
পঞ্চম পর্ব
এখন না পরে।
প্লিজ! পরে ভুলে যাব।
আচ্ছা বলো।
কথা দাও, তুমি মনে কিছু করবে না।
মনে করার মতো হলে বলবে কেন?
তোমাকে যে বলা দরকার!
আচ্ছা বলো।
তোমার কথাবার্তা না আরেকটু স্মার্ট হওয়া দরকার।
যেমন?
আজ তোমার ব্রিফিং দেখলাম। তোমার কথাবার্তাগুলো গেও টাইপের। আরও স্মার্টলি বলা যেত। তুমি এত বছর ধরে মন্ত্রিগিরি করছ। এখনো ঠিক স্মার্ট হতে পারলে না।
তাই? স্মার্টনেস তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে?
এই তো রাগ করলে।
মন্ত্রী কোনো কথা বললেন না। তিনি অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইলেন। মেহেরুন্নেসা ভাবলেন, এখন আর কথা বলা ঠিক হবে না। তিনিও চোখ বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করেন।
৫
ইউরোপের বাজারে মোহিনীর জুতার বাজার ছিল রমরমা। মোহিনীর জুতার কাছে ইতালির বাজার ফেল। এক সময় যে বাজার ছিল ইতালির দখলে, সে বাজার পুরোটাই দখলে নিয়েছে বাংলাদেশ। এ এক বিস্ময়কর ঘটনা। এর পুরো ক্রেডিট মোহিনীকে দিতে হবে। জুতার কারখানা করার আগে তিনি দিনের পর দিন ইউরোপের বাজার ঘুরেছেন। বাজার যাচাই-বাছাই করে তার পর তিনি জুতার ব্যবসায় নেমেছেন। সেখানকার বাজারে এত বেশি চাহিদা ছিল যে, তা পূরণ করাই মুশকিল ছিল। আসলে ইউরোপের বাজারটাকে মোহিনী খুব ভালোই ধরতে পেরেছিলেন। তার জুতার নতুন নতুন স্টাইল ইউরোপীয়দের ভীষণ পছন্দ। করোনার কারণে ইউরোপের সব অর্ডার স্থগিত হয়ে গেছে। কবে আবার শুরু করতে পারবেন তা বুঝতে পারছেন না। আগে অর্ডারগুলোর জুতা তৈরি হয়ে গেছে। নিজেদের গোডাউন ছাড়াও বাড়তি দুটি গোডাউন ভাড়া করা হয়েছে। নতুন অর্ডার না আসা পর্যন্ত কারখানায় কোনো কাজ নেই। তাই অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দিতে হচ্ছে। অবশ্য কিছু কর্মীকে দিয়ে মোহিনীর মানবিক কাজগুলো করানো হচ্ছে।
মোহিনীর অফিসও সীমিত আকারে খোলা রাখা হয়েছে। বেশির ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারীর তেমন কোনো কাজ নেই। সঙ্গত কারণেই তাদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বেতন ঠিকই দিতে হচ্ছে। ব্যাংকের জমা টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই করার নেই। মোহিনীর নীতি অনুযায়ী ধার করে হলেও সবার বেতন প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যেই তাকে দিতে হবে। মোহিনীর বাবা মোহসীন আহমেদও এই কাজটিই করছেন। কিন্তু করোনাকাল যদি আরও কয়েক মাস অব্যাহত থাকে তখন কী হবে? কী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হবে তা নিয়ে বাবা ও মেয়ে আলোচনায় বসল।
মোহসীন আহমেদ মোহিনীর কাছে জানতে চান, তোমার কী পরিকল্পনা তা আগে শুনি। তার পর আমি বলব। তোমার মাকেও ডাকো। সেও জানুক। তার যদি কোনো পরামর্শ দেওয়ার থাকে দিতে পারে।
মোহিনী আনোয়ারা বেগমকে ডাকলেন। মা মা...
আনোয়ারা বেগম বসার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, কি হলো মোহিনী?
এসো না মা। আমরা আলোচনায় বসেছি। তুমিও এসো।
আমি তোদের ব্যবসাপাতি অত বুঝি না। ওসব তোরা বাপবেটি সামলা। আমি ঘর সামলাচ্ছি। ঘরই সামলাই।
কে বলল মা? তুমি সবই বোঝ। তুমি আমাকে যতগুলো পরামর্শ দিয়েছ সবগুলোই খুব কাজে দিয়েছে।
তাই নাকি? যাক শুনে ভালো লাগল।
তোর বাবাকেও অনেক পরামর্শ দিয়েছি। কিন্তু তার কাছ থেকে একটা ধন্যবাদও পাই না।
মোহসীন আহমেদ বললেন, কি যে বলো! ধন্যবাদ দিতে দিতে মুখে ফেনা তুলে ফেললাম।
এই শোন তোর বাবার কথা! কবে কখন ধন্যবাদ দিয়েছ?
