![ব্যতিক্রমী সময়ে গতানুগতিকতার বাজেট](uploads/2024/06/10/Mostafijur-Rahman-1717994595.jpg)
২০২৪-২৫ অর্থবছরে যে বাজেট উপস্থাপন করা হয়েছে, বলা বাহুল্য এটি একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ের বাজেট। তবে এটি ব্যতিক্রমী সময়ের বাজেট হিসেবে গতানুগতিকতার বাইরে যেতে পারেনি। বাংলাদেশ একটি শক্তিমত্তার জায়গায় ছিল। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, নিম্ন মূল্যস্ফীতি এবং উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি- এই তিনটি ক্ষেত্র বর্তমান সময়ে একই সঙ্গে বিগত দুই বছরে বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের একটা অবনমন হয়েছে। আমরা আশা করেছিলাম, সেদিকে লক্ষ্য রেখে বাজেটে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করা, সাধারণ মানুষের সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়কে আরও শক্তিশালী করার দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হবে। আমরা দেখেছি যে, বাজেটে বেশ কিছু প্রস্তাব করা হয়েছে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য। এবারের বাজেটে কর কাঠামোর কিছুটা পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। যাতে মধ্যবিত্তদের ওপর করের চাপ কিছুটা কমে। উচ্চবিত্তের ওপর করের হার ২৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। কিছু কিছু আমদানি করা পণ্যের শুল্ক ও ভ্যাট কমানোর প্রস্তাবও করা হয়েছে। তার পরও আমাদের মনে হয়েছে, যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তা হয়নি। বিশেষত দুই বছর ধরে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে আছে। এ রকম একটা অবস্থায় সামাজিক সুরক্ষা খাতে আমরা মনে করেছিলাম বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হবে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ সামান্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতিকে যদি আমরা বিবেচনায় নিই, তবে প্রকৃত অর্থে সেই বৃদ্ধি খুব একটা বিবেচ্য নয়। আমরা আশা করেছিলাম, সামাজিক সুরক্ষার প্রাপ্তি ও স্থায়িত্ব আরও বাড়ানো হবে। কিন্তু আমরা দেখেছি, সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে হিসাব সেখানে কৃষি খাতের ভর্তুকিও আছে, সঞ্চয়পত্রের সুদের প্রিমিয়ামও আছে। সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন খাতের স্কিম ইত্যাদিও সেখানে ঢোকানো হয়েছে। এগুলো বাজেটের ১৭ শতাংশের মতো হয় অথবা জিডিপি ১.৩ শতাংশের মতো হয়। এটা খুব বেশি বাড়ানো হয়নি। আমাদের প্রস্তাব ছিল, শহরাঞ্চলে রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন ধরনের সার্ভে যেমন ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম, বিশ্বব্যাংক অথবা আমাদের বিবিএসের সার্ভে করা। দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টিনিরাপত্তায় ভুগছে মানুষ। এমনকি দারিদ্র্যসীমার ওপরে যারা আছে তারা এবং বিশেষত শিশুরা; যাদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তাহীনতা তুলনামূলকভাবে বেশি। সে ক্ষেত্রে আমরা মনে করেছিলাম স্কুল ফিডিংয়ের মতো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হবে, কিন্তু তা দেখিনি। বাজেটে যে ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৃদ্ধি তেমন একটা হয়নি। অন্যদিক থেকে অনেক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। যদিও আইএমএফের কথা উল্লেখ নেই। তবে ২০১২ সালের ভ্যাট সাপ্লিমেন্টারি যেটা করা হয়েছিল, অর্থাৎ গড়ে ১৫ শতাংশ সাপ্লিমেন্টারি; সে ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বেশ কিছু পণ্য ও মোবাইল টক টাইম থেকে শুরু করে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাত আছে, যেখানে এই ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে অথবা ভ্যাট প্রত্যাহারের যে সুযোগ ছিল সেগুলো বাতিল হওয়ার ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরও বাড়বে।
আমাদের বড় সমস্যা হলো, আমাদের রাজস্ব জিডিপির হার যেহেতু কম, আমরা ক্রমান্বয়ে ঋণনির্ভর হয়ে পড়ছি। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি যেটা ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার মতো আছে, সেটা পুরোটাই হয় অভ্যন্তরীণ ঋণ, নয়তো বৈদেশিক ঋণ। এই ঋণনির্ভরতা বাজেটেও দেখেছি। সুদের ব্যয় দুই নম্বরে চলে আসছে। প্রথমত, জনপ্রশাসন ব্যয়, তারপর সুদের ব্যয়। এটা নিঃসন্দেহে একটি অশনিসংকেত। ক্রমান্বয়ে সুদ ও আসলের পেছনে একটি বড় অংশ চলে যায়। তাহলে অন্যান্য খাতে ব্যয়ের যে সুযোগ সেগুলো থাকবে না। চেষ্টা করতে হবে, যেভাবেই হোক রাজস্ব যেন বাড়াতে পারি। রাজস্ব টার্গেট ধরা হয়েছে ৯.৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটা ছিল ৮.৩ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। সেখানে ৭০-৮০ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থাকবে। এ রকম অবস্থায় যদি ৯.৭ শতাংশ রাজস্ব আদায় করতে হয়, তাহলে ২৫ শতাংশের মতো রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। সে ক্ষেত্রে যে ধরনের বিনিয়োগ দরকার সেটা বাজেটে দেখিনি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে শক্তিশালী করা দরকার। ডিজিটালাইজেশনকে শক্তিশালী করা দরকার। করখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সে ধরনের উদ্যোগ এবারের বাজেটে দেখা যায়নি বরং আমরা দেখেছি যারা কর দেননি এবং যাদের কাছে অপ্রদর্শিত টাকা রয়েছে তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সেটাকে বৈধ করার। এখানে আমরা দেখেছি ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিলে আর কোনো ধরনের প্রশ্ন করা হবে না। অর্থাৎ যারা অবৈধভাবে টাকা আয় করেছে তাদেরও একধরনের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এটি অন্যায় এবং একটি অযৌক্তিক পদক্ষেপ এবং এটা প্রত্যাহার করা উচিত। এটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কর না দিয়ে পরবর্তী সময়ে ১৫ শতাংশ দিয়ে এ অপ্রদর্শিত টাকাকে বৈধ করে নেওয়া হলো। আমরা মনে করি সেটাও ঠিক নয়। এটা নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
রাজনৈতিকভাবেও মানুষ এটাকে ভালোভাবে নিতে পারে না। নৈতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক- কোনোভাবেই এটা গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ নয়। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, রাজস্ব ব্যয়, যেটা সরকারের রাজস্ব আয় এবং ঘাটতি অর্থায়ন ৪.৬ শতাংশ ধরা হয়েছে। এটা মিলে মোট সরকারি ব্যয় ১৪ শতাংশের মতো। রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে বিভিন্ন খাতে ব্যয় সক্ষমতাকে বাড়াতে হবে এবং ঋণনির্ভরতা কমাতে হবে। একই সঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে যে সরকারের ব্যয় যদি ১৪ শতাংশ হয় জাতীয় আয়ের, তাহলে বাকি অংশ বেসরকারি খাতে। বিনিয়োগবান্ধব ও ব্যবসার পরিবেশ যাতে ভালো হয় সেদিকেও নজর দিতে হবে। সেটা শুধু রাজস্বনীতি দিয়ে হবে না। সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একটা সংকোচনমূলক নীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বাজেটও কিছুটা সংকোচিত করা হচ্ছে। এ রকম একটা অবস্থায় বিনিয়োগ পরিস্থিতির যদি মান এবং দক্ষতা না বাড়ানো যায়, তাহলে আমরা যে প্রাক্কলন করছি, প্রবৃদ্ধি ৬.৭৫ শতাংশে নিয়ে আসব বা মূল্যস্ফীতি ৬.৫ শতাংশে নিয়ে আসব সেটা সম্ভব হবে না।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু বাজেট দিয়ে হবে না। সেই ব্যবস্থাপনা ও এর গুণগত মান ভালোভাবে রাখতে হলে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তার সেবা দেওয়ার দক্ষতাও সক্ষমতার দিকে নজর দিতে হবে। তাহলে বিভিন্ন বিনিয়োগ এবং আয় বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান ইত্যাদি কাজগুলো করতে পারব। সুতরাং বলা যায়, একটা চ্যালেঞ্জিং টাইমের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। যেখানে একদিকে মূলস্ফীতি কমাতে হবে, অন্যদিকে প্রবৃদ্ধি কিছুটা ছাড় দিয়ে হলেও বিনিয়োগ উৎকর্ষ বাড়িয়ে কর্মস্থান সৃষ্টি করে আয় বাড়াতে হবে। এটা একটা চ্যালেঞ্জিং সময়। অর্থনীতি যদি আগের জায়গায় নিয়ে যেতে হলে উচ্চ প্রযুক্তি, নিম্ন মূল্যস্ফীতি, সামষ্টিক স্থিতিশীলতার দিকটি বিবেচনায় রাখতে হবে। বাজেট কীভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে। বিশেষত, বাজেটের ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি, এটা যাতে সাশ্রয়ীভাবে ও সময়মতো করতে পারি, সুশাসনের সঙ্গে করতে পারি, সেদিকটায় বেশি নজর দিতে হবে। এবারের বাজেট বাস্তবায়নের উৎকর্ষ ও মানসম্মত বাস্তবায়ন প্রয়োজন। তার কারণ হলো যে, অর্থায়ন কিছুটা সংকুচিতভাবে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাজেটের আকারও খুব একটা বাড়েনি। গতবারের থেকে ৪-৫ শতাংশ মতো হয়তো বেড়েছে। এই কম টাকা দিয়েই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হবে। সুতরাং সুশাসনের পাশাপাশি সরকারি প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি প্রয়োগ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এই বাজেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সংকট কাটবে না। এটার জন্য আরও সময়ও লাগবে।
পরপর দুবার মূল্যস্ফীতির কারণে মূল্যস্তর অনেক ওপরে রয়েছে। সেটা কমাতে গেলে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে হবে। সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের যে অবনমন হয়েছে, সেটার প্রতি লক্ষ্য রেখে ফ্যামিলি কার্ড অথবা দুস্থ ভাতা প্রকল্প বলি, সে ক্ষেত্রে যে বাজেট বরাদ্দ হয়েছে সেটা আরও বৃদ্ধি করা উচিত। একই সঙ্গে যেসব খাতে বরাদ্দ আছে সে কাজগুলো যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয় স্পষ্টতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে, সেদিকেও নজর দিতে হবে। টাকা সাদা করার মতো এ ধরনের পদক্ষেপ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দায়মুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে বরঞ্চ যারা এগুলো করছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলে মনে হয়। সামগ্রিকভাবে যদি বলি, একটা ব্যতিক্রম সময়ে বাজেট দেওয়া হয়েছে, এই বাজেট গতানুগতিকতার বাইরে যেতে পারেনি।
লেখক: সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি
ডায়ালগ (সিপিডি)