ঢাকা ৯ ভাদ্র ১৪৩১, শনিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৪

ট্রাম্পের হত্যাচেষ্টা: রাজনৈতিক সহিংসতার এক ভয়ঙ্কর রূপ

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২৪, ১১:১৫ এএম
ট্রাম্পের হত্যাচেষ্টা: রাজনৈতিক সহিংসতার এক ভয়ঙ্কর রূপ
ময়রা ডোনেগান

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার বাটলারে নির্বাচনি প্রচারের সমাবেশে একজন হত্যাকারী এই চেষ্টা করে। এতে একজন দর্শকের প্রাণহানি ঘটে এবং বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হন। 

হত্যাচেষ্টাকারীও মারা গেছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডান কানে সামান্য আঘাত পেয়েছেন এবং তাকে হাসপাতালে নিয়ে প্রাথমিক সেবা দেওয়া হয়েছে। যদিও এখন হত্যাকারীকে শনাক্ত করা এবং তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা জায়নি। ঘটনাটি তীব্র রাজনৈতিক সহিংসতার ভয়াবহ যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে আমরা বাস করছি।

আমেরিকার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতা চলছে। ২০১১ সালে অ্যারিজোনায় একটি নির্বাচনি প্রচারে গুলিতে আহত হয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটিক কংগ্রেস নারী গ্যাবি গিফোর্ডস। ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড রিগানকে অভিনেতা জোডি ফস্টার নামে একজন গুপ্তহত্যাকারী দিয়ে হত্যা প্রচেষ্টাকালে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান।

কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা ভোটাধিকার প্রয়োগের সময় সহিংস নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছেন। যেটি কয়েক দশক ধরে দেশের বেশির ভাগ অংশে শুধু আইনের মাধ্যমে নয়, বরং শক্তির প্রভাব খাটিয়ে শ্বেতাঙ্গদের জন্য বিশেষ সুবিধা রাখা হয়েছিল। ট্রাম্পের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিতে রয়েছে ধর্মান্ধতা, উগ্র রাজনৈতিক উপজাতিবাদ এবং তার পছন্দকে বেশি প্রয়োগ করার অনুমতি দিতেন। ট্রাম্প তার বিপক্ষের লোকদের শারীরিক সহিংসতার মাধ্যমে শাস্তি দিতেন। ২০১৬ সালে তার প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নির্বাচনি সমাবেশে প্রচারের সময় সহিংসতার শিকার হন। সমর্থকরা প্রায়ই প্রতিবাদকারী এবং গণমাধ্যমের সদস্যদের ওপর আক্রমণ করতেন।

ট্রাম্প-সমর্থকরা তার বিপক্ষের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর সহিংসতা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন। ২০১৮ সালে ফ্লোরিডাভিত্তিক ট্রাম্প-সমর্থক সিজার সায়োক একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী পরিচালনা করেন। তিনি বারাক ওবামা, হিলারি ক্লিনটন, জন ব্রেনান, রবার্ট ডি নিরো, আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ, জো বাইডেনসহ বিভিন্ন প্রেসিডেন্টদের ক্ষতি করার চেষ্টা করেন। ২০২২ সালে ডেভিড ডিপেপ নামে একজন ট্রাম্প-সমর্থক হাউস স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সান ফ্রান্সিসকোর বাড়িতে ঢুকে পড়েন এবং তার স্বামী পল পেলোসিকে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। 

আধিপত্যের নৃশংস ও হিংসাত্মক রাজনীতির জন্য ট্রাম্পের উৎসাহ সংক্রামক ব্যাধির মতো বলে মনে হয়। রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে এই ধরনের রাজনীতির অনেক অনুসারী রয়েছেন। ২০১৮ সালে মন্টানার  প্রতিনিধি গ্রেগ জিয়ানফোর্ট তার কংগ্রেসনাল পুনর্নির্বাচন প্রচারের সময় হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এর জন্য ট্রাম্প প্রশংসা করেছিলেন।  

ট্রাম্প বলেছেন, ‘যেকোনো লোকই হোক না কেন, সে যদি আঘাত করতে পারে, সে আমার লোক’ জিয়ানফোর্ট যখন অপকর্মের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তখন থেকেই তিনি মন্টানার গভর্নর হয়েছেন। ট্রাম্পের ক্ষুব্ধ ও হিংস্র সমর্থকরা ২০২০ সালের নির্বাচনের ফল উল্টে দেওয়ার প্রয়াসে কংগ্রেসে হামলা করেছিলেন। সেখানে তারা কংগ্রেস সদস্যদের অপহরণ ও আক্রমণ করার হুমকি দিয়েছিলেন। 

ট্রাম্পের প্রভাব, তার স্পষ্ট দিকনির্দেশনা ও তর্ক  আমেরিকার রাজনৈতিক সহিংসতাকে আরও  বাড়িয়ে তোলে। ফলে দেশের কেন্দ্রীয় রাজনীতি আরও রক্তাক্ত রূপ ধারণ করে। ট্রাম্পের নির্বাচনি সমাবেশে এই প্রথম তাকে হত্যার প্রচেষ্টা করেছে। এখন  মনে হয় সময় পরিবর্তন হয়েছে। এই ধরনের সহিংসতা এই প্রথম ছোড়া হলো। 

পরবর্তী সময়ে যা ঘটবে তা আরও বিপজ্জনক হতে পারে। ট্রাম্প বুলেট এড়ানোর পর সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টরা তাকে ঘিরে ফেলেন। যারা তাকে মানবঢাল হিসেবে ঘনিষ্ঠভাবে ঘিরে রেখেছিলেন। ট্রাম্প মঞ্চে উঠেছিলেন এবং তাদের ইচ্ছাকে তুচ্ছভাবে অমান্য করলেন। তিনি মুখ উঁচিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন ‘ফাইট’। ট্রাম্প তখন খুবই প্রতিবাদী ছিলেন এবং প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ট্রাম্প-সমর্থকদের সতর্ক হওয়া উচিত। তাদের ওপর সহিংসতার ঝুঁকি রয়েছে। এর অর্থ হলো, ট্রাম্পের নেতাদের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার বা শাস্তি দেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাবে। ট্রাম্প বা তার সহযোগীদের এই ধরনের হুমকি বা ঝুঁকি থেকে প্রতিরোধ করার কোনো প্রচেষ্টা নেই। এটা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। তারা কেনই বা করবে? তারা আগেও কখনো করেনি। 