না দিয়ে থাকলে সরি। অনেক ধন্যবাদ। এবার বসে আমাদের কথা মন দিয়ে শোন। এখন একটা ভয়ংকর বিপদের সময়। এ সময় পরিবারের সবারই বুদ্ধি-পরামর্শ দরকার। ব্যাপারটা হচ্ছে, করোনা ডিসেম্বরেও যাবে কি না সন্দেহ। সবাই বলছে, দ্বিতীয় একটা ধাক্কা আসবে। সেটা আরও বড় হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। করোনা তো ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা। কাজেই শীতের সময় বাড়ার আশঙ্কা সবাই করছে। এই শীতটা পার করতে পারলে হয়তো আমরা সবাই বেঁচে যাব। তা না হলে আমাদের বয়সী লোকজন খুব বেশি থাকবে না। দেখছ না, সবই বয়স্ক লোক মারা যাচ্ছে। আসলে বয়স্ক নারী-পুরুষদের ইমিউন সিস্টেম দুর্বল! তাই তাদের ঝুঁকি বেশি। যা হোক, আমাদের আলোচনার বিষয় আমরা কীভাবে সারভাইভ করব? এ বিষয়ে আমি মোহিনীর কাছে জানতে চেয়েছি।
মোহিনী বললেন, আমাদের মূল বাজারই তো ইউরোপ। সেখানে সব অর্ডার স্থগিত হয়ে গেছে। এগুলো আমরা পাঠাতে পারব। তবে করোনা শেষ না হওয়ার আগে কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমরা কিছু অগ্রিম পেমেন্ট পেয়েছিলাম। তা দিয়ে আমরা সব অর্ডার রেডি করে ফেলেছি। আমাদের নিজেদের গোডাউনে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় দুটি গোডাউন ভাড়া নিয়েছি। কিন্তু করোনার পর নতুন কোনো অর্ডার আমরা পাইনি। এখন কারখানা বন্ধ। কবে খুলতে পারব তা বুঝতে পারছি না।
হুম। তুমি তো এখনো কারও বেতন বন্ধ করোনি? মোহসীন আহমেদ জানতে চাইলেন।
না। সবাইকেই বেতন দিয়ে যাচ্ছি। কিছু ছিল ডে-লেবার। দৈনিকভিত্তিতে কাজ করত। তারা সবাই গ্রামে চলে গেছে। তারা ছাড়া সবাই বেতন পাচ্ছে।
আমি ২০২১-এর মার্চ পর্যন্ত দিতে পারব। তার পরও যদি শিপমেন্ট করতে না পারি তখন সমস্যায় পড়ব। সেটা অবশ্যই অনেক বড় সমস্যা হবে।
তোর সব মিলিয়ে কত আসে বেতন? আনোয়ারা বেগম জানতে চাইলেন।
মোহিনী বলল, আড়াই কোটি।
কম না তো!
মোহসীন আহমেদ বললেন, আমার আসে ছয় কোটির মতো। তবে পাঁচ কোটির মতো ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। আমিও মার্চ পর্যন্ত ধরে রেখেছি। আশা করি, মার্চ পর্যন্ত টিকতে পারলে আর কোনো সমস্যা হবে না। কী বলো আনোয়ারা?
আমার তো মনে হয় সর্বোচ্চ ডিসেম্বর। তার পর করোনার কোনো ইফেক্ট থাকবে না।
মোহসীন আহমেদ স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে বললেন, আমারও তাই মনে হয়। এখনই তো মানুষ নেমে গেছে। মৃত্যুর হারটা কমে গেলেই মানুষ আর ঘরে থাকবে না।
আনোয়ারা বেগম বললেন, সেটাই বোধহয় ভালো। মানুষ বের না হলে খাবে কী? তাকে তো টিকে থাকতে হবে! দেখছ না, শুরুর দিকে মানুষের মধ্যে কেমন একটা হাহাকার ছিল। মানুষ যখন বের হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তখন কিন্তু হাহাকার অবস্থাটা কেটে গেছে।
মোহিনী সহমত পোষণ করে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ মা। আমাদের মতো দেশে পুরোপুরি লকডাইন করে রাখা সম্ভব না। উন্নত দেশগুলোই তো হিমশিম খাচ্ছে। তবে করোনার ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে আমি সরকারের ভূমিকার প্রশংসা করি।
চলবে...
আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন-