ঢাকা ১৩ ভাদ্র ১৪৩১, বুধবার, ২৮ আগস্ট ২০২৪

বাজেটে উপকূলীয় অর্থনীতি সুবিবেচনায় আসেনি

প্রকাশ: ১৭ জুলাই ২০২৪, ১০:০৫ এএম
বাজেটে উপকূলীয় অর্থনীতি সুবিবেচনায় আসেনি
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সেটা বোঝা যায় বাজেট বানানো, পেশ ও পাসের সময় রিমাল নামের ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলীয় অর্থনীতিতে এত বড় ছোবল মেরে গেল, সে ব্যাপারে উপেক্ষার অবয়বে ন্যূনতম উদ্বেগ প্রকাশের নাম-নিশানা মেলেনি। বাজেটে কর্মসূচিভিত্তিক বরাদ্দ তো নয়ই। রিমালের জলোচ্ছ্বাসে পুরো সুন্দরবন তলিয়ে গিয়ে সেখানকার প্রাণিসম্পদের ব্যাপক সংহারসাধনের বিপরীতে তাৎক্ষণিক করণীয় কিছুই ছিল না। 

উপকূলীয় অন্যান্য জনপদে জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সুরাহা সুদূর পরাহত প্রতীয়মান। ক্ষতিগ্রস্ত কিছু লোকজনকে শীর্ষ পর্যায় থেকে সরাসরি সাহায্য দিয়ে ‘আপনাদের জন্য যা কিছু করার করা হবে’- এই প্রতিশ্রুতি ওই উপদ্রুত উপকূলের মাঠেই মারা গেছে মনে হচ্ছে। বাজেটে কিছুই মেলেনি। 

এমনকি এবার পাবলিক চাঁদায় অর্জিত তহবিল গঠনের কোনো ছবি ওঠাতে পারেননি বিএবির মতো করিতকর্মা সংগঠন ও এর নেতারা। রিমাল-সাধিত সর্বনাশের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের সাম্প্রতিক প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে উপকূলীয় অর্থনীতির প্রতি সুরক্ষা-সুবিবেচনা, দায়িত্ববোধ, উদ্ধার-উদ্যোগের চিন্তাচেতনার রাজ্যে নৈরাজ্য বিরাজ করছে। স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে উপকূলীয় অর্থনীতি উদ্ধার উন্নয়ন কর্মতৎপরতার মধ্যে কোনো তালমিল পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।  

বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলের দৈর্ঘ্য ৭১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে সুন্দরবন ১২৫ কিলোমিটার, নদীর মোহনা ও ছোট-বড় দ্বীপমালা ২৭৫ কিলোমিটার, সমতল ও সমুদ্রসৈকত ৩১০ কিলোমিটার। টেকনাফের নাফ নদীর মোহনা থেকে সাতক্ষীরা জেলার সীমান্ত নদী রায়মঙ্গল-কালিন্দী পর্যন্ত খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের মোট ১৪টি উপকূলীয় জেলায় বিস্তৃত বাংলাদেশের উপকূলেই দেশের প্রধান দুটি সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম ও মোংলা, বিশ্বের সেরা গহিন গরান বন সুন্দরবন এবং বিশ্বের অন্যতম অখণ্ডিত (আনব্রোকেন) সমুদ্রসৈকত বা বেলাভূমি কক্সবাজার অবস্থিত। 

দেশের শতকরা ২৫ ভাগ জনগণ যেমন এই উপকূল অঞ্চলে বসবাস করে তেমনি জাতীয় অর্থনীতিতে জিডিপির কমবেশি প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ অবদানও এ অঞ্চলেরই। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এই অঞ্চল, এর অবকাঠামো এবং বসবাসকারী জনগণের অর্থনৈতিক জীবন নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্বিপাক, বৈষম্য, অবহেলা আর অমনোযোগিতার শিকার। 

অথচ এটা ঠিক বঙ্গোপসাগরের তীরে ও বিশ্বের সেরা গহিন গরান বনের নীড়ে গড়ে ওঠা গাঙ্গেয় বদ্বীপ বাংলাদেশ যেন প্রকৃতির এক বিচিত্র বিলাস। তার মাথার ওপর হিমালয় পর্বত, সাইবেরিয়ার হিমবাহ ঠেকিয়ে চলে অবিরত, পায়ের নিচে বঙ্গোপসাগর তার পা ধোয়ায় প্রতিনিয়ত। সে কারণেই কর্কট ক্রান্তি রেখার ওপর দাঁড়িয়েও চরম নয় তার আবহাওয়া, নাতিশীতোষ্ণ, মৌসুমি বায়ুর বরমাল্য বরিষণে বাংলা সতত সবুজ শস্যশ্যামল।  

প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চল প্রকৃতির বিরূপ আচরণের প্রথম ও প্রত্যক্ষ শিকার সব সময়েই। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে উপকূলীয় অঞ্চলের অর্থনীতির সুরতহাল রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে এটা প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, জাতীয় অর্থনীতির আন্তসলিলা শক্তির (রেজিলিয়েন্ট পাওয়ার) উদ্বোধন যার হাতে সেই সবচেয়ে বেদনায় বিবর্ণ। উপকূলীয় অঞ্চল যেন শুধু দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের মাথাব্যথা সূত্রে সমুপস্থিত, আকালের দিনে নাকালের মোহনায় এবং একমাত্র মিডিয়ায়। 

পাজি-পুঁথি ও সরকারি পরিসংখ্যান ঘেঁটে জানা যায়, ১৭৯৭ থেকে শুরু করে এই সেদিন ২৭ মে, ২০২৪ তারিখে সর্বশেষ রিমাল পর্যন্ত মোট ৪৯৬ বার মাঝারি ও মোটা দাগের জলোচ্ছ্বাস, গোর্কি, হারিকেন, সিডর, আইলা, নার্গিস, মাহাসেন, ফনি, বুলবুল ও আমফান, ইয়াস, রিমেল বাংলাদেশের উপকূলকে ক্ষতবিক্ষত করেছে। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ১৭৩ বছরে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে ৩২৯টি, এসেছে গড়ে ৫-১০ বছর পর পর, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত ৫৩ বছরে ১৭৪টি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাস ঘটেছে ঘন ঘন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ ও মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে পড়ে, তাপমাত্রার পবির্তনপ্রসূত তারতম্য সূত্রে সমুদ্রের তলদেশ স্ফীত হয়ে ওঠার ফলে পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে চলেছে বিশ্বের প্রায় সব সমুদ্র উপকূল বেষ্টনীতে বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বাংলাদেশের জন্য তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের অশনি সংকেত দিয়ে চলেছে। 

বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল, বিশেষ করে অদূরবর্তী দ্বীপাঞ্চল সামান্য জলোচ্ছ্বাসের ছুতানাতাতেই তলিয়ে যাচ্ছে, তা উদ্ধারে বশংবদ কোনো কার্যক্রম সফল হচ্ছে না। সুন্দরবনের প্রাণিবৈচিত্র্য বিপন্ন হতে চলেছে এর প্রভাবে। এবার রিমালের অকস্মাৎ জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের মৃত হরিণ ভেসে এসেছে লোকালয়ের নদীতে, সুন্দরবন অভ্যন্তরস্থ তিন শতাধিক সুপেয় পানির জলাধার (যা বন্যপ্রাণীদের একমাত্র পানীয় অবলম্বন) লোনা পানিতে একাকার হয়ে যাওয়ায় সেখানকার প্রাণিসম্পদ আজ নিদারুণ সংকটে। 

সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেছে ফসলের খেত, মাছের ঘের, বিধ্বস্ত হয়েছে বাড়িঘর। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে বেশ কিছু উপজেলা। ঘূর্ণিঝড় রিমালে উপকূলীয় এলাকার ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩৫ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে, আর আংশিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ঘরবাড়ি। 

বাংলাদেশে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার প্রশাসন জানাচ্ছে, রাস্তার ওপর গাছ পড়ে থাকায় অনেক এলাকায় ত্রাণ তৎপরতা চালানো যাচ্ছে না। সেই সঙ্গে ঝড়ের প্রভাব পুরোপুরি না কমায় শুরু করা যাচ্ছে না উদ্ধার অভিযান। বাগেরহাট, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এলাকার অসংখ্য মাছের ঘের, ফসলি জমি তলিয়ে গেছে পানির নিচে।

