দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ হিসেবে পরিচিত সিলেটের ওসমানী বিমানবন্দরের উত্তর পাশে টিলার ওপর লাক্কাতুরা চা বাগান অবস্থিত। ২৯৩ হেক্টর বা প্রায় ৩ হাজার ২০০ একরজুড়ে এর অবস্থান। মালনীছড়া আর লাক্কাতুরা চা বাগান পাশাপাশি। ব্যবধান শুধু রাস্তার এপাশ আর ওপাশ। শ্রেষ্ঠত্বের দিক থেকে লাক্কাতুরা চা বাগান কখনো কখনো মালনীছড়া চা বাগানকে ছাড়িয়ে গেছে। বাগানে হাঁটলেই চোখে পড়বে কমলা, কাঁঠাল ও সুপারি বাগান। এ ছাড়া ট্যাং ফল, আগর, রাবার, চন্দনসহ অনেক ঔষধি-শোভাবর্ধক বৃক্ষ। বাগানের সব পথের ধারে উঁচু-নিচু টিলার ভেতর দিয়ে চলে গেছে মাটির রাস্তা। হেঁটে ভেতরে গেলে একেকটি রাস্তা ধরে প্রায় দুই ঘণ্টা হাঁটা যায়।
চারপাশে সবুজের সমারোহ। নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা পেতে আছে সজীব প্রকৃতি। উঁচু-নিচু টিলা এবং টিলাঘেরা সমতলে সবুজের চাষাবাদ। শুধু সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে টিলা বেষ্টিত ছোট ছোট জনপদ। পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে ছুটে গেছে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ।
কোনো যান্ত্রিক দূষণ নেই। কোথাও আবার ধাবমান পথে ছুটে চলছে রুপালি ঝরনাধারা। প্রকৃতির সব সৌন্দর্যের সম্মিলন যেন এখানে। এমন অন্তহীন সৌন্দর্যে একাকার হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান।
দেশের মোট চায়ের ৯০ শতাংশই উৎপন্ন হয় সিলেটে। এজন্য বিভিন্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ হলেও প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অন্য এক ভালো লাগার ধারক হয়ে আছে সিলেটের চা বাগান। তাই ছুটির অবসরে কিংবা বৈকালিক বিনোদনের তৃষ্ণা মেটাতে তারা ছুটে যান চা বাগানের সবুজ অরণ্যে। সারা বিকেল চলে সবুজের ভেতর লুকোচুরি, হইহুল্লোড় আর আনন্দে অবগাহন।
ভ্রমণবিলাসী মানুষের কাছে আনন্দ ভ্রমণ কিংবা উচ্ছল সময় কাটানোর প্রথম পছন্দের স্থান হলো মালনীছড়া ও লাক্কাতুরা চা বাগান। সিলেট শহরের একেবারেই অদূরে হওয়ায় চা বাগান দেখতে পর্যটকরা প্রথমেই ছুটে যান এখানে। মালনীছড়া আর লাক্কাতুরা চা বাগানের প্রবেশদ্বার বেশ কয়েকটি। চাইলে যেকোনো একটি পথ দিয়েই চা বাগান দর্শনের কাজ শুরু করা যায়। তবে ঝামেলা এড়াতে বাগানে প্রবেশের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়াই বাঞ্ছনীয়। তারপর ঘুরে দেখেন বাগানের এপাশ থেকে ওপাশ। দেখে আসতে পারেন বাগানের বাংলো। মালনীছড়ার পাশেই রয়েছে আলী বাহার চা বাগান। ঘুরে আসতে পারেন ওখান থেকেও।
মালনীছড়া আর লাক্কাতুরা চা বাগান পাওয়া যাবে একই যাত্রাপথে। ব্যবধান শুধু রাস্তার এপাশ ওপাশ। নগরীর চৌকিদেখি আবাসিক এলাকা পেরোনোর পর গলফ ক্লাবের রাস্তা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই চলে যাবেন বাগানের মাঝখানে। বাগানের এপাশ ওপাশ ঘুরে গলফ ক্লাবের সুন্দরম টিলার ওপরও হতে পারে আনন্দ আয়োজন। আরেকটু সামনে এগোলেই পেয়ে যাবেন সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম। চারপাশে চা বাগান আর মাঝখানে স্টেডিয়াম, সত্যিই অসাধারণ! এমন সবুজ প্রকৃতির ভেতর স্টেডিয়াম পৃথিবীতে সম্ভবত একটাই।
প্রকৃতিপ্রেমীদের পদচারণায় প্রতিনিয়ত মুখর থাকে চা বাগান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে অন্য এক ভালো লাগার আবেশ সৃষ্টি করে চা বাগান। আপনার আগামীর জন্য এখানেও ফ্রেমবন্দি করে রাখতে পারেন কিছুটা সময়। সিলেট, যেন সবুজ প্রকৃতির অভয়াশ্রম! আর সব সময় প্রকৃতির কাছাকাছি থাকা মানুষের জন্য সেরা পছন্দের স্থান চা বাগান। প্রকৃতির সব বিচিত্র সৌন্দর্য মিশে আছে চা গাছের সবুজ পাতায়। তো এই অপরূপ চায়ের দেশে আপনি চাইলেই ঘুরে আসতে পারেন। নিঃসন্দেহে আপনার ভালো লাগবে লাক্কাতুরা, মালনীছড়া আর তারাপুর চা বাগানে নারী শ্রমিকদের চা পাতা তোলার দৃশ্য। স্থির হয়ে যায় পর্যটকের চোখ।
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে বাস, ট্রেন ও বিমানে সিলেট যাওয়া যায়। ঢাকার গাবতলী ও সায়েদাবাদ থেকে গ্রিনলাইন, সৌদিয়া, এস আলম, এনা, শ্যামলী পরিবহনের বাসে সিলেট যেতে পারবেন। নন-এসি বাসের জনপ্রতি ভাড়া ৬৮০ থেকে ৭০০ টাকা এবং এসি বাসের ভাড়া ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকা। আর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে উপবন, কালনী, জয়ন্তিকা ও পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেন সিলেট যায়। ট্রেনের জনপ্রতি টিকিটের মূল্য শ্রেণিভেদে ৩৭৫ থেকে ১২৮৮ টাকা। এ ছাড়া শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে নভোএয়ার, ইউএস বাংলা কিংবা বিমান বাংলাদেশের মতো ডোমেস্টিক এয়ারলাইন্সে সিলেটে যেতে পারবেন। সিলেট থেকে স্থানীয় পরিবহনে সহজে লাক্কাতুরা চা বাগানে পৌঁছানো যায়।
কোথায় থাকবেন
লাক্কাতুরা চা বাগানের ভেতরে চমৎকার একটা গেস্ট হাউস আছে। নিরিবিলি এই গেস্টহাউসে রাত্রিযাপন অনেকটা অন্য গ্রহে থাকার মতোই অ্যাডভেঞ্চারাস। এখানে তিনটি রুম, কিচেন এবং গেস্টরুম আছে। বারবিকিউ এবং ক্যাম্পফায়ারের জন্য একটি আদর্শ জায়গা। যারা এখানে থাকতে চান, ঢাকায় ন্যাশনাল টি বোর্ডের হেড অফিস থেকে আগেই অনুমতিপত্র জোগাড় করে নিয়ে যাবেন।
এ ছাড়া সিলেটে থাকার মতো অনেক হোটেল আছে, আপনি আপনার প্রয়োজন ও সামর্থ্য অনুযায়ী যেকোনো ধরনের হোটেল পাবেন। কয়েকটি পরিচিত হোটেল হলো- হোটেল হিল টাউন, গুলশান, দরগা গেট, সুরমা, কায়কোবাদ ইত্যাদি। লালা বাজার এলাকায় কম ভাড়ায় অনেক মানসম্মত রেস্ট হাউস আছে। হোটেল অনুরাগ-এ সিঙ্গেল রুম ৪০০ টাকা (দুজন আরামসে থাকতে পারবেন), তিন বেডের রুম ৫০০ টাকা (নরমালি চারজন থাকতে পারবেন)। রাত যাপনের জন্য মাজার/দরগা রোডে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। রুম ভাড়া ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত।
এ ছাড়া সিলেটে হোটেল স্টার প্যাসিফিক, নির্ভানা ইন, হোটেল সুপ্রিম, রোজ ভিউ হোটেল, হোটেল ভ্যালি গার্ডেন, হোটেল ফরচুন গার্ডেন, হোটেল নুরজাহান গ্র্যান্ড, হোটেল ভ্যালি গার্ডেন প্রভৃতি আবাসিক হোটেল রয়েছে।
কোথায় খাবেন
সিলেটের জিন্দাবাজার এলাকায় পানসী, বিগ বাইট রেস্টুরেন্ট, রেইনবো চাইনিজ, আড্ডা রেস্টুরেন্ট, স্পাইস কিচেন, হাংরী স্টেশন, প্রেসিডেন্ট রেস্টুরেন্ট, পালকি ও ট্রিট গ্যালারিসহ অসংখ্য ফাস্টফুড, চাইনিজ ও বাঙালি খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে। আর সুযোগ হলে সিলেটের জনপ্রিয় সাতকড়ার আচার এবং আখনি বিরিয়ানির স্বাদ নিতে ভুলবেন না।
ভ্রমণ পরামর্শ
বাংলো ও ফ্যাক্টরি ঘুরে দেখতে হলে আগেই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।
শুধু বাগান ঘুরে দেখার জন্য সাধারণত বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয় না। তবে অনুমতি নিলে গাইড নিয়ে পুরো বাগান ও চারপাশ ভালোভাবে ঘুরে দেখতে পারবেন।
নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা-আবর্জনা ফেলুন।
চা বাগানে জোঁক ও পোকামাকড়ের উপদ্রব রয়েছে এক্ষেত্রে সতর্ক।
সিলেটের দর্শনীয় স্থান
সিলেটের দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রাতারগুল, বিছনাকান্দি, জাফলং, ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর, লোভাছড়া, হজরত শাহ্জালাল (র.) ও হজরত শাহ্ পরান (রহ.) এর মাজার, সংগ্রামপুঞ্জি ঝর্ণা, তামাবিল, জিতু মিয়ার বাড়ি, আলী আমজদের ঘড়ি, পান্থুমাই ঝর্ণা, লক্ষনছড়া, ক্বীন ব্রিজ, মালনীছড়া চা বাগান, জৈন্তা হিল রিসোর্ট, ড্রিমল্যান্ড পার্ক, নাজিমগড় গার্ডেন রিসোর্ট, সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, লালাখান, হাকালুকি হাওর ও ডিবির হাওর অন্যতম।