হত্যাচেষ্টাকারী সম্পর্কে তথ্য প্রকাশের আগে ট্রাম্পের সমর্থকরা হামলার জন্য বিডেনকে দোষারোপ করছিলেন। জো বাইডেনের নির্বাচনি প্রচারের মূল ভিত্তি হলো যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী, তাকে যেকোনো মূল্যে হলেও থামাতে হবে।  জেডি ভ্যান্স, যিনি ওহাইও সিনেটর এবং ট্রাম্পের দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট টুইট করেছিলেন যে ট্রাম্পের উদ্ধত্যপূর্ণ বক্তৃতার কারণে তাকে হত্যার চেষ্টার প্রচেষ্টা হতে পারে। 

জর্জিয়ার রিপাবলিকান মাইক কলিন্স প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, জো বাইডেন আদেশ পাঠিয়েছেন। গুপ্তহত্যার চেষ্টায় কোনো গাম্ভীর্য নেই।  আমেরিকা কতটা নিচে নেমে গেছে, তা ভাবা যায় না।  এর কোনো তেমন প্রতিফলন দেখা যায়নি। আছে শুধু নোংরা রাজনীতি এবং একক স্বার্থপরতা। যতটা সম্ভব সহিংসতা থেকে লাভবান হওয়ার রাজনীতি এখন আমেরিকায়। 

এদিকে ডেমোক্র্যাটরা নতুনভাবে কোনো চিন্তা করছেন না। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা ট্রাম্পের নিরাপত্তার জন্য একটি বিবৃতি জারি করেছেন। তারা বলেছেন, আমাদের রাজনীতিতে সহিংসতার কোনো স্থান নেই। এটি ঠিক নয়। সহিংসতা এখন আমেরিকান রাজনৈতিক জীবনের একটি কেন্দ্রীয় অংশ। আমরা শিগগিরই এটি থেকে মুক্তি পাব না।

লেখক: গার্ডিয়ান কলামিস্ট
গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ: সানজিদ সকাল

বিশেষ সাক্ষাৎকার: ড. সদরুল আমিন সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১১:০৯ এএম
আপডেট: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১১:১০ এএম
সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে
ড. সদরুল আমিন

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর দেশকে এগিয়ে নিতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, এ ক্ষেত্রে সরকারের করণীয় কী- এসব বিষয় নিয়ে খবরের কাগজকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সাবেক ডিন এবং ইংরেজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. সদরুল আমিন। তিনি ২০০৭ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খবরের কাগজের সিনিয়র সহসম্পাদক সানজিদ সকাল

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকারকে আপনি কীভাবে দেখছেন এবং আপনার প্রত্যাশা কী? 

ড. সদরুল আমিন: দেশের ক্রান্তিকাল মুহূর্তে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়েছে, এটিই বড় সফলতা। ছাত্ররা যা করল, বিগত ১৭ বছরে তা কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারেনি। ছাত্রদের সবার পক্ষ থেকে সাধুবাদ দেওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকার গঠন আরেকটা কৃতিত্ব। তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। 

যদি সেনাবাহিনী সহযোগী ভূমিকা পালন না করত, তাহলে এই সরকার গঠন করা যেত না। সেনাবাহিনীর স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা ছিল আমাদের জন্য অভাবনীয় শক্তি। এবারের অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা সবাই অভিজ্ঞ। ড. ইউনূস সাহেবকে আমি ব্যক্তিগতভাবে জানি। তিনি অত্যন্ত নির্লোভ এবং দেশের জন্য নিবেদিতভাবেই কাজ করবেন। 

তিনি যে কমিটমেন্ট নিয়ে দেশে কাজ করছেন, আশা করি সফল হবেন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে এবং সময় দিতে হবে। এখন রাস্তাঘাটে যারা বিভিন্ন সুবিধার জন্য দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছে, তারা বর্তমান সরকারের বিপক্ষ গোষ্ঠী বা দেশের শত্রু বলে আমি মনে করি। যারা বিভিন্ন দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে, তাদের থামিয়ে দেওয়া উচিত। পরবর্তী সরকার গঠন হলে তখন তাদের দাবি তুলে ধরা উচিত। 

এই সরকারকে সংস্কারের কাজ করতে দেওয়া উচিত। ড. ইউনূসের ওপর আমার বিশ্বাস যে, তিনি সবকিছু সামলে এগিয়ে যাবেন। আমি ড. ইউনূসকে সাধুবাদ জানাই। 

খবরের কাগজ: বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরে আসবে কি? আপনার অভিমত জানতে চাই। 

ড. সদরুল আমিন: গণতন্ত্র অবশ্যই ফিরে আসবে। দেশের ভেতরে ও বাইরে কেউ যদি এই সরকারকে প্রতিহত করে, তাহলে গণতন্ত্র ফিরতে আরও বেশি সময় লাগবে। কোনো দেশে এ রকম গণ-অভ্যুত্থান হওয়ার পর স্থিতিশীল থাকে না। কেউ যদি এই সরকারকে বিরক্ত না করে, তাহলে অবশ্যই গণতন্ত্র ফিরে আসবে। 

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না? ড. ইউনূসের কারণে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ বিশেষ কোনো সুবিধা পাবে কি? আপনার অভিমত জানতে চাই। 

ড. সদরুল আমিন: ড. ইউনূসের সুনাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। তার কারণে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। দেশ ভঙ্গুর অবস্থায় যাবে- এমন নীতি তিনি কখনোই করবেন না। বাংলাদেশ খুব ছোট এবং গরিব একটি দেশ। কেউ যদি বাইরে থেকে এসে ক্ষতি করতে চায়, তাহলে অবশ্যই আমাদের সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। 

আমাদের তখন অন্য দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। আমাদের সেনাবাহিনী ঢেলে সাজাতে হবে। সবার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সব সময় সুসম্পর্ক রাখা উচিত। আমরা যখন বিদেশে যাই, তখন ভারতীয়দের দেখলে একদম আপন মনে হয়। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ আমাদের ভাইবোনের মতো। শেখ হাসিনা যখন ভারত গেলেন, তখন নরেন্দ্র মোদি অনেক সহযোগিতা করেছেন। 

এমনকি রাজীব গান্ধীর পরিবারও তাকে এবং তার পরিবারকে ভালোবাসে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, কেউ শেখ হাসিনাকে প্রশ্ন করল না যে, কেন ভারতে এসেছেন। অবশ্য তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, কী করেছেন এবং কেন ভারতে এসেছেন? অথচ তাদের জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল যে, কেন বাংলাদেশে হাজারের ওপর মানুষ মারা গেল। কেন দেশে এত ধ্বংসযজ্ঞ হলো। আমি কখনোই পাবলিক এবং প্রাইভেট সম্পত্তি ধ্বংস চাই না। দেশের যারা শত্রু, তারাই এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করে থাকে। 

খবরের কাগজ: পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

ড. সদরুল আমিন: দেশের ক্রান্তিকালে দুষ্কৃতকারীরা এ ধরনের লুটপাট ও ধ্বংসাত্মক কাজ সব সময় করে থাকে। পুলিশকে আমি খুব সম্মান করি। কারণ বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত কর্মঠ। 

আমি বহুদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদের ডিন ছিলাম, পুলিশ সব সময় আমাকে সহযোগিতা করেছে এবং কোনো সংঘর্ষে জড়ায়নি। পুলিশকে জনগণের বন্ধু হিসেবে ভাবা উচিত। পুলিশকে জনগণের কাজে লাগানো উচিত। তারা আমাদের পরিবারের অংশ। তারা আমাদের উপকার করলে আমরাও তাদের বিপদে এগিয়ে যাব। কেউ কারও শত্রু নয়। 

খবরের কাগজ: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের পদত্যাগের কারণে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কী করা উচিত বলে মনে করেন? 

