হাতপাখার শীতল বাতাস ক্লান্ত শরীরে এনে দেয় প্রশান্তি। বাঙালির জীবনে হাতপাখা তৈরি ও ব্যবহার হাজার বছরের। এখনো গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দেখা মেলে নানা কারুকাজ আর রং-বেরঙের হাতপাখার ব্যবহার। নানা নকশায় শোভিত হাতপাখাকে বলা হয় নকশি হাতপাখা। আর এই নকশি হাতপাখা তৈরি ও বিক্রি করে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের কয়েকটি গ্রামের মানুষের জীবনমান বদলে গেছে। এক সময় অভাব-অনটনে তিনবেলা খাবার জোগাতে না পারলেও এখন পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনে সুখে জীবনযাপন করছেন তারা, সন্তানদের করাচ্ছেন পড়াশোনা।
উপজেলার মশাখালী ইউনিয়নের বলদি গ্রাম, মুখী গ্রাম ও রাওনা ইউনিয়নের দীঘা গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি এই হাতপাখাশিল্পের সঙ্গে জড়িত কয়েক হাজার নারী-পুরুষ। অনেক পরিবারের স্কুল ও কলেজপড়ুয়া মেয়েরাও আয় করছেন হাতপাখা তৈরি করে। নকশি হাতপাখার কাজ করেই কেউ কিনেছেন জমি, কেউ করেছেন পাকা বাড়ি কিংবা ছেলেকে পাঠিয়েছেন বিদেশে।
সরেজমিনে কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বাড়ির উঠানে কাপড় ও বাঁশ দিয়ে পাখা তৈরি করা হচ্ছে। বাঁশ কেটে পাখার চাক ও হাতল বানিয়ে দিচ্ছেন পুরুষরা। এরপর নারীরা সুঁইয়ের ফোঁড়ে বাহারি সুতায় হাতপাখায় নানা নকশাখচিত ফুল, পাখি, লাভচিহ্ন, আয়না, ডালিম, মানুষের নামের ইংরেজি অক্ষরসহ বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তুলছেন। প্রতিটি হাতপাখা তৈরিতে পাঁচজন কাজ করছেন। কেউ বাঁশের চাক তৈরি করছেন, কেউ ফুল তুলছেন বা প্রিন্ট করছেন, কেউ মুড়ি (চাক), কেউ ঝালর লাগাচ্ছেন আবার কেউবা হাতল লাগানোর কাজ করছেন।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় ৪০ বছর আগে জামুনা নামে এক নারীর হাত ধরে এই গ্রামগুলোতে নকশি হাতপাখা তৈরির কাজ শুরু হয়। ধীরে ধীরে হাতপাখা তৈরির কাজে মনোনিবেশ করেন নিম্নআয়ের কিছু নারী-পুরুষ। দিন যত যায়, ততই এই কাজে লোকজন বাড়তে থাকে। যা এখনো চলছে।
বলদি গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল হাদি বলেন, ‘এখানে আমাদের গ্রামসহ কয়েকটি গ্রাম নকশি হাতপাখার গ্রাম বলেই পরিচিতি পেয়েছে। কারণ বেশির ভাগ নিম্নআয়ের মানুষের ঘরেই নকশি হাতপাখা তৈরি করা হয়। পরিবেশবান্ধব ও দামে সস্তা হওয়ায় বাজারে এর চাহিদাও অনেক। নকশি হাতপাখা তৈরি ও বিক্রি করে নিম্নআয়ের মানুষের জীবনে এসেছে সচ্ছলতা।’
একই গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ বয়সী ফয়েজ উদ্দিন নামের আরেকজন বলেন, ‘হাতপাখার ইতিহাস বহু প্রাচীন। এটি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। বিজ্ঞানের উন্নতিতে ধীরে ধীরে হাতপাখার ব্যবহার বহুলাংশে কমে গেছে। তবে এখনো গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই দেখা মেলে হাতপাখার ব্যবহার। বিশেষ করে গরমে এর চাহিদা বাড়ায় বিক্রিও বেড়ে যায়। এই উপজেলার কয়েকটি গ্রামে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে নকশি হাতপাখা তৈরির কাজ চলছে।’
দীঘা গ্রামের গৃহবধূ কুসুম আক্তার বলেন, ‘নকশি হাতপাখা তৈরিতে লাগে বাঁশের চাক, কাপড়, সুই-সুতা, ঝালর ও হাতল। হাতপাখা বিক্রি করে ভালো লাভ হওয়ায় প্রায় ৩০ বছর ধরে হাতপাখা তৈরি করে বিক্রি করছি। দেশের নানা প্রান্ত থেকে পাইকাররা এসে হাতপাখা কিনে নিয়ে যান।’
একই গ্রামের মর্জিনা খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামী দিনমজুর হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। বাড়িতে থাকলে তিনি বাঁশ কেটে পাখার চাক ও হাতল বানিয়ে দেন। পরে নকশি হাতপাখা তৈরির পুরো কাজ আমি করি। সংসারের কাজকর্ম শেষে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫টি হাতপাখা বানাতে পারি। এতে যে টাকা আয় হয়, সেটা দিয়ে নিজের বিভিন্ন খরচ ও সংসারে কৃষিকাজসহ বিভিন্ন কাজে লাগাই। স্বামীর রোজগারের টাকা জমিয়ে রাখি।’
মর্জিনা খাতুনের স্বামী লুৎফর রহমান বলেন, ‘আমার রোজগারের টাকায় তিন ছেলেমেয়েসহ স্ত্রীর ভরণপোষণ করা খুবই কঠিন। আমার স্ত্রী ও সন্তানরা প্রতিদিন হাতপাখা তৈরি করছে। এগুলো বিক্রি করে ভালো টাকা আয় হওয়ায় আমার দুঃশ্চিন্তা কমেছে।’
মুখী গ্রামের বৃদ্ধা হেলেনা খাতুন বলেন, ‘আমি ৩০ বছর ধরে হাতপাখা তৈরি করি। হাতপাখা বানানোর আয় থেকে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়েছি, জমি কিনেছি এবং পাকা বাড়ি করেছি। আমাদের যদি সরকার একটু সহযোগিতা করত এবং সহজ শর্তে ঋণ দিত তাহলে আমরা আরও স্বচ্ছল হতে পারতাম।’
হাতপাখার পাইকার জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই উপজেলার কয়েকটি গ্রামে প্রতি সপ্তাহে লাখ লাখ হাতপাখা তৈরি হয়। প্রতিটি হাতপাখা ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় কিনে নিই। পরে এগুলো দেশের নানা প্রান্তে বিক্রি করি। কয়েকটি হাত ঘুরে প্রতিটি নকশি হাতপাখা ৫০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হয়।’
আজিজুল হক নামের আরেক পাইকার বলেন, ‘এখান থেকে কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করি। এরপর অনেকে ফেরি করে ট্রেন, বাস ও লঞ্চসহ বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন। এই উপজেলায় তৈরি নকশি হাতপাখা দেশের চাহিদা মিটিয়ে পাশের দেশ ভারতেও রপ্তানি করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে গফরগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবাইয়া ইয়াসমিন বলেন, ‘তাদের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু করার সুযোগ নেই। ক্ষুদ্র ঋণ দেওয়ার মতো অনেক প্রতিষ্ঠান গ্রামে আছে। সেখানে আবেদন করলে ক্ষুদ্র ঋণ পাওয়া যাবে।’