঘেরা গ্রামের নিচু ফসলি মাঠগুলো ঝুম বৃষ্টিতে ও নদীর উপচে পড়া পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। হিজল কড়চ গাছগুলোর অবস্থা হয় ডুবুডুবু। একেকটি গ্রাম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। দেখতে অনেকটা দ্বীপের মতো লাগে। অধিবাসীদের চলাচলের জন্য নৌকাই একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে। স্থানীয়রা তাদের কৃষি পেশা পাল্টিয়ে মাছ শিকারিতে পরিণত হন। থই থই পানিতে পাতি হাঁসের প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ আর দলবদ্ধভাবে ভেসে বেড়ানোর অপরূপ দৃশ্য যে কারও নজর কাড়ে। ছোট ছোট ডিঙি নৌকায় সামান্য ভাড়ায় কয়েক ঘণ্টা ঘুরে বেড়ানো যায়। টলটলে স্বচ্ছ পানির তলদেশের গভীরতা মুগ্ধ করে। ইচ্ছে হলেই ডুব সাঁতারে মেতে ওঠা যায়। সঙ্গে নেওয়া হ্যামোকে দোল খেতে খেতে ঝুম বৃষ্টি উপভোগ করতে পারলে দিনটি স্মরণীয় হয়ে রবে। খোলা আকাশ থেকে সরাসরি পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার যে মন্ত্রমুগ্ধ আওয়াজ, তা হয়তো আজও অনেক মানুষ শুনতেই পায়নি।
কড়া রোদেও বৃষ্টি পড়ে– শিয়াল মামার বিয়ে। এরকম বিয়ের মজা মেলে যখন ঘুরতে গিয়ে, ভাসমান নৌকায় ঝুপ করে বৃষ্টি আসে। আবহাওয়া ও পরিবেশ পরিস্থিতি ভেদে যেকোনো ভ্রমণের আনন্দ সীমাহীন হয়ে উঠতে পারে।এর ভালো লাগার মাত্রা পরিমাপের আর সুযোগই থাকে না। দে-ছুট ভ্রমণ সংঘের বন্ধুরা সবসময় এরকম আকস্মিক ব্যাপারগুলোই পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখে। চলতি মৌসুমে যারা সময় সুযোগের অভাবে হাওরে যেতে পারছেন না, তাদের সেই আনন্দ অনেকটাই এখানকার বর্ষার পানি ও প্রকৃতির রূপে পাওয়া যেতে পারে।
ঘণ্টাখানেক নৌকায় ঘুরে ছবির মতো সুন্দর সিঁতী গ্রামের মেঠো পথে, সারি সারি তালগাছের ছায়ায় হেঁটে/অটোয় চড়ে আড়ালিয়া বাজার। সেখানকার টং দোকানের গরম গরম আলুপুরি, শিঙাড়া ও গাভির দুধের মালাই চায়ের স্বাদ জিভে লাগবে অসাধারণ। খেয়েদেয়ে চাঙ্গা হয়ে বাজারের পাশেই চৌটাইল গ্রামের পিঠঘেঁষে বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরীর বুকে, ডুব সাঁতারে মাতামাতি করে শৈশবের স্মৃতি হাতড়ানোর মোক্ষম সুযোগ রয়েছে। বিনা টিকিটে ইচ্ছেমতো গোসল করে চলে যেতে পারেন কাজিয়ালকুণ্ড। সড়কের দুপাশে সৃজন করা গাছের ছায়ায় পেতে রাখা বেঞ্চে, একবেলা পার করে দেওয়া যায় অনায়াসে। গাছের ফাঁক গলে হুহু করে আসা ফুরফুরে বাতাস চরম গরমেও স্বস্তি এনে দেবে। ধানের নাড়ার স্তূপ ও পাখির ডাক অপার্থিব সময় পার করাবে।
