তৃতীয় দফার নির্বাচন শেষ হওয়ার পরও সরকারপক্ষ, অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি এবং আরএসএস নিশ্চিত হতে পারছে না, তারা ৪০০ আসন পাবে কি না। নির্বাচন শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রচারে নেমেছেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ এবং আরএসএস-প্রধান মোহন ভাগবত।
তাদের কোনো বক্তৃতায় উন্নয়ন, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কথা নেই। শুধু গান্ধী পরিবারকে কুৎসিত ভাষায় গালাগালি রয়েছে। যেসব শব্দ তারা ব্যবহার করছেন টিভির পর্দায় সরাসরি দেখালেও ছাপার অক্ষরে তা লেখা যায় না।
সাত দফার মধ্যে তিন দফা ভোট গ্রহণ হয়ে গেলেও মোদি এখনো ৪০০ আসন পাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত নন। গোড়া থেকেই ৪০০ আসন পেয়ে সংবিধান সংশোধনের যে ডাক তিনি দিয়েছেন, তা কতটা কার্যকর হবে, নিজেও জানেন না।
সংবিধান সংশোধন করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের গো-মাংস ভক্ষণ বন্ধ করতে চাইছে মোদি সরকার। তৃতীয় দফার নির্বাচনের পর মোদি এখন উন্নয়ন-সংক্রান্ত সব কথাবার্তা বাদ দিয়ে গান্ধী পরিবার এবং সংখ্যালঘু দমন নিয়ে পড়েছেন। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিলেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে। কিন্তু মোদি সে অভিযোগের এখনো কোনো জবাব দেননি।
বিজেপি-আরএসএসের কটূক্তির জবাব দিয়েছেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য, তথা ইন্দিরা গান্ধীর নাতনি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। প্রিয়াঙ্কা মোদিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, গান্ধী পরিবার শহিদ পরিবার। শহিদ পরিবারকে অপমান করা ভারতবর্ষের মানুষ মেনে নেবে না। তিনি বলেন, আমার ঠাকুমা ইন্দিরা গান্ধীকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল, সে ব্যাপারে বিজেপি আরএসএসের কোনো ক্ষোভ, দুঃখ কিছুই নেই। আর ৯১ সালে নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে দক্ষিণ ভারতে তিরুঅনন্তপুরমে মানববোমার হানায় আমার বাবার দেহটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই দৃশ্য দেখেও আরএসএস উল্লসিত হয়েছিল। কেন হয়েছিল তা জানি না। তবে এই আরএসএসেরই অপর এক ব্যক্তি মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা মোদিজির মনে পড়ে না। আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, এ ধরনের প্রচার আপনি বন্ধ করুন। আমার দাদা রাহুল গান্ধী দুই বছর ধরে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরেছেন। দেখেছেন মানুষের দুর্দশা, হতাশা। তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় আনার জন্যই কংগ্রেসের নির্বাচনি ইশতেহারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় করার কথা ঘোষণা করেছেন।
শুধু কংগ্রেস নয়, গত তিন-চার দিন ধরে INDIA জোটের সব শরিকই পৃথকভাবে বিবৃতি দিয়ে রাহুলের দাবি সমর্থন করেছেন। প্রিয়াঙ্কার বক্তব্যের পরও বিজেপি-আরএসএস মুখে কুলুপ এঁটে আছে। বুধবারও বিভিন্ন জনসভায় মোদির বক্তব্য- সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিশেষ কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে না। বিজেপি দেবে না।
ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব মুসলিম লিগ প্রধান আসাফউদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, আমি কংগ্রেসবিরোধী। কিন্তু রাহুলের সংখ্যালঘু সংরক্ষণের প্রস্তাব পূর্ণ সমর্থন করি। চিরদিনের কংগ্রেসবিরোধী আসামের রাজনীতিবিদ বদরুদ্দিন বুধবার একাধিক জনসভায় বলেছেন, মুসলিমদের সংরক্ষণ নিয়ে রাহুলের চিন্তার সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত।
শুধু রাজনৈতিক নেতারা নন, দিল্লির একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি চ্যানেল এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা চালায়। সেই সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৯৬ শতাংশ মানুষই রাহুলের এই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়েছেন।
INDIA জোটের সংসদীয় বোর্ডের চেয়ারম্যান, তথা সাবেক কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী মঙ্গলবার মধ্যপ্রদেশে নির্বাচনি প্রচারে গিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক ফায়দার জন্যই ঘৃণাভাষণ দিয়ে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি আরও বলেন, হঠাৎই উন্নয়নের প্রচার বাদ দিয়ে সুস্পষ্ট মেরূকরণের পথে হাঁটছেন মোদি। তৃতীয় দফার ভোটপর্বে মোদি অস্ত্র করেছেন ‘ভোট জিহাদ’কে। তীব্র ঘৃণাভাষণ ছড়িয়ে মোদিকে এ কথাও বলতে শোনা গেছে যে, বিজেপিকে ৪০০ আসন পাইয়ে দিতেই হবে। তা না হলে রামমন্দিরে তালা দিয়ে দিতে পারে কংগ্রেস।
এ প্রসঙ্গে মোদি সরাসরি কংগ্রেসকেই দায়ী করছেন। অর্থাৎ মোদির অভিযোগ ভোট জিহাদের নামে একটা নির্দিষ্ট ধর্মের লোকদের একজোট হয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে ভোট দিতে বলছেন রাহুল গান্ধী। এদিকে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা বলছে, প্রচারে আসলে মোদির হাতে কোনো ইতিবাচক অস্ত্র নেই। তাই ফের কড়ামাত্রার হিন্দুত্বের দিকেই ঝোঁক মোদি এবং অমিত শাহর। আর মোদির এই অস্ত্রকে ভোঁতা করতে কংগ্রেস মূলত তাদের আর্থসামাজিক প্রচারকেই তুলে ধরছে। সোনিয়া গান্ধীও এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, দেশের যুব সম্প্রদায় চরম বেকারত্বের সম্মুখীন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলছেন- এবার ভারতের নির্বাচনে ‘রাম’ আর মানুষ খাচ্ছে না।
লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক