![ঘনিষ্ঠ সমর্থকদের অভিমত : ভুল চাল চেলেছেন রওশন](uploads/2024/01/30/1706587521.Rowshon.jpg)
নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার পরের দিনও রাজনৈতিক তৎপরতা থেমে নেই রওশন এরশাদ ও তার সমর্থকদের। দ্বিতীয় দিনের মতো তৎপরতা চালিয়ে গতকাল সোমবার দুপুরে তারা নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়েছেন; এরপর সন্ধ্যায় যৌথসভা করেছেন। তবে গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মূল অংশ এ প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারা ‘বিদ্রোহী অংশ’কে কোনো ছাড় দেবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। জাপার গঠনতন্ত্রেও চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে সরানোর কোনো বিধা নেই।
জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশনপন্থি নেতারা জানিয়েছেন, আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে অথবা মার্চের প্রথম সপ্তাহে তারা কাউন্সিল আয়োজন করবেন। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রের ১৪-এর ২ উপধারায় বলা হয়েছে, পার্টির চেয়ারম্যান প্রতিবছর নির্ধারিত তারিখ ও নির্ধারিত স্থানে জাতীয় কাউন্সিলের বার্ষিক সভা আহ্বান করতে পারবেন। ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, চেয়ারম্যানের অনুমোদনক্রমে জাতীয় পার্টির মহাসচিব যেকোনো সময়ে কাউন্সিল সভা আহ্বান করতে পারবেন। তার পরও গতকাল দুপুরে রওশনপন্থি নেতারা নির্বাচন কমিশনে চিঠি দিয়ে কাউন্সিল আয়োজনের কথা জানিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, তারা চেয়ারম্যান পদ থেকে জি এম কাদের ও মহাসচিব পদ থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা ইসিকে জানান। যদিও জাপার গঠনতন্ত্র অনুযায়ী এই দুজনকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা কাউকে দেওয়া হয়নি। আগের দিন রবিবার রওশন এরশাদ নিজেই নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়েছেন জাপা মূল অংশের নেতা-কর্মীরা।
গতকাল সোমবার জাপার বনানী কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, জাপা থেকে বহিষ্কৃত বা অব্যাহতিপ্রাপ্তরা ক্ষমা চাইলেও দলে ফিরতে পারবেন না।
এদিকে রওশনপন্থি কয়েকজন নেতা খবরের কাগজকে জানিয়েছেন, রওশন এরশাদ রবিবারের সভায় যেসব সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছেন, সেসব বিষয়ে তারা অবহিত ছিলেন না। রওশন এরশাদ ফের ‘ভুল চাল চেলেছেন’ বলেও মন্তব্য করেন তারা। রওশনপন্থি বলে পরিচিত নেতা ইকবাল হোসেন রাজু খবরের কাগজকে বলেন, রওশন এরশাদ ফের ভুল চাল চেলেছেন। বারবার ভুল চাল চেলে রাজনীতি করা যায় না। তার মতে, জাপা থেকে বহিষ্কৃত নেতারা রওশন এরশাদকে চাপ দিয়ে নানা কাজ করাচ্ছেন। রওশন এরশাদের সাবেক রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ বলেন, ‘রওশন এরশাদের সিদ্ধান্ত আমাদের মনঃপূত হয়নি।’
নির্বাচন কমিশনে রওশনপন্থিদের চিঠি
জাতীয় পার্টির (জাপা) কমিটি পরিবর্তন করে রওশনপন্থি কমিটিকে আমলে নিতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালকে চিঠি দিয়েছেন রওশন এরশাদের ঘোষিত কমিটির মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশিদ। গতকাল নবনিযুক্ত দলের মুখপাত্র সুনীল শুভ রায়ের নেতৃত্বে ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান নির্বাচন কমিশনারের একান্ত সচিবের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই চিঠি হস্তান্তর করে।