ঘুরতে ঘুরতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। পেটে নিশ্চয়ই লেগেছে টান। কাজিয়ালকুণ্ডের ঢুলিভিটা সড়কে রয়েছে নানান ক্যাটাগরির রেস্টুরেন্ট। খাবারের মানের চেয়ে টাকাটা একটু বেশিই মনে হবে। এর চেয়ে ভালো নিজেরাই সদাইপাতি করে, গ্রামের ভেতর কোনো টং দোকানিকে ম্যানেজ করে রান্না করিয়ে নিতে পারেন। এই রান্নার তরকারি আরও বেশি মজাদার। যেটাকে বলা হয় অল্প তেলে মচমচা। পেট ঠাণ্ডা তো সব ঠাণ্ডা। এবার হাঁটতে হাঁটতেই চলে যেতে পারেন মাখুলিয়া। ধান শুকানোর মনোরম মুহূর্ত, গ্রামের বউ-ঝিদের ধান গোলায় তোলার ব্যস্ততা- যান্ত্রিক রাজধানীর পাশে মাখুলিয়া গ্রামটা অনন্য। মানুষগুলোও বেশ সহজেই আগন্তুকের সঙ্গে মিশে যায়। মানুষ ও গ্রামীণ পরিবেশে মিলেমিশে একাকার হতে হতেই হয়তো কাঁঠাল পাকা গরমে শরীরটা ঘেমে যাবে।
ঘেমেই যখন গেছে তাহলে কানারচরের দিকে এগোনো যেতে পারে। সেখানটায় রয়েছে বিস্তৃত ফসলি জমি। মাটির গভীর থেকে ফসলের জন্য তোলা, শ্যালো মেশিনের নলের সামনে বসে আরও একবার গোসল করে নিন। আহ কী পানিরে! চোখ যত দূর যায়, শুধু কাঁচা-পাকা ধান আর ধান। মাথার ওপর আমগাছের ছায়া। সেই গাছে আবার ঝুলন্ত আম। এমন মনোরম পরিবেশে হিমশীতল পানিতে মনভরে গোসল করা যেতেই পারে। আশ্চর্য ব্যাপার এমন সুন্দর একটি গ্রাম অথচ কে যে এর নাম কানারচর রাখলেন, তাকেই এখন খোঁজে বের করা সময়ের দাবি। হা হা হা।
সূর্যটা যখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়বে ঠিক তখনই মধ্য ফোর্ডনগরের দিকে ছুটে, বটতলা ছাড়িয়ে বাঁশের সেতু মাড়িয়ে ইঞ্জিন বোটে চড়ে বংশী নদীতে ভেসে যাবেন। মাঝির সঙ্গে কথা হবে, ট্রলার যাবে দক্ষিণ দিকে। সঙ্গে নেবেন ছোলাবুট ভুনা, পিয়াজু ও হাতে ভাজা মুড়ি। নারী ও শিশুদের খাবারে রুচি বাড়ানোর জন্য ফুটপাতে বসা দোকানি থেকে পাঁচমিশালী আচারও নেওয়া যেতে পারে।
বর্ষার পানিতে বংশীর ফিরে আসা যৌবনের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ, আর উন্মাদ হাওয়া গায়ে লাগিয়ে মাখানো মুড়ি খাওয়ার স্বাদ হবে অতুলনীয়। মাখা মুড়ি শেষ হওয়ার আগেই হয়তো আবিষ্কার করবেন, জীবনটা এখানেই অনেক সুন্দর। ভাসতে ভাসতে ভর সন্ধ্যায় নেমে পড়ুন সাভারের নামাবাজার গুদারা ঘাটে।
আরও কী দেখা যাবে: খুব ভোরে পৌঁছাতে পারলে আড়ালিয়ার পাশে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার নয়নাভিরাম খড়ারচর, কাংশা ও ফড়িঙ্গা গ্রামগুলোও ঘুরে আসা যাবে। গ্রামগুলো রাজধানীর পাশে হলেও এখনো আবহমান বাংলার আদি সৌন্দর্যের দেখা মিলে। শোনা যায় চেনা অচেনা পাখির গান।
বিশেষত্ব: পূর্ণিমায় ক্যাম্পিং করার জন্য ধলেশ্বরীর তীর হতে পারে অসাধারণ একটি জায়গা।
টিপস: গল্পের মতো ঘুরতে চাইলে সঙ্গে রাখুন কয়েক সেট পরিধেয় জামাকাপড়। ভোজনরসিক হলে সকালের নাশতায়, নামাবাজারের থাপড়ানো রুটি ও দই-মিষ্টি তালিকায় রাখতে পারেন।
যাবেন কীভাবে: ঢাকার যেকোনো প্রান্ত থেকে নিজ/ভাড়া করা গাড়ি, মোটরসাইকেল/বাইসাইকেল কিংবা গণপরিবহনে সাভারের থানা রোড হয়ে নামাবাজার ব্রিজের ওপর দিয়ে গিয়ে দিনে দিনে ঘুরে আসা যাবে। উপজেলা ধামরাই। কিন্তু সাভারের থানা রোড/বাজার রোড দিয়ে এর যাতায়াত সহজ।
ছবি: দে-ছুট ভ্রমণ সংঘ
জাহ্নবী