![খেজুর রসের গ্রাম](uploads/2024/01/22/1705903271.Sitakundu-palm-tree-Story-1.jpg)
দুপাশে দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ। এর মধ্য দিয়ে প্রশস্ত সড়ক সোজা সমুদ্র তীরে গিয়ে মিশেছে। তার দুধারে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ছোটবড় খেজুরগাছ। শুধু সড়কের ধার নয়, খেতের আইল, পুকুরপাড়, খালের কিনারা, দীঘির চারকোণ, বাড়ির আঙিনা, বেড়িবাঁধের দুপাশে শোভা পাচ্ছে দীর্ঘ লাইনের খেজুরগাছ।
এসব গাছে আড়াআড়িভাবে বাঁধা আছে গাছের দণ্ড। তার ওপর দাঁড়িয়ে কোমরে ও গাছে মোটা রশি পেঁচিয়ে ধারালো বাটাল দিয়ে গাছের শীর্ষ ভাগ চাঁছছেন গাছিরা। তারপর কোমরে ঝুলন্ত বেতের টুকরিতে বাটাল সামলে রেখে অন্য হাতে থাকা রসের পাত্রটি ঠিকঠাকভাবে আটকে দিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই পাত্রে টপটপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় পড়তে শুরু করেছে সুমিষ্ট খেজুর রস। একই কায়দায় অনেক খেজুরগাছ চেঁছে পাত্র ঝুলানোর কাজটি সুনিপুণভাবে করছেন একদল গাছি।
গাছগুলোর কাটা অংশে জমেছে সাদা ফেনা। সেই ফেনা থেকে বের হওয়া রসের ম ম গন্ধে চারপাশে ভরে গেছে। রসের নলে বসতে পাখিদের আনাগোনাও নজর কাড়ছে। মনোরম এ দৃশ্য সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকতসংলগ্ন গ্রামের। যেখানে যেদিকে চোখ যায় শুধুই খেজুরগাছ। সেই সঙ্গে গাছে গাছে রস আহরণে গাছিদের ব্যস্ততা। এ যেন খেজুর রসের গ্রাম।
শুধু সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী নয়, পাশের বশরতনগর, ভাটেরখীল নামে আর দুটি রসের গ্রাম রয়েছে। খেজুর রসের গ্রাম খ্যাত এই তিন গ্রামে এখন রস নিয়ে নির্ঘুম রাত পার করছেন নারী, পুরুষ, শিশু-কিশোররা। মধ্য রাত থেকে সন্ধ্যা অবধি এখানে চলছে রসের মহোৎসব। সেই সঙ্গে রস দিয়ে গুড় আর সেই গুড় দিয়ে ভাপা, পুলি, চিতইসহ হরেক রকমের পিঠা-পায়েস তৈরির ধুম। যেন শীতের আমেজের কোনো কমতি নেই সেখানে। কিশোর থেকে বয়স্ক সবাই এ মৌসুমে রস ব্যবসায়ী।
জানা যায়, সীতাকুণ্ডের গুলিয়াখালী গ্রামে আছে প্রায় দুই হাজার খেজুরগাছ, বশরতনগর গ্রামে আছে প্রায় তিন হাজার আর ভাটেরখীল গ্রামে আছে অন্তত দেড় হাজার খেজুরগাছ। এছাড়াও মুরাদপুর ইউনিয়ন, সৈয়দপুর ইউনিয়ন, বারৈয়াঢালা ইউনিয়ন, বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নসহ এ উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আনুমানিক ২০ হাজার খেজুরগাছ। তবে গাছির অভাবে সব এলাকায় খেজুর রস সংগ্রহ করা হয় না।
যত্নের অভাবে ও নির্বিচারে নিধনের কারণে গাছের সংখ্যাও কমে এসেছে। বর্তমানে প্রধানত গুলিয়াখালী, বশরতনগর, ভাটেরখীল, এই তিন গ্রামে রস সংগ্রহ করা হয়। এখানে আছে দুই শতাধিক গাছি। রস বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুলিয়াখালী গ্রাম থেকে দৈনিক আড়াই হাজার লিটার, ভাটেরখীল গ্রাম থেকে দৈনিক দুই হাজার লিটার আর বশরতনগর গ্রাম থেকে দৈনিক চার হাজার লিটার রস উৎপাদন হয়। এসব রস শহরে ও গ্রামে বিক্রি হয়।