অতীব দুঃখজনক এই যে, রিমালে অসংখ্য বেড়িবাঁধ ধসে পড়েছে। ভেঙেছে আমতলী ও পরশুনিয়ার বাঁধ। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় বাঁধ টপকে পানি ঢুকেছে লোকালয়ে। ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা, কয়রা, আশাশুনি ও শ্যামনগরের ৯৬ স্থানে বাঁধে ভাঙন ধরেছে। লবণাক্ত পানিতে প্লাবিত হয়েছে বহু এলাকা। ভেঙে গেছে ঘরবাড়ি। ভেসে গেছে মাছের ঘের।

উপকূলীয় বেড়িবাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে ‘সমকাল’ পত্রিকায় ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত ‘বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ শুরু হচ্ছে মার্চে’ শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা থেকে উপকূলীয় এলাকার জমি ও ঘরবাড়ি রক্ষায় ছয় জেলায় নির্মাণ করা হচ্ছে প্রায় ৬২৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। এ কাজে ব্যয় হবে ৩ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড’। 

২০২০ সালের ১৪ জুলাই সংবাদমাধ্যম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম পরিবেশিত ‘টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়- ‘টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকার ৮ হাজার কোটি টাকার চারটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন পানিসম্পদ উপমন্ত্রী। চলতি অর্থবছরে (২০২০) প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এ ছাড়া উপকূল উন্নয়ন বোর্ড গঠনের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করছে’।

এ বিষয়ে ২০১৯ সালের ১২ মে দৈনিক প্রথম আলোয় ‘মেরামত ও রক্ষাণাবেক্ষণে নজর দিন, ঝুঁকিতে উপকূলের বেড়িবাঁধ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় স্তম্ভে বলা হয়- ‘ভয়ানক আতঙ্কের কথা হলো, দেশের উপকূলীয় এলাকার ৮ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার পর উপকূল এলাকার এসব বাঁধের অনেক জায়গা ভেঙে গিয়েছিল, অনেক জায়গা বানের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল; কিন্তু তার বড় অংশ এখনো যথাযথভাবে মেরামত হয়নি। 

তার মানে গোটা উপকূলীয় এলাকা এখন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে’। সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১৭ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোরায় প্রায় ২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর বাইরে ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলার আঘাতে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেগুলো মেরামত এখনো শেষ হয়নি। 

সরকারের হিসাবে দেশে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে চলে আসার পর টানা কয়েক বছর ফসল হয় না। মিঠাপানির মাছ ও অন্যান্য প্রকৃতিবান্ধব কীটপতঙ্গের বংশবিস্তার বাধাগ্রস্ত হয়। এ কারণে উপকূলের বেড়িবাঁধ সুরক্ষিত রাখায় অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। 

উদ্বেগের বিষয়, বেড়িবাঁধের রক্ষণাবেক্ষণে বরাদ্দ সব সময়ই অপ্রতুল। পানি উন্নয়ন বোর্ড তাদের অধীনে থাকা বেড়িবাঁধের ওপর স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘেঁষতে দেয় না। কিন্তু অনেক জায়গায় দেখা গেছে, বাঁধে সামাজিক বনায়ন করা হলে কিংবা এলাকাবাসী ঘরবাড়ি তুললে বাঁধ অনেক বেশি সুরক্ষিত থাকে। নিজেদের স্বার্থেই এলাকাবাসী বেড়িবাঁধকে সুরক্ষিত রাখতে উদ্যোগী হয়। 

এ কারণে বাঁধগুলোর সুরক্ষার সঙ্গে স্থানীয় মানুষের ব্যক্তিস্বার্থের মধ্যে সম্পর্ক বাড়ানো যেতে পারে। আমাদের দেশে দুর্যোগের আগে নানা রকমের প্রস্তুতি নেওয়া এবং দুর্যোগের পর পর সব ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতি চালু আছে। এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এ ছাড়া সরকারি বরাদ্দের অর্থ নয়ছয়ের চেষ্টাও দেখা যায়। 

জোয়ারের পানি ঠেকানোর রিংবাঁধ নির্মাণ, বাঁধ মেরামত, সংস্কার প্রভৃতি নামে প্রতি বছর নেওয়া হয় বিভিন্ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পে অর্থ নয়ছয়ের ঘটনাও ঘটে। বর্ষা এলে বাঁধ ভেঙে যায়। নতুন প্রকল্পের নামে শুরু হয় নতুন বরাদ্দ। এভাবে বছরের পর বছর উপকূলীয় বাঁধের সংস্কারের নামে চলে অর্থের অপচয়। এই মনোভঙ্গিরও অবসান জরুরি।

লক্ষ্য করার বিষয় যে, বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে যথাযথ তদারকি, গুণগতমান পরীক্ষা ও একে টেকসই করণে দায়িত্বশীল বিভাগ ও সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং কারিগরি নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা রয়েছে, রয়েছে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব।

উপকূলীয় অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে বেড়িবাঁধ টেকসই আকারে নির্মাণসহ সুন্দরবন সুরক্ষা এবং উপকূলীয় জনপদ, জীবন ও জীবিকা ও কৃষি অর্থনীতির দুর্দশা লাঘব উত্তর বিকাশকে গুরুত্ব দিতে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রদত্ত বরাদ্দ ও ইতোমধ্যে ঘোষিত উদ্যোগ ও নির্দেশনা যথাযথ বাস্তবায়নের ওপর কড়া নজরদারি, আগামী অর্থবছরে বিশেষ বরাদ্দদান ও তা বাস্তবায়নে দায়িত্বশীলতা নিশিচত করা। 

মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ হিসেবে উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড’ গঠন করা। উপকূলীয় উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হলে অর্থনীতির এক চতুর্থাংশ জিডিপি সরবরাহকারী উপকূলীয় অঞ্চলের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি থেকে উপকূল, সুন্দরবন ও লোকালয় রক্ষার সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়াস প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করবে।  

লেখক: সরকারের সাবেক সচিব। উপকূলীয় কৃষি অর্থনীতির গবেষক 

নারীর সম্ভ্রমহানি এবং আমাদের সামাজিক ব্যাধি

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৯ এএম
নারীর সম্ভ্রমহানি এবং আমাদের সামাজিক ব্যাধি
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

গল্পের অভাবের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাই বলে গল্প কি লেখা হচ্ছে না? পত্রিকার ঈদসংখ্যায় গল্প থাকে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আগের হারে না হলেও যে ম্যাগাজিন বের হয়, তাতে শিক্ষার্থীরা গল্প লেখে। ঈদসংখ্যার গল্পের মূল্যায়নের প্রয়োজন নেই, কারণ সেগুলো প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রতিষ্ঠা পাবেন- এমন লেখকের লেখা। 

তবে এটা বলতেই হবে যে, অধিকাংশ গল্পেই ঘটনা পাওয়া যায়, কিন্তু দার্শনিকতা অনুপস্থিত থাকে। আর এটা তো বলার অপেক্ষা রাখে না যে, লেখক যদি কেবল ঘটনার বিবরণই দিয়ে যান, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির ছাপটা তার গল্পে দিতে না পারেন, তাহলে গল্প সাহিত্য হয় না। গল্পে (এবং সাহিত্যেও) এখন ওই দৃষ্টিভঙ্গিটির বড়ই অভাব। 

কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে না, এ কেমন কথা? দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে দেখাটা কীভাবে ঘটছে? দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই আছে; কিন্তু তাতে অভাব দেখা যাচ্ছে গভীরতার। বয়স যাদের অল্প, তাদের কাছে গভীরতা আশা করা যায় না; পাওয়াও যায় না। ধরা যাক একটি কলেজের বার্ষিকীটির কথা, যেটি কৌতূহলের সঙ্গে পড়লাম, ছেলেমেয়েরা কী ভাবছে সে বিষয়ে নতুন কিছু খবর পাওয়া যাবে এই আশা নিয়ে। তা নিরাশ হয়েছি বলা যাবে না। 

কবিতায় যে ব্যক্তিগত কথা থাকবে, এটা তো অবধারিতই। আমাদের নামকরা কবিদের লেখাতেও এখন দেখি কেবল নিজের কথাই আছে। সেটা অস্বাভাবিক নয়; যেটা বেদনাদায়ক, তা হলো এই ঘটনা যে ওই ‘নিজ’ নিতান্তই ব্যক্তিগত। কবিতা লেখক তার আপনাকে অন্য অনেকের সঙ্গে যুক্ত করছেন না, নিজের দুঃখের (মূলত হতাশার) কথাই বলে যাচ্ছেন। 

কলেজ ম্যাগাজিনে অল্প বয়সীরাও তাদের লেখা কবিতায় ঠিক ওই কাজটিই করেছে; তবে একটু পার্থক্য আছে; একেবারেই নিজের কথা না বলে আপনজনদের কথাই বেশি বেশি বলেছে। কবিতাগুলোর কয়েকটির নাম এই রকমের: কলেজ, আমার কলেজ, বড় ভাই, বাবা, মা, স্মৃতি। 

গদ্যাংশের রচনাগুলোর কয়েকটি শিরোনাম এবং বিষয়বস্তুও ওই একই রকমের। যেমন, প্রিয় কলেজ, গ্রামে শৈশবকাল, বাবা, মা, স্মৃতি, প্রিয় বড় আপু, প্রিয়জন, মা-হারানোর বেদনা, বাবাকে নিয়ে কিছু কথা, আমার দেখা সেরা মানুষটি, বড় বোন, রত্নপুর আমার গ্রাম, স্মৃতির পাতায় স্কুলজীবন, বাবা তোমায় মনে পড়ে, আমার কলেজ আমার অহংকার, শিক্ষাসফর, মা-বাবার প্রতি ভালোবাসা, ভালোবাসি দাদাভাই তোমাকে, ভাইয়ের শূন্যতা সে-ই বুঝবে যার নেই, কলেজ লাইব্রেরি, হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বাবা, ভাই, মা আমার মা, স্কুলজীবনের স্মৃতি, যখন সময় থমকে দাঁড়ায়, বাবা আমার বাবা, স্মৃতির ঝুলি। 

যারা লিখেছে তাদের প্রায় সবাই ছাত্রী। বার্ষিকীটিতে কলেজের ছেলেরাও লিখেছে, তবে সংখ্যার দিক থেকে তারা নগণ্য। মেয়েরা যে লিখছে তার একটা কারণ হয়তো এই যে তাদের হাতে সময় আছে, ছেলেদের যা নেই; ছেলেদের তো অনেক কর্তব্য; ঘোরাফেরা, আড্ডা দেওয়া, এমনকি মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাও।

কিশোর গ্যাং তাদের ইতোমধ্যেই পেয়েছে কি না জানি না, দু-চারজনকে পেয়েছে শুনলেও চমকে উঠব না। তা ছাড়া আরও একটা বিষয় শুনেছি মফস্বল শহরের ব্যাপারে। সেখানকার কলেজগুলোতে এখন মেয়েদের সংখ্যাধিক্য। যে ছেলেদের কলেজে পড়বার কথা তাদের অনেকেই বিদেশে চলে গেছে। বিদেশ থেকে তারা টাকা পাঠায়, সেই টাকায় ছোট ভাইয়েরা আয়েশ করে; কিন্তু ছোট বোনেরা যায় পড়তে- স্কুলে, কলেজে। 

এ রকম ঘটনা এই কলেজটির ব্যাপারে ঘটাটাও বিচিত্র নয়। তবে মেয়েদের লেখা থেকে এই গল্পটা তো বেরিয়ে আসছেই যে, তারা বিশেষভাবে পিতৃনির্ভর। কারণটা বোঝা যায়। সেটা হলো এই যে, আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। পিতাকে সন্তানদের খুবই প্রয়োজন বিশেষ করে মেয়েদের দিক থেকে, পিতা না থাকলে তারা বিশেষভাবেই অরক্ষিত বোধ করে, ওই লেখিকারা যেমন করেছে। দ্বিতীয় সত্যটা এই যে, মেয়েরা কলেজ পর্যন্ত এসেছে বটে; কিন্তু তাদের জগৎটা মোটেই প্রসারিত হয়নি। 

অথচ আমাদের মেয়েরা তো এখন অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রসর। গত পাঁচ বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, এসএসসি পরীক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে ছেলেদের সরিয়ে দিয়ে। ওই কলেজবার্ষিকীটিও তো এ খবর জানাচ্ছে আমাদের যে, লেখার ব্যাপারে মেয়েদের আগ্রহটাই বেশি। তবে মেয়েরা এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু একটা ভয় কিছুতেই তাদের পিছু ছাড়ে না। সর্বদাই উপস্থিত থাকে; সুযোগ পেলেই টেনে ধরবে এমন ভাব। ওই ভয়টাই কলেজবার্ষিকীর লেখাগুলোকে একটি শোকসভায় পরিণত করেছে। 

মেয়েদের জন্য পথে-ঘাটে বিপদ ওত পেতে থাকে। সবচেয়ে ভয়ংকর যে ঘটনা সেটা অবশ্য ধর্ষণ। সব খবর কাগজে আসে না; ভুক্তভোগীরা প্রকাশ করতে চায় না, নতুন করে সম্ভ্রমহানি ঘটার ভয়ে; অভিভাবকরাও চান না প্রচার পাক এবং মেয়েকে পাত্রস্থ করার ব্যাপারে বিঘ্ন ঘটুক। এই নিষেধাজ্ঞার ফাঁক দিয়েও রোমহর্ষক সব খবর আসে। 

যেমন- একই দিনে একই পত্রিকায় তিনটি খবর। প্রথমটি ঢাকার: ‘২২ দিন ধরে আটকে রেখে তরুণী ধর্ষণের অভিযোগে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা গ্রেপ্তার’। দ্বিতীয়টি সিলেটের। ‘ধর্ষণের পরে শিশুটিকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে’। তৃতীয়টি একই রকমের যে, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় হত্যা মামলা তুলে না নেওয়ায় মেয়েকে ধর্ষণ এবং ছেলেকে ছুরিতে জখম করা হয়েছে। স্বামীকে হত্যা করা হলে স্ত্রী মামলা করেছিলেন তিনজনের বিরুদ্ধে। জামিনে বের হয়ে এসে তারা ওই তাণ্ডব ঘটিয়েছে (ভোরের কাগজ, ৩ এপ্রিল)। 

অন্য পত্রিকা থেকে একটি খবর: বাগেরহাটে বিয়ে উপলক্ষে এক বাড়িতে একজন নৃত্যশিল্পী গিয়েছিলেন; অনুষ্ঠান শেষে স্বামীর সঙ্গে ফিরছিলেন নিজেদের গৃহে। মোটরসাইকেলে চেপে কয়েকজন এসে বলল, তাদের পৌঁছে দেবে। তারা স্বামীকে ওঠাল এক মোটরসাইকেলে, স্ত্রীকে অন্য একটিতে। তারপর স্বামীকে ভুল বুঝিয়ে ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়ে একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে আটকে রাখল; এবং স্ত্রীকে নিয়ে গেল জঙ্গলে। 

সেখানে নৃত্যশিল্পী ওই মহিলাকে পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করল আটজন যুবক। স্থানীয়রা টের পেয়ে তাদের চারজনকে আটক করেন এবং টহল পুলিশের হাতে তুলে দেন। অন্যদের ধরার চেষ্টা নাকি চলছে (আজকের পত্রিকা, ১৬ এপ্রিল)। একই পত্রিকায় একই দিনে আরেকটি খবর: ‘শরীয়তপুরে স্কুলছাত্রীকে তিন দিন ধরে আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ। চার যুবক গ্রেপ্তার’। 

হতভাগ্য মেয়েটির বাবা নেই; কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। থাকত সে মায়ের সঙ্গে, কখনো আবার বোনের বাড়িতে। ঈদের দিন সন্ধ্যায় নানা বাড়িতে যাওয়ার পথে পরিচিত দুই যুবক মুখ চেপে ধরে তাকে নিয়ে যায় টিনের এক ঘরে এবং সেখানে আটকে রেখে তিন দিন ধরে তাকে ধর্ষণ করে। তৃতীয় দিন তারা আরও তিনজনকে ডেকে আনে। ওই তিনজনও একই কাজ করে। তিন দিন পর মেয়েটিকে তারা একটি অটোরিকশায় তুলে দেয়। 

এই লেখাটি তৈরি করতে করতেই খবর পড়লাম এ রকমের: পাবনায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ। মেয়েটি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। রাতের বেলায় টয়লেটে যওয়ার জন্য সে বের হয়েছিল। তখনই ওই ঘটনা। সদ্য সমাপ্ত উপজেলা নির্বাচনে ওই কিশোরীর স্বজনরা পরাজিত প্রার্থীর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। বিজয়ী প্রার্থীর ইন্ধনে স্থানীয় বখাটেরা ওই নিপীড়নটি ঘটিয়েছে বলে ভুক্তভোগীর পরিবারের দাবি। বিজয়ী এবং পরাজিত উভয় পক্ষই কিন্তু আওয়ামী লীগের স্থানীয় কর্মকর্তা (দেশ রূপান্তর, ১৯ মে)।

চরম একটি খবর পাওয়া গেল ওই দিনেরই আরেকটি পত্রিকায়। সেটি এ রকমের যে, ধর্ষণের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে বাংলাদেশ জুজুৎসু অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক, সহযোগিতার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সম্পাদক সাহেবের একজন নারী সহযোগীকেও। 

ধর্ষণের শিকার একজন নয়, কয়েকজন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে এবং ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জুজুৎসু প্রশিক্ষণের কেন্দ্রের ভেতরেই। ধর্ষক প্রশিক্ষকের কাজ করত। প্রশিক্ষক হিসেবে সে কিশোরী শিক্ষার্থীদের পোশাক পরিবর্তনের কক্ষে ঢুকে পড়ে ধর্ষণের কাজ সারত। মেয়েদের নগ্ন ছবি মোবাইলে ও ভিডিও ক্যামেরায় তুলে তাদের ব্ল্যাকমেল করত বলেও জানা গেছে। 

জুজুৎসু শিক্ষায় কিশোরীদের অভিভাবকরা পাঠান তাদের সন্তানরা আত্মরক্ষায় দক্ষ হয়ে উঠবে এই ভরসায়; সেখানেই যদি অমন ঘটনা ঘটে এবং ঘটায় অন্য কেউ নয় কেন্দ্রের প্রশিক্ষক নিজেই অপরাধী হয় এবং ওই সব কাজে তাকে সাহায্য করে তারই একজন নারী সহযোগী, তাহলে আর বাকি থাকে কি? (আজকের পত্রিকা, ১৯ মে)।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

অকার্যকর পরিকল্পনা, নদীর মৃত্যু অতঃপর...

প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৬ এএম
অকার্যকর পরিকল্পনা, নদীর মৃত্যু অতঃপর...
মোখলেছুর রহমান

নদী আমাদের প্রকৃতির এক অমোঘ দান, প্রাকৃতিক মূলধন। নদী সৃষ্টি করা যায় না। বরং নদী দেশ-জনপদের জন্য ভূমি ও ভূমিরূপ সৃষ্টি করে। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটি ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গার জলে পরিপুষ্ট হয়ে জন্মলাভ করা এক সবুজ-শ্যামল মায়াবতী ব-দ্বীপ। আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, চীন, ভারত, নেপাল, মায়ানমার ও পাকিস্তান সমন্বয়ে হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চল গঠিত। 

এই অঞ্চলটি বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘ওয়াটার টাওয়ার’ হিসেবে স্বীকৃত এবং এশিয়ার বৃহত্তম ১০টি নদীর উৎস। বাংলাদেশ হিন্দুকুশের নিম্নধারাভুক্ত একটি দেশ। তাই পরিপূর্ণ নদী ব্যবস্থাপনা করতে হলে আন্তর্দেশীয় জলকূটনীতিতে আমাদের অগ্রগামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। এর অভাবে অকালবন্যা, নদীভাঙনে জনপদ ধ্বংস, ফসল নাশ এবং মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতি হুমকি আরও ঘনীভূত হচ্ছে এব্রং জাতীয় জীবনে আমরা এরই ফল উপভোগ করছি।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা’ পুস্তিকায় নদীর সংখ্যা ১০০৮টি বলে প্রকাশ করেছে। তাই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর গতিরোধ করতে গিয়ে সংকটে জড়িয়ে পড়ছি। কারণ নদী সুরক্ষার কোনো কৌশল আমাদের জানা নেই। 

উল্লেখ্য, এই দেশের কোনো উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নদী ও জলাভূমি নিয়ে পাঠদানের গুরুত্বকে আমলে নেওয়া হয়নি। আমাদের শিক্ষক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, নীতিনির্ধারক মহল, রাজনীতিবিদ ও শাসক গোষ্ঠী নদী কিংবা জলাভূমিকে আমাদের জাতীয় সম্পদ ও জীবনধারার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেছেন। 

কেবল সাধারণ মানুষ বিপদে পড়লে কিছু সভা কিংবা প্রতিবাদ হয়, তাতে একে রক্ষার জন্য সবাই একমত পোষণ করে। বরং নদীকে সরকারিভাবে কখনো বদ্ধ জলাশয়, কখনো খাল ইত্যাদি বলে মাইলের পর মাইল নদীকে আইনি মোড়কে বেআইনিভাবে ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়া হয়েছে। নদী দখল করেছে সরকার, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিত্তশালী দুর্বৃত্ত এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের সহস্রাধিক নদী কীভাবে এই প্রবাহ হারাল, দখল হয়ে গেল কিংবা দূষণ করা হলো, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায় না।

ভূমিকম্প ও উজানের দেশগুলো কৃত্রিমভাবে পানির প্রবাহের হ্রাস টানা এবং সর্বোপরি নদী ব্যবস্থাপনায় আমাদের অজ্ঞতা ও উদাসীনতা ক্রমেই সংকটাপন্ন অবস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে। নদী বিষয়ে আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ের সমঝদার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠায় এর সংকটগুলোকে সুবিবেচনায় নেওয়া সম্ভব হয়নি। 

পানির প্রবাহ, ওয়াটার শেডের প্রভাব, নদীভাঙনের বৈজ্ঞানিক কারণ ইত্যাদি বুঝে ও গবেষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। অথচ বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক সংস্কৃতি ও জীবনধারা গড়ে ওঠার পেছনে নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা কৃষির অবদান প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত। প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে এর পানিতে মৎস্য চাষ ও পলিসমৃদ্ধ অববাহিকায় কৃষি ফসল উৎপাদন বাংলাদেশে এক প্রাকৃতিক স্নিগ্ধ জীবনব্যবস্থা প্রদান করেছে।

বাংলাদেশের নদীপারের জেলাগুলোতে জন্ম নিয়েছেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, দার্শনিক এবং বহু সৃজনশীল ক্ষণজন্মা মানুষ। তারা বাংলার শিল্প ও সাহিত্যে অনবদ্য অবদান রেখে অমর হয়েছেন।

আমাদের অনেকের ধারণা, নদীকে শাসন করলে এর উত্তম ও অর্থবহ ব্যবহার করা যায়। আর নাব্যর জন্য ড্রেজিং করলেই চলবে। কিন্তু পানির ভাষা বা হাইড্রোলজি, নদীর পানি ব্যবস্থাপনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করে চীন কীভাবে সফল হয়েছে- এসব কখনো তলিয়ে দেখার চেষ্টা করি না। 

তাই কোন স্থানে কতটুকু গভীরতায় ও কতটুকু প্রশস্ত করে নদীর পাড় ও তলদেশ কেটে ড্রেজিং করতে হবে, কোন কোন মাসে খনন চলবে, নদীর উত্তোলিত মাটি ও বালু কোন স্থানে কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে ইত্যাদি বিষয় অনুসরণ না করার জন্য চরম অব্যবস্থপনায় ও আশঙ্কাজনক অবস্থায় পড়ে ড্রেজিং-উত্তর নদীগুলো। 

সংগৃহীত ড্রেজিংয়ের বালু ও মাটি নদীর পাড়ে স্তূপ করে রাখা হচ্ছে, যা বর্ষাকালে আবার আগের জায়গায় ফিরে আসে। নাব্য হ্রাসের পাশাপাশি নদীর দখল ও দূষণ বাড়ছে। শহর ও শিল্পের নোংরা ও দূষিত পানি নালারূপী জলপ্রপাত তৈরি করে নগর ও শিল্পাঞ্চলে। বলতে দ্বিধা নেই, বিভিন্ন স্থানে তৈরি এসব নোংরা জলপ্রপাত স্থানীয় সরকারের এক মহাপ্রজ্ঞাপরাধের ফল। এতে নদীর বাস্তুপরিবেশ নষ্টের জন্য মাছ ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর আবাস হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। 

এ অবস্থায় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের প্রয়াস আমাদের মুক্তি দিতে পারে।  এ ভাবনা থেকে কতিপয় বিষয়কে বিবেচনার কোনো বিকল্প দেখি না। প্রথমেই নদীপারের মিথ সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী এর অগ্রগতির লক্ষ নির্ধারণ করতে হবে। নদী খনন করা হলে তা নিয়মিতভাবে পর্যালোচনার জন্য একটি মনিটরিং ছায়া টিম গঠন করা, যা নাব্য পরিমাপসহ নদীর চলমান অবস্থাকে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ মনিটরিংয়ে সহায়তা করবে। 

নদীপারের সংবাদকর্মী ও মিডিয়াকে সম্পৃক্ত করে একটি মিডিয়া টিম গঠন করা যেতে পারে। যারা নিয়মিতভাবে প্রতিটি নদীর সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে নদীবিষয়ক পাঠ্যক্রম যুক্ত করাও ভবিষ্যৎ নাগরিক গঠনে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ববিদ্যালগুলোয় ‘নদীবিজ্ঞান’ নামে একটি নতুন বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চালু করা উচিত। 

উল্লেখ্য, ভারতের কাবেরী নদী অধ্যয়নের জন্য কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে এক বছরমেয়াদি একটি কোর্স চালু করেছে। নদীবিষয়ক লেখক, গবেষক, পাঠদানকারী, বিজ্ঞানী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে নদী রক্ষা কমিশন নিয়মিত বিরতিতে একটি জাতীয় কনফারেন্সের আয়োজন করতে পারে। নদীর উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অগ্রগতির সঙ্গে তীরের মানুষের অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং নদীর বিজ্ঞোচিত ব্যবহার বিষয়ে জনগণকে সচেতন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা বিশেষ দরকারি। 

মানুষের সাধারণ ও ঐতিহ্যগত সম্পদের সংমিশ্রণে নদীকেন্দ্রিক জীবনধারা উদ্ভাবনের উদ্দেশ্যে একটি গবেষণা সেল তৈরি করা এবং সর্বোপরি, সফল জলকূটনীতির সূচনা করা অত্যন্ত জরুরি। এই পদক্ষেপ আমাদের হিন্দুকুশ হিমালয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের সব নদীর সংরক্ষণ ও পরিবীক্ষণে ভূমিকা রাখবে। 

আমাদের অনাদর, অবহেলা ও অনাচারে মাতৃরূপী নদীগুলো এখন বিপন্নপ্রায় মৃত ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কখনোই এর দিকে সুদৃষ্টি দেয়নি। যদিও আদালত ২০১৬ সালে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন।

লেখক: পর্যটনবিষয়ক গবেষক

বিশ্বকে শান্ত করার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৩ এএম
বিশ্বকে শান্ত করার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ
গর্ডন ব্রাউন

পৃথিবী এখন বড়ই উত্তপ্ত। ১৯৬২ সালে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র-সংকটের পর থেকে কোনো সময়ই বিশ্বকে এতটা বিপজ্জনক দেখা যায়নি। বিশ্বে এখনো প্রায় ৫৬ জায়গায় সংঘাত চলমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সংঘাতের এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যা। শিগগিরই এতগুলো সংঘাতের সমাধান হবে বলে মনে হচ্ছে না।

অভ্যন্তরীণ নির্বাচনি প্রচারে বিক্ষিপ্ততা, নিজেদের মধ্যে বিভাজনে আচ্ছন্ন এবং ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে আমরা অন্ধ হয়ে গেছি। ‘এক বিশ্ব, দুই ব্যবস্থা’, ‘চীন বনাম আমেরিকা’- এমন চিন্তাচেতনায় বিশ্ব হেঁটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তারা ঘুমের ঘোরে হাঁটছে। সারা বিশ্বে সংঘাত সমাধানের পথ এতটাই অধরা যে, বিশ্বব্যাপী মহামারির জন্য প্রস্তুতি এবং প্রতিরোধে কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি এখনো হয়নি। 

এমনকি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অস্তিত্বসংকট দেখা দিয়েছে। তাপামাত্রা স্বাভাবিক স্তরের চেয়ে ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকেই আশা করছেন, আজারবাইজানে অনুষ্ঠেয় কপ২৯ সম্মেলন এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। আমরা যা করতে পারি বা আমাদের যা সামর্থ্য আছে, তার চেয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করি বেশি। যত সময় প্রবাহিত হচ্ছে তত বেশি সমস্যা বাড়ছে।

আমরা বৈশ্বিকভাবেই বড় বিপদে আছি। শুধু ইউক্রেন-রাশিয়া এবং ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের কারণেই যে এত সংকট বাড়ছে তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন কারণেও বৈশ্বিক সংকট বাড়ছে। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশ আমেরিকা ও রাশিয়ার বলয়ে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। বাকিরা যারা আছে, তারা ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জোটনিরপেক্ষভাবে টিকে আছে। গত ৩০ বছরে একক বলয়, নব্য উদারপন্থি ও অতিবিশ্বায়ন বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। 

 প্রথমত, আমরা একটি একক বিশ্বব্যবস্থা থেকে বহুমুখী বিশ্বে চলে যাচ্ছি। সেটি এমন বিশ্বব্যবস্থা নয়, যেখানে বড় শক্তিগুলো সমান মর্যাদার অধিকারী হয়।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগামী কয়েক দশক ধরে সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। তবে বিশ্বে একাধিক প্রতিযোগী শক্তির দেশ রয়েছে। যেহেতু মার্কিন আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সে ক্ষেত্রে কিছু দেশ একক বলয়ের কবল থেকে মুক্তির জন্য নিজস্ব নীতিতে চলতে শুরু করেছে।

ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো কয়েকটি আঞ্চলিক শক্তি একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। পূর্ব-দক্ষিণের দেশগুলো বিশ্বব্যাপী আর্থিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া উন্নয়নে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। ভ্যাকসিন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবিক সংকটে সহায়তা না পাওয়ায় এ দেশগুলো ক্ষুব্ধ। পশ্চিমা নেতৃত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে তারা। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুক্তবাণিজ্য অর্থনীতি নব্য বাণিজ্যবাদী ও সুরক্ষাবাদী অর্থনীতির দিকে ধাবিত হয়েছে। শুধু শুল্ক বৃদ্ধি নয়, আরও অনেক কিছু রয়েছে, যেমন- বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা, বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞা এবং প্রযুক্তিগত বাধা। এগুলো দূর করতে হবে। 

একসময় মুক্তবাণিজ্যকে জীবনযাত্রার উচ্চমানের চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হতো। এখন বাণিজ্য বিধিনিষেধকে তাদের সুরক্ষার চাবিকাঠি হিসেবে দেখা হয়। বিশ্বকে একটি শূন্য-সমষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি মনে হচ্ছে। ‘আপনি ব্যর্থ হলেই আমি সফল হতে পারি’- এই নীতি এখন বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। এটাকে বাণিজ্যবিরোধী, অভিবাসনবিরোধী, বিশ্বায়নবিরোধী মনোভাবের প্রাদুর্ভাব বলে মনে হয়। কারণ শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, আরও ১৫টি দেশ সীমান্তে প্রাচীর নির্মাণ বা অভিবাসন রোধে পরিকল্পনা করছে।

অতিবিশ্বায়ন বলে যা আছে তা বিশ্বায়নে সীমাবদ্ধ হয়ে উঠেছে। কারণ নিরাপত্তা বিবেচনায় সেগুলোকে ঝুঁকিমুক্ত বলা যায়। ৪০ বছর ধরে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করছে বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথ। বিশ্ববাণিজ্যের দ্বার এখন সবার জন্য উন্মোচিত, কিন্তু অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, এটা বৈশ্বিক অসমতা বাড়ায়।
 
আমরা এমন এক যুগে বসবাস করছি, যখন চিকিৎসা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং পরিবেশগত প্রযুক্তিতে সবচেয়ে উদ্ভাবনী অগ্রগতির দ্বারপ্রান্তে রয়েছি। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের পর থেকে বিশ্ব তা দেখে আসছে। কয়েক দশক ধরে উৎপাদনশীলতা ও সমৃদ্ধির সবচেয়ে বড় পূর্বাভাস দেখছে বিশ্ববাসী। যদিও আমরা সুরক্ষাবাদ, বাণিজ্যবাদ এবং রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে আত্মসমর্পণ করে সুবিধা হারানোর ঝুঁকিতে আছি।

