![যশোরে মোটর পার্টস ব্যবসায় মন্দা](uploads/2024/05/22/jessor-(3)-1716362012.jpg)
ডলারের বিনিময় মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন যশোরের মোটর পার্টস ব্যবসায়ীরা। আমদানি খরচ বাড়ায় বেড়েছে পণ্যের দাম। এতে ভোক্তারা পার্টস কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এতে মন্দা যাচ্ছে ব্যবসার। আবার ডলারের কারণে অনেকে পণ্য আমদানি করতে পারছেন না। এর প্রভাব পড়েছে বেনাপোল কাস্টমসের রাজস্ব আহরণের ওপর। কারণ সিংহভাগ রাজস্ব আসে উচ্চ শুল্কযুক্ত গাড়ির চ্যাসিস ও মোটর পার্টস আমদানি থেকে। মোটর পার্টসের আমদানি কমে যাওয়ায় চলতি বছরের ১০ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কাস্টমসে হাজার কোটি টাকা রাজস্ব কম আদায় হয়েছে।
মোটর পার্টসের মাঝারি ও বড় ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হলেও শুল্ক-করে কোনো ছাড়ের উদ্যোগ নিচ্ছে না জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ব্যবসার খরচ কমে, এমন কোনো উদ্যোগও সরকারের তরফ থেকে দেখা যাচ্ছে না। এমনিতে ব্যবসার খরচ আগের থেকে কয়েকগুণ বেড়েছে। কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, অফিস ভাড়া ও অন্য সরঞ্জামসংক্রান্ত ব্যয়ের বোঝা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামীতে ব্যবসায়ীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও বাড়বে।
তারা বলছেন, প্রায় দুই বছর ধরে ডলারের দাম ব্যবসায়ীদের ভোগাচ্ছে । ২০২২ সালে ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা। আর বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত ডলারের দাম ১১৭ টাকা। তবে আমদানিকারকদের ডলার কিনতে হচ্ছে ১২৩ থেকে ১২৫ টাকায়। এতে পণ্য আমদানি খরচ বেড়ে গেছে।
মোটর পার্টসের বড় বাজার রয়েছে যশোরে। এখানকার আমদানিকারকরা পার্টস আমদানি করে সারা দেশে বিক্রি করেন। এখানে প্রায় দুই হাজার দোকানির ১০ হাজার কোটি টাকার অধিক বিনিয়োগ রয়েছে পার্টস খাতে। করোনাকালে এসব ব্যবসায়ীর বেশির ভাগ ছিলেন চরম আর্থিক ঝুঁকিতে। এখন ডলার সংকটে আমদানি করতে না পারায় ব্যবসা তলানিতে ঠেকেছে। আবার ভারতীয় কোম্পানির ডিলারশিপ বাতিলের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। কারণ পার্টস আমদানি করতে না পারলে তারা ঢাকার ব্যবসায়ীদের ডিলারশিপ দিয়ে দিতে পারেন। বর্তমানে পণ্য আমদানি করতে না পারায় অনেকের ব্যবসা প্রায় বন্ধের পথে। ফলে অফিস, দোকান, গুদাম ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তাদের।
যশোর-খুলনা সড়কের ফারিয়া মোটর্সের স্বত্বাধিকারী ও আমদানিকারক মুরাদ আহমেদ বলেন, ‘করোনাকালে কোনো ব্যবসা হয়নি। কোনোরকম টিকে আছি। পুঁজি ভেঙে কর্মচারীদের বেতন দিয়েছি। এখন এলসি করতে না পারায় পণ্য আনতে পারছি না। আবার ব্যাংক কোনো ঋণ দিচ্ছে না। ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার কারণে পণ্য আমদানিতে আমাদের অনেক খরচ বেড়েছে। পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে ক্রেতারা খুব প্রয়োজন ছাড়া মাল কিনছে না। সব মিলিয়ে দুর্দিন চলছে আমাদের।’
মূলত থ্রি-হুইলার ও ফোর হুইলার যানের পার্টস আমদানি করেন শহরের আরএন রোড নির্জন এন্টারপ্রাইজের মালিক সোহেল রানা। তিনি বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে গ্রাহক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা এসে এসব পার্টস নিয়ে যান। কিন্তু গত এক বছর ধরে এলসি বন্ধ থাকায় মালামাল আনতে পারছি না বললেই চলে। আবার ছোট আকারের এলসি মিললেও ডলারের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় এখন পণ্য আমদানি করলে অনেক খরচ বৃদ্ধি পাবে। ব্যাংকের ঋণের কিস্তি, দোকান ভাড়া-বাড়ি ভাড়া, কর্মচারীর বেতন দিয়ে সংসার ও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। সব মিলিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এভাবে চললে ব্যবসা ছেড়ে দিতে হতে পারে।’
মোটরসাইকেল পার্টস আমদানিকারক রিপন অটোস প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান এজাজ উদ্দিন টিপু বলেন, ‘ডলারের বিনিময় হার প্রতিনিয়িত বেড়েই চলেছে। আবার সরকার নির্ধারিত দামে ডলার মিলছে না। এতে করে পণ্য আমদানি খরচ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে বিক্রিতে। ক্রেতারা ডলারের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়টি বুঝতে চান না। আমাদের পার্টস খাতে সবারই ব্যবসায় মন্দাভাব যাচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র আমদানিকারকরা টিকতে পারছেন না।’
আরেক বৃহৎ ব্যবসায়ী মদিনা অটোসের মালিক ফারুক হোসেন বলেন, ‘মোটরসাইকেল পার্টস আমদানি করি। এসব পার্টস সারা দেশে পাঠানো হয়। করোনায় পার্টস আমদানি করে বিপাকে পড়তে হয়েছিল। তখন বিক্রি না হলেও ব্যাংকের সুদ ঠিকই দিতে হয়েছে আমাদের। এখন এলসি করতে না পেরে আরও বিপদে পড়েছি। ভারতীয় বড় কোম্পানিগুলো বলছে, পণ্য নিতে না পারলে ব্যবসা ছেড়ে দাও। পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে বুঝতে পারছি না।’
বাংলাদেশ মোটর পার্টস ও টায়ার টিউব ব্যবসায়ী সমিতি যশোর শাখার সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠান্ডু বলেন, ‘যশোরে প্রায় দুই হাজার গাড়ির পার্টস ও মোটরসাইকেল পার্টসের দোকান রয়েছে। যেখানে কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে। যার বেশির ভাগই ব্যাংক ঋণ। দুই হাজার দোকানে প্রায় ২০ হাজার কর্মচারী রয়েছেন। যাদের বেতন মাসে ৭ থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। কিন্তু এলসি করতে না পারায় বেশির ভাগ ব্যবসায়ী ব্যবসা করতে পারছেন না। কিছু বড় ব্যবসায়ী পণ্য আনলেও ডলারের কারণে খরচ বাড়ছে তাদের। এতে সব ব্যবসায়ী ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মন্দা ব্যবসা কারণে বহু পার্টস ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়েছেন।’
এদিকে বেনাপোল কাস্টমসের রাজস্ব আহরণের সিংহভাগ আসে উচ্চ শুল্কযুক্ত গাড়ির চ্যাসিস ও মোটর পার্টস আমদানি থেকে। কিন্তু এলসি না হওয়ায় মোটর পার্টসের আমদানি কমে গেছে। চলতি বছরের ১০ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কাস্টমসে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। বেনাপোল কাস্টম অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরে বেনাপোল দিয়ে মোটর পার্টস আমদানি হয়েছে দুই হাজার কোটি টাকার।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুর রহমান বলেন, ‘গাড়ির চেসিস ও মোটর পার্টস আমদানি বেশি হলে রাজস্ব আয় বাড়ে। কম শুল্কযুক্ত পণ্য আমদানি হলে রাজস্ব কমবে এটা স্বাভাবিক। এক বছর ধরে মোটর পার্টস আমদানি হচ্ছে না বললেই চলে।’
এ ব্যাপারে বেনাপোল কাস্টম হাউসের যুগ্ম কমিশনার শেফায়েত হোসেন বলেন, ‘এলসি না হাওয়ায় দেশের ব্যবসায় মন্দাভাব সৃষ্টি হয়েছে। এতে মোটর পার্টস আমদানি কমেছে। যে কারণে আমাদের রাজস্ব আয়ও কমেছে।’