কয়েক দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর সংঘর্ষের পর রাত ৯টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) নেমে আসে স্থবিরতা। এর পর ধীরে ধীরে স্থবিরতা কেটে গেলেও চাপা আতঙ্কে শিক্ষার্থীরা পার করেছেন ১৫ জুলাই রাত। হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ফোন চেক, মারধর ও হলছাড়া করার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।
এ ছাড়াও ছাত্রলীগের নেতাকে মারধর, হলের নেতার রুম ও ১০ মোটরসাইকেল ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে কোটা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে।
এদিকে এমন উদ্ভট পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাজনিত কারণে হলও ছেড়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
গত সোমবার ও মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বিভিন্ন সময়ে এসব ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, সোমবার বিভিন্ন সময়ে স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী মারধরের ঘটনা ঘটে। এ সময় মারধরের শিকার শিক্ষার্থীদের ফোন চেক করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এবং যাচাই করেন এই আন্দেলনের সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না!
কোটা সংস্কার আন্দোলনে যাওয়ায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি শেয়ার করায় মারধরের শিকার হয়েছেন স্যার এ এফ রহমান হলের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আব্দুল বাসিত, শাকাওয়াত হোসেন সাকু, লিমন খান রানা, মোর্শেদ ইসলাম এবং ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ফারুক ও তাওহীদ ইসলাম। এর মধ্যে শাকাওয়াত, লিমন ও মোর্শেদকে হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
এ বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. রফিক শাহরিয়ার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি আমি অবগত। আমি হলের রুমে রুমে আবাসিক শিক্ষকদের পাঠিয়েছি। তারা রুমে রুমে শিক্ষার্থীরা ঠিক আছে কিনা তারা সেটি দেখেছেন।’
এদিকে বিজয় একাত্তর হলের প্রবেশপথ এক শিক্ষার্থীকে লাঠি-স্ট্যাম্প দিয়ে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে। এ ছাড়াও সবমিলিয়ে এই হলে সাতজনের মতো শিক্ষার্থীকে মারধর করা হয়েছে গণমাধ্যমকে জানিয়ে ভুক্তভোগীরা। এ ঘটনায় অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানিয়েছেন হলটির প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির।
এ ছাড়াও বেশ কয়েকটি হলে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ফোন চেকের অভিযোগ উঠেছে। যদিও এই অভিযোগের বিষয়ে ছাত্রলীগের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
দুই ছাত্রলীগ নেতাকে মারধর, মোটরসাইকেল ও রুম ভাঙচুর:
বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হলের শিক্ষার্থী বিরুদ্ধে কবি জসীম উদ্দীন হল ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হেদায়েতুল ইসলাম মারধরের অভিযোগ তুলেছেন। এ সময় তার মোটরসাইকেলও ভাঙচুর করা হয়। বলা হচ্ছে, তারা সবাই কোটা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
হেদায়েত বলেন, ‘আমার ছোটো ভাইকে নিয়ে খেতে আসছিলাম। আমার মোটরসাইকেল আটকে রাখছে। মোটরসাইকেলটা দামি। এটা ছাড়িয়ে আনা দরকার।’
এদিকে শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি জাহিদুল ইসলাম জাহিদ তার রুম ভাঙচুরের অভিযোগ তুলেছেন আন্দেলনকারীদের বিরুদ্ধে।
লিখিত বক্তব্যে জাহিদ বলেন, ‘আমি জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু - স্লোগান ধরি এটা কি আমার অপরাধ? আমি সব সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কথা বলি এটা কি আমার অপরাধ? যারা তথাকথিত কোটা আন্দোলনের নাম করে ‘ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চান’ তাদের বিরুদ্ধে আমি কথা বলেছি এটা কি আমার অপরাধ? এই যে কোটা আন্দোলনকারীরা, আমি কি কখনও আপনাদের কোনো ক্ষতি করেছি যে নারকীয়ভাবে আমার রুমটা ভেঙে চুরমার করলেন? আমার সার্টিফিকেট ও বিছানাপত্র সব পুড়িয়ে ফেললেন! কী অন্যায় করেছি আমি যে আন্দোলনকারীরা আমার এতো বড় সর্বনাশ করলেন?’
আতঙ্কে হল ছাড়লেন বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী:
সোমবারের আন্দোলনকারী-ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে আতঙ্ক ছড়িয়েছে হলে থাকা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর মাঝে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন হল ছাড়া খবরও পাওয়া গেছে। হাতে ও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হল ছেড়ে যাওয়া এসব শিক্ষার্থীর অনেকেই গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘দুপুর থেকে এ পর্যন্ত বাড়ি থেকে অন্তত ২০ বার কল দিয়েছে। জানতে চেয়েছে কি অবস্থা এখন। তাই পরিবারের সদস্যরা বলছেন যেন বাড়ি চলে যাই। তাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, ক্লাস শুরু হলে আসব। তবে এখন হলে হয়তো আর ওঠা হবে না।’
হামলার দায় ছাত্রলীগকেই নিতে হবে:
দিনভর চলা এই হামলার দায় ছাত্রলীগকেই নিতে হবে বলে জানিয়েছে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর অন্যতম সারজিস আলম।
মঙ্গলবার রাত আড়াইটার দিকে অমর একুশে হলের সামনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যদি শিক্ষার্থীদের সমস্যা হতো তাহলে হয়তো তা ইট-পাটকেল ছোড়া পর্যন্তই থাকতো। কিন্তু বহিরাগতদের এনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে। তারা আমাদের যারা বোনেরা ছিল তাদের শরীরে হাত দিয়েছে, সম্ভ্রমহানি ও হেনস্তা করেছে। আমাদের বোনদের রাস্তায় ফেলে তাদের ওপর চড়াও হয়েছে, লাঠি দিয়ে আঘাত করেছে। এর দায় অবশ্যই ছাত্রলীগকেই নিতে হবে।’
আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে ঢামেকে শিক্ষক সমিতি:
ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং সংঘর্ষে দুই শতাধিক আন্দেলনকারী শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এদিকে ছাত্রলীগেরও কয়েক শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হয়েছেন। গত সোমবার রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি থাকা আহত শিক্ষার্থীদের দেখতে গিয়েছিলেন ঢাবি শিক্ষক সমিতি।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. নিজামুল হক বলেন, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষক সমিতি। তাদের সুচিকিৎসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সব রকম সহযোগিতা করা হবে।
ছাত্রলীগ ও কোটা আন্দেলনকারীদের পাল্টা কর্মসূচি আজ:
মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দেড়াটায় ঢাবির সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ, রাজাকারের সাফাই এবং সাধারণ শিক্ষার্থী ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি রয়েছে ছাত্রলীগের।
অন্যদিকে বেলা তিনটার দিকে সারাদেশ জুড়ে হামলার প্রতিবাদ এবং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার ও এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ-মিছিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
আরিফ জাওয়াদ/অমিয়/