ঢাকা ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, শনিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪

শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪৩ এএম
শাহজালালের নিরাপত্তা হুমকির মুখে
ফাইল ফটো

ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিভিন্ন দায়িত্বে কাজ করে প্রায় ২৫টি সংস্থা। এর মধ্যে নিরাপত্তাক্ষেত্রে বেশির ভাগ দায়িত্ব পালন করছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্স (এভসেক)। সম্প্রতি এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি বিনা নোটিশে দখল করে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এভসেকের বিরুদ্ধে।

এ ঘটনায় এভসেকের বিরুদ্ধে থানায় সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করেছে এপিবিএন। এতে সরকারি এ দুটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শাহজালালে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।

তবে সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেছেন, পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। এভিয়েশন সিকিউরিটি ফোর্সের সক্ষমতা বাড়লে সেখানে কর্মরত অন্য বাহিনীর সদস্যরা চলে যাবেন। 

গত ২৯ নভেম্বর মঙ্গলবার বিমানবন্দর আর্মড পুলিশে কর্মরত সহকারী পুলিশ সুপার জাকির হোসেনের করা জিডিতে বলা হয়েছে, ‘সকাল সোয়া ১০টার দিকে এভসেকে কর্মরত স্কোয়াড্রন লিডার তাসফিক তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর থেকে কল দিয়ে বলেন, ‘অ্যাপ্রোন এরিয়ার (অ্যাপ্রোন এলাকা হলো যেখানে বিমান পার্ক করা হয়, লোড-আনলোড করা হয়, রিফুয়েল করা বা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়) ৩৩ নম্বর গেটে আপনাদের (এপিবিএন) অফিস থেকে মালামাল সরিয়ে ৮ নম্বর হ্যাঙ্গার গেটে রাখা হয়েছে। আপনাদের পুলিশ পাঠিয়ে এগুলো নিয়ে যান।’

জিডিতে বলা হয়, ‘পরে তিনি এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানান। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আগে না জানিয়ে কেন মালামাল সরিয়ে অন্যত্র রাখলেন- এমন প্রশ্নে এভসেকের ডেপুটি ডিরেক্টর অপারেশন সাইফুর রহমান জানান, বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম ও এভসেকের পরিচালক উইং কমান্ডার জাহাঙ্গীরের নির্দেশে এগুলো সরানো হয়েছে।’

জিডিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘পরে তথ্য নিয়ে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, ওই অফিসের প্রবেশমুখে বাম পাশে দেয়ালে লেখা এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ, এয়ার সাইড কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল লেখা সাইনবোর্ডটি ভঙ্গুর অবস্থায় অফিসের ভেতরে রাখা হয়েছে। অফিসের ভেতরে সরকারি কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, ইলেকট্রনিকস ডিভাইস, ২০১০ সাল থেকে রক্ষিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথিপত্র নির্দিষ্ট স্থানে পাওয়া যায়নি।’

জানা গেছে, এরই মধ্যে অ্যাপ্রোন এলাকায় থাকা এপিবিএনের কমান্ড সেন্টারটি দখলে নিয়ে সেটিকে নিজেদের অফিস বানিয়ে ফেলেছে এভসেক। তবে এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য পাওয়া গেছে বিমানবন্দরে কর্মরতদের কাছ থেকে। 

বিমানবন্দরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে জানান, ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘনিয়ে এলে এপিবিএনের সদস্যরা তাদের অস্ত্র ও দায়িত্ব রেখে পালিয়ে যান। ফলে ওই সময় বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং শঙ্কা তৈরি হয়। পরে এভসেকের সদস্য বাড়িয়ে তাদের দিয়ে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সব কাজ করানো হয়। 

অন্যদিকে বন্দরের অন্য আরেকটি পক্ষের অভিযোগ, এভসেকের বাধায় এখন ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারছে না এপিবিএন। শাহজালাল থেকে এপিবিএন সদস্যদের সরিয়ে দিতে এমনটি করা হয়েছে বলেও তারা মনে করছেন।

তবে দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি এ অভিযোগের মধ্যে বিশ্লেষকরা বলছেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সরকারি দুই সংস্থার এমন মুখোমুখি অবস্থান নিরাপত্তার জন্য যেমন শঙ্কা হয়ে দেখা দিতে পারে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবেও বিমানবন্দরের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে।

এভিয়েশন বিশ্লেষক ড. কুদারাত-ই খুদা বলেন, ‘দুটি সংস্থার সমন্বয়ের মাধ্যমেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাড়তি অন্য কোনো সংস্থা থেকে নিরাপত্তার জন্য লোক আনার প্রয়োজন দেখি না।’

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম খবরের কাগজকে বলেন, ‘সরকারি দুটি সংস্থার এ ধরনের মুখোমুখি অবস্থান কারও কাম্য নয়। এ রকম মুখোমুখি অবস্থানে না থেকে একসঙ্গে মিলেমিশে থাকলে নিরাপত্তা আরও সুসংহত থাকবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিরাপত্তা ইস্যু আরও প্রশংসিত হবে। আমরা চাই নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলো একে অপরের সঙ্গে সহমর্মিতা নিয়ে কাজ করবে। সর্বশেষ আমি শুনেছি ৫ আগস্টের সময় দায়িত্ব নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল; তবে সে বিষয়ে তারা আলোচনা করে এখন দায়িত্ব ভাগ করে কাজ করছেন।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘বিমানবন্দরে নিরাপত্তার বিষয়টি একটি কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনে থাকা উচিত। পৃথিবীর সব দেশেই এটি রয়েছে। অথচ এখানে প্রায় ২৫-৩০টি সংস্থা নিজ নিজ এখতিয়ারে কাজ করে। এদের প্রত্যেকের পৃথক কমান্ড। এ কারণে মাঝে মাঝেই সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। নিরাপত্তাব্যবস্থা যতদিন পর্যন্ত একটি সেন্ট্রাল কমান্ডের আওতায় না আসবে, ততদিন এ অবস্থা চলতে থাকবে।’

জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনের নিয়ন্ত্রণাধীন এভসেকে যে জনবল রয়েছে তা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বাইরে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বিমানবাহিনী থেকে ৫০০-এর বেশি জনবল নিয়োগ দিয়েছে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ১৬০ জন, বাংলাদেশ পুলিশের ৭৯ জন শাহজালালে কর্মরত। এ ছাড়া চলতি বছরের গত ৩ অক্টোবর আবারও ৩২৮ জনসহ আরও প্রায় এক হাজার জনের নিয়োগের মন্ত্রণালয়ে অনুমোদন চাওয়া হয়। 

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সালের ১ জুন বিমানবন্দরে নিরাপত্তার কাজ শুরু করে আর্মড পুলিশ। নিরাপত্তার পাশাপাশি চোরাচালান রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে এই সংস্থাটি। 

এপিবিএনের অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান খবরের কাগজকে বলেন, ‘সক্ষমতার দিক থেকে আমরা আগে যেমন ছিলাম, এখনো তাই আছি। আমরা দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমাদের সেটি করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি পরিপত্র, আইকাও (আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা)-এর নিয়মাবলি যেভাবে রয়েছে, আমরা সেভাবেই দায়িত্ব পালন করে আসছি। এখন কেন দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে এটি বোঝা যাচ্ছে না। অ্যাপ্রোন এরিয়ায় আমাদের যে অফিসটি ছিল, আমাদের না জানিয়ে সেটি তারা সরিয়ে ফেলেছে।’

এদিকে বিমানবন্দর থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এভসেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা এপিবিএনের জিডির তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে যেহেতু দুটি সংস্থার মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা চলছে, তাই তদন্তের সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে পুলিশ অপেক্ষা করছে।

এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া খবরের কাগজকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের বিশেষ পরিস্থিতির কারণে এখানে বিমানবাহিনীর সদস্যদের এনে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তারাই ডিউটি করে যাচ্ছেন। আমাদের কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি। পরবর্তী সময়ে এপিবিএন দায়িত্বে ফিরে এসেছে। আমাদের তিন কিলোমিটারব্যাপী এয়ারপোর্টের এরিয়া, যা সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার। বহিরাঙ্গনের যে নিরাপত্তা সেটির কাজ এপিবিএন করে যাচ্ছে।’

এপিবিএনকে আবার পুরোনো দায়িত্বে ফেরানো হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক সংস্থাই তো ভেতরে ডিউটি করতে চায়, সবাইকে তো সুযোগ দেওয়া সম্ভব না।

সিভিল এভিয়েশন চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘পৃথিবীর সব বিমানবন্দরেই এভিয়েশন সিকিউরিটি দায়িত্ব পালন করে। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে এভিয়েশন সিকিউরিটিকে আরও শক্তিশালী করা। আমাদের সক্ষমতা বাড়লে বিমানবন্দরে কর্মরত এপিবিএনসহ অন্য কোনো বাহিনীই থাকবে না। বর্তমানে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি এভিয়েশন সিকিউরিটির কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। আমরা আরও সাড়ে তিন হাজার জনবল নিয়োগ দিতে যাচ্ছি। সব মিলিয়ে পাঁচ হাজারের মতো সিকিউরিটি কাজ করবে। একসময় এভিয়েশন সিকিউরিটি পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়ার পর অন্যরা চলে যাবে।’

নীতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের, আদায়ে এনবিআর

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ এএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১১ এএম
নীতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের, আদায়ে এনবিআর
অর্থ মন্ত্রণালয় ও এনবিআর

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতিপর্যায়ে বড় পরিবর্তন আনা হতে পারে। এতে রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং আদায় কার্যক্রম আলাদা থাকবে। 

এনবিআরকে গতিশীল করতে যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার, এটি তারই উদ্যোগ। এই উদ্যোগ কীভাবে কার্যকর করা হবে, তা নিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টরা কাজ শুরু করেছেন। 

৫২ বছর ধরে রাজস্ব খাতের নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রমও এনবিআর পরিচালনা করে আসছে।

এনবিআরের একটি সূত্র জানায়, রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রম এনবিআরের ওপর থাকলেও রাজস্বনীতি প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। 

রাজস্ব বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, একই প্রতিষ্ঠান নীতি প্রণয়ন ও রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বে থাকলে রাজস্ব খাতে দুর্নীতি করার সুযোগ তৈরি হয়। তারা আরও বলেন, অনেক সময় রাজস্ব আদায় বাড়ানোর স্বার্থে এনবিআর-সংশ্লিষ্টরা করদাতা ও ব্যবসায়ীদের সক্ষমতার কথা না ভেবেই নীতি প্রণয়ন করে থাকেন। এতে করদাতাদের ভোগান্তি বাড়ে।