ওই চিঠিতে দাবি করা হয়, গত ২৮ জানুয়ারি রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছেন। কাজী মো. মামুনুর রশিদকে অন্তর্বর্তীকালীনের জন্য (পরবর্তী সম্মেলন না হওয়া পর্যন্ত) জাতীয় পার্টির মহাসচিব নিয়োগ করেছেন তিনি। পাশাপাশি জাপা চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এবং মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুকে তাদের পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন রওশন এরশাদ।
রওশনপন্থি নেতাদের চিঠিতে বলা হয়, দ্রুততম সময়ের মধ্যে দলটির জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করা হবে। এর আগে রওশন এরশাদ জাপা চেয়ারম্যান এবং মহাসচিব কাজী মো. মামুনুর রশিদ জাতীয় পার্টির দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
এ বিষয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের একান্ত সচিব রিয়াজ উদ্দিন খবরের কাগজকে বলেন, জাতীয় পার্টির একাংশের ওই চিঠি গ্রহণ করা হয়েছে। মূলত দলটির অবস্থান জানিয়ে ইসিকে অবহিত করতে ওই চিঠিটি তারা দিয়েছেন। এ বিষয়ে বিধি ও আইন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বহিষ্কৃতরা চাইলেও দলে ফিরতে পারবেন না: চুন্নু
গতকাল জাপার বনানী কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন দলের মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। জাপা থেকে বহিষ্কৃত, অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতাদের সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা এই লোকগুলোকে নিয়ে কোনো চিন্তা করি না। তারা আসুক, এটা আমরা চাই না। আর এখন চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তারা যদি ক্ষমাও চায়, তবে তাদের আর দলে নেওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।’ রবিবার রওশন এরশাদের বাসভবনে মতবিনিময় সভায় জাপা থেকে বহিষ্কৃত ও অব্যাহতিপ্রাপ্ত নেতারা দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। জি এম কাদেরের শিবিরের অভিযোগ, এই অনুষ্ঠানে জাপার শীর্ষ নেতাদের গালমন্দ করেছেন রওশনপন্থিরা। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘তারা যদি ক্ষমাও চায়, তবে তাদের আর দলে নেওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। মহাসচিব হিসেবে আমি মনে করি, গতকালের (রবিবার) ঘটনার পরে তারা যদি দলে আসতে চায় তাদের দলে নেওয়া উচিত হবে না।’ বহিষ্কৃতদের উদ্দেশে জাপা মহাসচিব বলেন, জাপা একটি স্বীকৃত দল। এখন রাস্তার কোনো লোক বা টোকাই যদি বলে দলে আসতে চায়, তাহলে জাতীয় পার্টির কর্মীরা ব্যবস্থা নেবেন।
‘ভুল চাল চেলেছেন রওশন এরশাদ’
জাতীয় পার্টি থেকে বিভিন্ন সময়ে পদ-পদবি হারানো নেতাদের একটি অংশ রওশন এরশাদের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠেছিল এবারের নির্বাচনের আগে। তাদের মধ্যে রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ, সাবেক সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধা, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইকবাল হোসেন রাজু ছিলেন অগ্রভাগে। গতকাল সন্ধ্যায় এই তিন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেবেন এবং জাপা চেয়ারম্যান-মহাসচিবকে বহিষ্কার করবেন এ কথা তারা ঘুণাক্ষরেও জানতেন না।
নির্বাচনে ভরাডুবির পর জাতীয় পার্টির চলমান অস্থিরতা নিরসনে রওশন এরশাদ ভূমিকা রাখবেন, তিনি দলের দশম কাউন্সিল আয়োজনের জন্য পার্টি চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানাবেন, রওশন এরশাদের বাড়িতে এমন আলোচনা হয়েছিল বলে তারা জানান।
কিন্তু গত শনিবার রাতে জাপা থেকে অব্যাহতি পাওয়া প্রেসিডিয়ামের সাবেক সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু, সুনীল শুভ রায় ও রওশন এরশাদ মনোনীত মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদের সঙ্গে সাদ এরশাদের একটি বৈঠকে অনুষ্ঠিত হয়। পরে ‘বড় সিদ্ধান্ত’ নিতে রওশন এরশাদকে চাপ দেওয়া হয় বলে তারা জানান।
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে গোলাম মসীহ খবরের কাগজকে বলেন, ‘যে প্রক্রিয়ায় দলের চেয়ারম্যান, মহাসচিবকে বহিষ্কার করা হলো; কাউন্সিলের ঘোষণা দেওয়া হলো তা আমার মনঃপূত হয়নি। ম্যাডামের বাসায় কী হয়েছে, তা আমার ধারণায় নেই। কথা ছিল ম্যাডাম দলের কাউন্সিল ডাকতে চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানাবেন। চেয়ারম্যান সেটি না করলে অন্য একটি প্রক্রিয়া ছিল। তবে কাল (রবিবার) যা হলো, এমনটি হওয়া উচিত ছিল না।’
ইকবাল হোসেন রাজু খবরের কাগজকে বলেন, ‘শনিবার রাতেও তো কথা হলো সাদ এরশাদের সঙ্গে। আমরা কিছু জানতাম না। হঠাৎ সেন্টু সাহেব, সুনীল দাদারা এসে বৈঠক করে কী করলেন, আমরা কিছু বুঝতে পারলাম না।’ রাজু বলেন, এর আগেও ম্যাডাম দুবার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে বহিষ্কার করেছেন। কিন্তু এভাবে বহিষ্কার করা গঠনতান্ত্রিক না। তিনি পুনরায় ভুল করেছেন। বারবার ভুল করে রাজনীতি হয় না। রওশন এরশাদ আলাদাভাবে জাতীয় পার্টি গঠন করলে তাতে যুক্ত হতে সায় দেননি রাজু।
রওশনপন্থি নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সাবেক এমপি জিয়াউল হক মৃধা; যার রাজনীতি-নির্বাচন নিয়ে রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের দ্বন্দ্বের নতুন পর্বের সূত্রপাত হয়েছিল। মৃধা রবিবার রওশন এরশাদের মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন। খবরের কাগজকে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাকে সুনীলদা ফোন করে বলেছিলেন, সভায় আসেন। চমক দেখবেন। কিন্তু এই সভায় যে বক্তৃতা শুনলাম, আমি হতবাক।’ জিয়াউল হক মৃধাও রওশন এরশাদের কাছ থেকে সরে যাচ্ছেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছি। কিছু দিন দেখব দলের পরিস্থিতি। তারপর সরে দাঁড়াব।’
রওশনের বাসভবনে জরুরি বৈঠক
জাপার এই নাটকীয়তা চলে গতকাল রাত পর্যন্ত। রাত সাড়ে ৮টার দিকে রওশন এরশাদের গুলশানের বাসভবনে জরুরি বৈঠকে বসেন জাপা থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত দুই নেতা সাবেক কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। তাদের সঙ্গে পরে যুক্ত হন রওশন এরশাদের ছেলে সাদ এরশাদ, রওশন এরশাদ-মনোনীত মহাসচিব কাজী মামুনুর রশিদ, জাপার সাবেক এমপি গোলাম সারোয়ার মিলন, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম নুরু ও রওশন এরশাদের মুখপাত্র সুনীল শুভ রায়। বৈঠকের বিষয়ে সুনীল শুভ রায় গতকাল রাতে খবরের কাগজকে বলেন, ‘মূলত ম্যাডাম জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানাতে এসেছিলেন কাজী ফিরোজ রশীদ ও মসিউর রহমান রাঙ্গা। তারা ম্যাডামকে বলেছেন, দলের বেহাল অবস্থায় ম্যাডাম গত রবিবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা যথোপযুক্ত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত। এরপর দলের কিছু বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। আজকের মতো আলোচনা মুলতবি হয়েছে। মঙ্গলবার (আজ) এসব বিষয়ে আবার আলাপ-আলোচনা করা হবে।’ তিনি জানান, মঙ্গলবার সেই আলোচনা সভার খবর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।
তবে সভায় থাকা রওশনপন্থি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রওশন এরশাদ নেতৃত্বাধীন দলে কাজী ফিরোজ রশীদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করার ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সুনীল শুভ রায়। কাজী ফিরোজ রশীদকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি সাড়া দেননি।