
দ্বিতীয় অধ্যায় : সমাজকর্ম পেশার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
সৃজনশীল প্রশ্ন ও উত্তর
উদ্দীপকটি পড়ে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।
সাইফুল আলম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। সম্প্রতি তার জেলায় ভিক্ষাবৃত্তি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। সেজন্য তিনি একটি আইন পাস করান। এ আইন অনুযায়ী দরিদ্রদের সক্ষম দরিদ্র, অক্ষম দরিদ্র ও নির্ভরশীল বালক-বালিকা, এ তিন শ্রেণিতে ভাগ করে তাদের জন্য শ্রেণি অনুযায়ী ভিক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা করেন।
(ক) দরিদ্র আইন সংস্কার-১৮৩৪-এর শ্রমাগারকে ‘দরিদ্রদের জেলখানা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন কে?
(খ) ইংল্যান্ডকে দরিদ্র আইনের ভিত্তিভূমি বিবেচনা করা হয় কেন?
(গ) উদ্দীপকে সাইফুল আলমের ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের কোন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
(ঘ) সমাজকর্ম পেশায় ইংল্যান্ডের ওই আইনের গুরুত্ব আলোচনা করো।
উত্তর : (ক) দরিদ্র আইন সংস্কার-১৮৩৪-এর শ্রমাগারকে ‘দরিদ্রদের জেলখানা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন রিচার্ড ওয়েস্টলার।
(খ) দরিদ্রদের অবস্থার উন্নয়ন, ভিক্ষাবৃত্তি রোধ, সক্ষমদের কাজ করতে বাধ্য করা কিংবা তাদের সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ইংল্যান্ড বিভিন্ন সময় এবং অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করে। মূলত দারিদ্র্য দূরীকরণ ও ভিক্ষাবৃত্তি রোধকল্পে চতুর্দশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ইংল্যান্ডে যেসব আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হয় অন্য কোনো দেশে অনুরূপ হয়নি। তাই দরিদ্র আইনের ভিত্তিভূমি হিসেবে ইংল্যান্ডকে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
আরো পড়ুন : সমাজকর্ম পেশার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট অধ্যায়ের ৫টি অনুধাবনমূলক প্রশ্নোত্তর, ২য় পর্ব
(গ) উদ্দীপকে সাইফুল আলমের ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের দরিদ্রদের শ্রেণিবিন্যাসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনটি যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য দরিদ্র ভবঘুরেদের তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়। যথা-
১. সক্ষম দরিদ্র: সবল ও কর্মক্ষম ভিক্ষুকদের সক্ষম দরিদ্র বলা হতো। এদের ভিক্ষাদান কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সক্ষম দরিদ্রদের শ্রমাগারে অথবা সংশোধনাগারে কাজ করতে বাধ্য করা হতো। যেসব সক্ষম দরিদ্র শ্রমাগারে বা সংশোধনাগারে কাজ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করত, তাদের কারাগারে পাঠিয়ে শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা হতো।
২. অক্ষম দরিদ্র: যারা কাজ করতে অক্ষম বিশেষ করে দুর্বল, বৃদ্ধ, অসুস্থ, অন্ধ, বিকলাঙ্গ এবং ছোট শিশুসহ বিধবা নারী, এদের অক্ষম দরিদ্র শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা হতো। এদের দরিদ্রাগারে রেখে সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা হতো। যদি এসব অক্ষম দরিদ্রকে কোনো বাড়ি বা আশ্রয়স্থলে রেখে কম খরচে ভরণপোষণ সম্ভব হতো, সেক্ষেত্রে তাদের চাহিদানুযায়ী খাদ্য, বস্ত্র, জ্বালানি ইত্যাদি বাহ্যিক সাহায্য দেওয়া হতো। মূলত অক্ষম দরিদ্রদের ভরণপোষণের সার্বিক দায়িত্ব সরকার বহন করত।
৩. নির্ভরশীল বালক-বালিকা: এতিম, পরিত্যক্ত ও অক্ষম পিতামাতার সন্তানদের নির্ভরশীল বালক-বালিকা হিসেবে গণ্য করা হতো। উপরিউক্ত আলোচনায় দরিদ্রদের যে শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে, তা উদ্দীপকের সাইফুল আলমের ব্যবস্থাপনায়ও অনুরূপ শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। তাই বলা যায়, উদ্দীপকে সাইফুল আলমের ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ।
(ঘ) উদ্দীপকে ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের ইঙ্গিত রয়েছে। ১৬০১ সালের দরিদ্র আইন ইংল্যান্ড তথা সারা বিশ্বের দরিদ্রদের সাহায্যার্থে ও কল্যাণে গৃহীত প্রথম পরিকল্পিত আইনগত পদক্ষেপ। এ আইনে এমন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল, যা দরিদ্রদের ভাগ্যোন্নয়নে ফলপ্রসূ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল। দরিদ্রদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দারিদ্র্য নিরসনের পদক্ষেপ এবং কর্মসূচির ভিত্তি হিসেবে সমাজকর্মের ইতিহাসে আইনটি একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
এ আইনের মাধ্যমে সাহায্যপ্রার্থী দরিদ্রদের আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনুসন্ধানের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, তা কালক্রমে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজকর্ম পদ্ধতির উন্নয়নে বিশেষভাবে সাহায্য করে। এমনকি সমাজকর্ম এ আইন থেকে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে পরবর্তী সময়ে সমৃদ্ধশালী হয়। সক্ষম দরিদ্রদের কাজের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এ আইন দরিদ্র শ্রেণির সাহায্যার্থে জনগণের ভূমিকা সম্পর্কে পথনির্দেশ করে এবং সারা বিশ্বের দরিদ্র আইন প্রণয়নের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হয়। এ আইনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের সংস্কার কর্মসূচি ও নিরাপত্তামূলক আইন প্রণীত হয়।
সার্বিকভাবে বলা যায়, দরিদ্রদের অধিকারের স্বীকৃতি, ভিক্ষাবৃত্তির বিলোপ সাধন, দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান, ব্যক্তি সমাজকর্ম পদ্ধতির বিবর্তন ও সহায়তা প্রভৃতি কারণে ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনকে আধুনিক ও পেশাদার সমাজকর্মের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাশাপাশি আধুনিক সমাজকর্মের পেশাগত মান অর্জনেও এ দরিদ্র আইনের জ্ঞান বিশেষভাবে সহায়তা করে।
তাই সমাজকর্ম পেশা ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের প্রতি বিশেষভাবে ঋণী। উল্লিখিত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয় যে, সমাজকর্ম পেশায় ১৬০১ সালের দরিদ্র আইনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।
লেখক : প্রভাষক, সমাজকর্ম বিভাগ
শের-ই-বাংলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা
কবীর