![জাপার অন্তর্দ্বন্দ্ব আরও ঘনীভূত](uploads/2023/11/24/1700802744.Jatiyo_Party.jpg)
নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিলেও জাতীয় পার্টিতে (জাপা) নাটকীয়তার শেষ হয়নি এখনো। বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রির চতুর্থ দিনেও মনোনয়ন ফরম তোলেননি বিরোধীদলীয় নেতা ও জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ। ফরম তোলেননি তার ছেলে ও রংপুর-৩ আসনের বর্তমান এমপি রাহগির আল মাহি সাদ এরশাদও।
গত দুদিন ধরে জাপার রাজনীতিতে আলোচিত বিষয় ছিল সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর মনোনয়ন। একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় হুইপের দায়িত্বে থাকা রাঙ্গাঁকে ফিরিয়ে আনার আভাস মিললেও গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তিনিও মনোনয়ন ফরম নেননি।
রওশন এরশাদ ও মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর আসনে অনেকে দলের প্রার্থী হতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত মনোনয়নের দৌড়ে তারা যে টিকবেন না, সেই আভাস মিলেছে দলের শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে।
দলের মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই, প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার শেষে মনোনয়ন পর্ব শেষ করে জাতীয় পার্টি চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ২৮ নভেম্বরের মধ্যে শেষ করার কথা জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশনে ওই তালিকা জমা দিতে হবে আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ওই সময়ের মধ্যেই জাতীয় পার্টির মনোনয়ন ফরম নেবেন রওশন এরশাদ, সাদ এরশাদ।
মুজিবুল হক চুন্নু খবরের কাগজকে বলেন, ‘তিনি আমাদের দলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের স্ত্রী ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক, তিনি আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার। তিনি নির্বাচন করলে আমরা খুশি, তাকে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করব। তিনি নির্বাচন না করলে অবশ্য ভিন্ন বিষয়। নির্বাচন করবেন না, এমন কিছু এখন পর্যন্ত তিনি বলেন নাই।’
রওশনপন্থিরা ব্যাকফুটে
ভোটের আগে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের শিবিরে চেয়ারম্যান জি এম কাদেরবিরোধী তৎপরতা আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। নির্বাচনের আগে জাপার দশম কাউন্সিল অধিবেশন ডেকে রওশন এরশাদকে চেয়ারম্যান ঘোষণার নানা তোড়জোড় করেছেন তারা। তবে শেষ পর্যন্ত সে কাউন্সিল আর আয়োজন করতে পারেননি তারা।
এরপরও থমকে থাকেননি তারা। রওশনপন্থি এমপিদের অনেকে দশম জাতীয় সংসদের মতো এবারও ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে থেকে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে চাপে রাখেন বিরোধীদলীয় নেতাকে। জাপার প্রেসিডিয়াম ও কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সদস্যের অভিযোগ, ‘এই নেতারা কেবল নিজে এমপি-মন্ত্রী হতে পারলেই খুশি। সমঝোতায় যতগুলো আসন পাওয়া যায়, ততগুলোকে লাভজনক মনে করেন তারা। দলের কী হলো তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই তাদের।’ সর্বশেষ গত ২ নভেম্বর জাপার এমপিদের বড় একটি অংশ হঠাৎ জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে জাপায় গুঞ্জন ওঠে গোপন সমঝোতার।
জাপা চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি রওশন আরা মান্নান এ সময় প্রকাশ্যে রওশন এরশাদের পক্ষ নেন। তিনি পরে রওশন এরশাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেন।
ওই বৈঠকের পরে রওশন এরশাদপন্থি নেতারা ছক কষতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে ভোটে গেলে কয়টি আসন তারা পাবেন। তাদের প্রত্যাশায় বাদ সাধেন জি এম কাদের। জাপা চেয়ারম্যান সাফ জানিয়ে দেন, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কোনো জোট বাঁধবে না জাপা। নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুযায়ী, দলের চেয়ারম্যানের কথাই চূড়ান্ত। প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মহাজোটে যাওয়ার কথা জানিয়ে রওশন এরশাদ যে চিঠি দিয়েছিলেন ইসিতে, তা নিয়েও জলঘোলা হয়েছে অনেক। বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ বলেন, ‘ওই চিঠিটি ম্যাডামের কি না, তা আমরা জানি না।’
তৃণমূল বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও বিএনএমের ব্যানারে বিএনপির দলছুট নেতারা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর জাপার এই এমপিরা এখন বিপাকে পড়েছেন। এই তিন দলের যেকোনো একটি বেশি আসনে জিতে জাপাকে টক্কর দিতে পারলে বসবে প্রধান বিরোধী দলের আসনে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ খবর জোরালো ভিত্তি পেলে জাপার শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিরাজ করছে চাপা আতঙ্ক।
এমন এক পরিস্থিতিতে রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চান বলে জানান গোলাম মসীহ্। তিনি বলেন, ‘ম্যাডাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছেন। হয়তো দুই একদিনের মধ্যে আমরা সেই অনুমতি পেয়ে যাব।’
এদিকে রওশন শিবিরের মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ, রওশন আরা মান্নানের সঙ্গে এ সময় হঠাৎ আলোচনায় ফেরেন বিরোধীদলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মো. মামুনুর রশিদ। জাপায় জোর গুঞ্জন- রওশন এরশাদ শিবিরের বিষয়ে যেসব গুজব ছড়িয়েছে, তার নেপথ্যে রয়েছেন মামুন।
জাপার প্রেসিডিয়াম থেকে বহিষ্কৃত এই নেতার বিষয়ে এক প্রশ্নে বিরোধীদলীয় নেতার রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ্ খবরের কাগজকে বলেন, ‘রওশন এরশাদ সবসময় একটা ইউনাইটেড দল দেখতে চেয়েছেন। কিন্তু দুই চারজন লোক আছেন, যারা রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখতে চান। তারা দলকে কুক্ষিগত করে রাখতে চান।’
জাপার সাবেক এমপি গোলাম সারোয়ার মিলন, এম এ গোফরান, রওশনের পক্ষ নেওয়া ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন রাজু এবার লাঙলের প্রার্থী হবেন বলে যত তোড়জোড় শুরু করেছিলেন, এখনো তার কিছুই পরিলক্ষিত হয়নি। তাদের শিবির থেকে খবর রটেছিল, রওশন এরশাদ আলাদাভাবে মনোনয়ন ফরম দেবেন। গোলাম মসীহ্ জানান, আরপিও অনুযায়ী রওশন এরশাদ আলাদাভাবে মনোনয়ন ফরম দিতে পারেন না।
জাপা পেতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা: চুন্নু
আওয়ামী লীগবিরোধী ভোটের ওপর ভর করে জাতীয় পার্টি (জাপা) নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে পারে বলে মনে করেন দলটির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। বৃহস্পতিবার বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে দলটির মনোনয়ন বিক্রির শেষ দিনে সাংবাদিকদের এমন আশার কথা জানান চুন্নু।
তিনি বলেন, ‘ভোটাররা যদি ভোটকেন্দ্রে আসতে পারে... অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ভোট এদেশে ব্যাপক। আওয়ামী লীগের যা ভোট আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অ্যান্টি আওয়ামী লীগ ভোট। কেন্দ্রে যদি ভোটার আসতে পারে, তাহলে আমার মনে হয় ৩০০ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতেও পারি।’
কোনো চাপে পড়ে জাপা নির্বাচনে এসেছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে চুন্নু বলেন, ‘আমাদের কেউ কিনে নাই। টাকা পয়সাও দেয় নাই। দিলে তো ভালো হতো। জাতীয় পার্টি একটা বড় দল। তার নিজস্ব রাজনীতি আছে। নিজস্ব কৌশল আছে। কৌশল অনুযায়ী ভোটে যাওয়া বা না যাওয়া তা দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো স্বাধীনতা আছে। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নিইনি। অনেক তর্ক-বিতর্ক করে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
জাপার দপ্তর বিভাগ জানিয়েছে, দলের নেতা-কর্মীদের দাবির মুখে আজ শুক্রবারও দলের মনোনয়ন ফরম বিক্রি করা হবে। গতকাল ২৩ নভেম্বর জাপার বনানী কার্যালয় থেকে ২২৭টি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে। সব মিলিয়ে গত চার দিনে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৭৩৭ জন মনোনয়ন প্রত্যাশী জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন। আজ শুক্রবার বনানী কার্যালয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ পর্ব শুরু হবে।