গুলিয়াখালী গ্রামের গাছি আলমগীর হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রতিদিন রাত ৩টায় শুরু হয় গাছ থেকে রস আহরণ। এরপর অটোরিকশায় করে রসগুলো শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। শহরে বর্তমানে প্রতি লিটার রসে ১০০ টাকা পাওয়া যায়। আর গ্রামে চলে ৫০-৬০ টাকায়। রস বিক্রি করে এসে ফের গাছ কাটতে হয় গাছিদের। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে শুরু হয় রস পাহারার কাজ।
টর্চলাইটের আলোয় সারারাত পাহারা দিতে হয়। কেন না রস ঘিরে সক্রিয় আছে চোর চক্র। এভাবে দিনরাত নির্ঘুম কাটে গাছিদের।’ একই কথা বলেন, গাছি ও রস বিক্রেতা মনির উল্লাহ ও মোশাররফ।
গুলিয়াখালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, একসময় মাটির তৈরি হাঁড়ি ব্যবহার করা হলেও কালের বিবর্তনে মাটির হাঁড়ির স্থান দখল করেছে প্লাস্টিকের পাত্র। আগেকার দিনে পাত্র সরাসরি বাঁশের নলের সঙ্গে বাঁধা হতো। এখন নলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে লম্বা নাইলেন সুতো। গাছের শিরোভাগে থাকা নল থেকে রস গড়িয়ে পড়ছে সুতায়। আর সুতা বেয়ে রস নামছে নিচে বাঁধা পাত্রে। পাখি কিংবা বাদুড় থেকে বাঁচাতে এ বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করছেন গাছিরা। ভোর রাত ৪টা থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে রস কিনতে হাজির হন উৎসুক রসপ্রেমীরা। আবার অনলাইন উদ্যোক্তারাও গাছিদের কাছ থেকে রস কিনে নিয়ে শহরে বেশি দামে বিক্রি করছেন।
এদিকে গুলিয়াখালী সমুদ্র তীরে ১০০ টাকা কেজি দরে আগুনে জ্বাল দেওয়া গরম রস বিক্রি করছে শিশু-কিশোররা। সেই সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে গরম গরম ভাপা পিঠা। গৃহিণীরা উনুনে রস জ্বাল দিয়ে রাব মিঠাই বানাতে ব্যস্ত। গ্রামীণ পরিবেশে বানানো এসব মিঠাইয়ের বাজারে রয়েছে আলাদা কদর। গুলিয়াখালীর মতোই একই দৃশ্যের দেখা মেলে ভাটেরখীল ও বশরতনগর গ্রামে।
সত্তরোর্ধ্ব মোহাম্মদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘একসময় প্রাকৃতিকভাবে পাখিরা খেজুর খেয়ে বীজ ফেললে সেই বীজ মাটিতে পড়ে গাছ গজাত। এভাবেই বেশির ভাগ গাছের জন্ম। একেকটি খেজুরগাছ ৮০-৯০ হাত লম্বা হয়। বাঁচে ১০০-১৫০ বছর। পাঁচ বছর বয়স থেকে খেজুরগাছ রস দেওয়া শুরু করে। রসের স্বাদ ভালো পেতে সপ্তাহে তিন দিন সংগ্রহই উত্তম। যে গাছের আঁশ পাতলা সেই গাছের রস হয় বেশি মিষ্টি।’
মুরাদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বাহার খবরের কাগজকে বলেন, ‘শীত মানেই খেজুর রস। আমাদের এলাকায় খেজুর রস বিশেষ ঐতিহ্য। যার আলাদা কদর রয়েছে। এ ঐতিহ্য আমাদের ধরে রাখতে হবে। একসময় খেজুরগাছের কোনো যত্ন নেওয়া হতো না বলেই গাছ কমে গেছে। তবে এখন বাণিজ্যিক আকারে খেজুরগাছের বাগান করছেন কেউ কেউ। যদিও রসের দাম এখন দুধের সমতুল্য।’
সীতাকুণ্ড উপকূলীয় বন বিভাগের ফরেস্টার রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘সীতাকুণ্ডে ১৯৯৬-৯৭ সালে ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে কয়েক হাজার খেজুরগাছ লাগানো হয়েছিল। এখন বেড়িবাঁধের ধারে টিকে আছে মাত্র দুই হাজারের বেশি গাছ। এর বাইরেও আছে অনেক। বেড়িবাঁধের গাছগুলো প্রতি শীত মৌসুমে উন্মুক্ত টেন্ডারের মাধ্যমে ইজারা দেওয়া হয়। এ মৌসুমে ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা সরকারি রাজস্ব আয় এসেছে খেজুরগাছ থেকে। আগামীতে আর গাছ সৃজন করার পরিকল্পনা রয়েছে।