অতীতে দেখা গেছে, এনবিআরের কিছু অসাধু কর্মকর্তা প্রভাবশালীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সুবিধামতো নীতি প্রণয়ন করেছেন। রাজনৈতিক প্রভাবে রাজস্ব অব্যাহতি দিয়েছেন। এতে ব্যক্তিবিশেষ সুবিধা পেলেও সরকারের রাজস্ব আদায় কমেছে। 

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে এনবিআরের সদস্য (আয়কর নীতি) এ কে এম বদিউল আলম খবরের কাগজকে বলেন, রাজস্ব আদায়সংক্রান্ত কার্যক্রম এবং নীতি- দুটিই এনবিআর পরিচালনা করে থাকে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্ব আদায়ের কাজ আলাদা করার পরামর্শ দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাজস্বনীতি প্রণয়ন এবং রাজস্ব আদায় কে বা কারা করবে, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। বিষয়টি নিয়ে একটি রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে, সে অনুযায়ী সংস্কার করা হবে। 

রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৭৬-এর ভিত্তিতে ১৯৭২ সালে এনবিআর প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরু থেকেই সংস্থাটির মূল কাজ ছিল মূল্য সংযোজন কর (মূসক), আয়কর ও আমদানি শুল্ক আরোপ, আদায় এবং এ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন করা। 

আইএমএফের যুক্তি হচ্ছে, রক্ষক ভক্ষক হতে পারে না। যে সংস্থা নীতি প্রণয়ন করবে, সেই সংস্থাকে আদায়ের দায়িত্ব দিলে সেখানে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। তখন থেকে এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল আইএমএফ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সময়ে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হলেও বেশি দূর এগোয়নি। এখন নতুন করে এই আলোচনা উঠে এসেছে। 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফের চলমান ৪৭০ কোটি ঋণ কর্মসূচির মধ্যে যেসব শর্ত আছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করা। সরকার এখন সেই শর্তটি প্রতিপালন করতে যাচ্ছে। 

এনবিআরের সাবেক সদস্য আমিনুল করিম খবরের কাগজকে বলেন, এর আগেও রাজস্বনীতি ও আদায় আলাদা করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উদ্যোগটি থেমে যায়। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে প্রতিবছর বড় আকারের ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়। বাজেটের হিসাব মেলাতে এনবিআরের ওপর বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এনবিআর অনেকটা নিরুপায় হয়ে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে গিয়ে আদায় বাড়াতে রাজস্বনীতি প্রণয়ন করে থাকে। অর্থনীতি ও সাধারণের ওপর এর কী প্রভাব পড়ল, তা নিয়ে এনবিআর অতটা চিন্তা করে না। যতটা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়ে তৎপর থাকে। 

দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু খবরের কাগজকে বলেন, রাজস্বনীতি প্রণয়নের আগে অবশ্যই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতির ওপর কী প্রভাব পড়বে তা খতিয়ে দেখতে হবে। সাধারণ মানুষের ওপর কী প্রভাব পড়বে, তাও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। সবার জন্য স্বস্তিদায়ক নীতি প্রণয়ন করা হলে অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে আদায় বাড়বে। 

তিনি আরও বলেন, কিন্তু আদায় বাড়ানোকে গুরুত্ব দিয়ে নীতি প্রণয়ন করা হলে সবার জন্য স্বস্তিদায়ক নাও হতে পারে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি না এলে রাজস্ব পরিশোধ কীভাবে হবে। এনবিআর আদায় বাড়ানোর দায়িত্বে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি নীতি প্রণয়নের চেয়ে আদায় করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেবে এটাই স্বাভাবিক। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়কে গোটা অর্থনীতি নিয়ে চিন্তা করতে হয়। তাই আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় রাখতে হয়। নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব এনবিআর থেকে আলাদা প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকলে অর্থনীতির জন্য খারাপ হবে না।

তার মতে, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য সরকার রাজস্বনীতির ব্যবহার করে থাকে। ফলে অর্থনীতিতে রাজস্বনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। তাই আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান থেকে নীতি প্রণয়ন করলে ভালো ফল আসবে বলে মনে করি। 

আইএমএফের মতে, এনবিআরের নীতি বিভাগ ও আদায় বিভাগ আলাদা করলে রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা আসবে। নীতি বিভাগকে এনবিআর থেকে আলাদা করে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর ন্যস্ত করা যেতে পারে।

গতি ফিরছে প্রশাসনে

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৫ এএম
আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ এএম
গতি ফিরছে প্রশাসনে
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের চার মাস পর এখন প্রশাসনে গতি ফিরতে শুরু করেছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের পাশাপাশি প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইন অনুযায়ী কর্মসম্পাদনের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। তবে অধস্তনদের অনেকেই এখনো নির্ভার হতে পারছেন না। সচিবালয়ের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনে শুরু হয় শুদ্ধি অভিযান। সাবেক সরকারের ‘অপকর্মের’ সহযোগী শীর্ষ কর্তাদের অনেককেই বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। গত সরকারের শেষ সময়ে মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের উঠিয়ে এনে কম গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। তা ছাড়া সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত বেশ কিছু কর্মকর্তার দপ্তর বদল করা হয়েছে।

এদিকে গত সরকারের আমলে বঞ্চিত অনেক কর্মকর্তাকে এবার পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে। এক পক্ষ পদোন্নতি পাওয়ায় অন্য পক্ষে অসন্তোষ রয়েছে। কর্মকর্তাদের মধ্যে একধরনের নীরবতা রয়েছে, চেনাজানা অনেকেই এখন আর খোলামেলা কথাবার্তা বলছেন না। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা ও মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় আসে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এদিন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের ১৭ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ সরকার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ও প্রশাসনে কাজের গতি ফেরানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয় সরকার। প্রাথমিকভাবে সরকারের নীতি বা কর্মপদ্ধতি কেমন হবে তা নিয়ে সারা দেশে প্রশাসন স্থবিরতা শুরু হয়। সেই সময়ে প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয়কে ঘিরে শুরু হয় নানা পক্ষের দাবি-দাওয়া ও দাবি আদায়ের আন্দোলন। বিক্ষুব্ধ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা সচিবালয় ঘেরাও এবং অবরুদ্ধ কর্মসূচিও পালন করেন। দাবি আদায়ে অসহিষ্ণু আচরণ করায় গ্রেপ্তার হয়েছেন শতাধিক বিক্ষুব্ধ কর্মচারীসহ বেশ কিছু শিক্ষার্থী। এখন ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম তিন মাসের কার্যক্রমসংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী এই সময়ে (আগস্ট-অক্টোবর) সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ১২ জন, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৫, যুগ্ম সচিব পদে ২২৬, উপসচিব পদে ১২৫, অন্যান্য ক্যাডারে ২২১ এবং নন-ক্যাডারে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে ৯ জন ও সহকারী সচিব পদে ৩৭ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। একই সময়ে সিনিয়র সচিব ও সচিব পদে ৪৩ জন, গ্রেড-১ পদে ১১, অতিরিক্ত সচিব পদে ১৩৭, যুগ্ম সচিব পদে ১৭৩, উপসচিব পদে ৩৯১, বিভাগীয় কমিশনার পদে ৪ এবং অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার পদে ৩ জনকে বদলি করা হয়েছে। তা ছাড়া ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি, ১১৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১৬৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সিনিয়র সহকারী সচিব ও সহকারী সচিব পদে ৪১৪ জন, সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও সহকারী কমিশনার পদে ৮৩ জনসহ মোট ১ হাজার ৮৭০ জনের দপ্তর বদল করার পাশাপাশি ৪ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর, সহকারী সচিব থেকে সিনিয়র সচিব পর্যায় পর্যন্ত ৮০ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি এবং ১০১ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করেছে জনপ্রশাসন।

তবে প্রশাসনের বর্তমান স্থবিরতা নিয়ে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে আলোচনা-সমালোচনা থেমে নেই। আলোচনায় প্রায়ই উঠে আসছে সাবেক সরকারের মদদপুষ্ট প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তার দুষ্কর্ম। 

এদিকে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রশাসনে যেকোনো ধরনের বিভক্তি ও রেষারেশি বাড়লে নোংরা রাজনীতি শুরু হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, সম্প্রতি একটি সরকারের হঠাৎ পরিবর্তনে প্রশাসনসহ সব ক্ষেত্রেই একটা অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, আতঙ্ক কাজ করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাজের গতি কম হবে। কারণ পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ায় কাজের পরিবেশেরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তা ছাড়া নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বভাবতই গত সরকারের অনেক সিদ্ধান্ত, পরিকল্পনা বুঝতে কিছুটা সময় নিচ্ছে প্রশাসন। এ কারণে এই বিভাগে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত এখন নেই। কিন্তু স্বাভাবিক রুটিন কাজে কোনো ব্যাঘাত হচ্ছে না। তাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে প্রশাসনের কর্মকাণ্ড।

সংলাপকে সফল দেখছে সব পক্ষ

প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৫ এএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৫৩ পিএম
সংলাপকে সফল দেখছে সব পক্ষ
প্রতীকী ছবি

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপকে সফল মনে করছে রাজনৈতিক দলগুলো। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে গত সোমবার হামলা করেন দেশটির হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এই ঘটনার পর সারা দেশের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ ৪০টির বেশি রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন ধর্মের ৩২ জন প্রতিনিধির সঙ্গে সংলাপে বসেন।

বুধ ও বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সংলাপের উদ্দেশ্য ও সফলতা নিয়ে নানা মহলে আলোচনা চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে- জাতীয় ঐক্যের আহ্বানে এই সংলাপ শতভাগ সফল হয়েছে। আর সংলাপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মতে, ৫ আগস্টের পর সংলাপের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে মেসেজ দেওয়া গেছে যে ছাত্র-জনতার ঐক্যে কোনো যড়যন্ত্র করে চিড় ধরানো যাবে না। প্রতিবেশী ভারতের আগ্রাসন, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অনমনীয় জাতীয় ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবারের সংলাপে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে মৌলিকে সংস্কারের পর দ্রুত নির্বাচনের তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের কয়েকজন শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) খবরের কাগজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশের মানুষ ও বহির্বিশ্বকে দেখাতে সক্ষম হয়েছে- স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস করবে না বাংলাদেশ। ভারতীয় আগ্রাসন ও মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রত্যেক নাগরিক আজ ঐক্যবদ্ধ। ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিজমের পুনরুত্থানের কোনো ধরনের অপতৎপরতা সফল হতে দেবে না। নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে আগ্রসর হতে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তারা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক পেক্ষাপটসহ নানা সংকটের কারণে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। বিএনপি সেই জাতীয় ঐক্যে সমর্থন জানিয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে আমরা নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারকাজ শেষ করে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। কারণ দেশের জনগণ নির্বাচনমুখী হলে দ্রুতই যড়যন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, এই সরকার ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের সরকার। যারা জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং রাজনীতিতে বৈষম্য দূর করে গণতান্ত্রিক ধারা প্রবর্তন করবে।