আমরা যদি স্বীকার করি, বিশ্ব পরিবর্তিত হয়েছে, তা হলে এগিয়ে যাওয়ার অনেক উপায় রয়েছে। নতুন মতাদর্শ, সামরিক এবং ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উপায়গুলোর মধ্যে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা থাকতে হবে। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, নিজস্ব কারণেই প্রতিটি দেশে এখন বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা প্রয়োজন। ইউরোপে শক্তিশালী বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন। কারণ নিজস্ব কোনো শক্তির সরবরাহ নেই। 

বিশ্ববাণিজ্যের ওপর ইউরোপের সমৃদ্ধি নির্ভর করে। দক্ষিণ বিশ্বের জন্যও বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার প্রয়োজন। কারণ উত্তর বিশ্ব থেকে সম্পদের পুনর্বণ্টন ছাড়া দ্রুত অগ্রসর হতে পারে না। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো ও ভিয়েতনামের মতো মধ্যম বা উন্নয়নশীল শক্তিগুলোর প্রয়োজন বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা। কারণ তারা আমেরিকা ও চীনের সান্নিধ্য পছন্দ করে না। 

যেকোনো দেশকেই বহুপক্ষীয় জোটের সঙ্গে থাকা ভালো। যখন আমরা একক নেতৃত্বে চলতাম, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুপক্ষীয়ের ধুয়া তুলে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এখন আমাদের বুঝতে হবে যে, বহুমুখী ক্রম থেকে কখনো একতরফাভাবে কাজ করা যায় না। এই নতুন যুগে আরও বৈচিত্র্যময় ও বিশ্বচ্যাম্পিয়ন নেতা দরকার। 

চীনকে উচ্চ আয়ের দেশ হওয়ার জন্য রপ্তানিনির্ভর হওয়া প্রয়োজন। চীন ঘোষণা করেছে যে, তারা জাতিসংঘের সনদের অধীনে কাজ করতে চায়। আমি আমাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি বহুপক্ষীয়তার পক্ষে কথা বলছি না। কারণ প্রতিটি দেশেরই নিজেদের স্বায়ত্তশাসনকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যেসব বহুপক্ষীয়তাকে অর্জন করা সম্ভব আমি তার পক্ষে। 

কারণ আমরা এমন একটি বিশ্বে বসবাস করি, যেখানে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। শুধু সুদের হার বৃদ্ধি এবং মুদ্রা লেনদেনই মূল বিষয় নয়। সারা বিশ্বে উত্তেজনা, যুদ্ধ সংকট, বন্যা এবং খরা- সবকিছু নিয়ে বিশ্ব এক অন্ধকারে রয়েছে। 

সুরক্ষাবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার লড়াই করা উচিত। আইনি প্রতিকারের পাশাপাশি আলোচনা, সালিশ এবং সমঝোতার মাধ্যমে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। 

বিশ্বে এখনো অনেক মানুষ চরম দারিদ্র্যের নিচে বসবাস করছে, যা প্রায় ৭০০ মিলিয়নের মতো। আমরা এখনো তাদের জন্য বসতি স্থাপন করতে পারিনি। এ কারণেই ১৮ নভেম্বর ব্রাজিলে জি-২০ সম্মেলনে কী সিদ্ধান্ত হয় তা জানতে হবে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। 

প্রেসিডেন্ট লুলা তিনটি প্রধান বিষয় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নির্ধারণ করেছেন, যা দ্রুত সমাধানে আসতে হবে। এগুলো হলো- ক্ষুধা ও দারিদ্র্য এবং অসমতার বিরুদ্ধে লড়াই করা, টেকসই উন্নয়ন প্রচার এবং বিশ্বব্যাপী শাসনের সংস্কার করা।  

পৃথিবী আসলেই আগুনে পুড়ে যাওয়ার মতো দগ্ধ হয়ে আছে। বিশ্বের অনেক নেতাই দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ, সংঘাত তৈরিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করছেন। তারা সারা বিশ্বে অশান্তির শিখা জ্বালিয়েছেন। এখন আগুন নেভানোর সময় এসেছে। বিশ্বকে শান্ত করার ওপর নির্ভর করছে আমাদের ভবিষ্যৎ।

লেখক: ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী
দ্য গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

ভয়াবহ বন্যা, পরিত্রাণের উপায় কী

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১১:০০ এএম
আপডেট: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৭ এএম
ভয়াবহ বন্যা, পরিত্রাণের উপায় কী
রাজেকুজ্জামান রতন

একদিকে ভয়াবহ বন্যা, মানুষের দুর্ভোগ; অন্যদিকে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা- দুটোই দেখছি আমরা। পানির ধর্ম ওপর থেকে নিচে গড়িয়ে যাওয়া। এটা প্রকৃতির নিয়ম। রাষ্ট্রীয় সীমানা তৈরি করেছে মানুষ। কিন্তু যখন অতিবৃষ্টি হয় তখন বন্যা হয়, বন্যার পানি গড়িয়ে নিচের দিকেই নামে। তখন পানি ভারত-বাংলাদেশ সীমানা, কাঁটাতারের বেড়া- এগুলো  মানে না। 

কিন্তু একটা বিষয় পানি মানে, সেটা হলো নদীর অববাহিকা। প্রতিটি নদীর নির্দিষ্ট গতিপথ আছে, এই পথে চলতে চলতে একাধিক নদীর প্রবাহ মিলিত রূপে আরও ব্যাপক প্রবাহের জন্ম দেয়। কিন্তু পানির গতিপথ আলাদা থাকার কারণে সাধারণত এক অঞ্চলের নদীর পানি অন্য অঞ্চলের বন্যাকে বাড়িয়ে তোলে না।কিন্তু যখন পানির ঢল নামে তখন বিষয়টা আর আগের মতো থাকে না। 

কুমিল্লার গোমতীর পানিও ফেনীর অঞ্চলকে প্লাবিত করতে পারে। পানি প্রবাহের স্বাভাবিকতাকে বিবেচনা না করে যদি নদীর উজানে ড্যাম বা ব্যারাজ নির্মাণ করা হয়, তা যেমন পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে ভাটির অঞ্চলের মানুষের পানি পাওয়াকে কঠিন করে তোলে, তেমনি অতিরিক্ত পানির চাপ কমাতে পানি ছেড়ে দিয়ে ভাটির মানুষ, ফসল, খেত-খামারকে ডুবিয়েও মারে। এ নিয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে কম উত্তেজনা নেই, মানুষের কষ্টের আহাজারি কম নেই। আর ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনের এটাও অন্যতম কারণ।   
 
কিন্তু এবারের আকস্মিক ভয়াল বন্যার কি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা নেই? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা রাজ্যে যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি ও বন্যা হলো, প্রাথমিকভাবে তার  চারটি  কারণ হতে পারে। যেমন-  ১. এল-নিনো ২. মেডেন-জুলিয়ান দোলন বা সংক্ষেপে এমজেও ৩. জেট স্ট্রিম ও ৪. বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মৌসুমি লঘুচাপ। 

আবহাওয়া-সম্পর্কিত এই চারটির যেকোনো একটি কারণই ভারী বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য দায়ী। কিন্তু আগস্ট মাসের ১৫ তারিখের পর থেকে একই সঙ্গে চারটি বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে একই সময় সক্রিয় হওয়ায় রেকর্ড পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ভারী বৃষ্টি, সাগরের লঘুচাপ এবং সেই সঙ্গে পূর্ণিমার কারণে সাগরের জোয়ার স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ছিল। 

সে কারণে বৃষ্টির পানি নামার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়েছে। সেই সঙ্গে উজানের প্রবল বৃষ্টির কারণে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, ফেনী, চট্টগ্রামের নদীবাহিত নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এ ধরনের বন্যা এসব অঞ্চলের মানুষ অনেক দিন দেখেননি। ফলে তাদের প্রস্তুতি ছিল না, এক দিনের মধ্যেই পানি বৃদ্ধির তীব্রতা দেখে হতবাক হয়ে গেছেন অনেকেই।  

প্রশ্ন হলো, আমাদের আবহাওয়া বিভাগ কি এটা আগে জানতে পারেনি? আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে নিখুঁতভাবেই ৩ থেকে ১৫ দিন আগের আবহাওয়া পূর্বাভাস করা যায়। আর তিন দিন আগে  শতকরা ৯০ ভাগ নিশ্চয়তাসহ আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া যায়। 

সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি, তার পূর্বাভাস কি ১০ দিন আগে দেওয়া সম্ভব ছিল না? ভারী বৃষ্টির এই পূর্বাভাস কেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর দিতে ব্যর্থ হলো? এটা কি আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাব, দক্ষতার অভাব নাকি দায়িত্বপূর্ণতার অভাব? এর ব্যাখ্যা বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদদের কাছে জানতে চাওয়া উচিত, যাতে এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা এবং দুর্বলতা সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা থাকে। 

ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে পাওয়া বৃষ্টিপাতের তথ্য অনুযায়ী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত তিন দিনে মোট ৪৯০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আর বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত কুমিল্লা জেলায় মোট ৪৪৫ মিলিমিটার ও ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় ৪০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। 

আবার ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত দক্ষিণ ত্রিপুরার বাগাফা নামক স্থানে ৩৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যে জায়গাটি বাংলাদেশের ফেনী জেলার পাশেই। এসব বৃষ্টিপাতের পানি ফেনী জেলার মুহুরী নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই দিনে ত্রিপুরা রাজ্যের অন্যান্য স্থানে ৩০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। একই সময়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে ৩৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে, যার পানি বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার সুরমা নদীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। 

এখানে একটা কথা উল্লেখ করা দরকার যে, সাধারণত, আগস্ট মাসে কুমিল্লা জেলায় গড়ে বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে ৩৪৭ মিলিমিটার ও ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় গড়ে বৃষ্টি হয় ৪০৩ মিলিমিটার। অর্থাৎ ১৯ আগস্ট থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিনে কুমিল্লা ও ফেনী জেলায় মোট যে  বৃষ্টি হয়েছে, তা এই দুই জেলার পুরো আগস্ট মাসের মোট বৃষ্টিপাতের চেয়ে বেশি। এক মাসের সমান বৃষ্টি তিন দিনে হওয়া এই ভয়াবহ বন্যার অন্যতম প্রধান কারণ।   

কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত গোমতী ও ফেনী জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত মুহুরী নদীর উজানে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে পানি সংরক্ষণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কৃষিকাজের জন্য একাধিক বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণ করেছে সে দেশের সরকার। জুন মাস থেকে বর্ষা মৌসুম, তাই ১৮ আগস্টের আগেই এসব ড্যাম ও ব্যারাজ পানিতে পূর্ণ ছিল।

 ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের কারণে সব ড্যাম ও ব্যারাজের পানি ধারণক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। ২০ আগস্ট রাতে হঠাৎ করেই বেশির ভাগ ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেয় ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ।

কিন্তু ত্রিপুরা রাজ্য কর্তৃপক্ষ কিংবা ভারত সরকার ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত বাংলাদেশকে ড্যাম ও ব্যারাজের গেট খুলে দেওয়া বা তাদের ভাষ্য অনুযায়ী পানির চাপে ব্যারাজের গেট খুলে যাওয়া সম্পর্কে আগে থেকে কোনো রকম তথ্য দেয়নি। ফলে কোনোরূপ প্রস্তুতি নেওয়ার আগেই বিপুল পানির তোড়ে ভেসে গেছে কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল।   

মানুষের কষ্ট, হাহাকার এবং সম্পদ ধ্বংস হতে দেখে একদিকে যেমন মানবিক আবেদন তৈরি হয়, অন্যদিকে দেশের নদী ব্যবস্থাপনার ত্রুটি দেখে ক্ষোভের সঞ্চার হয় মানুষের মনে। বাংলাদেশ তো নদীর দেশ, পানির দেশ, বন্যার সঙ্গে সহাবস্থান করেই এই ভূখণ্ডে সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। তাহলে কেন এতদিনেও একটা বিজ্ঞানসম্মত পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠছে না? 

ভারত থেকে আসা ৫৪টি নদীর পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরে যাওয়া পানির ৫৬ শতাংশ ভারতের, ৪৪ শতাংশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরের। সমুদ্রের লোনা পানির প্রবেশ ঠেকাতে এই পানির প্রবাহ বজায় রাখা জরুরি। সে ক্ষেত্রে ভারতের পানি আগ্রাসন বা পানি কূটনীতি একটা জটিল ব্যাপার বাংলাদেশের জন্য। 

কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে নদী দখল, দূষণ এবং নদী হত্যা ঠেকানো যাচ্ছে না কেন? জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ৩৯ হাজার ৫৫৮ জন নদী দখলদারের একটা তালিকা প্রকাশ করেছিল। সেই তালিকা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি দখলদার ছিল কুমিল্লা জেলায়। 

অপরিকল্পিত রাস্তা, স্থাপনা, বাঁধ, ব্যারাজ পানি প্রবাহের পথে যে বাধা তৈরি করেছে তার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের। ফলে বন্যার ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রকৃতিবিনাশী পদক্ষেপ থেকে সরে আসতে হবে। 

উজানের দেশের সঙ্গে ভাটির দেশের পানি বণ্টন ও ব্যবহারের যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সেটা মেনে চলতে যেন বাধ্য করা যায়, এ ব্যাপারে জনমত শক্তিশালী করার বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। এই দুর্যোগ অনিবার্য নয়, পানি আগ্রাসন রোধ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিজ্ঞানসম্মত করে এই ভয়াবহতা থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি।   

লেখক: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)

দেশের সম্পদের মালিকানা জনগণেরই

প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ১০:৩২ এএম
দেশের সম্পদের মালিকানা জনগণেরই
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

রাষ্ট্র যখন আছে তখন রাজনীতি থাকবেই এবং আছেও। অতীতে অবৈধ পথে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তারা প্রথমেই যা বলেন তা হলো- তাদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই এবং তারা অতিদ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে অব্যাহতি নেবেন। কিন্তু অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার কাজটা তো নির্জলাভাবেই রাজনৈতিক এবং একেবারে প্রথম দিন থেকেই তারা নতুন রাজনীতি শুরু করেন; দল গড়েন, তাদের পক্ষে কাজ করতে প্রস্তুত এমন লোক খোঁজেন, তাদের উপদেষ্টা বানান, লোক দেখানো সংস্কারের নামে সাধারণ মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি করেন এবং সাজানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের নির্বাচিত বলে ঘোষণা করে দেন। সাধারণ মানুষও বিলক্ষণ রাজনীতি বোঝে, রাজনীতিকে তারা বলে পলিটিকস। ওই পলিটিকস কথাটা সব কিছু পরিষ্কার করে দেয়। বোঝা যায় যে, পলিটিকস সবখানেই আছে। রয়েছে এমনকি পরিবারের ভেতরেও, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। এই সব ছোট ছোট পলিটিকস রাষ্ট্রে যে পলিটিকস চলছে তার মূল্যবোধ দ্বারাই পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পলিটিকসে মূল্যবোধটা কী? স্পষ্টতই সেটা হলো নিজের দিকে সব কিছু টেনে নেওয়া, নিজের মতাদর্শকে নিজের হাতেই গুছিয়ে নেওয়া। 

এ ধরনের রাজনীতি দিয়ে দেশের কী কোনো উপকার হবে? এর জবাব ওই প্রশ্নটির ভেতরেই রয়ে গেছে। এই রাজনীতির দ্বারা দেশের কোনো উপকার হয়নি, হবেও না। বরঞ্চ দুর্দশা বাড়বে, যেমনটা বাড়ছে। এই রাজনীতি পুরোনো ও পরিচিত। রাষ্ট্র বদলেছে, রাজনীতি বদলায়নি। যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাতায়াত করে তারা নিজেদের স্বার্থ দেখে, দেশের স্বার্থ দেখে না। দেশের সম্পদ যেটুকু আছে সেটা তারা অতিদ্রুত নিজেদের করতলগত করে নিতে চায়। জনগণের মুক্তির কথা যখন আমরা বলি তখন ওই সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানার প্রশ্নটাই প্রথমে আসে, আসতে বাধ্য। আমাদের দেশ যে দরিদ্র তার কারণ সম্পদের অভাব নয়, কারণ হচ্ছে সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা না-থাকা, এবং সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া। দেশের খরচে আমরা মানুষকে শিক্ষিত করি, সেই শিক্ষিত মানুষদের স্বপ্ন থাকে বিদেশে যাওয়ার, নয়তো দেশে থেকেই বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করার। এ ক্ষেত্রে যেটা ঘটে তা হলো দেশের খরচে যে দক্ষতা তৈরি হয় তা দেশের কাজে লাগে না, ব্যয় হয় বিদেশিদের সম্পদ উৎপাদনে। তার চেয়েও যেটা নিষ্ঠুর তা হলো দেশের খনিজ সম্পদ বিদেশে চলে যাওয়া। 

