আপনি কি কখনো ভেবেছেন পৃথিবীতে কোন ঝড়ের গতি সবচেয়ে বেশি ছিল? অথবা কোন গ্রহে ঝড়ের গতি সবচেয়ে বেশি?- এ প্রশ্নের উত্তর খুবই আকর্ষণীয়। তাই বিজ্ঞানীরাও এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে বছরের পর বছর কাজ করে যাচ্ছেন।
১৯৩৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের মাউন্ট ওয়াশিংটন অবজারভেটরিতে ঝোড়ো বাতাসের গতিবেগ রেকর্ড করা হয় প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৩৭২ কিলোমিটার, যা ‘বিগ উইন্ড’ নামে পরিচিত। আবার ২০১৭ সালে হারিকেন ইরমার বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ২৯৮ কিলোমিটার, যার আঘাতে ছাদ উড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে গাছ উপড়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটেছে।
তা হলে এখন পর্যন্ত রেকর্ড করা ঝড়ের সর্বোচ্চ গতি কত? এ প্রশ্নের উত্তর বাতাসের উৎস, অবস্থান এবং পরিমাপের যন্ত্রের ওপর নির্ভর করে।
সৌরজগতে সবচেয়ে শক্তিশালী বাতাসের প্রবাহ পাওয়া যায় নেপচুন গ্রহে। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার তথ্য অনুসারে, সেখানে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১ হাজার ১০০ মাইল বা ১ হাজার ৭৭০ কিলোমিটার গতিতে বাতাস প্রবাহিত হয়, যা শব্দের গতির দেড় গুণ।
পৃথিবীতে কৃত্রিমভাবে তৈরি সুপারসনিক উইন্ড টানেলেও শব্দের চেয়ে দ্রুতগতির বায়ুপ্রবাহ তৈরি করা যায়। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠে প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ২২৫ কিলোমিটারের চেয়ে বেশি গতির ঝড়কে সুপারসনিক বলা হয়। নাসার গ্লেন রিসার্চ সেন্টারের ১০×১০ সুপারসনিক উইন্ড টানেলে ঘণ্টায় প্রায় ৪ হাজার ৩২১ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের গতি তৈরি করা সম্ভব।
আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএমও) পরিচালিত ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যান্ড ক্লাইমেট এক্সট্রিমস আর্কাইভ অনুযায়ী, প্রাকৃতিকভাবে রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ বাতাসের গতি ছিল প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৪০৭ কিলোমিটার। এই গতি রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৯৬ সালের ১০ এপ্রিল অস্ট্রেলিয়ার ব্যারো আইল্যান্ডে ট্রপিক্যাল সাইক্লোনের সময়। ট্রপিক্যাল সাইক্লোন হারিকেনের মতোই একটি ঘূর্ণিঝড়। তবে এটি সাধারণত দক্ষিণ প্যাসিফিক ও ভারত মহাসাগরে দেখা যায়। ব্যারো আইল্যান্ডের আবহাওয়া স্টেশনে অ্যানিমোমিটার নামের বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যেমে এই বাতাসের গতি পরিমাপ করা হয়। তখন মাত্র ৩ থেকে ৫ সেকেন্ডের জন্য এই তীব্র বায়ুপ্রবাহ রেকর্ড করা হয়।
ব্যারো আইল্যান্ডে বায়ুপ্রবাহের রেকর্ডের সত্যতা নিশ্চিত করতে এক দশক লেগেছে আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার। অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির জিওগ্রাফিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক র্যান্ডাল সার্ভেনি জানান, অস্ট্রেলিয়ার এই দ্বীপ জ্বালানি তেল কোম্পানি শেভরনের মালিকানাধীন হওয়ায় তথ্যটি প্রাথমিকভাবে নজরে আসেনি। সার্ভেনি আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার আবহাওয়া ও জলবায়ুর চরম ঘটনা পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন। তার দল অস্ট্রেলিয়া সফর করে ওই দ্বীপে ব্যবহৃত অ্যানিমোমিটারটি পরীক্ষা করেন। এরপর নিশ্চিত হন, রেকর্ডটি স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে। ফলে ওই রেকর্ডকৃত বাতাসের গতিবেগ নির্ধারণে কোনো ভুল ছিল না।
আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থা শুধু সরাসরি পরিমাপ করা তথ্যকে রেকর্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সার্ভেনি জানান, ব্যারো আইল্যান্ডের গতির চেয়ে দ্রুত গতিবেগের রেকর্ড পাওয়া গেছে, তবে সেগুলো অনুমান বা হিসাবভিত্তিক যন্ত্র দিয়ে পরিমাপ করায় সেগুলো রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অ্যানিমোমিটারে পরিমাপের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। এগুলো প্রচণ্ড বাতাসে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কেবল সেখানেই স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে মানুষ যেতে পারে। যেমন- জেট স্ট্রিমে বাতাস প্রতি ঘণ্টায় ৪৪৩ কিলোমিটার গতিতে প্রবাহিত হতে পারে। সেখানে অ্যানিমোমিটার স্থাপন করা বেশ কঠিন।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়ের খোঁজে বিজ্ঞানীরা টর্নেডোর গতিবেগ নিয়ে নতুন নতুন তথ্য উন্মোচন করেছেন। জাপান ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের ওপরে দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৮৩ কিলোমিটার বেগে বয়ে চলা বাতাসপ্রবাহের রেকর্ড তদন্ত করছেন সার্ভেনি ও তার দল। এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা গেলে, এটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঝড়ের গতি হিসেবে নতুন স্বীকৃত পেতে পারে।
এই তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে রেডিওসন্ড নামক একটি যন্ত্রের সাহায্যে, যা একটি আবহাওয়া বেলুনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই যন্ত্র বায়ুমণ্ডলে উঠে গিয়ে সরাসরি বাতাসের গতি পরিমাপ করে। সার্ভেনি বলেন, ‘এটি হতে পারে আমাদের দেখা পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী বায়ুপ্রবাহের মধ্যে একটি।’
অন্যদিকে, ঝড়ের গতি পরিমাপের আর একটি উপায় হলো ডপলার প্রযুক্তির রাডার। তবে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা রাডারের তথ্যকে সর্বোচ্চ ঝড়ের গতির রেকর্ড হিসেবে গণ্য করে না। কারণ রাডার দূর থেকে আনুমানিক হিসাব করে গতি পরিমাপ করে, সরাসরি পরিমাপ করে না। ইউনিভার্সিটি অব আলাবামার ফ্লেক্সিবল অ্যারে অব রাডারস অ্যান্ড মেসোনেটমসের পরিচালক জশুয়া ওয়ারম্যান বলেন, ‘রাডারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- এটি দূরবর্তী জিনিস পরিমাপ করতে পারে। রাডার দিয়ে দ্রুত গতিসম্পন্ন টর্নেডোর গতিও পরিমাপ করা যায়।
টর্নেডোর রহস্য উন্মোচনে নতুন মাত্রা
টর্নেডো বা ঘূর্ণিঝড় প্রকৃতির এক বিশাল শক্তির প্রকাশ। এই শক্তিশালী বায়ুবৃত্তের গতি কতটা হতে পারে, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুকাল ধরে গবেষণা করে আসছেন। জশুয়া ওয়ারম্যান টর্নেডোর গতি পরিমাপে ব্যবহার করছেন ‘ডপলার অন হুইলস’ নামের একটি বিশেষ রাডার। এই রাডারটি একটি ট্রাকে বসানো থাকে। এর সাহায্যে টর্নেডোর খুব কাছাকাছি গিয়েও নিরাপদে তথ্য সংগ্রহ করা যায়।
রেকর্ড ভাঙার সম্ভাবনা
১৯৯৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমার ব্রিজ ক্রিকে ঘণ্টায় প্রায় ৪৮৬ কিলোমিটার বেগে একটি টর্নেডো আঘাত হানে। এটি দীর্ঘদিন ধরে সর্বোচ্চ গতির টর্নেডো হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। তবে ২০২৪ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়ার গ্রিনফিল্ডে একটি টর্নেডোর গতি ঘণ্টায় ৪৯৭ থেকে ৫১২ কিলোমিটারের মধ্যে ছিল বলে ওয়ারম্যানের দলের গবেষণায় উঠে এসেছে। যদিও রাডারের পরিমাপে কিছুটা ত্রুটি থাকতে পারে। তবে এই নতুন তথ্য পুরোনো রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ওয়ারম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, খুব কম ক্ষেত্রেই টর্নেডোর গতি ঘণ্টায় ৪৮৩ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়। সম্ভবত ঘণ্টায় ৬৪৪ কিলোমিটারের বেশি গতিবেগের কোনো টর্নেডোই নেই। কারণ আমরা এখনো এত উচ্চগতির কোনো টর্নেডো দেখিনি।’
বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে ঝড়ের গতি আরও সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব হবে।