নির্বাচনের রোডম্যাপ কবে নাগাদ পেতে পারেন সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা কিছু বলেছেন কি না- এমন প্রশ্নের উত্তরে খন্দকার মোশাররফ বলেন, ‘সংলাপে আমরা আমাদের অভিমত দিয়েছি। সরকার কী করবে, কীভাবে বিবেচনায় নিয়েছে তা এখনই বলা যাবে না। আমরা সরকারের নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার অপেক্ষা আছি। রোডম্যাপের জন্য আমরা আরও কিছু দিন অপেক্ষা করব।’

এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই সংলাপের মাধ্যমে আমরা বিশ্বের কাছে মেসেজ দিতে পেরেছি- গত ৫ আগস্টের পর ছাত্র ও জনতার ঐক্যের ভিত্তিতে দেশ চলছে। এখানে কোনো বিভেদ-বিভাজন নেই। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবাই ঐক্যবদ্ধ। এখানে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করে লাভ হবে না। এই শক্ত মেসেজটাই বিশ্ববাসীর কাছে দিতে সক্ষম হয়েছি।’ 

তিনি বলেন, গত ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি নানা শক্তি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এ ছাড়া এ সময়ে দেশি ও বিদেশি নানা শক্তি ছাত্র-জনতার ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে আসছে বলেও অভিযোগ।

প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার খবরের কাগজকে বলেন, ‘এবারের সংলাপ এটাই প্রমাণ করেছে যে, সব সক্রিয় রাজনৈতিক দল জাতীয় ইস্যুতে আক্ষরিক অর্থেই প্রধান উপদেষ্টার পাশে দাঁড়িয়েছে। এবারে আরও প্রমাণ হয়েছে, যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় আমরা জাতীয়ভাবে ঐক‍্যবদ্ধ। সংলাপ সফল হয়েছে।’

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা গণ-অভ্যুত্থানে দেশছাড়া হওয়ার পর ৮ আগস্ট ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। চার মাসের মাথায় এসে সরকার নানা সংকটে পড়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে অনেকটা বেকায়দায় সরকার। প্রথম থেকেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জাতীয় ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। বিরাজমান সংকট নিরসনে জাতীয় ঐক্য গঠনের লক্ষ্যে ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বুধবার রাজনৈতিক দল এবং বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বসেন প্রধান উপদেষ্টা। তবে এবারের সংলাপে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টিসহ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া কোনো দলই আমন্ত্রণ পায়নি। আমন্ত্রণ পেয়েও তালিকায় নাম না থাকায় সংলাপে অংশ নিতে পারেননি এলডিপি প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) অলি আহমদ (বীর বিক্রম)। তবে পরদিন বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে কর্নেল অলি বলেন, ‘বর্তমানে ভারতের দালাল হিসেবে আমরা কাউকে কাজ করতে দেব না। আমরা ভারতের বিপক্ষে না, যারা আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। তবে বাংলাদেশ নিয়ে কেউ মিথ্যাচার করলে কাউকে ছাড় দেব না।’

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় নেতাদের বৈঠকে বেশ কিছু প্রস্তাব বা পরামর্শ উপস্থাপন করা হয়। এগুলো হলো- বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের দূতাবাসে আগের সরকারের নিয়োগপ্রাপ্তদের সরিয়ে বিপ্লবের পক্ষের শক্তিকে নিয়োগ দেওয়া, গত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে তা প্রকাশ করা এবং স্বার্থবিরোধী চুক্তি বাতিল করা; বাংলাদেশ ডে অথবা জাতীয় ঐক্যের প্রতীকী সংহতি দিবস হিসেবে একদিন পতাকা হাতে পালন করা, জাতীয় নিরাপত্তা কমিশন গঠন, আন্তর্জাতিক মহলের প্রোপাগান্ডা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাবলিক রিলেশন সেল গঠন করা এবং বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে প্রকাশ করা, জাতীয় নিরাপত্তা ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের সমঝোতা দলিল প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন করাসহ আরও কয়েকটি প্রস্তাব। সংলাপে উঠে আসা এসব প্রস্তাবের বিষয়ে পদক্ষেপ বা প্ল্যানের ঘোষণা দু-এক দিনের মধ্যে আসতে পারে।

এ বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না খবরের কাগজকে বলেন, ‘সংলাপে দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সবাই পরামর্শ দিয়েছি। কারণ প্রস্তাব দিলে সবাই মিলে লিখিত আকারে দেওয়া হতো। কিন্তু এসব পরামর্শ সরকার ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করবে কি না এটা তাদের বিষয়। সংলাপে সবাই ভারতের আগ্রাসন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকার ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।’ 

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান খবরের কাগজকে বলেন, ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক শ্রেণি রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল, উগ্র জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ছড়াতে চেয়েছে এই অঞ্চলে। বাংলাদেশকে তারা একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিল, সেই অভিলাষ তাদের পূরণ হয়নি। ভারতের আগ্রাসন মোকাবিলার পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরের সংকট তৈরি হয়েছে, সেই সব সংকট দ্রুত সমাধান করতে প্রতিটি রাজনৈতিক দল এক হয়েছে। এটাই এই সংলাপের সফলতা। 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ খবরের কাগজকে বলেন, সংলাপে ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্যে দেশের সংখ্যালঘুদের আসল চিত্র ফুটে উঠেছে। এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের জুলুম-নির্যাতন নিয়ে ভারতের মিথ্যাচার বন্ধ হবে। জাতীয় ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দল এক জায়গায় জড়ো হয়েছে- এটা ইতিবাচক।

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সদস্যসচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রথমত জাতীয় ইস্যুতে সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়েছে এটা বড় সফলতা। দ্বিতীয়ত, সাধারণত সরকারের ডাকে আগে কখনো একসঙ্গে সবা দল সংলাপে অংশ নেয়নি। দেশের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল ও সংগঠন এক- এটা বহির্বিশ্বকে দেখাতে পেরেছি। এটা ইতিবাচক দিক।’

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বরফ গলানোই হবে মূল লক্ষ্য

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৩৩ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৩ পিএম
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বরফ গলানোই হবে মূল লক্ষ্য
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে চরম উত্তেজনা ও টানাপোড়েনের মধ্যে অবশেষে আশার আলো দেখা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে সম্পর্কের এই জটিল সমীকরণের মধ্যেই আগামী ৯ ডিসেম্বর ঢাকায় শুরু হচ্ছে দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের নিয়মিত বৈঠক। বৈঠকটি নিয়মিত বলা হলেও উভয় দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিরসনে এই বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, কূটনীতিকরা মনে করছেন এই বৈঠকই হবে এ মুহূর্তে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের বরফ গলানোর টার্নিং পয়েন্ট। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। 

সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্র খবরের কাগজকে জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এবারের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকে সম্পর্কের বরফ গলানোই হবে বাংলাদেশের মূল টার্গেট। এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক মাসে অর্থাৎ ৫ আগস্টের পর দুই দেশের মধ্যে যে ভুল-বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে সব ধরনের চেষ্টা চালানো হবে। পাশাপাশি এই ভুল-বোঝাবুঝির কারণে যেসব বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ ও ক্ষোভ রয়েছে, তা ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সামনে বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। পারস্পরিক সমতা ও সম্মানের ভিত্তিতে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরা হবে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহ ও উদ্যোগের বিষয়টি পরিষ্কার করা হবে। জানানো হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এই সরকার সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে আগ্রহী। গত কয়েক মাসে দিল্লির পক্ষ থেকে যেসব উদ্বেগ রয়েছে, তা নিরসনে আশ্বস্ত করা হবে। 

সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এবারের পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলে যাওয়ায় ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে যে জট লেগেছে তা উভয় দেশে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। উভয় দেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তেজনা বেড়েছে। এ কারণে সম্পর্কের এই জট খুলতে বা বরফ গলাতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নানাভাবে চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের অভাবে সেই চেষ্টা সফল হয়নি বরং গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচক ও উসকানিমূলক প্রচার সরকারি পর্যায়ে সংকট নিরসনে উদ্যোগের পরিবেশ সৃষ্টিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অবশেষে সব বাধা পেছনে ফেলে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির নবায়ন, সীমান্তহত্যা বন্ধ, চোরাচালান প্রতিরোধ, বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা হবে বলে জানায় সূত্র। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এই বৈঠকে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। বৈঠকে বাংলাদেশ দলের প্রতিনিধিত্ব করবেন পররাষ্ট্রসচিব জসিম উদ্দিন। 

পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এই বৈঠকটি ইতিবাচক বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে সেটি ভারতকে মেনে নিতে হবে। এই বাস্তবতায় তিক্ততা না বাড়িয়ে কীভাবে লাভবান হতে পারে উভয় দেশ সেদিকে নজর দিতে হবে। দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা যত বাড়বে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো তত উপেক্ষিত হবে এবং তৃতীয় পক্ষ সুযোগ নেবে। কলকাতায় বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হিন্দু উগ্রপন্থিরা হামলা করেছে, যার প্রভাব সম্পর্কের ক্ষেত্রে পড়েছে। অথচ ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকলে দুই দেশই যে লাভবান হবে, এই বিষয়টি অবশেষে বুঝতে পারায় বৈঠকে সম্মতি জানিয়েছে উভয় পক্ষ। এটাই প্রাথমিক অগ্রগতি। এরপর দুই দেশ বৈঠকে বসলে উভয়ের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হবে। সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারবে দুই দেশ। 

ঢাকা-দিল্লি পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের এবারের বৈঠককে খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের যে বৈঠক হতে যাচ্ছে তাতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমতে পারে। উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে এ ধরনের আলোচনা আরও চলতে থাকলে সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আরেকটি বিষয়, ভারত যদি বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট মেনে নিয়ে বৈঠকে যোগ দেয় তাহলে সম্পর্কে গতিসঞ্চার হবে। 

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে চলমান টানাপোড়েন নিরসনে আসন্ন পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ঢাকা ও দিল্লির পক্ষ থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সম্পর্ক ভালো থাকলে উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে। বাইরে থেকে নানা ধরনের অপপ্রচার ও উসকানিতে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। এখন এসব বাদ দিয়ে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসায় উভয় দেশের লাভ হবে। 

আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘এই বৈঠকটি অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল। এ ধরনের বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উত্তেজনা বিষয়ে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ রয়েছে। তবে বৈঠকে ভারসাম্য বজায় রেখে আলোচনা হতে হবে, না হলে শুধু একটি দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে কী হয়, তা আমরা দেখেছি।’ দুই দেশের মধ্যে অন্যান্য পর্যায়েও দ্রুত এ ধরনের আলোচনা শুরু করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সয়াবিন তেল উধাও!

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পিএম
আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:০৩ পিএম
সয়াবিন তেল উধাও!
খবরের কাগজ গ্রাফিকস

‘প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ডিলাররা বোতলের সয়াবিন তেল দিচ্ছেন না। তাই বিক্রি করতে পারছি না। কবে পাব তাও জানি না। দাম বাড়ানোর জন্যই পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।’ বাজার থেকে তেল উধাও হওয়ায় এভাবেই হতাশার কথা জানান মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট বাজারের মুদি ব্যবসায়ী খোকন স্টোরের স্বত্বাধিকারী হুমায়ুন কবীর।

কারওয়ান বাজারের শাহপরান স্টোরের শাহজাহান আলীও হতাশা প্রকাশ করে প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘ডিলাররা বোতলজাত তেল না দিলে আমরা কীভাবে বিক্রি করব? অন্য বাজারেও একই অবস্থা। ডিলাররা বলছেন, মিল থেকে দিচ্ছে না। তাই সংকট তৈরি হয়েছে। মিলাররা বলছেন, দেওয়া হচ্ছে কিন্তু পরিমাণে কম।’

এদিকে বাজারে নতুন আলু উঠলেও দাম কমেনি। ১১০-১২০ টাকার কমে মিলছে না। পুরোনো আলুও ৮০ টাকা কেজি। শুল্ক প্রত্যাহার ও আমন ধান উঠলেও কমেনি চালের দাম। নির্ধারিত দরেও মেলে না ডিম, মুরগি। সবজির দাম ধীরে ধীরে কমছে। সবজি ৫০-৮০ টাকার ঘরে। 

বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট, হাতিরপুল বাজার ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

হঠাৎ করে তেলের সংকট কেন? জানতে চাইলে মেঘনা গ্রপের মহাব্যবস্থাপক তসলিম শাহরিয়ার খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা তেল দিচ্ছি। অন্যরা কে কী করছে জানি না।’ কিন্তু আপনাদের ডিলাররাও তো পাচ্ছেন না- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, চাহিদার তো শেষ নেই। তাই হয়তো কারও কারও কাছে মনে হচ্ছে কম পাওয়া যাচ্ছে।’

দাম বাড়ানোর জন্যই কি এভাবে সংকট তৈরি করা হয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের বৃহস্পতিবার (গতকাল) মিটিং হয়েছে। তারা মূল্য সংশোধনের ব্যাপারে প্রক্রিয়া যাচাই করছে। চূড়ান্ত হলে সেটা আমাদের জানানো হবে।’ সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। 

১ ও ২ লিটারের তেলের বোতল উধাও
গত সপ্তাহে এক লিটার সয়াবিন তেল ১৬৭ টাকায় ও পাঁচ লিটার ৮০০-৮১০ টাকায় বিক্রি হলেও গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। খুচরা বিক্রেতারা বলেন, ডিলাররা তেল দিচ্ছেন না। এ জন্য বিক্রি করতে পারছি না। তাদের কথা শুনে কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন পাইকারি দোকানি বলেন, মিল থেকে তেল দিচ্ছে না; যা দিচ্ছে তা খুবই সামান্য। এ ব্যাপারে সোনালি ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা ভালো নেই। হাত বুকে নিয়ে বসে আছি। কারণ মাল (তেল) নেই। তীরের তেল নেওয়ার জন্য টাকা দেওয়া আছে এক সপ্তাহ ধরে, তাও তেল পাচ্ছি না। গতকালও ডিলাররা তেল দেব-দিচ্ছি করেছেন কিন্তু দেননি। এ জন্য বিক্রি করতে পারছি না। তবে তীরের ক্যানোলা পাঁচ লিটার তেলের এমআরপি ৮৮০ টাকা। বেশি দামের কারণে অনেকেই এটা নেয় না।’

মেঘনা কোম্পানির ডিলার মেসার্স জামান ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জামাল হোসেন বলেন, ‘কোম্পানি থেকে মাল দিচ্ছে না। দিনে চাহিদা ১০০ কার্টন। আগে সেভাবেই বিক্রি হয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার ৮০ কার্টন তেল পেয়েছি। এক কার্টনে থাকে ২০ লিটার তেল। এটা পাওয়া না পাওয়া সমান কথা। এভাবে ব্যবসা করা যায় না।’ সিটি গ্রুপের ডিলার এটিএন এন্টারপ্রাইজের বিক্রয়কর্মী সেলিম রায়হানও তেল না থাকার তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘তেল কিছু পাচ্ছি। কিন্তু চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। তাই বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে। তিন-চার দিনে এক গাড়ি তেল লাগে। পাওয়া যাচ্ছে ৮০ কার্টন। এ জন্য সবাই পাচ্ছে না।’

কমেনি চালের দাম
অন্তর্বর্তী সরকার চালের দাম কমাতে গত ৩১ অক্টোবর চাল আমদানিতে সম্পূর্ণ শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, কমেনি দাম। আগের মতোই বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে কৃষি মার্কেটের আজান এন্টারপ্রাইজের মনির হোসেন, কারওয়ান বাজারের হাজি এন্টারপ্রাইজের হাজি মো. মাঈনুদ্দিন, টাউন হল বাজারের চাল বিক্রেতা আবদুল মান্নানসহ অন্য চাল বিক্রেতারা বলেন, ‘আমদানি করা চালের দাম বেশি পড়ে। তাই শুল্ক কমলেও বাইরের চাল দেশে আসে না। আবার নতুন ধান উঠলেও পর্যাপ্ত চাল আসেনি বাজারে। এ জন্য দাম কমে না। আগের মতোই বেশি দাম চালের। মিনিকেট ৭২-৭৬ টাকা, আটাশ চাল ৬০-৬২ ও মোটা চাল ৫২-৫৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। তবে ৫০ কেজির বস্তা কিনলে দাম একটু কম পড়ে। 

চড়া দামেই আলু বিক্রি
আগের সপ্তাহের মতো গতকালও বেশি দামে আলু বিক্রি করতে দেখা গেছে খুচরা বিক্রেতাদের। তারা নতুন আলু ১১০-১২০ ও পুরোনো আলু ৮০ টাকা কেজি বিক্রি করেন। অথচ এই আলুর দাম কমাতে সরকার শুল্ক অর্ধেক কমিয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত ৫ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে আলু আমদানিতে বিদ্যমান ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। একই সঙ্গে আলু আমদানিতে যে ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আছে, তা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার পরও কমছে না দাম। 

তবে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে। ভারতের পেঁয়াজ ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। এর প্রভাবে দেশি পেঁয়াজের দামও সপ্তাহে ১০ টাকা কমে ১২০-১৩০ টাকায় নেমেছে। সপ্তাহের ব্যবধানে রসুনের দাম কেজিতে ২০ টাকা কমেছে। বিদেশি রসুন ২৬০ টাকা, দেশিটা ২৪০ টাকা এবং দেশি আদার কেজি ১৬০ ও চায়না আদা ২৬০ টাকা । 

কমছে সবজির দাম
সবজি বিক্রেতারা বলেন, প্রতি সপ্তাহে বেগুন, টমেটো, শিমসহ অধিকাংশ সবজির দাম কমছে। ফলে বেগুন ও শিমের কেজি ৭০ থেকে ১০০ টাকায় নেমেছে। টমেটোর দামও কমে ১৪০-১৬০ টাকায় নেমেছে। কাঁচা মরিচও ১০০-১২০ টাকা কেজি হয়েছে। বরবটি, কচুরলতি ৭০-৮০ টাকা কেজি। ঝিঙ্গা ও কচুরমুখী ৭০ টাকা, পটোল ৬০-৭০, ধুন্দুল ৬০-৭০, ঢ্যাঁড়স ৬০-৮০ টাকা। তবে কমে না পেঁপের দাম। আগের মতোই ৪০-৫০ টাকা, শসা ৬০-৮০ টাকা। কপি, লাউ, চালকুমড়ার পিসও ৪০-৬০ টাকার ঘরে। শাকের দামও কমছে। পুঁইশাক ও লাউয়ের ডগার আঁটি ৩০ টাকা, লাল, পালং, কলমি ও পাটশাক ১০-১৫ টাকা আঁটি বিক্রি করতে দেখা গেছে। 

বেশি দামে মুরগি বিক্রি 
সরকার ব্রয়লার মুরগির কেজি ১৮০ ও সোনালি মুরগির দাম ২৭০ টাকা বেঁধে দিয়েছে। তার পরও গতকাল আগের মতোই ব্রয়লার মুরগি ১৯০-২০০ ও সোনালি মুরগি ৩০০-৩১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কৃষি মার্কেটের পদ্মা ব্রয়লার হাউসের শাহিন করিম ও কারওয়ান বাজারের ভাই ভাই মুরগি হাউসের বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘মোকামে বেশি দাম। তাই আমরাও আগের মতো ১৮০ টাকা ব্রয়লার ও ৩০০-৩১০ টাকা কেজি সোনালি মুরগি বিক্রি করছি।’ গরুর মাংসও আগের মতো ৭০০-৭৮০ টাকা, খাসির মাংস ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা কেজি। ডিমের দাম ১৪২ টাকা বেঁধে দেওয়া হলেও ১৪০-১৫০ টাকা ডজন দামে বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। 

কমেনি মাছের দাম 
নদী-খাল-বিলের পানি কমলেও অন্য পণ্যের মতো মাছের দামও কমছে না। মাছ বিক্রেতারা বলেন, আগের মতোই রুই-কাতলার কেজি ৩৫০ থেকে ৬০০ টাকা। কাজলি ১ হাজার টাকা, মলা ৫০০, ট্যাংরা ৫০০-৮০০, তেলাপিয়া ও পাঙাশের কেজি ২০০-২৫০ টাকা, চিংড়ি ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি। ইলিশের কেজি ২ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা ও জাটকা ১ হাজার টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।