![মন্দা ও মূল্যস্ফীতির চাপের বছর](uploads/2023/12/22/1703221513.price-inflation.jpg)
২০২৩ সালের পুরোটা সময় সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে দেশের অর্থনীতি। শুরুতে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা কম থাকলেও মাঝামাঝি সময় এসে পারদ চড়া হয়। সেই পারদ ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদ হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার পদক্ষেপ নেয়। যে কারণে বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে। সরকার আশা করছে এটি আরও কমে আসবে। তবে মূল্যস্ফীতিই যে এখন অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ সে বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই।
নানা প্রণোদনা ও সরকারের সময়োচিত নীতি-সহায়তার কারণে কোভিড-পরবর্তী অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থনীতি অস্থির হতে থাকে। সব সূচক নিম্নমুখী হয়। দেখা দেয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি, কমে টাকার মান, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ প্রতি মাসে কমতে থাকে আশঙ্কাজনকভাবে। ডলারসংকট প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে বছরজুড়ে চাপে থাকে অর্থনীতি।
২০২৩ সালে একদিকে অর্থনীতিতে দেখা দেয় মন্দার প্রভাব। অন্যদিকে ছিল মূল্যস্ফীতির চাপ। সেই সঙ্গে নির্বাচনের বছর হওয়াতে রাজনৈতিক সহিংসতা অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তোলে। মন্দার মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ছিল না বললেই চলে। কমে যায় আমদানি। শিল্পের মূলধনি যন্ত্রাংশের আমদানি কমেছে। ফলে উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বেড়েছে বেকার মানুষের সংখ্যা। অন্যদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে কমে যায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।
এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ কী হতে পারে বা নতুর বছর কেমন যাবে ? এ প্রশ্নের জবাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা পিআরআইএর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর খবরের কাগজকে বলেন, ২০২৪ সাল কেমন যাবে সেটি নির্ভর করছে নির্বাচনের পর পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় তার ওপর। আমরা জানি না রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা বহির্বিশ্বের চাপ কেমন হবে। আবার আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, সরকারের যেসব নীতি নেওয়ার কথা সেগুলো বাস্তবায়ন কতুটুকু হবে- এসবের ওপর নির্ভর করছে নতুন বছরের ভবিষ্যৎ। এক কথায় যদি বলেন, ২০২৩ সাল অর্থনীতির জন্য কেমন ছিল- এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি বলব অর্থনৈতিক মন্দা ও মূল্যস্ফীতির চাপের বছর।
২০২৩ সালে অর্থনীতি যে চাপের মধ্যে ছিল তার প্রতিফলন ঘটেছে সংশোধিত বাজেটে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকার জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল তা থেকে সরে এসেছে। বাজেট ঘোষণার সময় প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয় সাড়ে ৭ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে এটি কমিয়ে ৭ শতাংশ নির্ধারনের প্রস্তাব করা হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের সভায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। অবশ্য, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এ বছর যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না সেটি বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি এরই মধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে এ বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না। দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরাও একই মত দেন। বিশ্বব্যাংকের প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার হবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। এডিবি বলেছে, এটি হতে পারে ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
অর্থনীতির সূচকগুলো ছিল নিম্নমুখী। বছরের প্রথম মাসগুলোতে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ভালো থাকলেও শেষ দিকে এসে পরিস্থিতি খারাপ হয়। সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানিতে কিছুটা গতি বাড়লেও অক্টোবর, নভেম্বরে ধারাবাহিকভাবে কমে যায়। বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়া ও মজুরি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়।
২০২৩ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ ওঠানামা করে। হুন্ডির দাপটে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়ে। এ ছাড়া প্রবাসী আয় কমার অন্যতম কারণ,আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক খাতের মধ্যে ডলারের দামে পার্থক্য। অবশ্য, মোট পাঁচ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ায় সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্সে উল্লম্ফন লক্ষ্য করা যায়। রপ্তানি আয় কমে যাওয়া প্রবাসী আয়ে ধীরগতি ও ডলারসংকটের কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের চাপে থাকে।
আমদানি ব্যাপক কমে যায়। শিল্পের মূলধনি যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের আমদানি কম হওয়ায় বিনিয়োগে খরা চলে। আমদানি কমার প্রধানতম কারণ ডলারসংকট। এই সংকট বছরজুড়ে ছিল। ডলারসংকট এতটাই প্রকট হয় যে, ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে পারেননি। বড় কিছু ব্যবসায়ী কিছু এলসি খুলতে পারলেও ছোটরা পড়েন বিপদে। ব্যাংকগুলো তাদের এ বিষয়ে সহযোগিতা করেনি।
মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, ডলারের পৃথক রেট নির্ধারণসহ বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও ডলার সংকট কাটেনি। পরে অভিন্ন রেট করা হয়েছে। তাতেও কোনো লাভ হয়নি। ডলারের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে এখনো। সরকারের প্রধান আয় রাজস্ব খাত। বছরের শুরু থেকেই এ খাতের অবস্থা ভালো দেখা যায়নি। প্রতি মাসে বিশাল ঘাটতি হয়। ফলে দৈনন্দিন খরচ মেটাতে সরকারের ঋণ নির্ভরশীলতা বাড়ে। সরকারি আয়ের আরেকটি উৎস বৈদেশিক ঋণ প্রবাহে ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে। বৈশ্বিক মন্দার কারণে দাতাসংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থ ছাড়ের পরিমাণ কমে যায়।
অর্থনীতির লাইফলাইন ব্যাংক খাতের সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী। খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতি, ফলে আয় কমে গেছে ব্যাংকের। কমেছে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ। এর ফলে বিনিয়োগের গতি আরও শ্লথ হয়ে যায়। ব্যাংক খাতের আমানত ও ঋণের সুদ হার ৯/৬ পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটেছে। ঋণের সুদ হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট কাটতে শুরু করে। বাড়ে আমানত।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন,২০২৩ সালে দেশের অর্থনীতি বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে। বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা ভালো ছিল না। ডলারসংকট সারা দুনিয়াজুড়ে ছিল। বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়ছে। বিদেশি বিনিয়োগ কম এসেছে। বিদেশি ঋণও কম এসেছে। এসব কারণে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়ে। তাদের মতে, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।
খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক ঊর্ধ্বতন পরিচালক ড. জায়েদ বখত বলেন, নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেছে ২০২৩ সালের অর্থনীতি। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার অস্থিরতা থাকায় ডলারসংকট প্রকট আকার ধারণ করে। ডলার মূল্য একবারে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এটাকে আস্তে আস্তে বাজারভিত্তিক করতে হবে। রপ্তানিতে কিছুটা শ্লথ গতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে সামনে আরও বাড়বে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ আরও ইতিবাচক ধারায় যাবে। আশা করছি, নির্বাচন ভালোভাবে হবে। ফলে ২০২৪ সালের অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে। তবে আমি বলব ২০২৩ সালে অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মধ্যে থাকলেও আমরা পারফর্মেন্স খুব একটা খারাপ করিনি।