যাকে আমরা পরাধীনতা বলে জানি তার ভেতরকার মূল ব্যাপারটাই ছিল আমাদের সম্পদের ওপর বিদেশিদের কর্তৃত্ব। বিদেশি শাসকরা এ দেশে কর্মচারী, চাকরবাকর, দালাল ইত্যাদি তৈরি করেছে। উদ্দেশ্য এদের সাহায্যে এখানে যে সম্পদ রয়েছে তা দখল করা। কাজটা পাঠান ও মোগলরা করেছে, পরে ইংরেজরা করেছে আরও জোরেশোরে। পাঠান ও মোগলদের পাচার করা সম্পদ তবু উপমহাদেশের ভেতরেই রয়ে গেছে; ইংরেজরা তা নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে। খনিজ সম্পদ উত্তোলন, কলকারখানা স্থাপন, যান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, এমনকি এক সময়ে নীল, পরে পাট ও চা-এর উৎপাদন, সব কিছুর মালিকানা ইংরেজ শাসকদের হাতেই ছিল। এবং জাহাজ ভর্তি করে তারা সোনাদানা থেকে শুরু করে কত যে অর্থ ও বিত্ত পাচার করেছে তার হিসাব বের করা কঠিন। ফলে তারা যে পরিমাণে ধনী হয়েছে, আমরা ঠিক সেই পরিমাণেই নিঃস্ব হয়েছি। তাদের দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটেছে এবং আমরা পরিণত হয়েছি তাদের আটকে পড়া ক্রেতায়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূল কারণ ছিল সম্পদের ওই মালিকানাই। ইংরেজের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে যা ঘটেছে, তথাকথিত স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রেও তাই ঘটেছিল। পূর্ববঙ্গের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব পূর্ববঙ্গবাসীর ছিল না, কর্তৃত্ব ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের। আমরা বলেছিলাম, এ দেশে যা কিছু আছে তা আমাদেরই থাকবে। ওই দাবির ব্যাপারে বাঙালিদের দৃঢ়তা দেখেই পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী ক্ষেপে গেল এবং গণহত্যা শুরু করে দিল। নইলে বাঙালিদের সঙ্গে ওই রকমের বিপজ্জনক খেলায় তারা মত্ত হতে যাবে কেন?

যুদ্ধ শেষ হয়েছে। আমরা জয়ী হয়েছি, কিন্তু দেশের সম্পদের ওপর দেশবাসীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? না, হয়নি। আর সে জন্যই তো বলতে হয় যে, আমরা এখনো মুক্তি পাইনি। সামাজিক সম্পত্তি ক্রমাগত ব্যক্তিমালিকানায় চলে যাচ্ছে। কলকারখানা ব্যক্তিগত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। সবচেয়ে মারাত্মক যে বিপদ তা হলো দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে চলে যাওয়া। এই ব্যাপারে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন শাসকশ্রেণি রুখে দাঁড়াবে কী, উপরন্তু বিদেশিদের সাহায্য করছে। এটাই হচ্ছে এখন আমাদের শাসকদের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এটা তারা করছে নিজেদের স্বার্থে। বিদেশিদের কাছ থেকে যেটুকু পাওয়া যায় তাতেই তাদের লাভ এবং সেই লাভটাকে বিদেশে গচ্ছিত রাখাটাই নিরাপদ- এই হচ্ছে তাদের নীতি। 

তাদের এই নীতিকে নীতিবিগর্হিত বলার আবশ্যকতা দেখি না, একে দেশদ্রোহিতা বলাই যথেষ্ট। স্পষ্টতই এরা মনে করে যে বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, তাই অতিদ্রুততায় যতটুকু হস্তগত করা যায় সেটুকুই লাভ। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যত না তৎপর এদের তৎপরতা তার চেয়ে বেশি। আগামী নির্বাচনে জয়ী হওয়া যাবে কি যাবে না সেটা অনিশ্চিত, তাই হস্তগত করার কাজটা এখনই করতে হবে। সামনের বার জিতলে ভালো, না জিতলেও ক্ষতি নেই, মনোভাবটা এই রকমের। শেখ মুজিবুর রহমান যে অত বড় নেতা হয়েছিলেন তার কারণ এ দেশের সম্পদ জবরদখলকারীদের কাজে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি, তাদের হুঙ্কার তাকে বিচলিত করেনি; এবং তিনি সপরিবারে প্রাণ দিয়েছেন সেই সব বেইমানদের হাতে যারা ব্যস্ত ছিল পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়ে দেশের মানুষের ওপর বহুজাতিক পুঁজির শোষণকে স্থায়ী করবার কাজে। হুঙ্কার প্রদানকারীরা যেমন, বেইমানরাও তেমনি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে; মুজিব আছেন ইতিহাসের নায়ক হয়ে এবং থাকবেনও। আজকে যারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করার ব্যাপারে শশব্যস্ত হয়ে পড়েছে শেখ মুজিব তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন; সেই সতর্কবাণীতে তারা কান দেবে কি দেবে না সেটা তাদের ব্যাপার। কান না দিলে দেশের মানুষের যে ভয়ংকর রকমের ক্ষতি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশবাসী যে তাদেরও ক্ষমা করে দেবে তেমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। 

সম্পদের প্রশ্নে প্রথমে আসে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা। আমাদের নদীগুলোর প্রায় সবকটির উৎস ভারতে। গঙ্গার ওপর ফারাক্কা ব্যারাজ তারা পাকিস্তানি আমলেই তৈরি করেছিল। সেটাকে চালু করল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর; তার পর দুই দেশের মধ্যে পানিবণ্টন নিয়ে চুক্তি হয়েছে বটে, কিন্তু চুক্তি কার্যকর হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। তিস্তার পানি নিয়ে সমস্যা আছে। ভূগর্ভস্থ তেল ও গ্যাস নিয়েও সমস্যা দেখা দিয়েছে, কেননা ভূ-এলাকা তো একই, প্রকৃতি তাকে দুই রাষ্ট্রসীমায় বিভক্ত করেনি, যা করবার রাজনীতিকরাই করেছেন। 

১৯৮৬ সালে ভারতসংলগ্ন পঞ্চগড়ে জ্বালানি তেলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল, ১৯৮৯ সেখানে ঢাকঢোল পিটিয়ে তেল উত্তোলন শুরু হয়, উদ্বোধন করেন স্বৈরশাসক এরশাদ। কিন্তু আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের এক সপ্তাহের মধ্যেই উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। এখন সেখানে খনির চিহ্ন মাত্র নেই, লোকে চাষবাস করছে, অথচ ভারত কিন্তু সেখান থেকে ঠিকই জ্বালানি তেল উত্তোলন করে চলেছে। ওপরে থাকার ওই সুবিধা। অনুরূপভাবে বাংলা ও আসাম সীমান্তে গ্যাস ক্ষেত্রে যে ভয়ানক সব দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যাতে আমাদের এলাকার শত শত কোটি টাকার গ্যাস সম্পদ পুড়ে গেছে, সেগুলো দুর্ঘটনা নাকি ঘটনা, সে নিয়ে সন্দেহ আছে, কেননা সংলগ্ন এলাকায় ওপরের দিক থেকে ভারতে গ্যাস উত্তোলন সমানে চলছে। এশিয়া এনার্জি নামের একটি ভুয়া বিদেশি কোম্পানিকে আমাদের উত্তরাঞ্চলে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লার খনি খনন করে কয়লা উত্তোলন করে সেখানকার মানুষের স্থায়ী ক্ষতিসাধনের আয়োজন করা হয়েছিল, জনপ্রতিরোধের মুখে তা কার্যকর করা যায়নি। তবু তৎপরতার অবসান হয়নি। বিএনপি আমলে এর সূত্রপাত, তত্ত্বাবধায়ক আমলেও তা ছিল সক্রিয়, আওয়ামী লীগ আবার চেষ্টা চালিয়েছিল পুনরুজ্জীবনের। বর্তমান সরকার কী করে, সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়