ড. সদরুল আমিন: রাজনীতি খারাপ জিনিস নয়। কিন্তু সেই রাজনীতিকে যদি খারাপভাবে ব্যবহার করি, তাহলে সেটা খারাপ জিনিস। আমি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ক্লাসে পড়ানোর সময় কেউ আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেনি। কিন্তু গত ১৫ বছরে একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্ররা হলে থাকতেই পারেনি। 

রাজনীতিকে এভাবে ব্যবহার করা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পরিবর্তন আনা দরকার। যদি আবাসিক হলগুলোতে পুরোনো ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আবারও রাজনীতিকে খারাপভাবে ব্যবহার করবে। সবকিছু গণতান্ত্রিকভাবে হওয়া উচিত। ছাত্ররা অবশ্য রাজনীতি করবে। রাজনীতি না করলে দেশে রাজনীতিবিদ কারা হবে? কিন্তু রাজনীতিরও একটা সীমা থাকা উচিত। ছাত্ররাই তো সবকিছু করবে।
 
খবরের কাগজ: ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর বিপক্ষে এবং ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখছেন কি না?

ড. সদরুল আমিন: ২০০৭ সালে যখন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলনে নামে, তখন আমি ছিলাম শিক্ষক সমিতির সভাপতি। তখনকার প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। শিক্ষকদের তখন স্বাধীন ভূমিকা ছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পর আমরাই আন্দোলন করেছি। আমরা কিন্তু কখনোই সেনাবাহিনীবিরোধী নই। দেশকে রক্ষা করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করি। 

সেনাবাহিনী তখন আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছে। অবশেষে আমাকেসহ অন্য শিক্ষকদের ধরে নিয়ে জেলে রাখল। তাতেও সেনাবাবিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন থামেনি। তখন আমরা গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক সরকার আনয়নের জন্য আন্দোলন করেছিলাম। রাজনৈতিকভাবে আমাকে জেলে নিলেও পুলিশ আমার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেনি। তারা শ্রদ্ধা করেছে। সেই দিনটাকে প্রত্যেকে কালো দিবস পালন করে। 

এটা ঠিক নয়। বিডিআর হত্যার দিনকে কালো দিবস হিসেবে পালন করা যেতে পারত। আর্মি ও সিভিলদের মধ্যে কখনোই দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়। সেই ঘটনায় সেনাবাহিনী দুঃখ প্রকাশ করেছিল। সেখানে যে কর্নেল দায়িত্বে ছিলেন, তিনি আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, ক্যাম্পাস থেকে সেনাবাহিনী নিয়ে চলে যেতে। 

কর্নেল সাহেব বিনয়ের সঙ্গে বললেন, বিকেল ৫টার মধ্যে চলে যাব। সেনাবাহিনী ক্যাম্পাস ছেড়ে সকালেই চলে গেল। কিন্তু যাওয়ার আগের রাতে আমার ছেলেদের অনেক মারধর করল। আমার ছাত্ররা তখন ক্যাম্প আক্রমণ করেছিল। নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দিল। ভিসি বাসায় ছিলেন না। তার বাসায় আক্রমণ করল। এগুলো মোটেও ঠিক হয়নি। এবারের আন্দোলনে লাখ লাখ লোক ঢাকার উদ্দেশে কীভাবে এল, আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারি না। 

শেখ হাসিনা সরকার সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চায়নি। শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করলেন এবং তাদের আন্দোলন প্রতিহত করতে অ্যাকশন নিতে বললেন। কিন্তু সেনাবাহিনী অ্যাকশন নেয়নি। কারণ, সেনাবাহিনী এত মৃত্যুর দায়ভার নিতে চায়নি। এবারের আন্দোলনে কত মানুষ মারা গেল, শত শত মানুষ অন্ধ হয়েছে, অনেকের পা কেটে ফেলা হয়েছে। সে এক বীভৎস চিত্র। মানুষ এত নিষ্ঠুর কীভাবে হয়? বলা হচ্ছে- এগুলো বিএনপি, জামায়াত-শিবির করেছে। 

এ ধরনে রহস্যজনক কথাবার্তা বলা মোটেও ঠিক হয়নি। অন্যায় করলে তার শাস্তি অবশ্যই হবে। তার পরও দেশে থাকতে হয়, জনগণের মুখোমুখি হতে হয়। দেশের জনগণকে ভালোবাসলে দেশে থাকতে হয়। সেই সময় শিক্ষকরা উদ্যোগ নিয়েছেন, ছাত্ররা সঙ্গে ছিল। এবারের আন্দোলনে ছাত্ররাই সবকিছু করেছে। এবার শিক্ষকরা সহযোগিতা করেছেন। 

খবরের কাগজ: বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পোড়ানোর বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? 

ড. সদরুল আমিন: কোনো জ্বালাও-পোড়াও আমি পছন্দ করি না। তবে ওই দিন জনতা কোনো নিয়ন্ত্রণে ছিল না। জনতা গণভবনে ঢুকল, লুটপাট করল, যা মোটেও ঠিক হয়নি। আমি ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কাতেও দেখেছি যে, আন্দোলনকারীদের একটা জিনিসও ধরতে দেওয়া হয়নি।

অথচ গণভবনে হাঁস-মুরগি, মাছ ও আসবাবপত্র- সবকিছু লুটপাট করা হলো। এটা সরকারের দোষ। সেনাবাহিনী ও পুলিশ কেন এগুলো রক্ষা করতে পারল না। সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই এমনটা হয়েছে। 

খবরের কাগজ: অন্তর্বর্তী সরকারকে আপনার পরামর্শ কী?

ড. সদরুল আমিন: অন্তর্বর্তী সরকার অনেক পরিশ্রম করছে। দেশের সব জায়গায় সংস্কার করতে হবে। সে জন্য এই সরকারের যথেষ্ট সময় লাগবে। আমি বাংলাদেশকে ভালোবাসি। এই মুহূর্তে কোনো ধরনের কাউন্টার মুভমেন্ট আসা উচিত নয়। 

এই সরকারের কাজ করার অনেক বিষয় আছে। অন্তর্বর্তী সরকার চেষ্টা করছে ভালো কাজ করার। তাদের সহযোগিতা করা উচিত। দেশে অনেক অবিচার হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতার দ্রুত সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশকে সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে এই সরকারকে জনগণের সহযোগিতা করতে হবে। 

খবরের কাগজ: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

ড. সদরুল আমিন: খবরের কাগজকেও ধন্যবাদ।

শেষ দেখা, পথে

প্রকাশ: ২৪ আগস্ট ২০২৪, ১১:০২ এএম
শেষ দেখা, পথে
ড. পবিত্র সরকার

কলকাতায় একজন মানুষের মৃত্যু হলো। তার বয়স আমার চেয়ে কম, কিন্তু মৃত্যু এসব হিসাব করে আসে না। তা ছাড়া প্রচুর ধূমপানের ফলে তার ফুসফুস জীর্ণ হয়ে উঠেছিল, আর কিছুটা অভিমানে সে নিজেকে বাইরের সমস্ত জীবন থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। হয়তো মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছিল সে। সেই মৃত্যু অবশেষে এল গত ৮ আগস্ট, ২০২৪, সকালবেলায়।
 
সে আমার কোনো আত্মীয় ছিল না। কিন্তু ভাবনাচিন্তা, মেজাজ ও আদর্শের আমি সহচর ছিলাম, আর ব্যক্তিগতভাবে আমার জীবনের নানা কাজ তার আগ্রহ ও উৎসাহের বিষয় ছিল, তার উদ্যোগেই আমি নানা কাজে যুক্তও হয়েছি। ফলে আমার জীবনে তার একটা মূল্যবান ভূমিকা ছিল। আমার ওপর নানা সামাজিক আক্রমণও নেমে এসেছিল একবার, সে আমাকে ঢালের মতো রক্ষা করেছে। 

মুখে তার কাছে এসবের জন্য কোনো ঋণ আমি স্বীকার করতে পারিনি, তার ভালো ও খারাপ সময়ে তাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারিনি। তার রোগশয্যাতেও কখনো হাজির হয়ে এই সাধারণ প্রশ্নটা করতে পারিনি যে, ‘কেমন আছ?’ বলতে পারিনি যে, ‘ভালো থাকো’। হিসেবি লোকেরা বলবেন যে, ও কথাগুলোর প্রায়ই কোনো মানে দাঁড়ায় না, তবু কথাগুলো বলার ইচ্ছে মনের মধ্যে দীর্ঘদিন লালন করেছি। কিন্তু বলার সুযোগ হয়নি। 

তার পর সব সুযোগ চিরকালের মতো ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সে তো চলেই গেল। তার মৃত্যু শুধু আমার একার শোক নয়, অনেক বড়, ব্যাপ্ত শোক। জানতাম বহু মানুষ তাতে যুক্ত হবে। ভাবলাম, তবে তার শবদেহে গিয়ে একটা মালা দিই। অনেকের কাছে তা হাস্যকর ভণ্ডামি বলেই মনে হবে, তবু সাতাশি বছর পার হওয়া এই বৃদ্ধের মনে ইচ্ছেটা তৈরি হলো। বন্ধুদের বললাম। তারা বলল, ‘চলে আসুন ওমুক জায়গায়, সবাই মরদেহে মালা দিতে ওখানেই আসছে।’

আমি আমার বড় মেয়েকে বললাম, সে বলল সেও যাবে। মৃত মানুষটি তার বিয়েতে এসেছিল, বাইশ বছর আগে। সে যাদবপুর থেকে মালা কিনে আমার সঙ্গী হলো গাড়িতে, আমার ড্রাইভার মেহমুদ, খুব নিপুণভাবে রিকশা, অটো, আর পথবর্তী নিশ্চিন্ত পদাতিকদের কাটিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে চলল। 

কিন্তু তার যতই নিপুণতা আর সদিচ্ছা থাক, গন্তব্যের কিছুটা কাছাকাছি গিয়ে বুঝলাম, আমি সময়টা বেছেছি নির্বোধের মতো। আমাদের আরও অনেক আগে বেরোনো উচিত ছিল। পার্ক সার্কাসে মল্লিক বাজারের মোড়ে পৌঁছোতেই পুলিশ কর্ডন করে দিল এগোবার পথ। তাদেরই একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে যাব তা হলে? তিনি বললেন, ‘সিআইটি দিয়ে চলে যান, ওটা খোলা আছে।’ 

খোলা ছিল বটে, কিন্তু সবার জন্য তো ওই একটা মাত্রই রাস্তা খোলা, ফলে সেখানেও অটো, ট্যাক্সি, গাড়ি, বাস, ট্রাক, ভ্যান সবার ভিড় এবং আমার মেহমুদের নৈপুণ্য সেখানে ভোঁতা হয়ে গেল। আমি বসে বসে নিজেকে গালাগাল করতে লাগলাম ভুল সময় বেছেছি বলে। 

পরিকল্পনা ছিল মৌলালির মোড় থেকে মুখ ঘুরিয়ে তার সংগঠনের মূল কেন্দ্রে যাওয়ার। সেও সম্ভব হলো না, মৌলালির মোড়ে পৌঁছে আমার কন্যা বলল, শবযাত্রা শুরু হয়ে গেছে, ‘আমাদের গিয়ে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না, বাবা। এসো আমরা এখানে পথে কোথাও দাঁড়াই।’

পথে দাঁড়াব! এই সাতাশি বয়সে পথে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা একটু কষ্টকর। তবু আমি নড়বড়ে হলেও এখনো হাঁটি একটু-আধটু। কাজেই ওই বাধ্যতামূলক সিদ্ধান্ত নিতে হলো, পথেই অপেক্ষা করব তার জন্য। কারণ, মনে পড়ে গেল, কত কতবার তার সঙ্গে পথে নানা মিছিলে হেঁটেছি, কচিৎ-কখনো পাশাপাশিও।

বেশ, তাই হোক। আমরা সুরেন ব্যানার্জি রোডের মোড় ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই বেশ কিছু প্রবীণ লোক এগিয়ে এলেন। তারা আমাকে চেনেন। পথের সিমেন্ট-বাঁধানো উঁচু ডিভাইডারে বসেছিলেন, বললেন, ‘আপনি বসুন এখানে।’ বলে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলেন। আমি তাদের ধন্যবাদ দিয়ে মাথা নাড়লাম, বললাম, ‘না, আমি দাঁড়িয়েই দেখব।’

ততক্ষণে মানুষের মিছিল শুরু হয়ে গেছে। এত মানুষ ভালোবাসত তাকে! আমি তো মোটামুটি বৃদ্ধই, কিন্তু আমারই মতো বা কাছাকাছি কত বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে দেখলাম ধীরগতিতে হেঁটে চলে যাচ্ছেন, মধ্যবয়সী আর তরুণরা তো ছিলেনই। বড় দীর্ঘ ও মন্থর সে মিছিল। দলের প্রবীণ নেতারা গেলেন একটা দলে, প্রবীণদের মধ্যে আবার কেউ সাধারণ মানুষের লাইনে মিশেও হাঁটছিলেন, এই বৃদ্ধকে দেখে সমাদর জানালেন।

কিন্তু তরুণ-তরুণীদের সমাবেশ ছিল দেখবার মতো। মৃত মানুষটি ছিল তাদের প্রাণের খুব কাছাকাছি, সুস্থ হোক অসুস্থ হোক, তাদের অবিসংবাদিত নেতা। তারা দলে দলে গাইছিল শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক যুদ্ধের গান। তাদের গান আমার চোখে জল এনে দিল। 

মৃত মানুষটির জন্য শোক নিশ্চয়ই তাতে ছিল, কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোর চোখেমুখে না হারবার স্বপ্ন দেখতে পেলাম আমি, তাদের ওই স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল শবশকটে শান্ত শুয়ে থাকা ওই মানুষটি। 

ওদের মধ্য থেকেই একটি মেয়ে, এখন পশ্চিম বাংলার চেনা মুখ, ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরল, সবাইকে বলে পথ করে দিল ঠেলেঠুলে, বলল, ‘সরে যাও, স্যার ফুল দেবেন।’ আমি শবশকটের পাশে গিয়ে তার মুখটা দেখলাম। এর আগে তার রোগক্লিষ্ট দাড়ি না কামানো মুখ দেখে কষ্ট পেয়েছি। এখন ঝাপসা চোখে দেখলাম, আগেকার মতো পরিচ্ছন্ন মুখে রাজার মতো সে ফুলের বিছানায় শুয়ে আছে। আমার মেয়ে মালাটি এগিয়ে দিল, আমি সেটে অজস্র মালার পাশে রাখলাম।

বিদায়, প্রিয় অনুজ, বুদ্ধদেব। আমরা বৃদ্ধ, আমাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু ওই ছেলেমেয়েগুলোর কাছে তুমি তোমার সমস্ত স্বপ্ন গচ্ছিত রেখে যাও। 

লেখক: ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং সাবেক উপাচার্য, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

ভারতে বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে চাপে বিজেপি

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১০:৪৯ এএম
ভারতে বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে চাপে বিজেপি
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

অনেক দিন ধরেই সংঘ পরিবারের মধ্যে মতভেদ এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনের ফলই সেটা স্পষ্ট। দেরিতে হলেও এই বিষয়টি বুঝতে পেরে এখন বিজেপি নেতৃত্ব আরএসএসের সঙ্গে দূরত্ব মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে বিজেপি কোনোভাবেই চটাতে চাইছে না আরএসএস নেতৃত্বকে।

অপরদিকে আরএসএস নিজেদের পছন্দসই ব্যক্তিকেই বিজেপির পরবর্তী শীর্ষ নেতা হিসেবে চাইছে। সম্প্রতি কো-অর্ডিনেশন মিটিংয়ে তারা জানিয়েছেন, বিজেপির শীর্ষ নেতা হিসেবে তারা পিছিয়ে পরা শ্রেণি থেকে কোনো মহিলা নেত্রীকে চান। 

এই মিটিংয়ে সম্ভাব্য নাম নিয়েও আলোচনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য এতদিন বিজেপিতে কখনোই পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃত্বে কোনো মহিলা নির্বাচিত হননি। তবে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাসের পরিপ্রেক্ষিতে এখন মোদি নিজেও দলের রাজনৈতিক স্বার্থে মহিলাদের নেতৃত্ব স্বাগত জানিয়েছেন।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহের বাড়িতে পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী এই মিটিংয়ে আরও উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা এবং সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বি এল সন্তোষ। আরএসএসের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালে এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অরুণ কুমার। 

এই মিটিংয়ে মূলত বিজেপির পরবর্তী সভাপতি নির্বাচন, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড, হরিয়ানা ও জম্মু-কাশ্মীরের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচন এবং বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দুদের নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা করা হয়।

এবারের লোকসভা নির্বাচনের পরেই বিজেপি ও আরএসএসের মধ্যে বিভেদ সামনে চলে আসে। আরএসএস-প্রধান মোহন ভগবত মোদিকে নিশানা করেই খোলাখুলি বলেছেন, সেবকের মধ্যে এতখানি অহংকার তিনি কখনোই সমর্থন করেন না। 

প্রসঙ্গত, মোদি নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে প্রধান সেবক বলেই বর্ণনা করতে পছন্দ করেন। ভগবত আরও বলেন, বিজেপির প্রাক-নির্বাচনি প্রচারের ধরন ভারতের সামাজিক ঐক্য বিনষ্ট করেছে। আরএসএস সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ-প্রক্রিয়া থেকে আরএসএস-কে দূরে সরিয়ে রাখার ফল খুব একটা ভালো হয়নি।

বিশেষত, এবারের নির্বাচনে তার যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই বিজেপি এককভাবে এমন সব প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড় করিয়েছে, যারা ভোটারদের কাছে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে দাবি করেছে আরএসএস নেতৃত্ব। বিজেপির আগামী সভাপতি হিসেবে সম্ভাব্য নামের আলোচনা এই মিটিংয়ের প্রধান একটি বিষয় ছিল। জুন মাসে নাড্ডার সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও নতুন সভাপতি নিয়োগ করতে এত সময় লাগছে। 

বিজেপি-আরএসএসের মধ্যে দ্বন্দ্বই এর মূল কারণ হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। দুই পক্ষের কেউই অবশ্য এখনই সম্ভাব্য সভাপতির নাম বলতে নারাজ। তবে বিজেপি নেতাদের কাছ থেকে জানা গেছে, এ মাসের  শেষ দিকে আরএসএসের কেরালা অধিবেশনে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্ব নিশ্চিতভাবেই আরএসএসের সমর্থন পেতে চায়। বর্তমানে হরিয়ানা বিজেপির দখলে এবং মহারাষ্ট্রেও তাদের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে বলা যায়, হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রের ওপরে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখা এবং ইন্ডিয়া জোটের কাছ থেকে ঝাড়খন্ড ছিনিয়ে নেওয়া এখন বিজেপির কাছে প্রধান চ্যালেঞ্জ। এই কাজে বিজেপির সহায় হতে পারে আরএসএস। কারণ মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানায় আরএসএসের যথেষ্ট দাপট রয়েছে।

রাজনীতির প্রয়োজনেই দুই পক্ষের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এক আরএসএস নেতার বক্তব্য, আমরা সংঘ পরিবারের অংশ আর একটা পরিবারের মধ্যে অনেক সময়েই মতান্তর হতে পারে। কিন্তু এখন আমরা ভেদাভেদ যতটা সম্ভব কমিয়ে এনে নিজেদের মধ্যে আরও বেশি সমন্বয় সাধন করার চেষ্টা করছি।

আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে মহারাষ্ট্র থেকে যে রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, মহারাষ্ট্রের ‘স্ট্রং ম্যান’ শারদ পাওয়ার এবং কংগ্রেসসহ শিবসেনার উদ্ভব ঠাকরের অবস্থান বিজেপির তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। 

সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে এমন মতামতই দিচ্ছেন ভারতের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এই লেখার সময়ে খবর পাওয়া গেল যে, ঝাড়খন্ডের জেএমএম ও কংগ্রেস জোট সরকারের পতন হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে, কারণ সরকারের ছয়জন বিধায়ককে কিনে নিয়েছে বিজেপি।

বর্তমানে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যাচ্ছে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে ঘিরে বিজেপি যথেষ্ট চাপের মুখে। ঝাড়খন্ডের কিছু বিধায়ককে তারা টাকার বিনিময়ে কিনে নিতে চেয়েছে, কিন্তু সেই প্রয়াস সম্পূর্ণ সফল হয়নি। ঝাড়খন্ডের সাবেক অস্থায়ী মুখ্যমন্ত্রী চম্পাশরণ দিল্লি থেকে ঝাড়খন্ডে ফিরে এসে বলেছেন, তিনি আর রাজনীতি না-ও করতে পারেন। কারণ টাকার বিনিময়ে রাজনীতি করা তার পছন্দ নয়।

আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে এই প্রথম জম্মু ও কাশ্মীরে আলাদা বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এখানেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিজেপি লাগাতার যোগাযোগ রেখে চলেছে নিজেদের পক্ষে সমর্থন বাড়ানোর জন্য।

হরিয়ানায় কংগ্রেস দল মন্ত্রিসভা গঠনের আগেই অমিত শাহ ১০ জন বিধায়ককে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন। সেই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে, তিন দফায় এবারে সেখানে বিধানসভা নির্বাচন হবে।

মহারাষ্ট্রে কংগ্রেস শিবসেনা ও শারদ পাওয়ারের জোট সরকার দুই বছরের মাথাতেই বিজেপি টাকা দিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। এবারের নির্বাচনের আগে বিজেপি মরিয়া চেষ্টা করছে আরএসএস-প্রধান মোহন ভগবতের মাধ্যমে কংগ্রেস জোটের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। 

সম্প্রতি লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপি পিছিয়ে থাকার ফলেই এখন বিধানসভার আগে তাদের এই প্রচেষ্টা। কর্ণাটকের সরকারকেও ফেলে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। বর্তমানে ভারতের মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলে এ বিষয় নিয়ে তোলপাড় চলছে।

লেখক: ভারতের সিনিয়র সাংবাদিক

আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য রক্ষা জরুরি

প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৪, ১০:৪৫ এএম
আন্তক্যাডার বৈষম্য দূর করে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য রক্ষা জরুরি
ড. সুলতান মাহমুদ রানা

বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের বিসিএস প্রবণতা অত্যধিক বেড়েছে। আর তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রতিবছর বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনপত্রের সংখ্যা বিবেচনায়। বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ পাওয়ার পর গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পেশা বদলের বিষয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা লক্ষ করি। 

অভিভাবকরা যে সন্তানকে নিয়ে ছোটবেলা থেকেই চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী বানানোর স্বপ্ন দেখতেন, তারাও এখন চিকিৎসাবিদ্যা-প্রকৌশলবিদ্যা পড়ালেও ভবিষ্যতে বিসিএসের একটি দাপুটে ক্যাডার চেয়ারে দেখতে চান সন্তানকে। 

উল্লেখ্য, বর্তমান বাস্তবতায় দাপুটে ক্যাডার বলতে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পুলিশ, প্রশাসন, কাস্টমস, ট্যাক্স এবং পররাষ্ট্রকে বোঝানো হচ্ছে। একজন শিক্ষার্থী এমবিবিএস কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে তার নিজের দক্ষতানির্ভর পেশায় যাচ্ছে না। কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, তথাকথিত দাপুটে ক্যাডারের সুযোগ-সুবিধা তার নিজ ক্ষেত্রের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ তাদের মেধার ক্ষেত্রে কোনো কমতি নেই। 

মেধাক্রম বিবেচনায় এবং ক্যাডার পছন্দক্রম বিবেচনাতেই যেহেতু বিসিএসে চাকরি হয়, সেহেতু  নিজের সুযোগ-সুবিধার কথা বিবেচনা করেই তাদের সুবিধাভিত্তিক ক্যাডারে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ইদানীং বিসিএসের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল চিত্রে দেখা গেছে, পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস, ট্যাক্সের মতো শীর্ষ ক্যাডারের বেশির ভাগ পদে মনোনীত হচ্ছে এমবিবিএস এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা প্রার্থীরা। 

ক্রমাগতভাবে পরপর কয়েকটি বিসিএসে এমন চিত্র আমরা লক্ষ করেছি। এ প্রবণতার অন্যতম কারণ হিসেবে আন্তক্যাডার বৈষম্যকেই দায়ী করা যায়। সুযোগ-সুবিধা থেকে শুরু করে ক্যাডারভেদে পদোন্নতিতে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। 

আমরা যদি স্বাভাবিকভাবে সমাজের কল্যাণ ও গুণগত মানের চিন্তা করি তাহলে বলা যেতে পারে, দেশের যারা সর্বোচ্চ মেধাবী তাদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসার কথা ছিল শিক্ষা ক্যাডারে। কিন্তু লক্ষণীয় হলো, বিসিএস পরীক্ষায় ক্যাডার পছন্দক্রম ফরম পূরণ করতে গিয়ে শিক্ষা ক্যাডারকে অনেক নিচের পছন্দক্রমে রাখা হয়। কারণ একজন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তার সুযোগ-সুবিধা পূর্বে উল্লিখিত তথাকথিত যেকোনো দাপুটে ক্যাডারের তুলনায় অনেক কম। 

তা ছাড়া প্রভাব-প্রতিপত্তির বিষয় তো রয়েছেই। অথচ শিক্ষকতা একটি আদর্শ পেশা হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে মেধাবীদের এই পেশায় আসার প্রবণতা লক্ষণীয় মাত্রায় থাকার কথা ছিল। শুধু বৈষম্যের কারণে এখন আর কেউ বাই-চয়েস শিক্ষকতায় আসতে চাচ্ছে না। ঠিক একইভাবে ডাক্তারি এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়রিং পেশাতেও থাকতে চাচ্ছে না। 

কারণ সেখানেও ক্যাডারভেদে দৃশ্যমান বৈষম্য লক্ষ করা যাচ্ছ। বাস্তবতা এমন একটি পর্যায়ে এসেছে যে, অনেকেই মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও যথাযথ মূল্যায়ন পাচ্ছে না নিজ দক্ষতানির্ভর পেশায় থেকে। এ কারণে ডাক্তারি পড়ে অনেকেই ডাক্তার না হয়ে লোভনীয় ক্যাডার চয়েস দিচ্ছে, আবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও অন্য পেশায় যাওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। 

আমাদের দেশে যারা সবচেয়ে মেধাবী তারা মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়। তাই বিসিএসের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায়ও যে তারা ভালো করবে, এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে এমন কিছু প্রশ্ন আসতে দেখা যায় যেগুলো সাধারণ বিষয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা উত্তর করতে পারে না। 

অন্যদিকে একজন ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা ডাক্তারি পড়া শিক্ষার্থীর জন্য ওই প্রশ্নের উত্তর করা অনেকটা সহজ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সাধারণ বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা কম নম্বর পেয়ে ক্যাডার পছন্দের পেছনের সারিতে চলে যাচ্ছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা লক্ষ করছি, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার স্তর অনেকটা বিসিএসমুখী হয়ে উঠছে। কারণ স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনার ভিত্তিতে কোনো শিক্ষার্থী ভালো চাকরির সুযোগ পায় না। এ কারণে স্নাতক পর্যায়ের শুরু থেকেই শিক্ষার্থীরা বিসিএস সিলেবাস আত্মস্থ করার চেষ্টা করে থাকে। 

উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হলো একটি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়া, সে বিষয়ে জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান উন্নয়ন কিংবা জ্ঞানের সম্প্রসারণ। সুদূর দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে সেই জায়গাটা দখল করে নিয়েছে বিসিএস গাইড বই। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ক্লাসে লেকচার না শুনে, মনোযোগ না দিয়ে বিসিএস গাইড পড়ে। সম্মান শ্রেণিতেও পড়ে, মাস্টার্সেও পড়ে, আবার পড়াশোনা শেষ করে পাঁচ বছর সেই একই বইগুলো পড়ে।

শিক্ষার্থীরা পঠিত বিষয়ের অর্জিত জ্ঞান, শিক্ষা বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারছে না। তাহলে এই শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? কিছু ব্যতিক্রম থাকবে, কিন্তু গণহারে পেশা বদলের বিষয়টি কোনোভাবেই শুভ লক্ষণ মনে করছি না। একজন শিক্ষার্থী লোকপ্রশাসন কিংবা সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা প্রশাসনসংক্রান্ত বিষয়াদি- সরকার, রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রশাসন ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে। 

আবার যেখানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কিংবা রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা পররাষ্ট্রসংক্রান্ত বিষয়- পররাষ্ট্রনীতি, কূটনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে পাঁচ বছর পড়াশোনা করে। তা হলে এ অর্জিত শিক্ষার উদ্দেশ্য কী? বিসিএস সিলেবাসে যেখানে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, উচ্চতর গণিত বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার। 

মানবিক কিংবা কলা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীরা যেখানে গণিত, উচ্চতর গণিত, বিজ্ঞান ও কম্পিউটার এসব বিষয়ে কম অবগত। কারণ তারা এসব বিষয় পড়ে না। কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগ কিংবা মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক লেভেল থেকে বিজ্ঞান, কম্পিউটার, গণিত পড়ে অভ্যস্ত। তাই তাদের বিসিএস প্রবেশে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। আর অপেক্ষাকৃত মেধাবী হওয়ায় তারা ইচ্ছামতো ক্যাডার চয়েস করতে পারছে। এতে হোঁচট খাচ্ছে মানবিক কিংবা কলা ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীরা। 

বিশ্বের অন্যান্য দেশে দেখা যায়, যে যে বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে, পড়াশোনা শেষে সে সে বিষয়-সম্পর্কিত চাকরিতে যোগদান করছে। কিন্তু আমাদের দেশে এর উল্টো চিত্রটাই লক্ষ করা যায়। ইদানীং প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ফলে বিভিন্ন কারণেই শিক্ষার্থীদের মূল প্ল্যাটফর্ম হয়ে গেছে বিসিএস। 

এই মুহূর্তে আমাদের দেশের কর্মসংস্থান পরিকল্পনাকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। প্রভাব-প্রতিপত্তি, মর্যাদা-সম্মান এবং সুযোগ-সুবিধা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আবদ্ধ না রেখে এর যথাযথ প্রয়োগ ঘটালে এবং আন্তক্যাডার বৈষম্য কমিয়ে আনলে এমন পেশা বদলের প্রবণতা কিছুটা প্রতিরোধ করা যেতে পারে। 

আমাদের দেশের বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতি আর বিসিএস হুজুগ দেশ ও জাতির জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনছে কি না, সেটিও বিবেচনায় আনতে হবে। এখনই এ-সংক্রান্ত সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান দিতে না পারলে আগামী দিনের শিক্ষাযাত্রায় অশনিসংকেত বেজে ওঠার শঙ্কা রয়েছে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

দেশের পুঁজিবাজারকে অর্থবহ করতে গঠনমূলক সংস্কার জরুরি

প্রকাশ: ২২ আগস্ট ২০২৪, ১২:০৩ পিএম
দেশের পুঁজিবাজারকে অর্থবহ করতে গঠনমূলক সংস্কার জরুরি
আবু আহমেদ

দেশে পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা হতাশাব্যঞ্জক। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ অনেক কমে গেছে। যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের পুঁজি ওঠানো সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি অধিকাংশই বর্তমানে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। সরকার থেকে সুদহার বাড়ানোর ফলে বেসরকারি খাতে কেউ ঋণ নিলে তাকে বেশি পরিমাণে অর্থ দিতে হয়। 

এর ফলে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়েছেন এবং অবধারিতভাবেই পুঁজিবাজার তার চাঙা ভাব হারিয়েছে। ফ্লোর প্রাইসের কারণে তা আরও ঘনীভূত হয়েছে। সাধারণ মানুষ পুঁজিবাজারে উৎসাহিত হচ্ছেন না। পুঁজিবাজারকে নিরুৎসাহিত করেছে ভালো কোম্পানির অভাব। অথচ এটি গভীরভাবে জনগণের আগ্রহের সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, সে তুলনায় পুঁজিবাজারের উন্নতি হয়নি। বরং যে সুযোগ-সুবিধা ছিল সেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন কেউ তালিকাভুক্ত হতে আগ্রহী নয়। যে কারণে এটার পরিধি বড় হচ্ছে না। এশিয়ায় বাজার মূলধনে আমরা সর্বনিম্ন স্তরে থাকা দেশগুলোর সারিতে অবস্থান করছি। আমাদের অর্থনীতি এগিয়েছে, কিন্তু পুঁজিবাজার পিছিয়েছে। 

শেয়ার কেনার আগে সেই কোম্পানি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াটা খুবই জরুরি। কারণ তাদের হাতেই শেয়ারবাজারের বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ ও ভালোমন্দ নির্ভর করছে। আমাদের এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা না জেনেবুঝেই কোম্পানির শেয়ার কেনেন। সে কারণে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ সঠিক হয় না। 

পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, বিনিয়োগকারী লোকসান গুনছেন। মনে রাখতে হবে, ভালো ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ একটি খারাপ কোম্পানিকেও অনেক সময় ভালো কোম্পানিতে রূপ দিতে পারে। আবার ব্যবস্থাপনা দক্ষ না হলে ভালো কোম্পানিও অনেক সময় খারাপ হয়ে যায়। কেনার আগে কোম্পানিটি সম্পর্কে জানতে হবে। 

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের আগে বাজারের অবস্থা বোঝাটা খুব জরুরি। দেশের শেয়ারবাজারের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি, অর্থনীতির একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। তার চেয়েও বেশি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ব্যাংকের সুদহারের। ব্যাংকের সুদহার যদি বেড়ে যায়, তখন বুঝতে হবে বাজারে তারল্য কমবে। আবার ব্যাংকে সুদহার কমতির দিকে থাকলে বুঝতে হবে শেয়ারবাজারে তারল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট। এ নিয়ে জনমনে যথেষ্ট শঙ্কা-সংশয় আছে। নিম্নমুখী ডলারসংকট, মূল্যস্ফীতি, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস এর অন্যতম প্রধান কারণ। অন্যদিকে দেশের রপ্তানি সূচক নিম্নমুখী। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার সেভাবে অর্জিত হচ্ছে না। এই সংকট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। 

বছরব্যাপী ধাপে ধাপে এই সংকট শুরু হয়েছে। এর কারণ দুটি- প্রথমত, দেশের আয় বিদেশে চলে গেছে। ঋণখেলাপি, আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর ও সরকারের সুবিধাভোগী কিছু লোক এ জন্য দায়ী। তা ছাড়া শিগগিরই ডলারসংকট থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বাড়ানোর ফলে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়েছে। 

এর ফলে বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমে যাচ্ছে। একই সঙ্গে আনুপাতিক হারে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শেয়ারবাজারের বড় একটি তহবিল সরকার বেশি সুদে ঋণের মাধ্যমে নিয়ে নিচ্ছে। ফলে দীর্ঘ সময়ের জন্য যারা ব্যাংকে লেনদেন করেন, সেটির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। 

ধনীরা বিদেশে অর্থ পাচার করছে, এটি আস্থাহীনতার আরেকটি অংশ। অর্থাৎ নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তা থেকেই মানুষ বিদেশে অর্থ পাচার করে। পরিবার, সন্তান-সন্ততিদের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা বিদেশে টাকা পাচার করে থাকে। কারণ নিজেরা নানা রকম অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। 

বাংলাদেশে ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ রয়েছে, এটা দেশের সর্বকালের সর্বোচ্চ। অনেক ব্যাংক তারল্যসংকটে আছে। নতুন করে কেউ ডিপোজিট রাখছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধারকর্জ করে চলছে। মানুষের ওপর তাদের কোনো বিশ্বাস নেই। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে তারল্যসংকট উপেক্ষা করা যায় না। 

ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বৃদ্ধির সঙ্গে শেয়ারবাজারের সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে শেয়ারবাজার নিম্নমুখী এবং কেনাবেচা ঠিকমতো হচ্ছে না। বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারের অবস্থা তুলনামূলক ভালো। মূল্যস্ফীতিও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। আগামী দিনগুলোয় এটি যে খুব ভালো হবে সেটিও আশা করা যায় না। 

পুঁজিবাজারকে নতুনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। একটি সুন্দর সিস্টেম বা ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন রকম প্রণোদনা দিতে হবে। ভালো কোম্পানিকে জোর করে শেয়ারবাজারে আনা যাবে না। 

ভালো কোম্পানি আনতে হলে তাদের মতামত শুনতে হবে, প্রণোদনা দিতে হবে। ব্যাংকের অর্থ ও বড় তহবিল দিয়ে বেশি দূর এগোনো যাবে না। বিগত সময়ে সরকার যেসব অবকাঠামো বাস্তবায়ন করেছে, সেগুলো থেকে টোল আদায় করছে। টোল সংগ্রহ অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু এগুলোকে কোম্পানি করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। 

উদাহরণস্বরূপ মুম্বাই এয়ারপোর্ট অথবা হিথ্রো এয়ারপোর্টের কথা বলা যায়, এগুলো তালিকাভুক্ত কোম্পানি। এয়ার ইন্ডিয়া, যেটি বিক্রি করা হয়েছে, এটি এখনো তালিকাভুক্ত কোম্পানি। আমাদের দেশে এভাবে করা হয় না। 

আমরা এয়ারপোর্টকে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ফেলে দিয়েছি, এভাবে আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতি চলে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিকে বিস্তৃত করা দরকার। মধ্যবিত্তদের বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার জন্য তারা নীতি গ্রহণ করবে। মধ্যবিত্তরা শুধু জমি কিনবে, সঞ্চয়পত্র কিনবে, ফ্ল্যাট কিনবে- এগুলো কাজের কথা নয়। 

আমরা তাদের জমি কেনা, ফ্ল্যাট কেনা, সঞ্চয়পত্র এসবের দিকে ধাবিত করছি। ফ্ল্যাট কিনে, জমি কিনে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য এগুলো নীতিগতভাবে ভালো নয়, বরং এ জন্য ব্যবসা প্রয়োজন। ব্যবসার একটা বিরাট অংশ পুঁজিবাজারে যেতে হবে। শ্রেণিভেদে সবাই যেন পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হন, সেদিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। 

লেখক: অর্থনীতিবিদ