![বিতর্কিত রিয়াজ পদে থাকায় ক্ষোভ আওয়ামী লীগে](uploads/2024/04/26/1714108540.Riaz.jpg)
একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড করেই যাচ্ছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ। অর্থ ও নারী কেলেঙ্কারিসহ দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দলীয় পদ থেকে রিয়াজকে বহিষ্কারও করেছে আওয়ামী লীগ। তারপরও ক্ষান্ত হননি রিয়াজ। কেন্দ্রীয় নেতা ও মহানগর আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করেছেন রিয়াজ।
সর্বশেষ দক্ষিণ আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী ও কাউন্সিলর সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলীর সঙ্গে রিয়াজের ফোনালাপের এক অডিও ফাঁস হয়েছে। আলাপকালে চামেলীকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না বলে ১০ লাখ টাকায় রফাদফা করতে চেয়েছিলেন রিয়াজ। এর একটি রেকর্ড খবরের কাগজের কাছে রয়েছে। গত বুধবার ‘চামেলীকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার, ১০ লাখ টাকায় রফার- দপ্তর সম্পাদকের ফোনকল ফাঁস’ এমন শিরোনামে খবরের কাগজে একটি প্রতিবেদন ছাপানো হয়। খবরটি ছড়িয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মাঝে। তা নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয় মহানগরের রাজনৈতিক অঙ্গনে। এর পর থেকে রিয়াজের নামে একাধিক অপকর্মের কথা এ প্রতিবেদককে জানাতে শুরু করেন দক্ষিণের নেতারা। নগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর অন্তত ৫ জন নেতা একাধিক অভিযোগ করেন রিয়াজের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অভিযোগ হচ্ছে, দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফীর অনুসারী হওয়ায় তার নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, দৃশ্যমান ব্যবসা না থাকলেও রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাটের ও গাড়ির মালিক হওয়া, নারীদের অশালীন প্রস্তাব দেওয়া ও নিজের সিনিয়র নেতাদের অসম্মান করা। দল থেকে আগে বহিষ্কারের পরও রিয়াজ কাদের ছত্রচ্ছায়ায় এসব করছেন, কেন তাকে দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছে তা নিয়েও নেতারা ক্ষোভ জানান।
দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র এক নেতা খবরের কাগজকে বলেন, ‘রিয়াজ আওয়ামী লীগ করা ছেলে না। হঠাৎ এসে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ দপ্তর সম্পাদক হয়ে গেল। কারণ, সে সভাপতি মান্নাফীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী। আওয়ামী লীগের পদ পেয়ে সে টাকা-পয়সা বানিয়ে ফেলেছে। ঢাকায় তার একাধিক ফ্ল্যাট ও গাড়ি রয়েছে। কোনো ব্যবসাও করতে দেখি না। সচিবালয়ে গিয়ে তদবির বাণিজ্য করতে দেখা যায়। নারীদের সঙ্গে অপকর্মের কারণে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। তার পরও কেন তাকে- কোন প্রয়োজনে আবার দলে ফেরানো হলো? তার যে বয়স- এই বয়সে নগর আওয়ামী লীগের মতো জায়গায় এতবড় পোস্ট কীভাবে পায়? মান্নাফীর ঘনিষ্ঠ হলে কি দলে রাখতে হবে?’ তাকে যারা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন তাদেরও বিচার চেয়েছেন দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সম্পাদক পর্যায়ের আরেক নেতা।
নগর আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, রিয়াজের নাম নতুন করে আলোচনায় আসে চামেলীর সঙ্গে একটি দফারফা করতে ফোন কলের অডিও ফাঁস হওয়ার পর। অনৈতিক কাজে জড়িত থাকায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেত্রী ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর সৈয়দা রোকসানা ইসলাম চামেলীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয় গত বুধবার। এর আগে গত মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) চামেলীকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না এই মর্মে ১০ লাখ টাকায় রফাদফা করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা রিয়াজ উদ্দিন।
মতিঝিলের হীরাঝিলের রেস্টুরেন্ট মঙ্গলবার বিকেল ৩টার দিকে রিয়াজ চামেলীর সঙ্গে রফাদফা করার জন্য বৈঠক করেন। চামেলীর সঙ্গে তার স্বামীও ছিলেন। এ সময় রিয়াজ চামেলীকে বলেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মন্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ূন কবিরের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, ১০ লাখ টাকা হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে না। নিয়ম রক্ষার জন্য প্রথমে শুধু অব্যাহতি দেওয়া হবে। আর সেটি পরবর্তীকালে যাতে তুলে নেওয়া যায় তার ব্যবস্থা করা হবে। পরে টাকার বিষয়ে জানতে রিয়াজ ফোন করেন চামেলীকে। সে ফোনের অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে।
অডিও রেকর্ড ও রেস্তোরাঁয় বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে স্বীকার করে চামেলী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বিশ্বাস না হলে হীরাঝিলের ২৩ তারিখের সিসি টিভি ফুটেজ দেখেন। আমি আর আমার স্বামীর সঙ্গে বৈঠক করে রিয়াজ বলেন, ওবায়দুল কাদের (আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক) ভাইকে ম্যানেজ করা যাবে। সমস্যা নেই। দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি মান্নাফী ও সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, ১০ লাখ টাকা হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে না। নিয়ম রক্ষার জন্য প্রথমে শুধু অব্যাহতি দেওয়া হবে। আমি রাজি হই। পরবর্তী সময়ে ওই দিন সন্ধ্যায় রিয়াজ আমাকে আবার ফোন করে টাকা চান। তখন আমি বলি সকালে টাকা ম্যানেজ করে পাঠাবো।’ সেই কল রেকর্ডটি এখন নগর আওয়ামী লীগ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের মোবাইলে ঘুরছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সব অস্বীকার করে রিয়াজ খবরের কাগজকে বলেন, ‘রেকর্ড ১০ এর আলোচনা শোনা গেছে। তবে এখানে এই ১০টা কী? এখন আমিও তো ফোনের শেষে ১০ পাঠাই দেব- একথা বলে রাখতে পারি। তার মানে কি আমি আপনাকে ১০ লাখ টাকা দেব।’ ফোনে চামেলীর সঙ্গে কথা বলেছেন কি না জানতে চাইলে এ বিষয়ে তিনি সরাসরি হ্যাঁ অথবা না স্পষ্ট কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে টাকা নিয়ে কোনো কথা হয়নি।’
রিয়াজের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি মান্নাফী গত বুধবার রাতে খবরের কাগজকে বলেন, ‘এসব খারাপ কাজ। ঘৃণিত কাজ। সে (রিয়াজ) কাউকে বহিষ্কার কিংবা দলীয় পদ দিতে পারবে না। এটা তার কাজও না। সে আমাদের বিক্রি করেছে নাকি তা জানব। আমি তার কাছে এগুলো নিয়ে জানতে চাইব।’ সত্যতা পেলে ফের রিয়াজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন মান্নাফী।
নগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ অন্যায়। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আমরা এর সত্যতা যাচাই করব। প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
রিয়াজের বিষয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগে আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পেলে আমরা ব্যবস্থা নেব। সে (রিয়াজ) কাউকে বহিষ্কার করতে পারবে না। তাহলে এমন কিছু পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এর আগে গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে রিয়াজের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অনিয়ম ও শিক্ষিকাদের অশালীন প্রস্তাব দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের (নারী শিক্ষা মন্দির) শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে তৎকালীন বিদ্যালয়টির সভাপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজের বিরুদ্ধে। তখন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল। পরে লবিং-তদবির করে আবার নিজের পদ ফিরে পান রিয়াজ। পদ পাওয়ার পরই আবার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি।